“আমাদের মতো এরকম আর কোনো জাতি বিশ্বে আছে কিনা আমার সন্দেহ, প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাদের খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়। আমরা অতীত নিয়ে পড়ে থাকি, বর্তমানকেই জীবনের সবকিছু মনে করি। আর ভবিষ্যৎ? ওটা নিয়ে ভাববার সময় কই আমাদের?”
সমালোচনা আমাদের বাঙালি সমাজে একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। একে অনেকটা বিকৃত রুচিও বলা যায়। এটা না করলে যেন পেটের ভাত হজম হয় না। নিজেদের মতো করে অন্যের সমালোচনা করতে আমরা যতোটা পটু, ততোটা অন্যের সমস্যা অনুধাবন করে তাদের পাশে দাঁড়াতে নয়। কোনো কিছু ঘটলেই হলো, ব্যস! দশদিক থেকে শুরু হবে সমালোচনা। কেন হলো, কিসের জন্য হলো সেগুলো নিয়ে ভাববার সময় আমাদের নেই। সঠিকভাবে জানারও প্রয়োজনবোধ করি না। নিজের মতো করে আমরা ভেবে নিই, তারপর শুরু করি অন্যের সমালোচনা।
আমাদের এসব অগঠনমূলক ও আক্রমণাত্মক সমালোচনায় যে কতটা ভয়াবহতা রয়েছে, সমাজের গভীরে দৃষ্টিপাত করলেই তা বোঝা যায়। আমরা যদি ভেবে দেখি আমাদের সমালোচনাগুলো সমাজে কতোটা প্রভাব ফেলছে, তাহলে সমাজে ‘নিয়মের’ নামে গড়ে উঠা শোষণগুলোর দিকে যেন চোখ খুলে একটু তাকাই। বিশেষ করে নারীরা এর শিকার হচ্ছে বেশি। যদিও আমার মতে, নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ কারোরই রক্ষা নেই, সমালোচনার এই ভাইরাস থেকে। আমি, আপনি, আমরা আমাদের সমালোচনার স্বভাবদোষে কতো অন্যায়কে নিয়ম বানিয়ে ফেলেছি, সহজ-সরল বিষয়কে জটিল করে তুলছি, সমাজের প্রকৃত মেধাগুলোকে ধংস করে ফেলছি তার হিসেব নেই।
“তিলকে তাল করতে আমাদের জুড়ি নেই। উঁচু আর নিচু শ্রেণির মানুষ এগুলোর তোয়াক্কা না করলেও মধ্যবিত্তরা পারে না এড়িয়ে যেতে। সমালোচনা তাদের গলার কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। মধ্যবিত্তের পায়ে পায়ে সমালোচনা। পরিবার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু তাকে ভাবতে হচ্ছে আশপাশের মানুষ কী বলবে।”
আমাদের সমাজে উঁচুশ্রেণি থেকে নিচুশ্রেণি- সবক্ষেত্রেই এর প্রভাব বিদ্যমান। মধ্যবিত্তের অবস্থা আরো শোচনীয়। বরং এ শ্রেণির মানুষগুলোকে আরো বেশি সমালোচনার শিকার হতে হয়। তাদের ঘরে মেয়ের বিয়ে কেন হচ্ছে না, হলেও কীভাবে হলো, মেয়ে কেমন সংসারী, তার সংসার কেন টিকছে না ইত্যাদি। ছেলে কী করে বেড়ায়? বাড়ির কর্তা এ রকম কেন? মহিলা এভাবে চলে কেন? এই মেয়ের পোশাক এমন কেন? নানারকম সমালোচনা।
আরো পড়ুন> ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক আজ কোথায়?
তিলকে তাল করতে আমাদের জুড়ি নেই। উঁচু আর নিচু শ্রেণির মানুষ এগুলোর তোয়াক্কা না করলেও মধ্যবিত্তরা পারে না এড়িয়ে যেতে। সমালোচনা তাদের গলার কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। মধ্যবিত্তের পায়ে পায়ে সমালোচনা। পরিবার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু তাকে ভাবতে হচ্ছে আশপাশের মানুষ কী বলবে। যে কারণে আমাদের অনেক সঠিক সিদ্ধান্ত আমরা সঠিকভাবে নিতে পারি না।
কোনো একটা ভালো কাজও আমাদের সমালোচনার তোপে মুখথুবড়ে পড়ে। পৃথিবীর সব জাতির মধ্যেই সমালোচনা আছে। কিন্তু আমাদের মতো ব্যক্তিগত পর্যায়ে তা এত ভয়াবহ নয়। আমরা বহু অন্যায়কে মেনে নিতে বাধ্য হই, এ সমালোচনার ভয়ে। আমাদের মতো এরকম আর কোনো জাতি বিশ্বে আছে কিনা আমার সন্দেহ, প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাদের খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়। আমরা অতীত নিয়ে পড়ে থাকি, বর্তমানকেই জীবনের সবকিছু মনে করি। আর ভবিষ্যৎ? ওটা নিয়ে ভাববার সময় কই আমাদের?
লেখকের সব লেখা
এদিকে আমাদের প্রতিহিংসা তো আরো ভয়াবহ! বিচারের নামে আমরা চরম নির্মমতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তবেই শান্তি পাই। আমরা নাস্তিক হই বিকৃত রুচি নিয়ে। আস্তিক হই সহিংস মানসিকতা নিয়ে। আমাদের যারা সঠিক পথ দেখাতে আসে তাদের ভণ্ড বলি। আর যারা মিথ্যা স্বপ্ন দেখায়, তাদের নিয়ে আশার বীজ বুনি। অন্যের সমালোচনা করতে খুব মজা পাই, কিন্তু নিজের ভুলগুলো কেউ ধরিয়ে দিলে মেনে নিতে পারি না।
আমাদের অবস্থা হচ্ছে অবাধ্য সন্তানের মতো। যাদেরকে কড়া শাসনে রেখে তারপর পথচলা শেখাতে হয়। এ কারণেই হয়তো আমাদের এ জাতির কপালে শোষক জুটেছে বেশি, শাসক নয়।
জান্নাতুল মাওয়া ড্রথি
ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস, ঢাকা
ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম, সম্পাদকের বাছাই
[sharethis-inline-buttons]