শুক্রবার বিকাল ৪:১১, ১৩ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

মীর জাফর ও তার দাম্পত্য জীবন

ইতিহাসের জঘন্য অধ্যায়

এই যে দেশে এত দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, খোঁজ নিলে দেখা যাবে এদের প্রত্যেকের স্ত্রী একেকজন মুন্নী বাঈ, না হয় এরা মগ্ন আছে কোনো বব্বু বাঈয়ের প্রেমে৷ তাই তো কবি বলেছেন- “যুগে যুগে মীর জাফরদের যত কুকর্ম, যত দুর্নীতি, পেছনে তার জড়িয়ে আছে কোনো অসতী নারীর প্রীতি৷”

ভালো কর্ম যেমন মানুষকে খ্যাতি এনে দেয়, তেমনি কুকর্মও কাউকে কাউকে বিখ্যাত করে তোলে৷ মীরজাফর ইতিহাসে বিখ্যাত হয়েছে তার কুকর্মের জন্যে৷ আজকে আমরা আলোচনা করবো মীর জাফরের দাম্পত্য জীবন নিয়ে।

মীর জাফর পারস্য থেকে নি:স্ব অবস্থায় ভাগ্যান্বেষণে বাংলায় আসে এবং বিহারের নায়েব নাযিম আলীবর্দী খানের অধীনে চাকরি গ্রহণ করে৷ গিরিয়ার যুদ্ধে মীর জাফর আলীবর্দী খানের হয়ে নবাব সরফরাজ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং খ্যাতি লাভ করে৷ আলীবর্দী নবাব হওয়ার পর মীর জাফরকে তার কৃতিত্বের জন্য মনসবদার পদ প্রদান করেন এবং আলীবর্দীর বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানুম সাহিবাকে মীর জাফরের সঙ্গে বিবাহ দেন৷ পরবর্তীতে মীর জাফর নবাবের পুরাতন সৈন্যদলের প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করে৷

নবাব আলীবর্দীর রং মহলে অসম্ভব সুন্দর দেহবল্লবীর অধিকারিণী বাঈজি ছিলো মুন্নী বাঈ৷ তার রূপ মাধুরী আর নুপুরের নিক্কনে অন্দর মহলের অনেক যুবা, বৃদ্ধ পুরুষেরই অন্তরে কাঁপন ধরতো৷ এই নর্তকী মীর জাফরের অন্তরও কাঁপিয়েছিলো৷ আলীবর্দী খাঁর প্রধান সেনাপতি থাকাবস্থায় মীর জাফর প্রায়ই জলসা ঘরে গিয়ে মুন্নী বাঈয়ের সাথে ফূর্তি করত৷ এতেই তার মন ভরেনি, তাকে আরো আপন করে পেতে চাইলো৷ তার মনে মুন্নী বাঈকে বিয়ে করে ঘরে তোলার খায়েশ জাগলো৷ তখনকার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী অভিজাত শ্রেণীর পুরুষেরা রং মহলের কোন বাঈজীকে বিয়ে করা সম্ভব ছিলো না৷ মীর জাফর তার লালিত খায়েশ পূরণ করে পলাশীর যুদ্ধের পর পুতুল নবাব হয়ে৷ সকল লোক লজ্জার মাথা খেয়ে সত্তর বছরের বৃদ্ধ নবাব মীর জাফর আলী খাঁ শুধু মুন্নী বাঈকে নয়, এক সপ্তাহের ব্যবধানে অপর বাঈজী বব্বু বাঈকেও শাদী করে বেগমের মর্যাদা দেয়৷ এভাবে মুর্শিদাবাদের অন্দর মহলে শুরু হয় বাঈজী থেকে বেগম হওয়ার অধঃপতিত ও ঘৃণিত কাহিনী৷ এই কাহিনীর নায়কও মীর জাফর৷

মুন্নী বাঈকে বিয়ে করার পূর্বে আকস্মিকভাবে তার প্রথম স্ত্রী শাহ খানুম এবং বিনা মেঘে বজ্রপাতে শাহ খানুমের পুত্র মিরনের মৃত্যু হয়৷ শাহ খানুমের মৃত্যু নিয়ে ঐতিহাসিকগণের কাছে কোন তথ্য না থাকলেও মিরনের মৃত্যু নিয়ে আধুনিক ঐতিহাসিকগণের দ্বিমত আছে৷ কারণ বিনা মেঘে কখনো বজ্রপাত হয় না৷ অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, মিরনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে বজ্রপাতে মৃত্যু বলে প্রচার করা হয়েছে৷ এই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা কে সে বিষয়টি আড়ালে থেকে গেছে৷ মুন্নী বাঈয়ের রূপে বিমুগ্ধ আরেক খদ্দের ছিলো লর্ড ক্লাইভ৷ রং মহলে নবাব মীর জাফর অন্যান্য বাঈজীর সাথে আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত। আর এই সুযোগে রাজমহলের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিত এই বাঈজী৷ এভাবে বাংলার নবাবী চালাত এক লম্পট ইংরেজ আরেক দেহপসারিনী বাঈজী৷

নবাব আলীবর্দীর রং মহলে অসম্ভব সুন্দর দেহবল্লবীর অধিকারিণী বাঈজি ছিলো মুন্নী বাঈ৷ তার রূপ মাধুরী আর নুপুরের নিক্কনে অন্দর মহলের অনেক যুবা, বৃদ্ধ পুরুষেরই অন্তরে কাঁপন ধরতো৷ এই নর্তকী মীর জাফরের অন্তরও কাঁপিয়েছিলো৷ আলীবর্দী খাঁর প্রধান সেনাপতি থাকাবস্থায় মীর জাফর প্রায়ই জলসা ঘরে গিয়ে মুন্নী বাঈয়ের সাথে ফূর্তি করত৷

মুন্নী বাঈ লর্ড ক্লাইভের মনোরঞ্জন করে তার পুত্র নাজিমু্দ্দীনের জন্য বাংলার পরবর্তী নবাব পদটি নিশ্চিত করে নিয়েছিলো৷ ১৭৬৫ সালে মীর জাফরের মৃত্যু হলে মুন্নী বাঈয়ের পুত্র নাজিম উদ্দীন আলী খাঁন ওরফে ওরফে নজম উদ দৌলা পতুল নবাব হন৷ সিংহাসন আরোহন করার মাত্র এক বছর পর নজম উদ দৌলার মৃত্যু হলে ১৭৬৬ সালে, মুন্নী বাঈয়ের আরেক পুত্র নাজাবুত আলী খাঁন ওরফে সাঈফ উদ দৌলা নবাব হন৷ চার বছর পর ১৭৭০ সালে তারও মৃত্যু হয়৷ মিরনের মৃত্যুর মত মুন্নী বাঈয়ের দুই পুত্রের মৃত্যু রহস্যও থেকে গেছে আড়ালে৷ ধারণা করা হয়, তাদেরকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে৷ মিরনের মৃত্যুর মূল ষড়যন্ত্রকারী কে মীর জাফর, মুন্নী বাঈ না লর্ড ক্লাইভ? সে সম্পর্কে যেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি; তেমনি মুন্নী বাঈয়ের পুত্রদের ষড়যন্ত্রকারী কে বব্বু বাঈ, বব্বু বাঈয়ের কোন ইংরেজ খদ্দের, না অন্য কেউ? এ বিষয়ে তেমন নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই৷

মুন্নী বাঈয়ের দুই পুত্রের মৃত্যু পর বব্বু বাঈয়ের গর্ভজাত সন্তান আশরাফ আলী খাঁন ওরফে মোবারক উদ দৌলা নবাবী পায় (১৭৭১-৯৩)৷ মুন্নী বাঈয়ের চেয়ে বব্বু বাঈ ভাগ্যবতী রমণী ছিলেন৷ কারণ পরবর্তীতে বব্বু বাঈয়ের পুত্র এবং পৌত্রগণ ধারাবাহিকভাবে বাংলার পুতুল নবাব হন৷ আবহমান কাল ধরে বাংলার বধূ এবং বাঈজীদের মাঝে বিরাট ব্যবধান চলে আসছে৷ বধূদের খুব বেশি চাহিদা থাকে না৷ ছোট্ট একটা ঘর, দু’বেলা দু’মুঠো ভাত, শরীর ঢাকার জন্য এক জোড়া তাঁতের সাথে আর একটু ভালো ব্যবহারেই তারা সন্তুষ্ট৷ একজোড়া কাচের চুড়ি কিনলে এরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্বামীকে বলে, “শুধু শুধু বাড়তি খরচ কেন করতে গেলে?” মাসে সংসার খরচ দশ হাজার লাগলে এরা চেষ্টা করে আট হাজার টাকা খরচ করে দুই হাজার টাকা সঞ্চয় করতে৷ আর এই দুই হাজার টাকা সঞ্চয় করতে গিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রমে এরা হারায় রূপ লাবণ্য৷ সৎ লোকেরা সেই রূপহীন বধূতেই মগ্ন থাকে, অসৎ লোকেরা ছুটে যায় বাঈজীর কাছে৷ বাঈজীদের চাহিদা অনেক৷ এরা থাকে প্রাসাদে৷ জামদানী শাড়ি আর সোনার গয়নার ভারে এদের দেহ নুয়ে পড়ে৷ খদ্দরের রুচি অনুযায়ী সাজসজ্জাও ভিন্ন ভিন্ন৷

আবহমান কাল ধরে বাংলার বধূ এবং বাঈজীদের মাঝে বিরাট ব্যবধান চলে আসছে৷ বধূদের খুব বেশি চাহিদা থাকে না৷ ছোট্ট একটা ঘর, দু’বেলা দু’মুঠো ভাত, শরীর ঢাকার জন্য এক জোড়া তাঁতের সাথে আর একটু ভালো ব্যবহারেই তারা সন্তুষ্ট৷ একজোড়া কাচের চুড়ি কিনলে এরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্বামীকে বলে, “শুধু শুধু বাড়তি খরচ কেন করতে গেলে?”

মীর জাফরের মত কোনো প্রেমিক সোনার চুড়ি দিলে এরা বলে, “তোমার চেয়ে লর্ড ক্লাইভই তো ভালো৷ সে আমাকে হীরার লকেটের সোনার হার দিয়েছে৷” একজন বধূ যে টাকায় পুরো মাস সংসার চালায়, এরা এক রাতে সে টাকা আয় করে৷ বাঈজীদের ব্যবসাটা যেহেতু শরীরবৃত্তীয়, তাই এদের চিন্তাধারাও শরীরকেন্দ্রিক৷ বাংলার ছেলেরা যেদিন থেকে বধূর চেয়ে বাঈজীকে প্রাধান্য দিয়েছে সেদিন থেকেই বাংলার আকাশে দূর্ভাগ্যের ঘনঘটা শুরু৷ বাংলার মেয়েরা যেদিন থেকে বাঈজীদের অনুসরণ করতে শুরু করেছে সেদিন থেকেই জন্ম নিয়েছে মীরজাফরদের৷

এই যে দেশে এত দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, খোঁজ নিলে দেখা যাবে এদের প্রত্যেকের স্ত্রী একেকজন মুন্নী বাঈ, না হয় এরা মগ্ন আছে কোনো বব্বু বাঈয়ের প্রেমে৷ তাই তো কবি বলেছেন- “যুগে যুগে মীর জাফরদের যত কুকর্ম, যত দুর্নীতি, পেছনে তার জড়িয়ে আছে কোনো অসতী নারীর প্রীতি৷” অসৎ লোকেরা কি দাম্পত্য জীবনে সুখী হয়? মীরজাফরতো সুখী হয় নি তার জীবনে৷ সে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হলে খাস কবিরাজ অসীম কৃষ্ণ রায়ের পরামর্শে তাকে সকাল-বিকাল মূর্শিদাবাদের কীটেশ্বর মন্দিরের দেবতার চরণ ধোয়া জল সেবন করানো হয়৷ মানুষের হক্ব লুন্ঠন করে সারা জীবন হাজরে আসওয়াদে চুমু দিলে যেমন লাভ হবে না, দেবতা চরণের জল পান করেও মীর জাফরের কোন লাভ হয়নি৷ তার মৃত্যুর তিন দিন পূর্বে ধন-সম্পদের ভাগ-ভাটোয়ারা নিয়ে মুন্নী বাঈ ও বব্বু বাঈ ঝগড়া করে প্রাসাদ ত্যাগ করে। বিশাল প্রাসাদে মীর জাফরের গলিত পঁচা লাশ নিঃসঙ্গ পড়ে থাকে।

ক্যাটাগরি: সারাদেশ

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply