বুধবার ভোর ৫:৪৬, ২২শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ৫ই নভেম্বর, ২০২৪ ইং

অপরিণামদর্শী বিয়ে, আস্থার সংকট ও তালাক (পর্ব-২)

শরীফ উদ্দীন রনি

“আজ নদী ভাঙ্গনের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার, পরিবেশ দূষণে সোচ্চার, সমাজ-সংগঠন ভাঙ্গনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কেবল পরিবারটাই আস্ত রাখতে চাই না, এটা নিজ হাতে ভেঙ্গে দিতে চাই। পরিবার ছাড়া একা চলতে চাই। কারণ পরিবার থাকলে যে আমার অনেক পশুপ্রবৃত্তি পূরণ করতে পারব না!”

তালাকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি কথিত ‘উন্নত’ ও ‘শিক্ষিত’ পরিবারে। এ উন্নত ও শিক্ষিতরা সমাজ-রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক ভিত- ‘পরিবার’ গঠন করতে পারছে না। যারা এমন একটি মৌলিক এবং একেবারেই ছোট্ট ও ক্ষুদ্র সংগঠন গড়ে তুলতে পারে না, টিকিয়ে রাখতে পারে না, তারা কীভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের মতো বৃহৎ সংগঠন গড়ে তুলবে এবং টিকিয়ে রাখবে? যারা একান্তই ক্ষুদ্র একটি সংগঠন- ‘পরিবারের’ সীমিত সদস্যদের সমস্যার সমাধান করতে পারে না, তারা কীভাবে বৃহৎ সংগঠন- জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যাসমূহ মোকাবেলা করবে?

বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার একশ একটা কারণ থাকতে পারে। যার প্রতিটি কারণ নিয়ে আবার বহু বড় বড় বই লেখা যেতে পারে। গ্রন্থ প্রণেতা ও গবেষকরা লিখছেনও। তারা ‘গবেষণাও’ করছেন দিব্যি। কিন্তু তাতে সমস্যা কতটুকু দূর হচ্ছে তা বাস্তবে না দেখেই আমরা তাদের বাহবা দেই, পুরস্কৃত করি। কোনো দেশ-জাতিই আজ পরিবারের ভাঙ্গন থেকে মুক্ত নয়। এ পর্যন্ত লেখক-গবেষক ও বক্তারা যত রকম সমস্যা উত্তরণের পথ বাতলে দিয়েছেন, বলার অপেক্ষা রাখে না যে তা সার্বিক সমাধানে ব্যর্থ। কারণ তারা মানুষকে নয়, বরং মানুষের আশপাশের কথিত পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র- সবকিছু ঠিক রেখে তার সমাধানের চেষ্টা করছেন। অর্থাৎ তরা সবকিছু ঠিক রাখতে চান, কেবল মানুষ ছাড়া।

আজ নদী ভাঙ্গনের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার, পরিবেশ দূষণে সোচ্চার, সমাজ-সংগঠন ভাঙ্গনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কেবল পরিবারটাই আস্ত রাখতে চাই না, এটা নিজ হাতে ভেঙ্গে দিতে চাই। পরিবার ছাড়া একা চলতে চাই। কারণ পরিবার থাকলে যে আমার অনেক পশুপ্রবৃত্তি পূরণ করতে পারব না!

“বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার একশ একটা কারণ থাকতে পারে। যার প্রতিটি কারণ নিয়ে আবার বহু বড় বড় বই লেখা যেতে পারে। গ্রন্থ প্রণেতা ও গবেষকরা লিখছেনও। তারা ‘গবেষণাও’ করছেন দিব্যি। কিন্তু তাতে সমস্যা কতটুকু দূর হচ্ছে তা বাস্তবে না দেখেই আমরা তাদের বাহবা দেই, পুরস্কৃত করি।”

পরিবার ঠিক রাখতে গিয়ে আশপাশটা ধ্বংস করে ফেলতে হবে- এমন না। তবে মাঝে মাঝে স্রোতের বিপরীতে গিয়েও দাঁড়াতে হয়, স্রোতকে ঠেকানোর জন্য। কোনো মানুষের জীবনদর্শনে মানবিক বিষয়টি না রেখে যতই বস্তুগত উন্নতি সাধিত হোক, তাতে সার্বিক সমস্যা না কমে বরং বাড়ে। এর প্রমাণ আজকের পশ্চিমা বিশ্ব। যারা সমস্যা সমাধানে প্রতিটি মানুষকে এনে দিতে চায় ‘অবাধ স্বাধীনতা’। তারা পরিবার ভেঙ্গে দিয়েছে অনেক আগেই।

