শনিবার রাত ৯:৫৭, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজত-এমপি দ্বন্দ্ব: নিঃস্ব হাজারো পরিবার

নিজস্ব প্রতিবেদক

মাওলানা সাজিদুর রহমান ও মুফতি মুবারকুল্লাহ

হেফাজতের এ অপরিণামদর্শী তাণ্ডবের মামলায় ‘সরাসরি বা অজ্ঞাত আসামী’ হয়ে হাজার হাজার নিরীহ মাদরাসা ছাত্র-শিক্ষক, পথচারী ও সাধারণ পরিবার একেবারে অসহায় ও নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। অনেক পরিবারের বহু সদস্য এখনো পলাতক। সেই তাণ্ডবে অংশ না নেওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের ঘর-বাড়িতে ফিরতে পারছে না পুলিশের ভয়ে।

গত ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও এর আশপাশে হেফাজতে ইসলামের অপরিকল্পিত ও অপরিণামদর্শী বিক্ষোভ-ভাংচুর-সংঘর্ষে অনেকদিনের জন্য স্থবির হয়ে পড়ে পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত শহরটি মুহূর্তেই পরিণত হয় এক মৃত ও ভূতুরে শহরে। চারপাশে ছাইপোড়া গন্ধ, মৃতদের পরিবারে গগণবিদারি আহাজারি। পুলিশের ভয়ে বাড়িঘর পুরুষশূন্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ মসজিদ-মাদরাসাও তখন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর করোনার ভয়াবহতা ও একের পর এক লকডাউন ঘোষণা যেন মরার উপর খাড়ার ঘা!

এখনো স্বাভাবিকতা ফেরেনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেই ভয়াবহতাও ভুলতে পারছেন না অনেকে। এভাবে আর কতদিন চলতে পারে একটি জেলার বাসিন্দাগণ? একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলার প্রধান রেলস্টেশন অচল, পুড়ে ছাড়খার; আজও মেরামত হয়নি। নিরবতায় খাঁ খাঁ করছে পুরো এলাকা। পৌরসভার সবকিছু ভস্মিভূত; এখনো সেভাবেই আছে। আর জেলা ভূমি অফিস যেন শ্মশান। লাখো মানুষের জায়গা-জমির কাগজ-পত্র, দলিল-দস্তাবেজ পুড়ে অঙ্গার। সেই মানুষগুলো এখনো জানে না তাদের সেসব জায়গা-জমির কী হবে। আর সে সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত পনেরো জনের।

এমনই যখন অবস্থা, পুলিশ-প্রশাসন, ডিসি এসপি ওসি কিংকর্তব্যবিমূঢ়; তখন স্থানীয় সংসদ সদস্যও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। একের পর এক বিক্ষুব্ধ মন্তব্য করেন। কিন্তু তবুও দায়িত্বের খাতিরে তিনি সবকিছু সামলে নিয়ে একটি ছোট্ট অনলাইন পোর্টালে এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে সমঝোতার বার্তা দেন।

“স্থানীয় সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর সঙ্গে জেলা হেফাজত নেতাদের সরাসরি কোনো রকম বোঝাপড়া, বৈঠক, কিংবা দাবি-দাওয়া পেশের কোনো খবরও এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি। এমনকি তাদের কেউ সরাসরি অন্তত সেই চেষ্টা করেছেন কিংবা ফোনে কথা বলেছেন তেমনটাও শোনা যায়নি।”

পরবর্তীতে আবার তিনি দেশ দর্শনকে ফোনে বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলেমদের সঙ্গে তার বহুদিনের সুসম্পর্ক রয়েছে এবং সেটা তিনি ধরে রাখতে চান। তাই সেদিনের ঘটনাগুলোর জন্য জেলাবাসীর কাছে কেবল ক্ষমা চাইলে বা দুঃখ প্রকাশ করলেই চলবে। তাহলে উভয়পক্ষেরই একটা সমাধানে আসার পথ সহজ হবে। এসব বার্তা পেয়ে উক্ত পত্রিকার সম্পাদক নিজ দায়িত্বে দেখা করেছেন স্থানীয় উর্ধ্বতন একজন হেফাজত নেতার সঙ্গে, কথা বলেছেন।

তিনি হেফাজতকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন- ‘শর্ত’ কোনো মুখ্য বিষয় নয়, সংসদ সদস্যের বসার আগ্রহটাই মুখ্য। উভয়পক্ষ সামনাসামনি বসাটাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং বসার দ্বারা কোনো একটা সমাধান আশা করা যায়। অন্যদিকে ক্ষমা চাওয়া বা দুঃখপ্রকাশ খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। আর যেহেতু বহু মাদরাসার নিরীহ ছাত্র-শিক্ষক, পথচারী এবং সাধারণ মানুষ পুলিশের মামলা-হয়রানীর শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তাই এদের জন্য অন্তত কিছু একটা করা দরকার।

কিন্তু এতে তারা না আশ্বস্ত হতে পেরেছেন, আর না এটাকে পাত্তা দিয়েছেন। অন্যদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর সঙ্গে জেলা হেফাজত নেতাদের সরাসরি কোনো রকম বোঝাপড়া, বৈঠক, কিংবা দাবি-দাওয়া পেশের কোনো খবরও এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি। এমনকি তাদের কেউ সরাসরি অন্তত সেই চেষ্টা করেছেন কিংবা ফোনে কথা বলেছেন তেমনটাও শোনা যায়নি।

সেই অগ্নিকাণ্ডের খণ্ডচিত্র

এতে জনমনে অসংখ্য প্রশ্ন তৈরি হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার উর্ধ্বতন হেফাজত নেতাদের নিয়ে। মধ্যমসারির কয়েকজন কারাগারে, বাকি সবাই পলাতক। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, ‘উনারা দু’তিনজন নিজেদের গা বাঁচিয়ে আমাদের মহাসমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় হেফাজত উনাদের সুরক্ষা দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় পদবীও দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা-চেষ্টা বা মাথাব্যথা নেই।

এদিকে সরেজমিনে দেখা যায়, হেফাজতের এ অপরিণামদর্শী তাণ্ডবের মামলায় ‘সরাসরি বা অজ্ঞাত আসামী’ হয়ে হাজার হাজার নিরীহ মাদরাসা ছাত্র-শিক্ষক, পথচারী ও সাধারণ পরিবার একেবারে অসহায় ও নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। এসব পরিবারে কান্না ছাড়া আর কিছুই নেই। অনেক পরিবারের বহু সদস্য এখনো পলাতক। সেই তাণ্ডবে অংশ না নেওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের ঘর-বাড়িতে ফিরতে পারছে না পুলিশের ভয়ে। কাজে যোগ দিতে পারছে না। এরই মধ্যে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম কেউ কেউ কারাগারেও আটক আছেন। তাদের জামিন ও মুক্তির কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। জেলখানায় তারা ধুকে ধুকে মরছেন।

আরো পড়ুন> হুজুরদের সঙ্গে মোকাবিলা নয়, সমন্বয় চাই

এ বিষয়ে দেশ দর্শনের পক্ষ থেকে মাওলানা সাজিদুর রহমানের ফোনে কল দেয়া হলে রিসিভ করা হয়নি। অন্য ক’জন হেফাজত নেতাকে নিম্নোক্ত লিখিত প্রশ্নগুলো পাঠানো হলে কোনো উত্তর মেলেনি।

প্রশ্নগুলো ছিল: ১. সেই সহিংসতার ঘটনায় সাধারণ ও নিরীহ গ্রেফতারকৃতদের আশু মুক্তির বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হেফাজত প্রধানদের বর্তমান পদক্ষেপ কী?

২. সেই সহিংসতায় না থাকার পরও যারা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মামলা ও হয়রানীর শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন এবং পুলিশের ভয়ে পলাতক, তাদের সুরক্ষা দিতে তারা কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

৩. হেফাজতের প্রতিবাদ বিক্ষোভের ডাকে সাড়া দিয়ে যেসব সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছিল কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ভাঙচুরের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ বা অভিযোগ নেই, পুলিশের হয়রানী ও গ্রেফতার থেকে এদের সুরক্ষা ও মুক্তির জন্য স্থানীয় হেফাজত নেতাগণ কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

৪. স্থানীয় অসংখ্য ছোট ছোট মাদরাসা, হিফজ বিভাগ ও নূরানী- যেগুলো এসব কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত নয়, সেগুলো খুলে দিতে সরকার ও স্থানীয় সংসদ সদস্যকে তারা সরাসরি কোনো অনুরোধ করেছেন কি না?

৫. চলমান সঙ্কট নিরসনে স্থানীয় সংসদ সদস্যের পক্ষ থেকে তারা কোনো পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ সমঝোতার বার্তা পেয়েছেন কি না?

৬. সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে মাওলানা সাজিদুর রহমান ও মুফতি মোবারকুল্লাহ সাহেব উক্ত সংসদ সদস্যের সঙ্গে সরাসরি কোনো কথা বলেছেন বা বৈঠক করেছেন কি না? না করে থাকলে করতে সমস্যা কোথায়? কারণ তার সঙ্গে তো তাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে।

উল্লেখ্য, এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলেনি।

আরো পড়ুন> কারাগারে কেমন আছেন বীর কাসেমী

ক্যাটাগরি: প্রধান খবর,  ব্রাহ্মণবাড়িয়া,  শীর্ষ তিন,  সাক্ষাৎকার

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply