প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ জনপদ হিসেবে আজ হতে তিন হাজার বছরের প্রাচীন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে বানিজ্যিক সুবিধার্থে এর যোগাযোগ ঘটে সুদূর প্রাচ্য -পশ্চিম এশিয়ার সাথে।
“নারায়ণগঞ্জ একটি ঐতিহাসিক স্থান। মোগল আমলে এখানে একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল। এ কাঠামোর মূলকেন্দ্র ছিল হাজীগঞ্জ ও সোনাকান্দা কেল্লা। এসব কেল্লাকে কেন্দ্র করে এতদ্বঞ্চলে একসময় গড়ে উঠেছিল এক বিরাট জনপদ। ” [১]
প্রায় সকল ঐতিহাসিকগণ একমত যে হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের শাসকগণ এখান থেকেই বঙ্গদেশকে শাসন করেছিলেন।তৎপর সুলতানি আমলে সুলতানগণও সোনারগাঁও থেকেই শাসন করেছিলেন।বাংলার স্বাধীন বার ভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খানের রাজধানীও ছিল নারায়ণগঞ্জের খিজিরপুরে(খানপুর)।
“জানা যায় যে, ১৭৬৩-১৭৬৬ সালের দিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনৈক নেতা বিকললাল পান্ডে এই অঞ্চলে বসবাস করতেন। যিনি বেণুর ঠাকুর কিংবা লক্ষ্মী নারায়ণ ঠাকুর নামেই সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে এই অঞ্চলের মালিকানা গ্রহন করেন। এরপর তিনি দেবতা প্রভু নারায়ণের সেবার ব্যয়ভার নির্বাহের নিমিত্তে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত বাজারটিকে ইচ্ছাপত্রের মাধ্যমে ‘দেবোত্তর’ সম্পত্তি ঘোষণা করেন। উক্ত দেবতা নারায়ণের নামেই এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় নারায়ণগঞ্জ। কেউ কেউ মনে করেন দেবতার নামে নয় বরং নিজের নামেই এলাকার নাম হয় ‘নারায়ণগঞ্জ’।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে স্থানীয় রাজা দনুজ মর্দন দশরথ দেবের রাজধানী ছিল সুবর্ণ গ্রাম। পরে বাংলার বার ভূইয়াদের নেতা ঈসা খাঁনের স্ত্রী সোনাবিবি নামানুসারে একে সোনারগাঁও নামকরণ করা হয়।
সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজশাহ ১৩০৫ সালে এখানে একটি টাকশাল স্থাপন করেন, ফলে এটি মধ্যযুগীয় বাংলার একটি অন্যতম শহর হিসেবে আর্বিভূত হয়। পরবর্তীকালে একশতকেরও বেশি সময় এটি টাকশাল হিসেবে চালু ছিল। গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহ ১৩২২ সালে এটিকে তার আঞ্চলিক প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।বাংলার সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ ১৩৩৮-১৩৪৯ সালে এবং তার পুত্র ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহের ১৩৪৯-৫২ শাসনামলে এটি একটি স্বাধীন সালতানাতের রাজধানী শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মুগলদের আমলে সুবা বাংলার ১৯টি সরকারের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। সপ্তদশ শতকের দিকে বিখ্যাত বারো ভূইয়ার অর্ন্তভুক্ত ঈসা খান ও পুত্র মুসা খানের (১৬১১খ্রিঃ) অধীনে শহরটি পুনরায় বাংলার রাজধানীর মর্যাদা ফিরে পায়। ঊনিশ শতকের দিকে এখানেই পানাম-নগর নামে আরেকটি শহর গড়ে ওঠে। মধ্যযুগে সোনারগাঁও এ পরিখাসহ দুর্গ-প্রাচীর -বেষ্টিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট ,বাজার ছিল এবং সব ধরনের পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ ও বন্টনের জন্য বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। দক্ষিণ-পূবাঞ্চলীয় দেশগুলোর সঙ্গে এর সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। খাসা নামে পরিচিত একধরনের মসলিন কাপড় এবং দাস ও দাস ও নপুংসকের বিশাল বাজারের জন্য শহরটি বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। বুখারার সুফি সাধক শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা এখানে একটি খানকাহ ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং তারই পৃষ্ঠপোষকতায় শহরটি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠে। ১৩৪৫ সালে বাংলার সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহের শাসনামলে (১৩৩৮-৫০ খ্রিঃ) মরক্কোর বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তৎকালীন বাংলার রাজধানী ও প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র এই সোনারগাঁও ভ্রমন করেছিলেন।পরবর্তী সোনারগাঁও থেকে তিনি জাহাজে চড়ে চীনের পথে বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার জাভা গমন করেন। তাছাড়া পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে চীনদেশীয় দূতগণ সোনারগাঁও ভ্রমন করেছিলেন।বার ভূইয়াদের নেতা ঈসা খান মুগলদের নিকট পরাজিত হলে সোনারগাঁও মুগলদের অধিকারে চলে আসে। পরবর্তীতে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও এর পরিবর্তে ১৬১০ সালে মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে আধুনিক ঢাকা নগরী বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে গড়ে ওঠে। ফলে এই সোনারগাঁও ধীরে ধীরে শ্রীহীন হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে মোগল ও ইংরেজ শাসনামলে বহু সংখ্যক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার এই স্থান ত্যাগ করে অন্যান্য স্থানে চলে যায়। তদস্থলে এই অঞ্চলের হিন্দুরা ধনেমান বিদ্যাবুদ্ধিতে বিশেষ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন। আর তাদের এ সময়ের অসংখ্য ইমারতের অস্তিত্ব সোনারগাঁও এর সবর্ত্র বিশেষ করে পানাম এলাকায় আজও দেখা যায়। [২]
চিরতরুণ ও নতুনের প্রতীক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি শুধু কবিই ছিলেন না, একাধারে ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক ছিলেন।তাঁর গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গান আজো কোটি বাঙালির আত্মার কথা বলে।
১৯২৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন। ২৭ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা নাগাদ তিনি নারায়ণগঞ্জ এসে পৌঁছান। স্থানীয় ছাত্র সংস্থা স্টীমার ঘাটে কবিকে এবং তাঁর দলের সকলকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। ছাত্ররা সেখান থেকে শোভাযাত্রাসহ কবিকে নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে নিয়ে আসেন। নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুল প্রাঙ্গণে এক সভায় কবিকে সংবর্ধনা জ্ঞাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জী’তে তা সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন।
একসময় নারায়ণগঞ্জ ছিল পূর্ববঙ্গের প্রবেশদ্বার। ভারত থেকে বাংলায় প্রবেশের প্রধান যাত্রাপথ ছিল কলকাতা > গোয়ালন্দ > নারায়ণগঞ্জ। ডাক যোগাযোগের জন্য প্রতিদিন গোয়ালন্দ -নারায়ণগঞ্জ স্টিমার আসা যাওয়া করতো। ১৮৮১ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়।ফলে দেশের যেকোনো জায়গায় যাওয়ার জন্য নারায়ণগঞ্জ বন্দরে অবতরণ করতে হতো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গে ভ্রমণকালে অনন্ত ২বার এ নারায়ণগঞ্জ দিয়েই কলকাতা থেকে আসা যাওয়া করেছেন। ব্রিটিশ ভারতে কলকাতার সাথে সমগ্র পূর্ববঙ্গের যোগাযোগ নারায়ণগঞ্জের মাধ্যমে হওয়ার কারণে দেশবরেণ্য নেতাদের পূর্ববঙ্গে আসতে হলে প্রথমে তাকে শিয়ালদা থেকে ট্রেনে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ ঘাট থেকে (১০০ মাইল) স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ এসে নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেনে ঢাকা বা দেশের অন্যান্য স্থানে যেতে হতো। স্টিমার সার্ভিসের কারণেই নারায়ণগঞ্জে আগমন ঘটেছিল উপমহাদেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, শরৎ বোস, উদয় শংকর, পি সি যোশী, কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ।
বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ভূইয়া ইকবাল-এর
‘বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংবর্ধনা’ গ্রন্থে কবিকে নারায়ণগঞ্জের সংবর্ধনাতে প্রদানকৃত মানপত্র ও কবির পূর্ণাঙ্গ ভাষনটি তুলে ধরা হয়েছে। “সেদিন কবির উদ্দেশে ঐতিহ্যবাহী এই স্কুলের শিক্ষার্থী কামাক্ষ্যাচরণ মানপত্র পাঠ করেন। কবিগুরুও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে একটি উপদেশমূলক বক্তব্য দেন। মানপত্রের একটি কপি ও কবিগুরুর উপদেশমূলক বক্তব্যটি নথিভুক্ত করে স্কুলের লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করা আছে।”[৪]
#সংবর্ধনাপত্র :
‘বিশ্ববরেণ্য কবিসম্রাট শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রাথ ঠাকুর মহাশয়ের শ্রীশ্রীচরণকমলেষু। দেব, পূর্ব্ববঙ্গের তোরণ-দ্বারে-পুণ্যসলিলা শীতলক্ষ্যার পবিত্র তীরে- হে কবি! তোমাকে তোমার প্রত্যাবর্ত্তন-পথে স্বাগতম অভিনন্দনের সুযোগ পাইয়া- আমরা আপনাদিগকে কৃতার্থ মনে করিতেছি। ছাত্র আমরা- তোমার শিষ্যানুশিষ্যের যোগ্য নহি! তোমার চরণ-রেণু স্পর্শ করিবার অধিকার লাভের স্পর্দ্ধাও আমাদের নাই- কিন্তু সর্ব্বজনপ্রিয় তুমি- দয়া করিয়া আমাদের ছাত্রসঙ্ঘের ন্যায় দীনতম-ক্ষুদ্রতম প্রতিষ্ঠানের কথাও বিস্মৃত হও নাই- সে আনন্দে সে-গর্ব্বে আমরা স্নেহ-পুলকিত-হৃদয়ে আমাদের দীন আয়োজন- আমাদের বন-ফুলমালা তোমার শ্রীচরণসরোজে অর্পণ করিতে সাহসী হইয়াছি। হে কবি! তুমি তাহা গ্রহণ করিয়া সার্থক কর- কৃতার্থ কর- আমাদিগকে ধন্য কর। আমাদের এ বাংলাদেশ- দেশে দেশে শুধু অন্নই বিতরণ করে না- দেশকে সুজলা সুফলা ও শস্যশ্যামলা করিয়াই শুধু নদীর শুভ্র-রজতধারা তাহার গতিপথে অগ্রসর হয় না- তাহার কল প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানের পবিত্র আলোকধারাও লহরে লহরে দিগ্দিগন্তে ব্যাপ্ত করিয়া দিয়া আপনাকে মহিমান্বিত করিয়াছে- সে লুপ্তধারা- ধূর্জ্জটির জটানিষ্যন্দী পবিত্রধারার ন্যায় তুমিই আবার বিশ্বভারতীর শান্তিনিকেতন হইতে প্রবাহিত করিয়া সমস্ত বিশ্ববাসীকে ভারতের বাণী নূতন করিয়া প্রচার করিতেছ। নালন্দা নাই- তক্ষশীলা নাই- বিক্রম শীলা নাই! তাহাতে দুঃখ কি? তোমার বিশ্ব-ভারতী- অতীত ও বর্ত্তমানকে জাগ্রত করিয়াছে। আমরা তোমার সেই আদর্শ হৃদয়ে গ্রহণ করিয়া- লক্ষ্য পথে চলিতে পারি- আমাদিগকে সে আশীর্ব্বাদ কর। পলীর লুপ্তগৌরব প্রতিষ্ঠা- দেশকে অন্তরের সহিত ভালোবাসার- শিক্ষার প্রদীপ হাতে করিয়া কেমন করিয়া আমরা মানুষ হইব? কেমন করিয়া প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান পাইব? কথায় নহে কাজে- শুধু নয় দীক্ষায়- প্রকৃত কর্ম্মীরূপে দীনভাবে ও দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করিতে পারি- তোমার চরণে উপদেশ-ভিক্ষু আমরা সে আবেদন নিবেদন করিতেছি। আমাদের এই নারায়ণগঞ্জ-বন্দর অতি প্রাচীন বন্দর- অতি প্রাচীন ইতিহাসেও ইহার নাম আছে। দুর্ভাগ্য আমাদের এখানে বাণীর সেবক নাই বলিলেও চলে। এখানকার নীরস শুষ্ক মরুভূমির বুকে কোনদিন বর্ষণ নামে নাই- এই ঊষর মরুভূমিকে সরস করে নাই, সৌভাগ্য আমাদের আজ এই মরুভূমির বুকে সুধাধারা সিঞ্চিত হইবে- নব বসন্তের আবির্ভাব হইবে নব রূপে- নব ভাবে- নব পিককুহরণে- এই বসন্তোদয় চির বসন্তের উজ্জ্বল শ্যামল শ্রীতে মণ্ডিত হউক- এই আশীর্ব্বাদ ভিক্ষা করিয়া তোমাকে অর্ঘ্যডালা সমর্পণ করিতেছি। এই দীর্ঘ নগরের পৌরগণের গর্ব্ব করিবার অতীত ইতিহাস আছে,- ঐ দূরে- লক্ষ্যার তীরে- সোনাকান্দার দুর্গ এখনও বাঁচিয়া আছে। সুবর্ণগ্রামের শত প্রাচীন কীর্ত্তি- সেন পাল ও পাঠান-মোগলের রণ-ভেরী শব্দিত কানন-প্রান্তর ও মগ-বাঙ্গাীর রণ কোলাহল- এখনও এই ভূমির আকাশে বাতাসে শব্দায়মান- সে কাহিনী আমাদিগকে অতীত গর্ব্বে গৌরবান্বিত করে- সেই অতীত কীর্ত্তিগরিমামণ্ডিত- শত শত পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যে-ভূষিত দেশ আজ শুরু স্মৃতির কঙ্কাল লইয়া বাঁচিয়া আছে- তোমার পাদস্পর্শে আবার তাহা নবজীবন লাভ করিয়াছে। কবি তুমি! ঋষি তুমি! বাঙ্গালীর হৃদয়াসনে সুপ্রতিষ্ঠিত উজ্জ্বল রবি তুমি কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাইয়া তোমাকে বলিতেছি- ‘জগৎ কবি-সভার মাঝে তোমার করি গর্ব্ব / বাঙ্গালী আজি গানের রাজা বাঙ্গালী নহে খর্ব্ব।’
প্রণতঃ ছাত্রসঙ্ঘের সভ্যবৃন্দ।
নারায়ণগঞ্জ ১৫/১১/৩২ বঙ্গাব্দ
নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে প্রদত্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের #ভাষন :
নারায়ণগঞ্জের প্রবেশদ্বার দিয়ে আমি পূর্ববঙ্গে প্রবেশ করেছিলাম। ফেরার পথে আবার এখানে এসেছি। পূর্ববঙ্গের যেখানে গিয়েছি, আমার বলবার কথা বলেছি; কিন্তু বলার দ্বারা ফল হয় বলে আমি বিশ্বাস করিনে। কর্মের মধ্য দিয়েই আমাদের দেশের বিচিত্র সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশের বিদ্যালয়ে চাকুরিই ছিল শিক্ষার উদ্দেশ্য। লোকে চাকরি পাওয়ার জন্য নিজেকে শিক্ষিত করতে স্কুল-কলেজে পড়তে যায়। সৈাভাগ্যক্রমে চাকুরির পথ সংকীর্ণ হয়েছে। তাই শিক্ষিত যুবকগণ স্বাধীন উপায়ে জীবিকার্জনে সচেষ্ট হয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রেও কাজ কর্মে এক পরিবর্তন এসেছে। এমন একটি সময় ছিল, যখন লোকে ভাবতেন বক্তৃতা দিয়েই তাঁরা তাঁদের কাজ উদ্ধার করতে সক্ষম হবেন। তাঁরা পুরাতন অভ্যাসবশতঃ এখনও ঐরূপ কাজ করে বসেন। কিন্তু বর্তমানে যুবসমাজ বাস্তব ও আসল কাজের দিকে তাকায়। বর্তমান আন্দোলন কালে যে উদ্দীপনা এসেছে, তাকে যেন তারা স্থায়ী করে। কবি বলেন- শান্তিনিকেতনে পূর্ববঙ্গের বহু ছেলে পড়ে। তাদরে মধ্যে চরিত্রের দৃঢ়তা, একাগ্রতা ও শ্রদ্ধার ভাব দেখেছি। আমি পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ করে দেখলাম, এটা একটা ভাল কর্মী সংগ্রহের স্থান। এখানকার ছেলেদের যে কাজেই লাগানো যাবে, তারা তাদের একাগ্রতা ও নিষ্ঠার দ্বারা কৃতকার্য হবেই। আমি যদি এখনও যুবক থাকতাম, তাহলে এখানে বক্তৃতা না করে হাত-নাতে কাজে লেগে যেতাম। এখানকার উর্বরা মাটির মতই এখানকার মানুষের উদ্যম আগ্রহও প্রবল। কিন্তু আজ আমার বয়স এবং স্বাস্থ্য দুই-ই নেই। আমার কর্মক্ষেত্র পশ্চিমবাংলার এক সীমান্তে অবস্থিত। সেখানকার মাটি উর্বরা নয় এবং মানুষও অনেকটা উদাসীন। পূর্ববঙ্গের এ অঞ্চলে উপযুক্ত পরিবেশে লোকে যদি তাদের কাজ আরম্ভ করে তাহলে তারা অতি সহজেই সফলকাম হবে। রাজনৈতিক নেতারা গ্রাম থেকে দূর শহরে শহরে খুব ভাল বক্তৃতা দিয়ে থাকে। এই উপায়ে গ্রামের কোন উপকার করাই সম্ভব নয়। পূর্ববঙ্গে পলী উন্নয়ন নিঃসন্দেহে সম্ভবপর। এই প্রসঙ্গে কুমিল্লায় অভয় আশ্রমের কথা আমার মনে পড়ে। ঐ আশ্রমের কর্মীরা স্বার্থত্যাগের মধ্য দিয়ে যে কাজ করে চলেছেন, তা দেখে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছি। তাঁরা খুবই সাহস দেখিয়ে নিম্নবর্ণের মানুষদের নিজেদের মধ্যে নিয়েছেন। আমি এটা ক্বচিৎ কোথাও দেখেছি। নিম্নবর্ণের লোকদের সঙ্গে আমাদের মেলামেশার অভাব, সেটা আমাদের ঐক্যের পথে একটা বড় অন্তরায়। এটা দূর করতে না পারলে দেশের মুক্তি অসম্ভব। আমরা আমাদের মধ্যে এই বিভেদ সৃষ্টি করে দেশকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছি। অভয় আশ্রমে অস্পৃশ্যদের মধ্যে যে আত্মসম্মানবোধ দেখলাম, তা সত্যই প্রশংসার যোগ্য। সাহসের সঙ্গে গ্রামবাসীদের পলী সংস্কারের কাজ করে যাওয়া উচিৎ। তাহলেই দেশের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। পূর্ববঙ্গে প্রকৃতি যেমন সৌন্দর্যে ও প্রাচুর্যে নিজেকে বিকশিত করেছে, এখানকার লোকদের মধ্যেও দেখেছি তেমন প্রাণ-প্রাচুর্য ও প্রাণের উদারতা। পূর্ববঙ্গের যুবকরা যদি তাদের এ অঞ্চলে গ্রামীণ কাজ আরম্ভ করে, তাহলে তারা নিশ্চয়ই সফলকাম হবে। উপসংহারে আমি ছাত্রদের আশীর্বাদ জানিয়ে বলব- তারা তাদের ত্যাগ ও নিষ্ঠার দ্বারা কাজ করলে শুধু বাংলাকেই নয়, সারা ভারতকেও আসল পথের সন্ধান দেবে।
নারায়ণগঞ্জ ১৫/১১/৩২ বঙ্গাব্দ
রবীন্দ্রনাথের সেই ছোট্ট ভাষণটি স্কুলের লাইব্রেরিতে বড় করে টানানো আছে।
লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
➤তথ্য ঋণ:
[১] নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস
[২] মোঃ আবু সাঈদ।।নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও : ইতিহাস ও ঐতিহ্যর রাজধানী
Mati news.com
২১ ডিসেম্বর ২০১৯
[৩] বিলু কবীর, বাংলাদেশের জেলা: নামকরণের ইতিহাস, গতিধারা, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০১০
[৪] নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
দৈনিক কালের কণ্ঠ
৬ আগস্ট, ২০১৪
[৫] নারায়ণগঞ্জের স্মৃতি বিস্মৃতি।।এস এম শহীদুল্লাহ
Some text
ক্যাটাগরি: বিবিধ
[sharethis-inline-buttons]