আরো পড়ুন> অপরিণামদর্শী বিয়ে (পর্ব-১)

ইউরোপ-আমেরিকায় ছেলে-মেয়ারা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো বিয়ে করে থাকে। বিয়ের পূর্বেই তারা একটি মেয়ের সকল দিক দেখার সুযোগ পায়। তবু কেন তাদের বিয়ে টেকশই হচ্ছে না? আবার এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলোতে আগে পরিবার দেখেশুনে বিয়ে দিত বলে খুব বেশি একটা তালাকের খবর না পাওয়া গেলেও মেয়েরা প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হতো। কারণ পারস্পরিক মতামত বিনিময় ব্যতীত কোনো সম্পর্কই স্থায়ী ও মজবুত হয় না। গৃহিণী হিসেবে ঘরেই আবদ্ধ থাকতে হতো তাদের। তারা নিজেদের মত প্রকাশের খুব বেশি একটা সুযোগ পেত না বললেই চলে। তাই একসময় তারাও মনে করতে শুরু করলো যে উন্নত রাষ্ট্রের মতো আমরাও অবাধ স্বাধীনতার পথ অনুসরণ করে পার পেয়ে যাব। কিন্তু না, ফলাফল তার ব্যতিক্রম।

“ইউরোপ-আমেরিকায় ছেলে-মেয়ারা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো বিয়ে করে থাকে। বিয়ের পূর্বেই তারা একটি মেয়ের সকল দিক দেখার সুযোগ পায়। তবু কেন তাদের বিয়ে টেকশই হচ্ছে না? আবার এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলোতে আগে পরিবার দেখেশুনে বিয়ে দিত বলে খুব বেশি একটা তালাকের খবর না পাওয়া গেলেও মেয়েরা প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হতো।”

দিন দিন অবাধ স্বাধীনতার কারণে নারী-পুরুষের একে অপরের প্রতি বিশ্বাস-শ্রদ্ধা-ভক্তি কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব সংসার জীবনে পড়ছে। তারা একে অপরের মতকে খুব সহজে মেনে নিতে পারে না। তার উপর সহশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষগুলো জানে কে কতটা যোগ্য আর কে যোগ্য নয়? যার ফলে ছাড় দেওয়ার পরিবর্তে তারা কঠোরতার পন্থাটাই অবলম্বন করে থাকে। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে কঠোর হতে যেমন শেখায়, তেমনি ছাড় দিতেও শেখায়।

লেখকের সব কলাম

অন্যদিকে পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের ঘিরে স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে গিয়ে তাদের নিজের চাহিদা ও সন্তানের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আয়-রোজগার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই সন্তান জন্মের পর পিতা-মাতার কাছ থেকে যে প্রকৃত ও বাস্তবসম্মত শিক্ষা পাওয়ার কথা, তা থেকে সন্তানরা বঞ্চিত হয়। তারা শেখাবে কী করে? ছেলেমেয়ের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে গিয়ে তার মূল শিক্ষার কথা তারা নিজেরাই ভুলে যায়।

এটি তাদের বিবেচ্য বিষয় হিসেবেও গণ্য নয়। কারণ অর্থদিয়ে সবকিছু পাবার আশা মনে থাকলে কি তা বিবেচ্য হওয়ার কথা?  শিশুকালের প্রকৃত শিক্ষা সারাজীবনের অন্যকোনো শিক্ষা পূরণ করতে পারে না। তাই আজকের পিতা-মাতারাও সন্তানের ডিভোর্সের কোনো সমাধান দিতে না পেরে সন্তানের কাছে শেষ পর্যন্ত মাথা নত করে। তবুও মানুষগুলো অনুধাবন করতে পারে না যে সমস্যা সম্মুখে আসলে নয় বরং পূর্ব থেকেই এর ব্যাপারে সচেতন ও সমাধানের উপায় খোঁজ করা দরকার। পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে তো আর প্রস্তুতির কথা ভাবা যায় না। তার পূর্বেই প্রস্তুতির কথা ভাবতে হয়।

চলবে…

লেখকের ব্লগ

শরীফ উদ্দীন রনি : বার্তা সম্পাদক, দেশ দর্শন

ক্যাটাগরি: নারী,  প্রধান কলাম,  সম্পাদকের বাছাই

ট্যাগ: শরীফ উদ্দীন রনি

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply