শুক্রবার রাত ৩:৫০, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ইং

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নামকরণের ইতিহাস

লিটন চৌধুরি

নামের মধ্যে পরিচয় নিহিত থাকলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নামকরণ নিয়ে নানাবিধ জনশ্রুতি রয়েছে। সঠিকভাবে জানা যায়নি এই জেলার নামকরণের ইতিহাস। এ নিয়ে একাধিক মতভেদ আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এগুলোর কোনো কোনোটির ঐতিহাসিক ভিত্তি বা প্রমাণাদি নেই। কেবল সাংস্কৃতিক ধারণ বা ধারক বলে এসব আনুমানিক তথ্যাদি বা জনশ্রুতি আজও টিকে আছে।

ঐতিহাসিকদের মতে, ভারতের কর্ণাটকের আদিবাসি সেন ব্রাহ্মণদের শাসনাধীনে ছিল এ অঞ্চল। তখনো এই অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ঘটেনি। রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে এই অঞ্চলে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল না। ফলে বছরের বিভিন্ন সময়ে পূঁজা পর্বণে হিন্দুদের বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতো। তখন রাজা লক্ষণ সেন তার শাসনাধীন কান্যকুজ (আধুনিক কনৌজ) থেকে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবার এ অঞ্চলে এনে বসতি স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে কিংবা তারও কিছুকাল আগে সরাইলের প্রভাবশালী জমিদার দেওয়ান মোস্তফা আলি আরো কিছু ব্রাহ্মণ পরিবার এনেছিলেন। ধারণা করা হয়, আগত ব্রাহ্মণদের বাড়ি ও আস্তানা থেকে এ জেলার নামকরণ হতে পারে ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’।

প্রাচীন জনপথ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। মহাভারত প্রণেতা বেদব্যাসের ‘পদ্মপুরান’ গ্রন্থে জনশ্রুতি আছে, কালিদহ সায়র বা কালিদাস সাগরের তলদেশ থেকে ধীরে ধীরে স্থল ও জনপদে রূপান্তরিত হয় জেলার বৃহত্তর অংশ, একাদশ থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। কালিদহ সায়র বা কালিদাস সাগর এর নামকরনেই এ অঞ্চলে হিন্দু আধিক্য ছিল বলে অনেকটা প্রমাণ মিলে। জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস পর্যলোচনা করলে এর সত্যতা নিরূপণ করা যায়। হিন্দু আধিক্যের কারণে এই এলাকার কর্তৃত্ব তৎকালীন ত্রিপুরায় ব্রাহ্মণ্যবাদের বিস্তার ঘটে। ব্রাহ্মণ আধিক্য বা ‘ব্রাহ্মণদের বাড়ি’ থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকেরই ধারণা। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, ব্রাহ্মণ শব্দ থেকে ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামকরণ হয়েছে।

এক. প্রাচীনকালে বর্তমান শহরের “পৌর মিলনায়তন” এর পশ্চিম দিকটায় অভিজাত ব্রাহ্মণদের একটা বাড়ি ছিল। সেন রাজা আদিশূর, উত্তর প্রদেশের কান্যাকুজ থেকে যে পাঁচ ব্রাহ্মণ পরিবার এনেছিলেন তারাও এই ব্রাহ্মণবাড়িতে উঠেছিলেন। উল্লেখিত বাড়িটি ছিল এ ব্রাহ্মণদেরই বংশধর। তাই বাড়িটির নাম হয় ‘ব্রাহ্মণবাড়ি’। এ ‘ব্রাহ্মণবাড়ি’ থেকেই তৎকালীন মহকুমার নামকরণ করা হয় ‘ব্রাহ্মণবাড়ি’ তথা ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’। যেহেতু একজন মুসলমান ব্রাহ্মণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, সেহেতু এ শহরের নামকরণ করা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

দুই. অনেকের মতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নামকরণের সাথে সুফী সাধক কাজী মাহমুদ শাহ (র.) এর নাম জড়িত। সুদূর দিল্লি থেকে আগত মুসলিম দরবেশ ও ইসলাম ধর্ম প্রচারক শাহ সুফী হযরত কাজী মাহমুদ শাহ (র) তৎকালীন ভারতের পূর্বাঞ্চলে আগমন করেন ষোড়শ অথবা সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে। তিতাস পাড়ের আলোচ্য স্থানটিতে একচেটিয়া হিন্দু ব্রাহ্মণদের বাস দেখে এখানেই তিনি আস্তানা গাড়েন। এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত শহর খালের দক্ষিণ পাড়ের জঙ্গলাকীর্ণ একটি উঁচু টিলায়, যা বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকাধিন ৮নং ওয়ার্ডের কাজীপাড়া দরগাহ্ মহল্লা নামে পরিচিত। তাঁর নামানুসারে ওখানে একটি মাজার রয়েছে। এটি কাজী খন্দকারের দরগাহ্ বা মাজার নামে পরিচয় বহন করে। কাজী মাহমুদ শাহ (র.) শুধু ধর্মপ্রচারকই ছিলেন না, আল্লাহর ওলিও ছিলেন। নানাবিধ অলৌকিক কীর্তি-কর্মে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীকে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতে থাকেন। ফলে বেশ কিছুসংখ্যক ব্রাহ্মণ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। আর কিছুসংখ্যক দীক্ষিত না হলেও দূরে থাকেন। জনশ্রুতি রয়েছে, যারা দীক্ষিত হননি তাদের প্রতি রুষ্ট হয়ে সাধক কাজী মাহমুদ শাহ (র:) বলেন, ‘ব্রাহ্মণ বেরিয়ে যাও’। তাঁর এই উক্তি থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি, যা আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামে পরিচিত।


অথবা যে সকল ব্রাহ্মণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি, তাঁরা সবাই অন্যত্র চলে যাবার মনস্থ করেন এবং ওলিকে সানুনয়ে বলেন, হুজুর; আমরা তো চলেই যাচ্ছি, তবে আমাদের একটা অনুরোধ, আমাদের চৌদ্দ পুরুষের ভিটে-মাটিতে একটা স্মৃতি থাখুক, আমাদের নামানুসারে এ জায়গার নাম করণ করা হোক। কাজী সাহেব ব্রাহ্মণদের অনুরোধ বা দাবি মেনে নেন এবং যেহেতু এখানে ব্রাহ্মণদের বাড়ি ছিল, সেহেতু এ জায়গার নামকরণ করেন ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’।

তিন, এ মতবাদের ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি আছে কি নেই, তা হলফ করে বলা কঠিন। তবে মানুষের মুখে মুখে মতবাদটি প্রচারিত হয়ে অনেকটা কিংবদন্তি হিসেবে বিভিন্ন বই পুস্তকে স্থান করে নিয়েছে। এছাড়া পশ্চিমের গৌড়রাজ্যের কুলীন ব্রাহ্মণগণ এখানে এসে বসবাস করেন বলেই এর নাম করণ করা হয় ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’।

চার, ব্রাহ্মণ প্রসিদ্ধ স্থান বলেও ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামকরণ হতে পারে বলে মনে করা হয়। ত্রিপুর সিংহাসনে আরোহনের পর কিরাত নামের উচ্ছেদ করে স্বীয় নামানুসারে রাজ্যের নাম ত্রিপুরা এবং প্রজাগণকে ত্রিপুরা জাতি বলে প্রচার করেন। অধিকন্তু তিনি শিব বিদ্বেষী ছিলেন। ব্রাহ্মণগণ ধর্মদ্বেষী ত্রিপুরের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রাজ্য পরিত্যাগ করে অন্যত্র গমন করেন। ত্রিপুরের মৃত্যুর পর মহারাজ ত্রিলোচন বহুবিধ দেব উপাসনা এবং সৎকার্য সম্পন্ন করে এক মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে আনয়ন করতে গঙ্গাসাগরে লোক প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণবিদ্বেষী দূর্দান্ত ত্রিপুর তখনও জীবিত রয়েছে অনুমান করে ব্রাহ্মণগণ নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে প্রথমে স্বীকার করেননি। কিন্তু যখন জানতে পরলেন ত্রিপুর মানবলীলা সংবরণ করেছেন, তখন তারা হৃষ্ট-চিত্তে ত্রিপুরায় গমন করে যজ্ঞাদী সমাপন করেছিলেন।

পাঁচ, ‘যযাতি থেতে কল্যাণ মাণিক্য’ নামে ত্রিপুরার ১১৭জন রাজা-মহারাজার সময়কালে তাদের অনেকেই বিভিন্নভাবে ব্রাহ্মণদের খেদমত করতে গিয়ে অকাতরে ভূমি দান করে গেছেন। ধারণা করা হয়, সেই থেকে এখানে ব্রাহ্মণদের বসবাস শুরু হলে এর নামকরণ হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

তাদের এই দান করা ভূমিতে বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরতলীর নাটাই উত্তর ইউনিয়নে এককালে ব্রাহ্মণদের বসবাস ছিল বলে এখনো গ্রামটি ক্ষুদ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া বা ‘ক্ষুদ বাউন বাইরা’ নামে পরিচিত।

লিটন চৌধুরি : সাবাদিক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস অনুসন্ধানকারী

ক্যাটাগরি: ব্রাহ্মণবাড়িয়া,  শীর্ষ তিন

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply