বুধবার ভোর ৫:৪৭, ২২শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ৫ই নভেম্বর, ২০২৪ ইং

পরিবারতন্ত্র ও মূর্খতার শেকলে বন্দী রাজনীতি

খায়রুল আকরাম খান

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান অথবা জিয়াউর রহমানের স্বাভাবিক মৃত্যু হলে খালেদা-হাসিনা কেউই ক্ষমতায় আসতে পারতেন না। আবার এ কথাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী্ হবেন তাদের দুজনের দুই সোনার ছেলে(?) সজীব ওয়াজেদ জয় ও তারেক রহমান!

একবিংশ শতাব্দীর এই যুগেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি চরম মূর্খতা ও পরিবারতন্ত্রের শেকলে বন্দী। অপ্রিয় হলেও সত্য, এ অঞ্চলের সংসদগুলো হয়ে উঠেছে ধনিক শ্রেণির পারিবারিক ক্লাব। প্রান্তিক মানুষের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে এসব সংসদ গঠিত হলেও এসব জায়গায় সাধারণ মানুষের কোনো স্বার্থ বিবেচিত হয় না। গণতন্ত্র, উন্নয়ন, আইনের শাসন ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এ ধরনের প্রবণতা খুবই ভয়াবহ! বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে পরিবারতন্ত্র আরো পাকাপোক্ত আকার ধারণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পরিবারতন্ত্র নিয়ে হরহামেশাই সর্বত্র আলোচনা চলছে। বিশ্লেষকদের মতে, ৩৬ বছর ধরে বাংলাদেশে চলছে পরিবারতন্ত্রের প্যাকেটে মোড়ানো উদ্ভট এক গণতন্ত্র। এমতাবস্থায় সৎ ও নিষ্ঠাবান নেতা-কর্মীরা রাজনীতিতে থাকার আগ্রহ হারাচ্ছেন। মেধাবীদের রাজনীতিতে আসার পথও বন্ধ করে দিচ্ছে পারিবারিক দখলস্বত্বের ধারা।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জহরলাল নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতে শুরু হয় নেহেরুতন্ত্র। নেহেরুর মৃত্যুর পর তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী হলেন দলীয় প্রধান। ইন্দিরার মৃত্যুর পর তার পুত্র রাজিব গান্ধী হলেন প্রধানমন্ত্রী্। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী ক্ষমতার কিনারে গিয়ে বিশেষ কারণে ফিরে এলেও পুত্র রাহুল গান্ধী যে কংগ্রেস থেকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী্ হবে- সেটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুর পর কন্যা বেনজির ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী্ হয়েছেন। তার মৃত্যুর পর স্বামী আসিফ আলী জারদারি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন আর কিশোর বয়সে পুত্র বিলওয়াল ভুট্টো হয়েছেন পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান। আশা করা যায়, পরবর্তীতে পিপলস পার্টি সরকার গঠন করলে বিলওয়াল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী্ হবেন।

বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর তার কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ, জিয়াউর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পরে তার স্ত্রী খালেদা জিয়া দেশের সরকার প্রধান হয়েছেন। সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান অথবা জিয়াউর রহমানের স্বাভাবিক মৃত্যু হলে খালেদা-হাসিনা কেউই ক্ষমতায় আসতে পারতেন না। আবার এ কথাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী্ হবেন তাদের দুজনের দুই সোনার ছেলে(?) সজীব ওয়াজেদ জয় ও তারেক রহমান!

দুঃখজনক হলেও সত্য, উল্লেখিত রাষ্ট্রগুলোতে ন্যাক্কারজনকভাবে পারিবারিক রাজতন্ত্র চলছে। দলের প্রধান বা সরকার প্রধান নিহত হলে পরিবারের সদস্যদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি তৈরি হয়। সে পরিবারের বাইরের কেউ নেতা হিসেবে দলের মধ্যে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও গ্রহণযোগ্য নন বলেই দলীয় ঐক্যের স্বার্থে সে পরিবারেরই একজনের হাতে ঘটনাচক্রে দলের নেতৃত্ব ও পরবর্তী রাষ্ট্রক্ষমতা ন্যস্ত হয়। তার স্বাভাবিক মৃত্যুর পরও পরিবারেরই কেউ দলীয় প্রধান হয়ে থাকেন।

খালেদা-হাসিনার মৃত্যুর পর তাদের পুত্ররা দলের নেতৃত্ব না দিলে দল যেমন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, তেমনি যোগ্যতা থাকার পরও শেখ পরিবার ও জিয়া পরিবারের বাইরে থেকে অন্য কোনো নাগরিক অদূর ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না। হাজার সাধনা-চেষ্টা করলেও একজন নাগরিক সময়-সুযোগে দেশের রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, প্রধান নিবার্চন কশিনার, সেনা প্রধান হতে পারবেন; তবে কখনো প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। কেননা, প্রধানমন্ত্রী কেবলমাত্র সেই দুই পরিবারের জন্যই বরাদ্ধকৃত! এ যেন এক ধরনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।

সমাজ গবেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, এক নেতাসবর্স্ব কোনো রাজনৈতিক দল দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা সবাই স্বেচ্ছাসেবী, কারও দাস নয়। রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র চলতে পারে না। একজনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দল এবং পরিবারতন্ত্র দেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আজকের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র যেন আরো বেশি শিকড় গেড়ে বসেছে। জনগণ আরো বেশি স্বশিক্ষিত ও সচেতন হয়ে না উঠলে বাংলাদেশে পরিবারতন্ত্র আছে এবং থাকবে। এটাকে মেনে না নিলে সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এর বিরুদ্ধে সুস্থ এবং গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। আর এ গড়ে তোলার দায়িত্ব প্রতিটি সচেতন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের।

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম,  সম্পাদকের বাছাই

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply