শনিবার সকাল ৭:৫০, ১৪ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৮শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

শিক্ষা, সামাজিকতা, নৈতিকতা আজ ধ্বংসের মুখে

জান্নাতুল মাওয়া ড্রথি

“গণতান্ত্রিক দলগুলোতেই গণতন্ত্রের চর্চা নেই। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পেয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। এক শেখ হাসিনার কিছুটা ক্যারিশমায় দলটা টিকে আছে, কিন্তু তিনি সারাজীবন থাকবেন না। যেদিন তিনি থাকবেন না, সেদিন এই দলের কী হবে তা সত্যিই ভাববার বিষয়।”

“তেত্রিশ কোটি দেবতার পাপে স্বর্গ যে টলমল, দেবতার পাপ-পথ দিয়া পশে স্বর্গে অসুর দল।” কাজী নজরুল ইসলামের ‘পাপ’ কবিতার দুটো লাইন। যুগে যুগে এই লাইন দুটি আমাদের অনেক শিক্ষা দিয়েছে। দেবতারা সবসময় খুব ক্ষমতাধর হয়। এক কথায়, সনাতনী ধর্মের ভাষায় ক্ষমতাধররাই দেবতা। একেক দেবতা একেক ক্ষমতার অধিকারী, স্বর্গে ‘ইহাদের’ বাস। কোনো এক সময় ক্ষমতার দম্ভে এরা পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। এ দম্ভ আর দ্বন্দ্ব তাদের নৈতিকতাচ্যুত করে ফেলে। এদের ‘ক্ষমতার পাপে’ স্বর্গ তখন টলমল। ঠিক তখনই অশুভ শক্তির ধারক অসুর বাহিনী স্বর্গ দখলের পথে যাত্রা করে। যেহেতু দেবতারা একে অন্যের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত, সেহেতু এটাই তাদের কাছে মোক্ষম সুযোগ। অসুর বাহিনী দেবতাদের দ্বন্দ্বের সুযোগে স্বর্গ দখল করা শুরু করলে ‘দেবতাবর্গ’ তাদের হারানো চৈতন্য ফিরে পায়। কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটার, ঘটে গেল।

আমাদের পৃথিবী নামক এই গ্রহের সাতটি মহাদেশে মোট ১৯৬টি রাষ্ট্র। এর মধ্যে একটি ছোট্ট স্বাধীন রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’। আমাদের জন্মভূমি ১৮ কোটি বাঙালির স্বর্গ। ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের এই ভূমি বাঙালির অস্তিত্বের অংশ। কিন্তু আজ বাঙালির স্বর্গ, বাঙালির জন্মভূমি- লাল সবুজের এই বাংলাদেশ ক্ষমতাধর সুশীল ও রাজনীতিকদের পাপে টলমল করছে। তারা কে ক্ষমতায় যাবে আর কে ক্ষমতায় টিকে থাকবে- এই লড়াইয়ে ব্যস্ত, ঠিক পুরানের সেই স্বর্গের মত। এদিকে হয়তো অসুর বাহিনীও প্রস্তুত হচ্ছে।

“সনাতনী ধর্মের ভাষায় ক্ষমতাধররাই দেবতা। একেক দেবতা একেক ক্ষমতার অধিকারী, স্বর্গে ‘ইহাদের’ বাস। কোনো এক সময় ক্ষমতার দম্ভে এরা পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। এ দম্ভ আর দ্বন্দ্ব তাদের নৈতিকতাচ্যুত করে ফেলে। এদের ‘ক্ষমতার পাপে’ স্বর্গ তখন টলমল।”

হওয়াটাই স্বাভাবিক, এমন সুযোগ হাতছাড়া করবে কেন তারা। বাঙালির এই স্বর্গভূমির উপর তাদের বহুদিনের লোভ। কত রক্ত ঝরালো এই ভুমির উপর রাজত্ব করার লোভে! আজ যখন আমাদের দেশের ক্ষমতাধর দেবতারা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত, দেশের মানুষদের গিনিপিগ বানিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের মগ্ন, তখন দেশের দরজায় মনে হচ্ছে অসুরের পদধ্বনি…। অবশ্য পুরানের মতো এ দেশে অসুর বাহিনীর দখল করা লাগে না, বরং আমাদের ক্ষমতাধর ‘দেবতাবর্গ’ নিজেদের ক্ষমতার লোভে ‘তাহাদের এমনিতেই ডাকিয়া আনেন’।

স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৫ এর পর দেশের রাজনীতিতে অনেকবার অসুরের পদধ্বনি শোনা গিয়েছে, যদিও পুরাপুরিভাবে তারা সফলতা অর্জন  করতে পারেনি কখনো। কিন্তু ২০০৭-এ এক-এগারোর সময় কিছুটা সফলতা পায়। সে সময় কযত খেসারত দিতে হয়েছে রাজনীতিকদের। তবু তাদের শিক্ষা হয়নি, মনে হয় না আদৌ হবে। যদি হতোই তবে আজ আমাদের রাজনীতির এই করুন দশা হতো না। দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। এখন অবশ্য বিএনপি কিছুটা অস্তিত্বের সংকটে আছে, নিজেদের সঠিক সিদ্ধান্তহীনতার ফলে। আদৌ সঠিক সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারবে কিনা সন্দেহ। যদিও ঐকক্যফ্রন্ট নামে জোড়াতালি দিয়ে সে চেষ্টা তারা চালাচ্ছে। ছেঁড়া পোশাকে তালি লাগিয়ে কিছু দিনের জন্য চালিয়ে নেওয়া যায়, দীর্ঘ দিনের জন্য নয়।

আরো পড়ুন> আমি কার পক্ষে, শ্রমিক না স্টুডেন্ট?

গণতান্ত্রিক দলগুলোতেই গণতন্ত্রের চর্চা নেই। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পেয়ে  জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। এক শেখ হাসিনার কিছুটা ক্যারিশমায় দলটা টিকে আছে, কিন্তু তিনি সারাজীবন থাকবেন না। যেদিন তিনি থাকবেন না, সেদিন এই দলের কী হবে তা সত্যিই ভাববার বিষয়। বিএনপির মতো পুত্রকেন্দ্রিক অন্ধ মানসিকতা না থাকলেও সে রকম কোনো নেতাও এখনো তৈরি হয়নি আওয়ামী লীগে, এ যাকে শেখ হাসিনার উত্তরসুরি অথবা বিকল্প বলা যাবে। আর আমাদের তথাকথিত সুশীলদের অবস্থা হচ্ছে, শুচিবায়ী ব্রাক্ষণ পণ্ডিতদের মতো। তাদের ফ্যান্টাসটিক স্বপ্নে তারা বাংলাদেশকে দেখে। সাধারণ জনগণ তাদের কাছে নিম্ন জাতের মতো।

“একটি ছোট্ট স্বাধীন রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’। আমাদের জন্মভূমি ১৮ কোটি বাঙালির স্বর্গ। ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের এই ভূমি বাঙালির অস্তিত্বের অংশ। কিন্তু আজ বাঙালির স্বর্গ, বাঙালির জন্মভূমি- লাল সবুজের এই বাংলাদেশ ক্ষমতাধর সুশীল ও রাজনীতিকদের পাপে টলমল করছে। তারা কে ক্ষমতায় যাবে আর কে ক্ষমতায় টিকে থাকবে- এই লড়াইয়ে ব্যস্ত।”

এদিকে আমরা জনগণ আছি ফাঁটা বাঁশের চিপায়। আমরা কী চাই আমরা জানি না, জানেন এ দেশের রাজনীতির কর্তাব্যক্তিরা এবং সুশীল সমাজ। তাদের একেক জনের একেক ভাষ্য জনগণের চাওয়ার ব্যাপারে। কেউ বলে দিল জনগণ নিরপেক্ষ ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে, না পেলে তাঁরা মানবে না। আবার কেউ বললো জনগণ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে বেড়াচ্ছে। আবার কারো মতে, জনগন ধর্মের চাপে দিশেহারা। ‌প্রকৃতপক্ষে জনগণ আসলে কী চায় তা এরা কেউ জানে না অথবা জানতে চাওয়ার প্রয়োজন বা ইচ্ছা আদৌ এদের নেই। কারণ জনগণের ইচ্ছার দাম দিলে নিজেদের স্বার্থের লড়াইটা হবে না।

লেখকের সব লেখা

আমরা জনগণ আসলে কী চাই? আমরা শান্তি চাই। চাই একটা সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে নিরাপদে বাস করতে পারবো। আমরা চাই নিরাপদে ঘর থেকে বেরিয়ে আবার নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে। আমরা চাই আমাদের ৫টি মৌলিক চাহিদার পূরণ- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং শিক্ষা। আর এর সাথে নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার। কিন্তু এগুলোর কোনোটা নিয়ে আজ পর্যন্ত তেমন কোনো কথা বলতে শুনিনি দেশের সুশীল বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের। তাদের একটাই কথা, তাদের ভোটাধিকার দিয়ে ‘গণতন্ত্রের উদ্ধার’।‍ হ্যাঁ, একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোট হবে স্বাভাবিক, কিন্তু ভোট দিলেই কি কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারবে এদেশে শান্তি ফিরে আসবে?

আজ পর্যন্ত এ দেশে কম ইলেকশন তো হলো না, কিন্তু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন কোথায়? যেই লাউ সেই কদু। উন্নয়ন হয়তো হয়েছে অবকাঠামোগত দিক থেকে, কিন্তু অধঃপতন হয়েছে তাঁর থেকেও বেশি। আমাদের শিক্ষা, আমাদের সামাজিকতা, নৈতিকতা আজ ধ্বংসের মুখে।

জান্নাতুল মাওয়া ড্রথি: কলামিস্ট

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম

ট্যাগ: জান্নাতুল মাওয়া ড্রথি

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply