বুধবার দুপুর ২:২২, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

আত্মনিয়ন্ত্রণ

১৩৮৭ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

জীবনের জন্য পানি অতি প্রয়োজন। কিন্তু ঘরজুড়ে পানি ছড়িয়ে পড়লে প্রয়োজন তো মেটেই না, বরং সমস্যা বাড়ে। পানি প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হলে এর সংরক্ষণ, চলাচল ও অনুপূরণ নিয়ন্ত্রণে থাকতে হয়। নিয়ন্ত্রণ মানে দমন নয়, বিনাশও নয়। নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য দুর্বলতাকে শক্তিতে রূপান্তর, বিশৃঙ্খলকে শৃঙ্খলায় রূপান্তর। শৃঙ্খলা বন্ধন নয়- লক্ষ্যে পৌঁছার পথ। দেহের অগ্নি নিয়ন্ত্রণে রাখা অবদমন নয়- যেমনটি বলেন ফ্রয়েডবাদীরা। বরং অগ্নির সম্যক ব্যবহার নিশ্চিত করতেই একে নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। অনিয়ন্ত্রিত অগ্নি যেমন দুঃখ ও সংহারের কারণ- তেমনি নিয়ন্ত্রিত অগ্নি সুখ ও সৃষ্টির কারণ।

যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, হতাশা কখনো তাকে গ্রাস করে না। সুখ ও জ্ঞান বসবাস করে তার ঘরে। যে প্রবৃত্তিকে জীবনের উপর কর্তৃত্ব করতে দেয় সে বসবাস করে দুঃখ ও অজ্ঞতার ঘরে। যে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না- সে প্রবৃত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এজন্যই বলা হয়- “যার গুরু (অধীশ্বর, নিয়ন্ত্রক) নেই তার গুরু (অধীশ্বর, নিয়ন্ত্রক) শয়তান”। যে নিজে নিজের গুরু কেবল সেই গুরু। কোনো মানুষের পক্ষে আরেকজনের প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কেবল নিজের প্রবৃত্তি।

যার আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই, একবিন্দু জ্ঞানের স্পর্শ পাওয়াও তার পক্ষে সম্ভব না। জ্ঞানবৃক্ষের অঙ্কুরোদগম হয় আত্মনিয়ন্ত্রণের মাটিতে আর ফুলে ফলে ভরে উঠে শুদ্ধতার আকাশে। কাননে ফুল ফুটাতে হলে আগাছা পরিষ্কার রাখতে হয়, জল সিঞ্চন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। জলাবদ্ধতা ও শুষ্কতায় পুষ্পগুল্মের মৃত্যু ঘটে। নিয়ন্ত্রণ মানে ফুলগাছ কাটা নয়- আগাছা পরিষ্কার করা। যা নিজে নিজেই বেড়ে উঠে, তা আগাছা। যা অনেক যত্নের পর বেড়ে উঠে, তা পুষ্পগুল্ম। আগাছা বেড়ে উঠলে যেমন পুষ্পগুল্মগুলো মরে যায় তেমনি অনিয়ন্ত্রিত প্রবৃত্তি মেরে ফেলে সৃজনীশক্তি ও আনন্দের উৎসগুলো। আনন্দের জন্য মজা ছাড়তে হয়। মজা ছাড়তে হলে নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য।

যে ব্যক্তি প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সে তার চিন্তা ও শক্তিকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। তাই আত্মনিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জ্ঞানের কিরণ প্রবেশ করে হৃদয়ে। নিয়ন্ত্রিত জীবনই শুদ্ধ জীবন। শুদ্ধ জীবনই মুক্ত জীবন। মুক্ত জীবনই আনন্দের জীবন। আনন্দের জীবনই আলোকিত জীবন। অটল অভ্যাস টলানো সহজ ব্যাপার নয়। এজন্য প্রয়োজন নিরলস প্রচেষ্টা ও ধৈর্য। মানুষের ব্যর্থতা এখানেই। অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা করার প্রশ্নটি সম্মুখে এলেই মানুষ টালবাহনা করে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের পথ ছেড়ে আনুষ্ঠানিকতায় লিপ্ত হয়। ফলস্বরূপে ভিতরের গুরু ঘুমিয়ে যায়, পশুপ্রবৃত্তি জেগে উঠে। দেহমন্দিরের চিলেকোঠায় বাসা বাঁধে বিষধর সর্প।

চরিত্রের রূপান্তর হয় শনৈঃশনৈঃ। চিন্তা থেকে কর্ম উৎপন্ন হয়। কর্মের পুনরাবৃত্তি থেকে অভ্যাস হয়, অভ্যাস ও কর্ম দ্বারা গঠিত হয় চরিত্র। মনুষ্য চরিত্রের তাৎক্ষণিক রূপান্তর অসম্ভব। এটি কষ্টকর কিন্তু আনন্দদায়ক প্রক্রিয়া। বদঅভ্যাস ছেড়ে দিতে কষ্ট হয়, কিন্তু ছেড়ে দিলে আনন্দ হয়। কষ্ট সাময়িক- কিন্তু আনন্দ দীর্ঘদিনের। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে গাড়ি যেমন খাদে পতিত হয়, জীবনও তেমনি। নিয়ন্ত্রণহীনতাই দুর্বলতা। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই শক্তিমত্তা। নিয়ন্ত্রিত জীবন হলো বিজয়ীর জীবন। নিয়ন্ত্রিত জীবনে অনুতাপ নেই; কারণ অশুদ্ধি নেই। উদ্বেগ নেই; কারণ- আত্মবিরোধ নেই। দুঃখ নেই; কারণ মিথ্যার আশ্রয় নেই।

অনিয়ন্ত্রিত জীবনের অবলম্বন হলো হিংসা, ঈর্ষা, লোভ, স্বার্থপরতা, কামনা-বাসনা। নিয়ন্ত্রিত জীবনের অবলম্বন হলো ধৈর্য, উদারতা, প্রেম, জ্ঞান, আনন্দ। সবকিছুরই বিকল্প আছে কিন্তু আত্মনিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। নিয়ন্ত্রণ ছাড়া শিক্ষা অর্থহীন শব্দ, আত্মোন্নতি উপহাস্য, শান্তি অসম্ভব। যার আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই তার আত্মবিশ্বাস নেই। যার আত্মবিশ্বাস নেই তার ঈশ্বর বিশ্বাস ক্ষণিক। নিয়ন্ত্রণের স্থান আর কোনোকিছুই নিতে পারে না। সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিও এখনই আত্মনিয়ন্ত্রণ শুরু করতে পারে। দুর্বল ততক্ষণ পর্যন্ত দুর্বলই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত সে আত্মনিয়ন্ত্রণ শুরু না করে।

দুর্বলতা হলো লক্ষ্যহীনভাবে যেদিকে সহজ সেদিকে সামর্থের অপবর্তন। সামর্থ্য যখন একটি লক্ষ্যে চালিত হয় তখন তা শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। নিচের দিকে নামা সহজ। নিচের দিকে নামার জন্য শক্তি কেন্দ্রীভূত করতে হয় না। এজন্য আসক্তিই যথেষ্ট। উপরের দিকে উঠা কঠিন। তাই উপরের দিকে উঠতে শক্তির কেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন হয়। আস্তিক কিংবা নাস্তিক, ভাববাদী কিংবা বস্তুবাদী কেউ আত্মনিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতা অস্বীকার করতে পারে না। যে তা অস্বীকার করবে তার প্রকৃতিই তাকে শাস্তি দেবে- দুর্বিপাক ও দুর্ভোগ ধেয়ে আসবে তার জীবনে। মনুষ্য জীবনের সব রোগ ও দুর্ভোগের মূলে রয়েছে অনিয়ন্ত্রণ। জগতে এমন কোনো শক্তি নেই যা অনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিকে মনোদৈহিক সুস্থতা দিতে পারে।

যাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই, তারাই কর্মধর্ম ফেলে ধর্মকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে। অনিয়ন্ত্রিত মানুষের ঝুঁক থাকে আনুষ্ঠানিকতা, হৈ-চৈ ও মজার দিকে। শাস্ত্রের অসংযত ব্যাখ্যা তাদের অসংযত আচার-আচরণের সঙ্গে খাপ খায়। ফলে স্বকল্পিত পরিত্রাণের দিকে অগ্রসর হয়ে তারা সান্ত্বনা লাভ করে।

ধর্ম ব্যক্তির কল্পনার আধারে সংস্থাপিত হয় না। ধর্মের জন্য প্রয়োজন শুদ্ধ চিন্তা, প্রেমময় হৃদয়। ধর্মের জন্য সুরক্ষার প্রয়োজন নেই। ধর্ম স্বয়ং সুরক্ষা। একজন মানুষ ততটাই ধার্মিক হয় যতটা তার আত্মনিয়ন্ত্রণ।

আহার-নিদ্রায়, চলনে-বলনে, ভোগে, সম্ভোগে, উপার্জনে, শ্রবণে, দর্শনে, আবেগে, স্পর্শে, দমে, চিন্তায় আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নামই সিয়াম। জ্ঞানের পথে অগ্রসর হওয়ার প্রথম পাঠ আত্মনিয়ন্ত্রণ। সম্ভবত শেষ পাঠও আত্মনিয়ন্ত্রণই।

Some text

ক্যাটাগরি: মতামত

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি