রবিবার দুপুর ২:৪৫, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

দেশ-জাতি অসীম বিতর্কের ঘূর্ণিপাকে

জাকির মাহদিন

এলিটরা গরমে এসি লাগায়, ফ্রিজ কিনে, রাষ্ট্রের সহায়তায় কৃষিজমি দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করে, বহুজাতিক কোম্পানি গড়ে তোলে, উন্নয়নের জোয়ারে গরিবের টাকায় গরিবের পেটে কষে লাথি মারে। আর গরিবরা বড়লোকের লাথি খেয়ে মরে, শীত-গরমে মরে, না খেয়ে মরে, বিনা চিকিৎসায় মরে, বেকার হয়ে মরে, হতাশায় মরে, গণতন্ত্র-উন্নয়ন-নির্বাচনের নিচে পিষ্ট হয়ে মরে। বিচারেও মরে বিনাবিচারেও মরে। কিন্তু তবু গরিব কমে না, শুধু বাড়ে। এ যেন আরেক অভিশাপ। গরিবের প্রতি ফোটা রক্ত থেকে আবার ‘গরিব’ জন্ম নেয়।

বৈষম্য, বিভক্তি, সংঘাত বাড়ছে ঝড়ের বেগে। ক্ষোভ, ঘৃণা, প্রতিহিংসা ঊর্ধ্বমুখী। জীবন-ভাবনায় সংশয়, হতাশা, পারস্পরিক অবিশ্বাস, অনাস্থা সীমাহীন। অসীম বিতর্কের ঘূর্ণিপাকে ঘুরছে মৌলবাদ, নারীবাদ, ধর্মান্ধতা, মুক্তচিন্তা, রাষ্ট্রক্ষমতা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, নির্বাচন, দুর্নীতি ইস্যুগুলোতে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন ইস্যু তৈরি হচ্ছে- জঙ্গিবাদ, দ্রব্যমূল্য, সড়ক দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, আইনশৃঙ্খলা, আইন-আদালত, বিচারব্যবস্থা, পুলিশের অন্যায়, খুন-গুম ইত্যাদি।

ইস্যুর নিচে চাপা পড়ছে ইস্যু। জমছে টকশো, কলাম, বিতর্ক। চলছে সীমাহীন পুঁজির মালিক অগণিত মিডিয়া। চলছেন প্রচুর নামী-বেনামী বুদ্ধিজীবী, নব্যবুদ্ধিজীবী, মুক্তবুদ্ধিচর্চাকারী, সমাজচিন্ত্যক, সাংবাদিক, আলেম, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিক, উপস্থাপক, নারীনেত্রী, ইয়ংলেডি, মানবতাবাদী, বিতার্কিক। মরছে লক্ষ লক্ষ খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ, কোটি কোটি আমজনতা। পাড়া-গাঁয়ের চায়ের কাপের ঝড় এখন টিভি টকশোর এসিরুমে দোল খায়।

এলিটরা গরমে এসি লাগায়, ফ্রিজ কিনে, রাষ্ট্রের সহায়তায় কৃষিজমি দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করে, বহুজাতিক কোম্পানি গড়ে তোলে, উন্নয়নের জোয়ারে গরিবের টাকায় গরিবের পেটে কষে লাথি মারে। আর গরিবরা বড়লোকের লাথি খেয়ে মরে, শীত-গরমে মরে, না খেয়ে মরে, বিনা চিকিৎসায় মরে, বেকার হয়ে মরে, হতাশায় মরে, গণতন্ত্র-উন্নয়ন-নির্বাচনের নিচে পিষ্ট হয়ে মরে। বিচারেও মরে বিনাবিচারেও মরে। কিন্তু তবু গরিব কমে না, শুধু বাড়ে। এ যেন আরেক অভিশাপ। গরিবের প্রতি ফোটা রক্ত থেকে আবার ‘গরিব’ জন্ম নেয়। অতঃপর দীর্ঘপথ ঘুরে এলিট শ্রেণিকে পাল্টা আঘাত হানে, অথবা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এলিটরা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এতে আবহাওয়া আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় সমাজের উচুতলা হয়ে পড়ে বেসামাল। তখন মনুষ্য সমাজ, মনুষ্যজাতি হয় সবচেয়ে অসুখী, অতৃপ্ত। তখন প্রচলিত শিক্ষা, ডিগ্রি, স্বীকৃতি, পুরস্কার, ক্ষমতা, টাকা, ইত্যাদি দিয়ে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা যায় না। তখন কেউ ধর্মকে আঘাত করে, কেউ ধর্মের নামে ব্যবসা করে। দুপক্ষেরই পেট চলে ভালো। কিন্তু মনুষ্য সমাজের আচার-আচরণে কোনো উন্নতি হয় না।

মানুষের জীবন কেন এত দুর্বিষহ! জীবনে কেন এত কষ্ট-অশান্তি, এত হতাশা-বিতর্ক? মানুষে মানুষে কেন এত সংঘাত, ধর্মে ধর্মে কেন এত দ্বন্দ্ব? মানুষ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানুষ অতিমূল্যবান বাকশক্তি ও চিন্তাশক্তির অধিকারী। বুদ্ধি ও জ্ঞানশক্তির অধিকারী। এসবই কি আজ মানুষের অধঃপতনের জন্য দায়ী? জীবন কী? ক্ষণিকের ভোগ, ক্ষণিকের বিজয়, ক্ষণিকের আরামই জীবন? আবার কিছুমাত্রায় এসব ছাড়াও কি জীবন চলে?

মানুষ প্রবৃত্তির পূজারী। অহংকারী। প্রবল আবেগী। তার প্রবৃত্তিপূজা, আবেগ ও অহংকার এত বেশি যে অধিকাংশ সময়েই প্রকৃত সত্য ও বাস্তবতা বিচারের শক্তি থাকে না। ওসব আচরণ সাধারণত তার পরিবেশ, প্রতিষ্ঠান, ধর্ম, ব্যক্তি ও পরিবারচিন্তা দ্বারা প্রভাবিত। যা আবার সমাজের অন্য অনেক ব্যক্তি, পরিবেশ, প্রতিষ্ঠান, ধর্ম ইত্যাদির সঙ্গে প্রবলভাবে সাংঘর্ষিক। সমস্যাটা এখানেই। প্রত্যেকেই যদি এই স্বাভাবিক জানাশোনা-আবেগ-অহংকার-প্রবৃত্তিপূজায় গড়াগড়ি খায় তবে সমাজে মানুষ বাস করা কঠিন। বর্তমান বিশ্বে অনেক ধর্ম আছে। এসব ধর্মের অনুসারীদের অধিকাংশই জন্মগত ও শিক্ষাগতভাবে এটা পেয়েছেন। প্রত্যেকেই তার নিজ ধর্মের প্রতি প্রবল আবেগী ও অহংকারী। নিজেরটা সত্য বলে জানেন। বিশেষ করে এক্ষেত্রে তাদের আবেগ-অনুভূতি-অহংকার-পূজা সবরকম যুক্তি-বুদ্ধি, বিচার-বিশ্লেষণ এবং পারস্পরিক সহযোগিতা-সহমর্মীতার ভিত্তিতে আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনর পথ রুদ্ধ করে দেয় যা তাদের সত্য ধর্মকে প্রমাণিত করতে ব্যর্থ হয়।

এই সাধারণ ধারণা, জানা, শিক্ষা আর আবেগ কখনো বাস্তবজীবনের অসংখ্য সংঘাত-সমস্যা-সংকট নিরসন করে না, করছেও না। তাহলে উপায় কি? অনেকগুলো ধর্মের মধ্যে সত্য ধর্ম বাছাই করার পথ কি এবং সত্য ধর্ম বা প্রকৃত ধর্ম দ্বিপাক্ষিক-বহুপাক্ষিক বিচার, স্বার্থ ও অন্যান্য বিষয়ে আবেগ-অহংকারকে কতটুকু জোর দেয়? বিশেষ করে ইহজাগতিক বিষয়গুলোতে নিজেদের প্রাধান্য দেয়, না অন্যদের? অর্থাৎ সত্য ধর্মানুসারীদের সামগ্রিক আচরণ কী- সংঘর্ষ-সংঘাতধর্মী, না মীমাংসাধর্মী? দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক ও পারস্পরিক মীমাংসার বাস্তবতা কি? এই প্রশ্নগুলো কেবল ধর্মের বাছাইপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, একটি নির্দিষ্ট ধর্মের অভ্যন্তরীণ দলাদলি-বলাবলি এমনকি ধর্মের বাইরের দল-মত-পথের বাছাইপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অথচ এসবে আমরা কেউই আগ্রহী নই।

মানুষের জীবন কেন এত দুর্বিষহ! জীবনে কেন এত কষ্ট-অশান্তি, এত হতাশা-বিতর্ক? মানুষে মানুষে কেন এত সংঘাত, ধর্মে ধর্মে কেন এত দ্বন্দ্ব? মানুষ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানুষ অতিমূল্যবান বাকশক্তি ও চিন্তাশক্তির অধিকারী। বুদ্ধি ও জ্ঞানশক্তির অধিকারী। এসবই কি আজ মানুষের অধঃপতনের জন্য দায়ী? জীবন কী? ক্ষণিকের ভোগ, ক্ষণিকের বিজয়, ক্ষণিকের আরামই জীবন? আবার কিছুমাত্রায় এসব ছাড়াও কি জীবন চলে? ধর্ম কী? ধর্মের নামে মানুষকে অশ্রদ্ধা, হুমকি, ফেৎনা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, ক্ষমতার বাসনা, টাকায় পকেটভর্তি করা, সম্মান দাবি করা, আলেম-শায়খ-পীর-মাওলানা সাজা, সাধারণ মানুষকে অশিক্ষিত-মূর্খ রেখে ধর্মের নামে বিতর্ক উসকে দেওয়াই কি ধর্ম? শিক্ষার নামে আজ কী চলছে? গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার নামে কী হচ্ছে? আইন-শৃঙ্খলা ও বিচারের নামে কী দেখা যাচ্ছে?

প্রকৃত সমস্যাটা আমাদের ভুল চিন্তা-চেতনা ও ভুল জীবন-দর্শনে। এটাকে ভুল না বলে ভ্রান্তিও বলা যায়। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সঠিক চিন্তা-চেতনা ও জীবন-দর্শনটা কী? সেটা না হয় সবাই মিলেই ঠিক করলাম। এই একটি পয়েন্টে সর্বোচ্চ গুরুত্বদান, মতবিনিময় ও বসাবসিতে (গোলটেবিল বৈঠক, সেমিনার, দ্বিপাক্ষিক-বহুপাক্ষিক, আন্তঃধর্মীয়, আন্তঃরাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক) আগ্রহ, সময়-ইচ্ছা-আন্তরিকতা, দৌড়-ঝাঁপ, নিরপেক্ষতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসাই মূলত সুস্পষ্ট করে তুলবে যে কোন-চিন্তা-চেতনা ও জীবন-দর্শন কতটা সঠিক, আর কোনগুলো একেবারেই ভ্রান্ত।

এসবের কোনটা নিয়ে বলব? কার কাছে বলব? কার জন্য বলব? যারা বলছে তারা কী বলছে, কেন বলছে? এমন অসংখ্য প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর নেই। আসলে কি উত্তর নেই? আমাদের প্রায় প্রতিটি চিন্তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। বিশেষ কিছু ব্যক্তির কাছ থেকে মাঝে মধ্যে যে সামগ্রিক চিন্তা ও চেতনার স্ফূরণ দেখা যায় তাও আদতে ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিকই। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক খরচা বেড়ে যাওয়ায়, ভোগের পরিসব ক্রমাগত ছোট হতে থাকায়, নিরাপত্তাঝুঁকি সৃষ্টি হওয়ায় ‘তাহারা’ ত্যক্ত-বিরক্ত, কিম্বা রীতিমতো বিপ্লবী! ছেলের বিয়ে মেয়ের বিয়ে থেকে শুরু করে সবকিছুতেই তারা যেসব চিন্তা ও কর্মকাণ্ড করেন তা লক্ষ্য করলেই সমস্যার সূত্রগুলো আশা করি আমরা ধরতে পারব। যদি অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানই মানবজীবনের প্রধান লক্ষ্য হয় তাহলে মানুষের চেয়ে নিরীহ ও নিকৃষ্ট জাতি আর নেই। কারণ এসবে পশু ও প্রাণীরা মানুষের চেয়ে হাজারগুণ এগিয়ে। তাদের উৎপাদন-উপার্জন করতে হয় না, রান্না করতে হয় না, জমা করতে হয় না, মামলা-মোকাদ্দমা চালাতে হয় না, শিক্ষা এবং চিকিৎসাও লাগে না। অগণিত প্রাণী আছে যারা মানুষের চেয়ে খায় বেশি, বাঁচে বেশি, সুস্থতা ও শক্তি-সামর্থ্য বেশি। কিন্তু দুশ্চিন্তা নেই। সীমাহীন আশা-আকাক্সক্ষা নেই। সুতরাং যা খেল, যতদিন বাঁচল পুরোটাই বোনাস।

মানুষের ও সমাজের সমস্যা কেবলই অর্থনৈতিক নয়। যতটুকুওবা অর্থনৈতিক, সেক্ষেত্রেও সব দোষ বড়লোকের নয়। কারণ তাদের অনেকেই প্রচলিত ‘অর্থনৈতিক সিস্টেমে’ বড়লোক। এই সিস্টেমের ভেতরের ‘অ-সিস্টেমটাও’ আসলে একটা সিস্টেম। এককালে বাপ-দাদার সম্পত্তি বা ব্যবসা ছিল, সেটা এখন সিস্টেমে হু হু করে বাড়ছে। অথবা ‘কোনো না কোনোভাবে’ নিজেই টাকা বানিয়েছে। এখন সেটা থামছেই না! অন্যদিকে একই সিস্টেমের চিপায় পড়ে কোটি কোটি মানুষ সর্বস্ব হারাচ্ছে। কিন্তু কার খবর কে রাখে? দেশে এত ঝানু অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, ধার্মিক ও মানবতাবাদী থাকতেও কোথা থেকে কী হচ্ছে, কীভাবে কেউ কিছুই বুঝতে ও বলতে পারছে না। আসলেই কি বুঝতে ও বলতে পারছে না? সরকারও কি এটা থামানোর শক্তি রাখে না, ইচ্ছা রাখে না? না জ্ঞান রাখে না?

একটি বিষয় না বললেই নয়, প্রকৃত সমস্যাটা আমাদের ভুল চিন্তা-চেতনা ও ভুল জীবন-দর্শনে। এটাকে ভুল না বলে ভ্রান্তিও বলা যায়। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সঠিক চিন্তা-চেতনা ও জীবন-দর্শনটা কী? সেটা না হয় সবাই মিলেই ঠিক করলাম। এই একটি পয়েন্টে সর্বোচ্চ গুরুত্বদান, মতবিনিময় ও বসাবসিতে (গোলটেবিল বৈঠক, সেমিনার, দ্বিপাক্ষিক-বহুপাক্ষিক, আন্তঃধর্মীয়, আন্তঃরাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক) আগ্রহ, সময়-ইচ্ছা-আন্তরিকতা, দৌড়-ঝাঁপ, নিরপেক্ষতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসাই মূলত সুস্পষ্ট করে তুলবে যে কোন-চিন্তা-চেতনা ও জীবন-দর্শন কতটা সঠিক, আর কোনগুলো একেবারেই ভ্রান্ত।

জাকির মাহদিন : সমাজচিন্ত্যক, কলামিস্ট

zakirmahdin@yahoo.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম,  সম্পাদকের কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply