১. গণতন্ত্রে গণতন্ত্র নেই। আরও মৌলিকভাবে বললে, স্বয়ং গণতন্ত্রও গণতান্ত্রিক নয়। ২.অতীতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যম তেমন না থাকলেও সেসব ব্যবস্থা একদিন জনগণ পরিবর্তন করতে পেরেছিল। কিন্তু আজ বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের সূক্ষ্ম জাল ছিন্ন করার কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখছি না। যে দেশ যতবেশি গণতান্ত্রিক, সে দেশ ততবেশি স্বৈরাচারী। সেখানকার জনগণ ততবেশি পরাধীন, অজ্ঞ, ভীতু, কাপুরুষ। তাই গতানুগতিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও সমালোচনা-সাহিত্যে সমাজব্যস্থার আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয়।
ভারতের বিখ্যাত ও প্রতিবাদী লেখিকা অরুন্ধতি রায়ের একটি সমালোচনামূলক বই ‘এ্যান অর্ডিনারি পার্সন্স গাইড টু এম্পায়ার’ এর জবাবে…
আধুনিক বিশ্বের দেশে দেশে রাষ্ট্র, সরকার ও শাসনব্যবস্থার প্রশ্নে গণতন্ত্রপ্রেমী ও তার সমর্থকদের গর্বের শেষ নেই। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা, গণতন্ত্রের ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠা নিয়ে বহু প্রশ্ন ও বিতর্ক থাকলেও শেষ পর্যন্ত মানুষের মনে ‘গণতন্ত্রের’ একটা বিশুদ্ধ অর্থবহ ভাবমূর্তি জেগে ওঠে। যদিও পৃথিবীর কোথাও কোনো কালে তেমন গণতন্ত্র দেখা যায়নি। যাবে যাবে হবে হবে বলে আমাদের অপেক্ষা যেন অনন্তকাল ধরে চলছেই। এরই মধ্যে গণতন্ত্র তার লুকিয়ে রাখা সব নখ-শিং-দাঁত একে একে বের করেছে এবং জায়গায় জায়গায় এর ‘যথার্থ প্রয়োগও’ দেখিয়েছে, তবুও আমাদের স্বপ্নভঙ্গ হয় না।
প্রচলিত গণতন্ত্রের আরেক নাম সাম্রাজ্যবাদ। তবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের চরিত্র বুঝে আরো অনেক নাম দেয়া যায়। যেমন স্বৈরাচারবাদ, মূর্খতাবাদ, মিথ্যাবাদ ইত্যাদি। পুঁজিবাদ এর মূল স্তম্ভ। যুদ্ধ, প্রোপাগাণ্ডা, ষড়যন্ত্র, প্রকাশ্য মিথ্যাচার, মারণাস্ত্র তৈরি, গুপ্তহত্যা তো আছেই। কথিত ‘জাতি’, ‘রাষ্ট্র’ ও ‘ক্ষমতার’ স্বার্থে হেন অপকর্ম নেই যা লিঙ্কনের গণতন্ত্রে জায়েজ নেই। কেবল শর্ত হচ্ছে, বিশাল একটা অংশের জনগণকে যে-কোনোভাবেই হোক, বোকা বানিয়ে সাথে রাখতে হবে। অবশ্য ইদানিং তেমন একটা সাথে না রাখলেও চলে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে বেশি গণতন্ত্র চর্চাকারী (!) দেশগুলোর অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের চর্চা নেই। বাইরে তো প্রশ্নই আসে না। উন্নয়ন-অগ্রগতির নামে এক একটি গণতান্ত্রিক দেশ বা রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ-বহির্মুখী লাখো-কোটি মানুষের রক্ত ও কঙ্কালের ওপর দাঁড়ানো (অবশ্য সমাজতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক বা গোঁড়া ধর্মীয় রাষ্ট্র- কেউ কারও চেয়ে কম যায় না)। অথচ আমরা তা বিশ্বাস করতে পারি না। কারণ আজকের গণতন্ত্র মানুষের মন-মগজও মিডিয়া বা সূক্ষ্ম জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে পরিবর্তন-প্রতিস্থাপন করে ফেলেছে। মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান ও সম্ভাবনাময় যে শক্তি- ‘মন ও মস্তিষ্ক’ আজ লিঙ্কনিক গণতন্ত্রের দখলে।
প্রচলিত গণতন্ত্রের আরেক নাম সাম্রাজ্যবাদ। তবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের চরিত্র বুঝে আরো অনেক নাম দেয়া যায়। যেমন স্বৈরাচারবাদ, মূর্খতাবাদ, মিথ্যাবাদ ইত্যাদি। পুঁজিবাদ এর মূল স্তম্ভ। যুদ্ধ, প্রোপাগাণ্ডা, ষড়যন্ত্র, প্রকাশ্য মিথ্যাচার, মারণাস্ত্র তৈরি, গুপ্তহত্যা তো আছেই। কথিত ‘জাতি’, ‘রাষ্ট্র’ ও ‘ক্ষমতার’ স্বার্থে হেন অপকর্ম নেই যা লিঙ্কনের গণতন্ত্রে জায়েজ নেই। কেবল শর্ত হচ্ছে, বিশাল একটা অংশের জনগণকে যে-কোনোভাবেই হোক, বোকা বানিয়ে সাথে রাখতে হবে। অবশ্য ইদানিং তেমন একটা সাথে না রাখলেও চলে।
প্রতিটি দিন ও রাত, সত্য ও মিথ্যা এখন নির্ধারিত হয় সংসদে বসে, একেবারে ‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতিতে। উচ্চতর সিদ্ধান্তগুলো নির্ধারণ করে আরও উচ্চতর কোনো কর্তৃপক্ষ। কোন যুদ্ধটা যুদ্ধ নয় বরং শান্তি, আর কোন শান্তি শান্তি না হয়ে যুদ্ধ, কারা কখন জঙ্গিবাদী-সন্ত্রাসী, আর কারা কখন দেশপ্রেমিক তা নির্ধারিত হবে উচ্চতর কোনো সংস্থা বা সংঘে। একেবারে নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। আপনার, আমার, মিডিয়ার, সুশীলদের- সবার কাজ কেবল তাদের হয়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করা। সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে।
এই যে আমি লিখছি, গণতন্ত্রের পক্ষে বা বিপক্ষে, এটাকে গণতন্ত্র তার মতো করেই ব্যবহার করতে সক্ষম। কারণ আমাদের মতো হাজারো চিন্তাশীল ও সাধারণ মানুষের বিক্ষিপ্ত, অসংগঠিত, দুর্বল, পারস্পরিক সংকীর্ণ স্বার্থ-মান-সম্মান নিয়ে সর্বদা দ্বন্দ্বমুখর এসব বলাবলি, লেখালেখি ও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শক্তিহীন, গতিহীন। গণতন্ত্রই একে গতি ও শক্তি দান করে, তার ইচ্ছেমতো। আপাত দৃষ্টিতে যেগুলোকে আমরা দেখি আমাদের বা জনগণের ইচ্ছের প্রতিফলন বা বিস্ফোরণ, আগুনঝরা বক্তৃতা, আন্দোলন ও প্রতিবাদ- আসলে তা নয়। জাতীয় সরকার, বিশ্ব সরকার ও বিরোধী দলের আওতার ভেতরেই থেকে যায় ওসব। প্রথাগত গণতন্ত্রের সংস্থা আছে, সংগঠন-সংবিধান আছে, অস্ত্র-সামরিক বাহিনী আছে, চুক্তি ও স্বীকৃতি আছে, যে কোনো কর্ম-কুকর্ম-অপকর্মের ‘বৈধতা’ আছে। কিন্তু আপনার আমার কী আছে? কতটুকু আছে? যা আছে, যতটুকু আছে তা তো তারই দান ও সতর্ক পাহারার ভেতরেই। বরং আমাদের মতো কিছু প্রতিবাদী মানুষ দরকার সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণ ও একে জায়েজ করার স্বার্থেই।
তাই বলি, পৃথিবীব্যাপী যারা গণতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার, প্রতিবাদমুখর, জাতীয়-আন্তর্জাতিক যে কোনো অন্যায়-অত্যাচার-বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, জনগণকেও ফেটে পড়তে বলেন, বক্তব্য ও লেখনিতে অগ্নিবর্ষণ করেন, সরকার ও আন্তর্জাতিক মহলের ভুলত্রুটি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, একটু চিন্তা করে দেখুন শেষ পর্যন্ত এসব কার ও কাদের স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। কথিত গণতন্ত্রের এটাই সবচেয়ে বড় পুঁজি যে, সে দেখাতে পারছে বর্তমান পৃথিবীতে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আজ অনেক বেশি। এটা একটা ক্যারিশমাও বটে। প্রকৃতপক্ষে এ জাতীয় স্বাধীনতা এবং সাম্রাজ্যবাদ তথা শোষণ-নিপীড়ন হাত ধরাধরি করেই চলে।
গণতন্ত্রে গণতন্ত্র নেই। আরও মৌলিকভাবে বললে, স্বয়ং গণতন্ত্রও গণতান্ত্রিক নয়। অর্থাৎ আমাদের চেনাজানা গণতন্ত্র চরম স্ববিরোধী। প্রতিটি সরকার, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাপী সংখ্যাধিক্য জনগণ সবসময়ই এর বিপরীতে অবস্থান করে। একটি রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকারের প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে বিরোধী শিবিরগুলোর প্রাপ্ত ভোট, না-ভোট (যারা ভোট দেয়নি, দেয় না এবং যাদের কথিত ভোটাধিকার নেই) ইত্যাদি সমন্বয় করে তুলনা করলেই হিসাব স্পষ্ট হয়ে যাবে।
অতীতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যম তেমন না থাকলেও সেসব ব্যবস্থা একদিন জনগণ পরিবর্তন করতে পেরেছিল। কিন্তু আজ বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের সূক্ষ্ম জাল ছিন্ন করার কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখছি না। যে দেশ যতবেশি গণতান্ত্রিক, সে দেশ ততবেশি স্বৈরাচারী। সেখানকার জনগণ ততবেশি পরাধীন, অজ্ঞ, ভীতু, কাপুরুষ। তাই গতানুগতিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও সমালোচনা-সাহিত্যে সমাজব্যস্থার আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই বলে যে এসবের কোনোই মূল্য নেই তা নয়। তবে আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে। শাসক-শাসিতের মৌলিক স্বার্থ ও ঐক্যের সূত্রগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী অখণ্ড মানবতার দর্শন-চিন্তা-আত্মোপলব্ধি জাগিয়ে তুলতে হবে।
গণতন্ত্রে গণতন্ত্র নেই। আরও মৌলিকভাবে বললে, স্বয়ং গণতন্ত্রও গণতান্ত্রিক নয়। অর্থাৎ আমাদের চেনাজানা গণতন্ত্র চরম স্ববিরোধী। প্রতিটি সরকার, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাপী সংখ্যাধিক্য জনগণ সবসময়ই এর বিপরীতে অবস্থান করে। একটি রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকারের প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে বিরোধী শিবিরগুলোর প্রাপ্ত ভোট, না-ভোট (যারা ভোট দেয়নি, দেয় না এবং যাদের কথিত ভোটাধিকার নেই) ইত্যাদি সমন্বয় করে তুলনা করলেই হিসাব স্পষ্ট হয়ে যাবে। যা হোক, গণতন্ত্রের গণতান্ত্রিক না হওয়াটা একদিকে যেমন সাম্রাজ্যবাদ ও বহু বহু স্বৈরাচারের জন্ম দিচ্ছে, অন্যদিকে একে ‘নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিবর্তনের’ পথও চিন্তাশীল মানুষ ও ব্যাপক জনগোষ্ঠীর জন্য খোলা আছে। আর এটা নিশ্চিতভাবেই শাসক-শাসিতের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব।
পৃথিবীজুড়ে এত এত সংবাদ, তথ্য, মিডিয়া; প্রতিদিনকার মুখরোচক খবর, ফাঁস করা গোপন দলীল ও নথিপত্র, সমালোচনামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কলাম- এসব আমাদের, দলিত-মথিত-পীড়িতদের, ব্যাপক জনগোষ্ঠীর আসলে কতটুকু উপকারে আসছে? শাসকরাইবা কতটুকু শান্তি ও নিরাপদে আছেন?
পৃথিবীর কোথাও কোনো কালে গণতন্ত্রের নামে খাঁটি গণতন্ত্রের দেখা মেলেনি। তাহলে মানবজাতির মানসপটে তেমন একটি বিশুদ্ধ, সুন্দর, সর্বজনীন গণতন্ত্রের ধারণা ও ছবি আসলো কোত্থেকে, কীভাবে? এ ছবি আঁকলো কে? এর মডেল কোথায়? নাকি পুরোটাই স্বপ্ন বা কল্পনা? অবশ্য এটা স্বপ্ন-কল্পনা হলেও মন্দ নয়। বিজ্ঞান বলে, স্বপ্ন-কল্পনারও বাস্তব ভিত্তি আছে। সুতরাং আসুন, আমরা সর্বাঙ্গীণ সুন্দর, মঙ্গলময় ও খাঁটি গণতান্ত্রিক এক সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। যে পৃথিবী হবে সাতশ’ কোটি মানুষের। যে পৃথিবী হবে আপনার, আমার, সবার।
জাকির মাহদিন এর অন্যান্য কলাম পড়ুন এখানে
জাকির মাহদিন : সমাজ-গবেষক, কলামিস্ট
zakirmahdin@yahoo.com
ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম, সম্পাদকের কলাম
[sharethis-inline-buttons]
Really excellent description about democracy.
অনেক ধন্যবাদ
অনেক প্রয়োজনীয়, খুবই মূল্যবান যোগউপযোগী একটি গভীর চিন্তাশীল লেখার জন্য, আপনাকে সাদামাটা ধন্যবাদ জানালে, খুবই অল্প কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হল। কিভাবে যে আপনাকে সাধুবাদ জানাব তার ভাষা খুজে পাচ্ছি না! যাক সে কথা, আপনি বর্তমানে গনতন্ত্র নামে যে শাসন ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে প্রচলিত আছে এর পর্যালোচনা করে এর নানাবিধ ত্রুটি বিচুৎতি তোলে ধরেছেন। সমস্যার জন্য আপনি মুলত শাসকদের দায়ী করেছেন। শাসকদের পাশাপাশি শাসিতদেরও তথা জনগনের কিছু দায়িত্ব কর্ত্বব্য আছে এ ব্যাপারে অাপনি উল্লেখ করেননি। ছোট একটি উদাহরণ, ঈগিতে বলি চোর/ডাকাত/ছিনতাইকারীকে কিন্তু প্রথমে পুলিশে ধরে না। প্রথমে জনগন হস্তক্ষেপ করে আইনে তথা পুলিশের কাছে সোপার্দ করে।তবে যত ত্রুটিই থাক না কেন বিশ্বজুড়ে এপর্যন্ত যত শাসন ব্যবস্থা উদ্ভাবিত হয়েছে এর মধ্যে আমাদের তথাকথিত গনতন্ত্রই এখন পর্যন্ত উত্তম বলে বিবেচিত !
জনগণের অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে দোষ আছে। কিন্তু জনগণের দোষ বলে তাদের সংশোধন করার কোনো পথ নেই। বরং সেসব নিয়ে বলার চেয়ে আমরা কাজে গুরুত্ব দিচ্ছি। আর শাসক ও ভিআইপিদের নিয়ে কাজ করার সুযোগ কম। তাই তাদের চিন্তাগত ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়া কর্তব্য।