বৃহস্পতিবার দুপুর ১২:৪৩, ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের তোফায়েল-আজম স্মৃতিস্তম্ভের ইতিহাস

লিটন চৌধুরী

তাঁরা দুজনই ছিলেন অবাঙালি। দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তথা এই বীর দুই শহীদকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৫৮ খ্রীস্টব্দে ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার উদ্যোগে এই স্মৃতি স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের তোফায়েল আজম স্মৃতি স্তম্ভ (লক্ষীপুরের যুদ্ধ)

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ফকিরাপুল ব্রীজের উত্তরে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রধান ডাকঘরের সন্মুখে আর পুরাতন কাচারি পুকুরের তথা পৌর পুকুরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে মেজর তোফায়েল-জমাদার আজম নামে একটি স্মৃতি স্তম্ভ রয়েছে। স্থানীয়ভাবে তা মঠের গোড়া নামে পরিচিত। এই স্মৃতিস্তম্ভে শ্বেত পাথরের ওপর “Lucky are those who die so that others may live with honour and dignity” একটি কোটেশন রয়েছে। এর মর্ম কথা হল, “তারা ভাগ্যবান- যাতে অন্যেরা সম্মান এবং মর্যাদার সাথে বাঁচতে পারে, এজন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে।” এই স্তম্ভের পেছনে রয়েছে ১৯৫৮ খ্রীস্টাব্দে আগস্টের ৭ তারিখ এক দুঃসাহসিক অভিযানের ইতিকথা।

ভারত বিভক্তির পর তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার বর্তমান বিজয়নগর উপজেলার মুকুন্দপুর রেলস্টেশনের পূর্বদিকে ভারতের আগরতলা রাজ্যের সীমান্তবর্তী লক্ষীপুর নামে একটি বড় গ্রাম ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বল প্রয়োগে দখল করে নেয়। এ নিয়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস ও ভারতীয় বি.এস.এফ’র মধ্যে একাধিক পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও ভারতীয় বাহিনী কোনো অবস্থাতেই লক্ষীপুর গ্রামটির দখল ছাড়তে নারাজ। এতে পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস্-এর জোয়ানদের মাঝে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। উপায়ন্ত না দেখে মেজর তোফায়েল আহম্মদ নিজ দেশের পবিত্র ভূখণ্ড এই লক্ষীপুর গ্রামকে উদ্ধার করতে এক দুঃসাহসিক অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

ঘটনাস্থল : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বর্তমান বিজয়নগর থানার লক্ষীপুর গ্রামের মঠ

যেহেতু ভারতীয় বাহিনী শক্তিশালী ও সংখ্যায় অধিক, তাই তিনি আকষ্মিক আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটনার দিন শেষ রাতে মেজর তোয়ায়েল আহম্মদ এর নেতৃত্বে পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস্ এর জোয়ানরা ভারতীয় বাহিনীর ওপর আত্রমণ চালিয়ে লক্ষীপুর এলাকা থেকে ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক বিগ্রেডিয়ার ভিক্ষু ঠাকুরকে জীবিত অবস্থায় ধরে নিয়ে আসার সময় ভারতীয় বাহিনীর শিকার হয়ে জমাদার আজম ঘটনাস্থলে শহীদ হন এবং মেজর তোফায়েল আহম্মদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হলেও তিনি ভিক্ষু ঠাকুরকে ছেড়ে দেননি। এ অবস্থায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ভারতীয় জোয়ানরা লক্ষীপুর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান এবং প্রভাত হতেই লক্ষীপুর গ্রামটি ভারতীয় দখলমুক্ত হয়। কিন্তু মেজর তোফায়েল আহম্মদ-এর উরু থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে কুমিল্লা নেয়ার সময় চিকিৎসা দেয়ার পূর্বেই পথিমধ্যে শহীদ হন।

তাঁরা দুজনই ছিলেন অবাঙালি। দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তথা এই বীর দুই শহীদকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৫৮ খ্রীস্টব্দে ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার উদ্যোগে এই স্মৃতি স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়। এর উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন জি ও সি মেজর জেনারেল ওমরাও খান। আজ অনেকটাই অবহেলিত এই স্মৃতি স্তম্ভটি। এছাড়া তাঁদের স্মরণেই টি.এ (তোফায়েল-আজম) রোড নামকরণ হয়।

লিটন চৌধুরী : সাংবাদিক ও ইতিহাস লেখক

লেখকের প্রকাশিতব্য বই- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডায়েরি

ক্যাটাগরি: ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply