“শিশুসন্তানের দেখাশোনার বিষয়ে (জিম্মাদারির ক্ষেত্রে) সবচেয়ে বড় অধিকারী হলেন মাতা। তিনি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সন্তানের জিম্মাদার হয়ে থাকেন; কিন্তু তিনি কখনো অভিভাবক হতে পারেন না। একজন সন্তান জন্মের পেছনে বাবা-মা দুজনেরই ভূমিকা রয়েছে, কিন্তু অধিকার প্রতিষ্ঠিত শুধু বাবার।”
একটি সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য একজন মায়ের ভুমিকা অনস্বীকার্য। একটি ভ্রূণকে নিজ গর্ভে দশ মাস লালন করার পরে যখন সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে, তখন একজন মায়ের জন্ম হয়। আর সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে পূর্ণতা পায় সেই মায়ের নারিত্ব। সমাজের একটি গতানুগতিক ধারা হচ্ছে, বাহ্যিক আবরণে একজন পুরুষকে পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও একজন নারীকে কখনো বাহ্যিক আবরণে চিহ্নিত করা হয় না৷ তার নারিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, যখন তিনি মাতৃত্বসাধন করেন। নারীর মাতৃত্ব হয়ে ওঠে নারীর নারিত্ব।
একটি ভ্রূণের সৃষ্টির রহস্যকে বায়োলজিক্যালভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একজন পুরুষ এবং একজন নারীর শারীরিক মিলনের ফলে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর যে বিক্রিয়া ঘটে, সেখান থেকে ভ্রূণের জন্ম। তাই বলা যায়, বায়োলজিক্যালি সন্তান জন্মদানে বাবার ভূমিকা একটি সফল শুক্রাণু দান পর্যন্ত। ভ্রূণের জন্ম থেকে সন্তানকে বড় করে তোলা অবধি মায়ের যে ভূমিকা থাকে তা কোনো যুদ্ধের থেকে কম নয়।
আইনগত দিক থেকে পিতা হচ্ছেন সন্তানের প্রকৃতিপ্রদত্ত বা আইনগত অভিভাবক। যার ফলে বলা চলে, পিতার অধিকার সন্তানের উপর বিদ্যমান। কিন্তু যখন মায়ের অধিকারের প্রশ্ন আসে, তখন খুব কষ্ট হলেও সত্যি, সন্তানের প্রতি অধিকার পেতে মাকে আদালতের বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতে হয়। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম, সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে একজন নারী হবেন মা। কিন্তু সন্তানের অভিভাবক নয়। সন্তানের অভিভাবক শুধু পিতাই থাকবেন এবং সন্তানের উপর তার একচ্ছত্র ক্ষমতা৷ বর্তমান জরিপে দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের হার যেমন দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি সে সাথে সৃষ্টি হচ্ছে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে প্রশ্ন।
একটি ভ্রূণের সৃষ্টির রহস্যকে বায়োলজিক্যালভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একজন পুরুষ এবং একজন নারীর শারীরিক মিলনের ফলে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর যে বিক্রিয়া ঘটে, সেখান থেকে ভ্রূণের জন্ম। তাই বলা যায়, বায়োলজিক্যালি সন্তান জন্মদানে বাবার ভূমিকা একটি সফল শুক্রাণু দান পর্যন্ত। ভ্রূণের জন্ম থেকে সন্তানকে বড় করে তোলা অবধি মায়ের যে ভূমিকা থাকে তা কোনো যুদ্ধের থেকে কম নয়।
সন্তানের অভিভাবকত্ব সাধারণভাবে বাবাই পেয়ে থাকেন, কিন্তু সন্তান যদি মায়ের কাছে থাকেন তবে মাকে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সেই অভিভাবকত্বের দাবি জানাতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষ ব্যতীত মায়ের এই অভিভাবকত্ব পাওয়া হয়ে ওঠে বিশ্ব জয়ের সমান। আবার অনেক সময় সন্তানের হেফাজত পাওয়া গেলেও অভিভাবকত্ব আদালত দিতেও চান না। সাধারণত ভরণ-পোষণ, অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীর ব্যক্তিগত আইনগুলো অনুসরণ করা হয়ে থাকে৷ আমাদের দেশের প্রায় সব ধর্মাবলম্বীর মানুষ রয়েছেন। আর তাদের সবার ব্যক্তিগত আইনও রয়েছে। বিবাহ, তালাক- এই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকলেও অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে কোনো ভিন্নতা নেই বললেই চলে। সাধারনত শিশু সন্তানের তত্ত্বাবধান, অভিভাবকত্ব ও ভরণপোষণের বিষয়গুলি পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ ও গার্ডিয়ানস এন্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৯০ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। উল্লেখ্য, গার্ডিয়ানস এন্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৯০ হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য।
আরো পড়ুন> প্রিয় ভ্যালেন্টিনোর মৃত্যিুবার্ষিকী আজ
পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ অনুসারে, সাধারণত একজন শিশু সন্তানের তত্ত্বাবধানের অধিকার বা দায়িত্ব একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পেয়ে থাকে ঐ শিশু সন্তানটির মাতা। শিশুসন্তানের দেখাশোনার বিষয়ে (জিম্মাদারির ক্ষেত্রে) সবচেয়ে বড় অধিকারী হলেন মাতা। তিনি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সন্তানের জিম্মাদার হয়ে থাকেন; কিন্তু তিনি কখনো অভিভাবক হতে পারেন না। একজন সন্তান জন্মের পেছনে বাবা-মা দুজনেরই ভূমিকা রয়েছে, কিন্তু অধিকার প্রতিষ্ঠিত শুধু বাবার। অনেকে আবার একে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কথা বলে থাকেন। অস্বীকার করছি না, সেই ক্ষেত্রগুলোকে কিন্তু ধর্মীয় দিক থেকে একজন মাকে যে সম্মান দেবার কথা বলা হয়েছে, সেটুকু দেওয়া হলে হয়তো সন্তানের উপর মায়ের অধিকারের ক্ষেত্রে ‘অভিভাবকত্ব’ শব্দটি আজ প্রশ্নবিদ্ধ হতো না।
একজন নারীর কাছে কোনটার মুল্য বেশি? ‘সম্পত্তি’, নাকি ‘সম্পদ’? বতর্মানে নারীদের অধিকার নিয়ে তথাকথিত অনেকেই সোচ্চার। অনেকে ধর্মের উর্ধ্বে গিয়ে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু সম্পত্তিতে সমঅধিকারের দাবিতে রাজপথে থেকে বাসায় গিয়ে একবারও ভাবেন না, ঘরে যে সম্পদকে ভ্রূণ অবস্থা থেকে লালন পালন করে আসছেন সেখানেও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
একজন পিতা সে মাতাল, জুয়াড়ি বা চরিত্রগত দোষ- এসব থাকলে তার অভিভাবকত্ব শিথিল হয়ে যায়, তবে হারায় না। কিন্তু একজন মাতা খারাপ বা ভালো যেটাই হোক না কেন, তার অভিভাবকত্ব পেতে হলে আদালতের বিবেচনায় আসতে হয়। সন্তানের অভিভাবকত্ব পেতে একজন মাকে নানা প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিতে হয়। আবার সবক্ষেত্রে তা পাড়ি দেওয়া হয়েও উঠে না। খুব হাস্যকর হলেও সত্যি, ভ্রূণকে লালন পালন করে সন্তানে রূপ দেওয়া একজন মা এই সমাজে মা হতে পারলেও, হতে পারেন না সেই সন্তানের অভিভাবক। অথচ তারপরেও এই সমাজে মায়েরা তাদের ভূমিকা রেখে চলেছেন।
লেখকের সব লেখা
একজন নারীর কাছে কোনটার মুল্য বেশি? ‘সম্পত্তি’, নাকি ‘সম্পদ’? বতর্মানে নারীদের অধিকার নিয়ে তথাকথিত অনেকেই সোচ্চার। অনেকে ধর্মের উর্ধ্বে গিয়ে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু সম্পত্তিতে সমঅধিকারের দাবিতে রাজপথে থেকে বাসায় গিয়ে একবারও ভাবেন না, ঘরে যে সম্পদকে ভ্রূণ অবস্থা থেকে লালন পালন করে আসছেন সেখানেও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অথচ একজন বাবার সাথে সমভাবে একজন মাও সন্তানের প্রাকৃতিক বা আইনগত অভিভাবক হওয়ার হকদার। কিন্তু ‘সম্পদে’ অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা তো দূরে থাক, একবারের জন্যও কেউ ভাবতে চান না, সম্পদে সমঅধিকার না পাওয়ার দায় কার- আইনের নাকি সমাজের?
জান্নাতুল কারার তিথি : এডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট
ক্যাটাগরি: নারী, প্রধান কলাম
[sharethis-inline-buttons]