শনিবার রাত ১০:০৪, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

শুধু নির্বাচনের নাম গণতন্ত্র নয় -উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

সাক্ষাৎকার

গণতন্ত্র এমন একটি ধারণা যা অবশ্যই উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গণতন্ত্র থাকলে উন্নয়ন হবে। কিন্তু উন্নয়ন গণতন্ত্র ছাড়াও সম্ভব। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে উন্নয়ন হয় তবে সেটা আংশিক এবং ক্ষণভঙ্গুর। সার্বিক এবং টেকসই উন্নয়নে গণতন্ত্রের বিকল্প নেই।

জাকির মাহদিন : প্রথমেই আপনার কাছে জানতে চাইব, জীবন সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?

মোকতাদির চৌধুরী : জীবন এমন একটি প্রত্যয়, যা ব্যাখ্যার অতীত।  জীবনকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। জীবন গতিশীল, স্থবির নয়। এটা একটা চলমান সংগ্রাম। এই সংগ্রামশীলতার ভেতরেই আমাদের প্রতি মুহূর্তে অবস্থান। জীবনকে আমরা সৎ কাজে ব্যবহার করতে পারি, অসৎ কাজেও ব্যবহার করতে পারি। মানুষ তার জীবনকে গঠনমূলক কাজে এবং মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করতে পারে এবং এটাই করা উচিত।

মানুষের জীবনের তাৎপর্য ব্যাপক। জীবনকে যেমন ব্যক্তিগত বৈষয়িক উন্নয়নে ব্যবহার করা যায়, আবার লাখো কোটি মানুষের কল্যাণেও ব্যবহার করা যায়। যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, নিজের পাশাপাশি অন্যের এবং বিশ্ববাসীর কল্যাণে চিন্তা ও কাজ করা উচিত। স্টিফেন হকিং এক্ষেত্রে একটি উজ্বল দৃষ্টান্ত। তার পুরো শরীর অবশ, শুধু ব্রেনটা সামান্য কাজ করে। এ দিয়েই তিনি মানুষের জন্য অনেক কিছু করেছেন। তার জীবনটা তিনি মহৎ কাজে ব্যয় করেছেন।

পৃথিবীটা হচ্ছে একটা সংঘাতময় জায়গা। সর্বক্ষণ এখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মার্কসের একটা কথায় বিশ্বাস করি। তিনি বলেছেন, যেখানে ধন-সম্পদ আছে, সেখানেই লুটপাট আছে। তাই আমি এসব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। পৃথিবী, মাটি-পানি-আলো-বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্র, মহাবিশ্ব সবার জন্য উন্মুক্ত। যে যতটুকু প্রয়োজন নিতে পারে। এসব স্রষ্টার অসীম দান। এই অসংখ্য সৃষ্টি নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, স্রষ্টা নিয়ে নয়, আমরা চিন্তা করব সৃষ্টি নিয়ে। বিশেষ করে ‘মানুষ’ নিয়ে। মানুষ নিয়ে আমাদের প্রচুর চিন্তা ও গবেষণা করতে হবে। কারণ ইসলাম মানুষের জন্য। ধর্ম একমাত্র মানুষের জন্যই।

মানুষের হাতের আঙ্গুলের যে ছাপ, সেটার মধ্যেই অসংখ্য রহস্য লুকিয়ে আছে। যদি এসব নিয়ে চিন্তা করতে পারি তাহলেই জীবন সার্থক ও সমৃদ্ধ হবে। আসমান জমিন নিয়ে চিন্তার কথা কোরআনে বারবার বলা হয়েছে।

 

জাকির মাহদিন : ভাষা ও জ্ঞানের পার্থক্য সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।

মোকতাদির চৌধুরী : ভাষা হচ্ছে, আমরা মুখে যা বলি এবং কলমে যা লিখি। এই বলা বা লেখাটা ভাষা, কিন্তু বিষয়টা জ্ঞান। আরো সহজ করে বললে, পৃথিবীতে আমাদের যে অস্তিত্ব, সেই অস্তিত্বের সূত্রে আমরা যা দেখছি, ভাবছি, অভিজ্ঞতা অর্জন করছি, চিন্তার মাধ্যমে এসব সমন্বয় করে জীবনকে সঠিকভাবে বিকশিত করতে এবং গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করতে যে ‘সার-নির্যাস’ বের করছি তাই জ্ঞান।

জ্ঞান নিশ্চয় ধৈর্য ও সহনশীলতা শিক্ষা দেয়, যা ভাষা পারে না। ভাষা জ্ঞান নয়। কিন্তু জ্ঞানের বিস্তার এবং বিনিময়ের জন্য ভাষা প্রয়োজন। ভাষা হচ্ছে জ্ঞান প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। তাই ভাষাকে অস্বীকরের পথ নেই। যে ভাষা যত বেশি গতিশীল, ধারণক্ষমতাসম্পন্ন, সে ভাষা তত বেশি সমৃদ্ধ। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে আমি ইংরেজি ভাষাকেই এগিয়ে রাখব। এতে পৃথিবীর আদি এবং সমকালীন সব ধরনের ও সব স্তরের জ্ঞান সংরক্ষিত আছে। এমনকি ধর্মীয় বিভিন্ন শাখার জ্ঞানও।  তবে আমাদের মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা কোনোভাবেই কম নয়। এটাও আমাদের সর্বোচ্চ মাত্রায় শিখতে হবে। মানুষকে আল্লাহ সবকিছুই শিক্ষা দিয়ে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তা চর্চার অপেক্ষা রাখে। মোটকথা, বয়ান ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বাস্তব জগৎ সবিস্তারে আমাদের সামনে রয়েছে।

জাকির মাহদিন : উন্নয়ন এবং গণতন্ত্র, একটি ছাড়া কি অন্যটি  সম্ভব?

মোকতাদির চৌধুরী : গণতন্ত্র এমন একটি ধারণা যা অবশ্যই উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গণতন্ত্র থাকলে উন্নয়ন হবে। কিন্তু উন্নয়ন গণতন্ত্র ছাড়াও সম্ভব। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে উন্নয়ন হয় তবে সেটা আংশিক এবং ক্ষণভঙ্গুর। সার্বিক এবং টেকসই উন্নয়নে গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। যেসব বুদ্ধিজীবী মনে করছেন, বর্তমান সরকার গণতন্ত্র বাদ দিয়ে উন্নয়নকে প্রাধান্য দিচ্ছে, তারা ভুল বুঝছেন। আমরা গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসী এবং শ্রদ্ধাশীল। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এবং গণতন্ত্র সঙ্গে নিয়েই সরকার উন্নয়নে জোর দিচ্ছেন।

 

জাকির মাহদিন : পৃথিবীতে খাঁটি গণতন্ত্রের কোনো মডেল আছে?

মোকতাদির চৌধুরী : আছে। ভারত, আমরিকা ও ব্রিটেন। সেখানে নির্বাচনী প্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছ। প্রতিযোগিতার মাঠ সবার জন্য সমান। যে কারণে একজন চা বিক্রেতা এবং ফার্স্ট জেনারেশন প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছেন।

জাকির মাহদিন : শুধু নির্বাচনের নামই কি গণতন্ত্র? আর সে নির্বাচনটাও কি বিভিন্ন লবিস্ট ফার্ম এবং ব্যবসায়ী ও কালো টাকার কাছে জিম্মী নয়?

মোকতাদির চৌধুরী : শুধু নির্বাচনের নাম গণতন্ত্র নয়। আর প্রার্থীগণ দেশ-জাতির সামগ্রিক স্বার্থ সামনে রেখেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বোঝাপড়া করেন। সেসব দেশের অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী মানবতার জন্য তাদের সমস্ত সম্পদ বিলিয়ে দিচ্ছেন যা ইসলামের প্রাথমিক যুগের পর মুসলমানদের কেউ আর করছে না। যেমন বিল গেটস। তিনি তার অঢেল সম্পদ মানবতার জন্য দিয়ে দিচ্ছেন। তারপরও মানুষ হিসেবে তাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।

জাকির মাহদিন : ‘পলিটিক্স’ শব্দের বাংলা কি রাজনীতি? ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ কথাটির সঙ্গে ‘রাজনীতি’ শব্দটি কতটুকু মানানসই?

মোকতাদির চৌধুরী : আমার মতে পলিটিক্সের সঠিক বাংলা হবে রাষ্ট্রনীতি। গণনীতিও বলতে পারো। রাজনীতি শব্দটি বহুল ব্যবহৃত। তবে তোমরা তরুণরা লেখালেখির মাধ্যমে রাজনীতির জায়গায় ‘গণনীতি’ শব্দটি প্রয়োগ করলে পরিবর্তন চলে আসবে।

র.আ.ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। তিনি একজন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক। ‘মত ও পথ’ নামে একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পর্যালোচনামূলক পাক্ষিকের সম্পাদক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর-৩ আসনের সংসদ সদস্য এবং বর্তমান সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।

 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ দর্শন সম্পাদক জাকির মাহদিন

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম,  সাক্ষাৎকার

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply