১. ন্যায় বিচার দুরাশা : অসহায় পরিবারটি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। ২. আলামীন নিহতের ঘটনা ও উভয়পক্ষের মামলার বিষয়ে প্রশাসন কী চিন্তা করছে বা তারা কোনো সামাজিক ও মানবিক মীমাংসার চিন্তা করছে কি না সেসব নিয়ে সদর থানার ওসি মঈনুর রহমানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কান্দিপারাস্থ মাইমল হাটির মৃত জিল্লু মিয়ার ছেলে আলামীনকে (২৮) গত ৬ ফেব্রুয়ারি (২০১৭) সাদা পোশাকে পুলিশের (এলাকাবাসী সুনির্দিষ্টভাবে তাদের নাম ও পদবী বলছে) একটি দল বাড়ি থেকে মেরে-পিটে আধমরা ও উলঙ্গ করে ধরে নিয়ে দিনভর অমানবিক নির্যাতন করে রাতে থানার বাইরে গুলি করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় ও জাতীয় প্রায় সবগুলো প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টিভি চ্যানেলগুলো পরদিন এ নিয়ে নিউজ করেছে (বিস্তারিত জানতে- আলআমিন হত্যার বিচার চাই), তবে গতানুগতিক। এতে না ন্যায় বিচারের কোনো সম্ভাবনা আছে, না চরম অসহায় পরিবারটির পরবর্তী নিরাপত্তার কোনো আবেদন আছে। অবশ্য কার এত ঠ্যাকা যে স্থানীয় প্রশাসনের লৌহহৃদয় উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একটি সহায়-সম্বলহীন পরিবারের পাশে দাঁড়াতে কিংবা অন্তত নিরাপত্তার ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তিত হতে? দেশ দর্শনের সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, হত্যার পর পুলিশ ও সোর্সের পক্ষ থেকে পরিবারটিকে ভয় ও হুমকির ওপর রাখা হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে আলামীনের বৃদ্ধা মা পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করেছেন (মামলা নং-১০১)। মামলায় আসামী করা হয়েছে সদর থানার ওসি মঈনুর রহমান, এসআই আশরাফ, দুই সোর্স এবং আরো ক’জন পুলিশ সদস্যকে। মামলার নিউজটিও জনকণ্ঠ, অবজারভার, ইত্তেফাক, নয়া দিগন্ত, বাংলাদেশ প্রতিদিন, আমাদের সময়সহ প্রথম সারির দৈনিকগুলো গুরুত্বসহ কাভার করে।
১৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠ প্রথম পৃষ্ঠায় নিউজ করেছে “বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ওসি, এসআই ও ছয় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা”। এতে লিখেছে, “শহরে এক যুবককে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যার ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ কনস্টেবল এবং ২ সোর্সের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শফিকুল ইসলামের আদালতে এ মামলা দায়ের করা হয়। আদালত পিবিআইকে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। নিহত আল আমিনের মা নেছা বেগম গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মঈনুর রহমান, এসআই মোঃ আশরাফ, পুলিশের সোর্স খোকন ও সুমনকে হত্যার আসামি করা হয়েছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি শহরের কান্দিপাড়ার বাসিন্দা আল-আমিনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতের বুকে একাধিক গুলির ক্ষত ছিল। পুলিশ জানায়, মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আল-আমিন নিহত হয়। কিন্তু নিহতের স্ত্রী ও মাসহ পরিবারের সদস্যদের দাবি, সাদা পোশাকধারী পুলিশ প্রকাশ্যে তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তার গুলিবিদ্ধ লাশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে পাওয়া যায়।”
জাগো নিউজে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়া যুবকের মরদেহ উদ্ধার
এ রিপোর্ট :১৫ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি নয়া দিগন্তে মামলার আর্জি ও পুলিশের ‘গোপন মামলা’ বিষয়ে জানা যায়, “মামলার আর্জিতে উল্লেখ করা হয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ঐ মামলায় ভারতের হাসপাতালে ভর্তি কিডনী ও হার্ট আক্রান্ত রোগী ও কারাগারে আটক একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা ও অস্ত্র মামলার আসামী করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, পুলিশের দায়ের করা মামলার ৯নং আসামী কালু মিয়া। সে কিডনী ও হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত। মামলা হওয়ার ১১ দিন আগেই ভারতের জিবি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বুধবার সকালে তার সাথে কথা হয়। তিনি জানান, বর্তমানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় জিবি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালের ২য় তলার ১১নং ওয়ার্ডের ৫ নং সিটে রয়েছেন। তাকে অস্ত্র ও হত্যা মামলার আসামী করা হয়েছে। একই মামলার ৩নং আসামী জাকির হোসেন দীর্ঘদিন ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারে আটক। তিনি ১২ ফেব্রুয়ারী জেলা কারাগার থেকে জামিনে বের হন। অপর আসামী এরশাদ মিয়াও দীর্ঘদিন কারাগারে আটক রয়েছে। …স্থানীয় সূত্র বলছে, হার্ট ও কিডনী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় এবং কারাগারে আটক ব্যক্তি কিভাবে গোলাগুলিতে অংশ নিয়েছে এনিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারী সদর থানায় (পুলিশ বাদী হয়ে) পৃথক ২টি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১১ ও ১২। সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভারতে চিকিৎসাধীন এবং কারাগারে আটক ব্যক্তিদের আসামী করার মধ্য দিয়ে প্রকৃত ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা নয় তো?”
উল্লেখ্য যে, গত ২১ মার্চ (২০১৭) পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আদালতে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা তা দেননি, এমনকি তদন্তে গিয়ে নিহতের স্বজনদের সঙ্গে এখনো পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি বলে জানা যায়। তাই পিবিআইয়ের তদন্ত রিপোর্ট দেয়া নিয়ে নিহতের পরিবার সন্দেহ প্রকাশ করছে। এদিকে পুলিশের করা মামলার অন্যতম আসামী এরশাদ মিয়া গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পায়। মুক্তির পর জেলগেট থেকেই নিখোঁজ হয় এবং কিছুদিন পর তার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়।
১৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠ প্রথম পৃষ্ঠায় নিউজ করেছে “বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ওসি, এসআই ও ছয় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা”। এতে লিখেছে, “শহরে এক যুবককে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যার ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ কনস্টেবল এবং ২ সোর্সের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শফিকুল ইসলামের আদালতে এ মামলা দায়ের করা হয়। আদালত পিবিআইকে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। নিহত আল আমিনের মা নেছা বেগম গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মঈনুর রহমান, এসআই মোঃ আশরাফ, পুলিশের সোর্স খোকন ও সুমনকে হত্যার আসামি করা হয়েছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি শহরের কান্দিপাড়ার বাসিন্দা আল-আমিনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতের বুকে একাধিক গুলির ক্ষত ছিল। পুলিশ জানায়, মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আল-আমিন নিহত হয়। কিন্তু নিহতের স্ত্রী ও মাসহ পরিবারের সদস্যদের দাবি, সাদা পোশাকধারী পুলিশ প্রকাশ্যে তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তার গুলিবিদ্ধ লাশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে পাওয়া যায়।”
অন্যদিকে আলামীনের বৃদ্ধা মা স্বামী ও পুত্রশোকে কাতর। তার ওপর পুলিশের টহল ও সোর্সদের হুমকিতে বাড়িতে তিনি ঘুমাতে পারছেন না। আলামীনকে তিতাস নদীর দু’পাড়ের হাজার হাজার মানুষসহ তার বোন ও বৃদ্ধা মা’র চোখের সামনেই পানিতে চুবিয়ে নগ্ন করে মারধর করে হাড়গোড় ভেঙ্গে দেয়। এ দৃশ্য এখনো পর্যন্ত এলাকাবাসী ও আলামীনের স্বজনরা ভুলতে পারেনি। এর মাত্র দুমাস আগে তার বাবা পানিতে পড়ে মারা যান। আলামীনের তিনটি ছোট ছোট মেয়ে সন্তান রয়েছে। তিনটি ছোট ভাইও আছে। তার স্ত্রী শারীরিক প্রতিবন্ধী। মা অশীতিপর বৃদ্ধা, স্বামী-সন্তানের শোকে এখন পাথর। তিনি ন্যায় বিচারের পাশাপাশি নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চান। স্থানীয় প্রশাসন, আদালত ও রাজনীতিকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ন্যায় বিচারের নিশ্চয়তা ও একটুখানি নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু কে দেবে তার নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচারের নিশ্চয়তা? প্রতিদিন এমন কত শত অন্যায় অপরাধ হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। দায়িত্বশীল রাজনীতিকদের সময়ইবা কোথায় এসব ছোটখাট ঘটনা-দুর্ঘটনার প্রতি নজর দেয়ার? তাছাড়া শোনা যাচ্ছে সরকারদলীয় কোনো না কোনো নেতা বা কর্মীর ইঙ্গিতেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। আবার মাদকব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যারা নিয়মিত মাসোহারা পেতেন, আলামীন সে ব্যবসা ছেড়ে ভালো হয়ে যাওয়ায় তাদের ‘ভাগা’ কমে যায়। সেজন্যও এটা হতে পারে।
অবশ্য অনুসন্ধানে আরেকটি বিষয় ধরা পড়েছে, সরকারের সবুজ সংকেতেই চিহ্নিত সন্ত্রাসী-চোরাকারবারীর পাশাপাশি দেশের বড় বড় মাদকব্যবসায়ীকেও ক্রসফায়ারে ফেলা হচ্ছে। কারণ যারা একবার বিপথে পা বাড়ায় তারা সাময়িকভাবে এ থেকে ফিরে এলেও স্থায়ীভাবে এ থেকে দূরে থাকতে পারে না। আবার স্থায়ীভাবে তাদের মনোভাব পরিবর্তনের মতো যোগ্য চিন্ত্যক ও প্রশিক্ষকও সরকারের হাতে নেই। তাই সরকার বিকল্প পথ(?) বেছে নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে সমস্যা কমবে না আরো বাড়বে? তাছাড়া দেখা যাচ্ছে এর অপপ্রয়োগই বেশি হচ্ছে। এর ফায়দা নিচ্ছে কিছু অসৎ রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কমকর্তা। বিশেষ করে পুলিশ বিভাগে মানবিক চেতনা, সম্প্রীতি ও নিরপেক্ষ থেকে সামগ্রিক দায়িত্ববোধ জাগরণে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আজকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়ও বিষয়গুলো অনুপস্থিত। তাই উদ্ভূত সমস্যাগুলোর সৃষ্টিশীল ও সামাজিক সমাধান বেরিয়ে আসছে না।
আলামীন নিহতের ঘটনা ও উভয়পক্ষের মামলার বিষয়ে প্রশাসন কী চিন্তা করছে বা তারা কোনো সামাজিক ও মানবিক মীমাংসার চিন্তা করছে কি না সেসব নিয়ে সদর থানার ওসি মঈনুর রহমানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
এ নিউজটি গত ২০১৭ এর ১৭ এপ্রিল পাক্ষিক দেশ দর্শনের প্রিন্ট পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। তখন দেশ দর্শনের ওয়েব সাইট না থাকায় এর কোনো ইন্টারনেট সংস্করণ নেই। এখন দেশ দর্শনের ওয়েব সাইট হওয়ায় সংরক্ষণের স্বার্থে পুরনো এ নিউজটি দেশ দর্শনের ওয়েব সাইটে দেয়া হল।
ক্যাটাগরি: ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সারাদেশ
[sharethis-inline-buttons]