রবিবার সকাল ১১:০৯, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

মানুষ এখন কতটা নদীপ্রেমী?

৩৭৮ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এখানকার মানুষ এখন কতটা নদীপ্রেমী? ‘তিতাস’ নিয়ে কবি আল-মাহমুদ তার একটি কবিতায় লিখেছেন-

এ আমার শৈশবের নদী, এই জলের প্রহার

সারাদিন তীর ভাঙে, পাক খায়, ঘোলা স্রোত টানে

যৌবনের প্রতীকের মতো অসংখ্য নৌকার পালে

গতির প্রবাহ হানে। মাটির কলসে জল ভরে

ঘরে ফিরে সলিমের বউ তার ভিজে দুটি পায়।

অদূরের বিল থেকে পানকৌড়ি, মাছরাঙা, বক

পাখায় জলের ফোঁটা ফেলে দিয়ে উড়ে যায় দূরে;

জনপদে কি অধীর কোলাহল মায়াবী এ নদী

এনেছে স্রোতের মতো, আমি তার খুঁজিনি কিছুই।

কিছুই খুঁজিনি আমি, যতবার এসেছি এ তীরে

নীরব তৃপ্তির জন্য আনমনে বসে থেকে ঘাসে

নির্মল বাতাস টেনে বহুক্ষণ ভরেছি এ বুক।

একটি কাশের ফুল তারপর আঙুলে আমার

ছিঁড়ে নিয়ে এই পথে হেঁটে চলে গেছি। শহরের

শেষ প্রান্তে যেখানে আমার ঘর, নরম বিছানা,

সেখানে রেখেছি দেহ। অবসাদে ঘুম নেমে এলে

আবার দেখেছি সেই ঝিকিমিকি শবরী তিতাস

কি গভীর জলধারা ছড়ালো সে হৃদয়ে আমার।

সোনার বৈঠার ঘায়ে পবনের নাও যেন আমি

বেয়ে নিয়ে চলি একা অলৌকিক যৌবনের দেশে।

 

তিতাসের সাথে কবির শৈশবের বেশ মিল আছে। এই কবিতায় কবি ‘তিতাস’ নদীকে শৈশব থেকে যৌবনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি লিখেছেন-

“এ আমার শৈশবের নদী, এই জলের প্রহার সারাদিন তীর ভাঙে, পাক খায়, ঘোলা স্রোত টানে যৌবনের প্রতীকের মতো অসংখ্য নৌকার পালে গতির প্রবাহ হানে।” … ”সোনার বৈঠার ঘায়ে পবনের নাও যেন আমি বেয়ে নিয়ে চলি একা অলৌকিক যৌবনের দেশে।”

খুব ছোটবেলায় নদীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটি ছিল কেবলই শারীরিক। যে কোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়তাম নদীর বুকে। এর পর বয়স যত বেড়েছে, আমি টের পেয়েছি, এর সঙ্গে সম্পর্কটি অনেকখানি মানসিক হয়ে উঠেছে। নদীকে আমরা ছেলেবেলায় বলতাম গাং, গাঙ বা গাঙ্গ। আসলে গাঙ্গ শব্দটি এসেছে গঙ্গা থেকে। এ অর্থে গঙ্গাও নদীর নামবাচক শব্দ। আমার জন্ম যে গ্রামে (ভাদুঘর), সেই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে এক নদী। তিতাস নদী। ছোট্ট একটি নাম। অথচ কত গভীর, কত প্রশস্ত ব্যঞ্জনায় সে ছড়িয়ে আছে আমার জীবনে! আমার গ্রামের এই নদীর মতো এমনই কত শত নদী এদেশের মানুষের সঙ্গে সখ্যের চাদরে জড়ানো, সে হিসাব করা কি সহজ?

সম্প্রতি বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের করা এক জরিপের প্রতিবেদন দেখে মনে হলো, আমরা আর কবে নদী নিয়ে আরও সচেতন হবো? সে জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৪৭ বছরে প্রায় অর্ধেক সংখ্যক নদী শুকিয়ে গেছে কিংবা মরে গেছে। আর সরকারি তথ্যমতে, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০। বর্তমানে এ তা দাঁড়িয়েছে ৪০৫-এ। আর বেসরকারি হিসাব বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ২৩০। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে ভাবনা আসা স্বাভাবিক আমরা কি আমাদের নদীগুলো হারাতে যাচ্ছি? এ ভাবনায় মন বিষাদপূর্ণ হয়। ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের ছোট নদী’ পড়ে, আশপাশে এমন নদী দেখে, এর পাড় ধরে হেঁটেই তো আমরা বড় হয়েছি। আর মুখস্থ করেছি- বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ।

আমরা দেশকে মা বলি। এ দেশের মা কিন্তু নদী। নদীমাতৃক বাংলাদেশ বলতে আমাদের এ দেশে নদীর যে ভূমিকা, যে ব্যাপকতা বোঝায়; সেই অর্থে প্রশ্ন জাগে নদী বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান পরিমার্জিত সংস্করণে নদী প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে- নদ (নদ) নদী শব্দের পুংলিঙ্গ; কপোতাক্ষ, বলেশ্বর, দামোদর, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদ নামে অভিহিত। নদী গবেষক মাহমুদ শামসুল হক তার নদী গ্রন্থে লিখেছেন- সাধারণ অর্থে যে জলপ্রবাহ নাদ বা কলধ্বনি করে প্রবাহিত হয় তাই নদী। বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা অনুসারে পণ্ডিতরা পুরুষবাচক নদ শব্দটির উদ্ভাবন করেছেন। দুয়ে মিলে নদ-নদী।

জানা কথা, পৃথিবীর আদি সভ্যতা ও মনুষ্যবসতি এই নদীকেন্দ্রিক। নদীতীরেই প্রাচীন সব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। যেমন ইরাকের ইউফ্রেতিস-তাইগ্রিস নদের সুমেরীয় সভ্যতা, সিন্ধু নদের মোহেনজোদারো ও হরপ্পা সভ্যতা, চীনের হোয়াংহো ও ইয়াংসি নদী সভ্যতা এবং মিসরীয়দের নীল নদের সভ্যতা। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে, প্রাচীন মানুষ প্রধানত যাতায়াতের সুবিধার্থেই নদীতীরে বসতি গড়ে তুলেছিল। নদীর সুপেয় পানি এবং চাষাবাদের জন্য পানি- এ দুটো কারণ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

আমরা দেশকে মা বলি। এ দেশের মা কিন্তু নদী। নদীমাতৃক বাংলাদেশ বলতে আমাদের এ দেশে নদীর যে ভূমিকা, যে ব্যাপকতা বোঝায়; সেই অর্থে প্রশ্ন জাগে নদী বলতে আমরা আসলে কী বুঝি?

ইতিহাস পাঠে জানি, যে কোনো নদীর গঠনরূপ, পর্যায়, প্রকৃতি ও ক্রিয়াকাণ্ড নিয়ত বিবর্তনশীল। তা ছাড়া নদ-নদীর এই নিরন্তর ছুটে চলার সঙ্গে মানুষ নিবিড়ভাবে একাত্ম হয়ে আছে প্রাচীনকাল থেকেই। এদেশের বেশিরভাগ নদ-নদীর জন্ম পাহাড়ে। কিছুকাল আগেও আমাদের এই দেশে চার হাজার নদ-নদী বয়ে যেত। বর্তমানে এ নদীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে।

গবেষকদের মতে, প্রতি বছর গড়ে ১০টি নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। ইতোমধ্যে দখল-দূষণের কারণে বিলীন হয়ে গেছে ২৫টি নদী। বর্তমানে বিপন্ন নদীর সংখ্যা ১৭৪। সহজেই বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের নদীমাতৃকতা বিশেষণটি হারিয়ে যেতে বসেছে মূলত নদী দখলের ফলে। নদীগুলো দখল হচ্ছে দুইভাবে- ভূমিদস্যুদের দাপটে নদী ভরাট করে স্থাপনা তৈরি এবং বর্জ্য ও শিল্প বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে নদীতে ফেলে। আমাদের দেশের প্রায় সব এলাকায় নদী, খাল-বিল অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ার কারণে পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

তাতে নদ-নদী সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। ফলে বর্ষাকালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে গ্রামীণ এলাকায় অনেক স্থানে বৃষ্টির পানি জমে ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে যায়। ঠিক একই কারণে শহরাঞ্চলের ড্রেনেজ ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করছে না। বৃষ্টি ও অতিবৃষ্টিতে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে।

এ দেশের প্রাকৃতিক সব জলাশয় যেমন নদ-নদী, খাল-বিল এ সবই আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। তাই এসব জলাশয় সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নদী দখলদার ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে যত দেরি হবে, আমাদের ক্ষতির পরিমাণ তত বাড়বে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ঢাকাসহ বাংলাদেশের নদীগুলোকে দখল-দূষণমুক্ত করতে আদালত থেকে বারবার নির্দেশনা এসেছে। সরকারও প্রায়শ নদীর ওপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করছে। কিন্তু আবার নদীগুলো দখল হচ্ছে। আর নদী দখলের ফলে রাজধানী ঢাকা সবচেয়ে বেশি হুমকিতে আছে।

অপরদিকে শিল্প বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নানা প্রকার বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। আশপাশের লোকজন এই দূষিত পানি ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করলেও নদীর এই দূষণ এক জায়গায় স্থির থাকে না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই দূষণ আমাদের খাদ্যচক্রেও প্রবেশ করছে। সব ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য তা কী ধরনের হুমকি সৃষ্টি করবে, সেটি সহজেই অনুমেয়।

আমাদের নদীগুলো দখল করে অনেক প্রভাবশালী বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করছেন, অর্থবিত্তের মালিক হচ্ছেন অবৈধভাবে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, ভুল নদী শাসন আর দখল ও দূষণের কারণে এখন অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে দেশের বেশিরভাগ নদী কিংবা খাল। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি উষ্ণ মরুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ?

আদিত্ব্য কামাল: সাংবাদিক কলামিস্ট

 

Some text

ক্যাটাগরি: নাগরিক সাংবাদিকতা

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি