অকুতোভয় বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ৭ কোটি অতি সাধারণ শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের অসম সংগ্রাম। ২৫ মার্চের পর এ সংগ্রাম দুর্বার মুক্তিসংগ্রামে গতি পায়। মুক্তিসংগ্রামকে আরো শাণিত করার জন্য কর্নেল এম এ জি ওসমানীর সভাপতিত্বে (সিলেট হবিগঞ্জ মহকুমার তেলিয়াপাড়া ডাকবাংলোয়) ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও যশোর- এই চারটি অঞ্চলে ভাগ করে যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ (শিলিগুড়ি বেতারকেন্দ্র থেকে) ১১ এপ্রিল সমগ্র দেশকে আটটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে আটজন সেক্টর কমান্ডার নিয়োগের ঘোষণা দেন।সর্বশেষ জুলাই মাসে তাজউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে সমগ্র দেশকে এগারোটি সেক্টরে ভাগ করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম এ রবকে বাংলাদেশ ফোর্সেস-এর চিফ অব স্টাফ ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এবং রণাঙ্গনের প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে মনোনীত করা হয়।
১১ টি সামরিক সেক্টরের মধ্যে একাত্তরের অন্যতম যুদ্ধবহুল সেক্টর ছিল ২ নং সেক্টর। গোটা মুক্তিযুদ্ধের উত্তপ্ত রণাঙ্গন সালদা নদী ও বিলোনিয়া ছিল এই সেক্টরেরই অন্তর্ভুক্ত। এর সদর দপ্তর ছিল ভারতের আগরতলা রাজ্যের মেলাঘর।মেজর খালেদ মোশাররফ (১০ এপ্রিল থেকে ২২ সেপ্টেম্বর, পরে মেজর জেনারেল, বীর উত্তম, ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যূত্থানে নিহত হন।) এবং মেজর এটিএম হায়দার (২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর) ২ নং সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
২ নং সেক্টরের স্টাফ অফিসার ছিলেন মেজর আবদুল মতিন ও ক্যাপ্টেন আনোয়ারুল আলম। আর মেডিক্যাল অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আকতার আহমেদ।এই সেক্টরের উল্লেখযোগ্য হাসপাতালটির নাম ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’। দু’শ শয্যার এই হাসপাতালটি আগরতলায় স্থাপিত হয়।
#২নং সেক্টর এলাকা বৃহত্তর ঢাকা (মূলত ঢাকা শহরসহ ঢাকা জেলার দক্ষিণাংশ), কুমিল্লা (আখাউড়া-আশুগঞ্জ রেললাইনের উত্তরাংশ বাদে), ফরিদপুরের পূর্বাঞ্চল ও নোয়াখালীর অংশবিশেষ (মুহুরী নদীর পূর্বাঞ্চল বাদে) নিয়ে গঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ (বর্তমানের সাপেক্ষে) #ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে কসবা গঙ্গাসাগর ও আখাউড়া থেকে পশ্চিমে ভৈরব বাজার রেল লাইন পর্যন্ত ছিল ২নং সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত ।
#সেক্টর বাহিনী: ৪- ইস্টবেঙ্গল, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর ইপিআর বাহিনী নিয়ে গঠিত ২ নং সেক্টর বাহিনীতে একটি নিয়মিত বাহিনী (প্রায় ৮ হাজার সদস্য) ও একটি গণবাহিনী (প্রায় ৩৫ হাজার দেশপ্রেমিক সদস্য যা মোট বাহিনীর প্রায় ৮১ শতাংশ) ছিল।
#২নং সেক্টরকে ৬ টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়।(গঙ্গাসাগর, মন্দভাগ, সালদা নদী, মতিনগর, নির্ভয়পুর, রাজনগর।) মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরো কসবা থানা গঙ্গাসাগর ও মন্দভাগ সাব-সেক্টরের আওতাধীন ছিল।সীমান্তবর্তী সালদা নদী,মন্দভাগ, বায়েক, নয়নপুর,কসবা,গঙ্গাসাগর, আখাউড়া প্রভৃতি স্থানে প্রায় সব সময়ই পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ লেগে থাকতো। বিশেষ বিশেষ স্থানে সম্মুখ যুদ্ধেরও বিরতি ছিলনা। মে-জুন মাস থেকেই গেরিলা তৎপরতাও শুরু হয়।
#গঙ্গাসাগর সাব-সেক্টর:
এই সেক্টর এলাকা কসবার অংশবিশেষ, আখাউড়া, মুরাদনগর, সৈয়দাবাদ, বাঞ্ছারামপুর, নবীনগর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখানে ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানি, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের দুটি “X” কোম্পানি ছাড়াও একটি মর্টার চালনাকারী বাহিনী ছিল। এই সাব-সেক্টরে সালদা নদীর অবস্থানের কারণে মুক্তিযোদ্ধাগণ নৌপথেও বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিতে পারতেন।
এই এলাকায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রেলপথ অবস্থিত ছিল। ঢাকা থেকে একটি সড়ক ভৈরব ও সিলেট হয়ে জৈন্তাপুর সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত চলে গেছে। আবার ঢাকা থেকে একটি রেলপথ সেই ভৈরব হয়ে পূর্ব দিকে আখাউড়াতে গিয়ে মিলিত হয়েছে এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে ময়মনসিংহ অভিমুখে চলে গেছে। অন্য একটি রেলপথ নোয়াখালীর মাইজদী হতে সীমান্ত ঘেঁষে বিয়ানীবাজারের দিকে চলে গেছে। অর্থাৎ এই সাব-সেক্টর মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদার বাহিনী উভয়ের জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
আয়তন: প্রায় ৭০০ বর্গ কিলোমিটার
#সাব-সেক্টর কমান্ডার: ক্যাপ্টেন মো: আইন উদ্দিন (পরে মেজর জেনারেল অব. বীর প্রতিক, পিএসসি)। তাঁর সঙ্গে ক্যাপ্টেন মাহবুব, লেফটেন্যান্ট ফারুক ও লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবীরও ছিলেন।
#দায়িত্বপূর্ণ এলাকা: কসবার অংশবিশেষ, আখাউড়া, মুরাদনগর, সৈয়দাবাদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অংশবিশেষ ও নবীনগর।
#উল্লেখযোগ্য আক্রমণ, অ্যামবুশ ও যুদ্ধসমূহ: কুমিল্লা-দাউদকান্দি সড়কে মাইন বিস্ফোরণ (১৬ জুলাই), কাশিমপুর রেলসেতু ধ্বংস (১৮ জুলাই), গোসাই পাকিস্তানী ঘাঁটি আক্রমণ (৩১ জুলাই), মুরাদনগরে অ্যামবুশ (১৭ আগস্ট), বিবিরবাজারে মাইন অপারেশন (২ সেপ্টেম্বর), কসবার গোপীনাথপুর অ্যামবুশ (সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ), নবীনগরের মীরপুর গুন্ডিগ্রামের যুদ্ধ ও কসবার চারগাছ গ্রামে যুদ্ধ (সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি), কাইমপুরের যুদ্ধ (১৯ সেপ্টেম্বর), চারদারী জগন্নাথপুর যুদ্ধ (সেপ্টেম্বর), হোমনা থানা আক্রমণ (২ অক্টোবর), উজানচর-আসাদনগর লঞ্চ আক্রমণ (১১ অক্টোবর), দাউদকান্দি থানার (তৎকালীন) অন্তর্ভূত মেহার, ফরিদগঞ্জ ও মতলবে সিরিজ অপারেশন (২৭ অক্টোবর), দৌলতপুর গ্রামে যুদ্ধ (অক্টোবর), মুরাদনগরের চাপিতলার দুর্নিবার লড়াই (৭ ও ৮ নভেম্বর), কৃষ্ণপুর ও বাগবাড়ি দখল (১১ ও ১২ নভেম্বর), চন্দ্রপুর অপারেশন (১৮-২২ নভেম্বর), মুকুন্দপুর আক্রমণ (১৯ নভেম্বর) ইত্যাদি।
[গঙ্গাসাগর সাব-সেক্টর: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, পৃষ্ঠা ২৩৫]
#মন্দভাগ সাব-সেক্টর
এই সাব-সেক্টর এলাকা মন্দভাগ রেলস্টেশন থেকে কুটি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই এলাকার মধ্য দিয়ে সীমান্ত বরাবর একটি রেলপথ চলে গেছে। অর্থাৎ ভারত সীমান্তবর্তী সাব-সেক্টর হওয়ার কারণে এই এলাকাটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বেশ সুবিধাজনক একটি রণাঙ্গন ছিল। এখানে ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানি, একটি মর্টার চালনা বাহিনী ও গণবাহিনীর কিছু মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছেন।
আয়তন: প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার।
#সাব-সেক্টর কমান্ডার: ক্যাপ্টেন এইচ এম এ গাফফার (পরে লেঃ কর্ণেল অব. বীর উত্তম)। সালদা নদী-কোনাবন সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সাব সেক্টরে একটি মর্টার প্লাটুনের কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মঈন (বীর উত্তম)। সালদা নদী-মন্দভাগ এলাকার যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।
#দায়িত্বপূর্ণ এলাকা: কসবার অংশবিশেষ, কাইমপুর, বায়েক, আখাউড়ার কিছু অংশ, গোপীনাথপুর।
#উল্লেখযোগ্য আক্রমণ, অ্যামবুশ ও যুদ্ধসমূহ: নোয়াগাঁও অভিযান (১৭ জুলাই), মন্দভাগ অপারেশন (১৯ জুলাই), মন্দভাগ এলাকায় আক্রমণ (৯-১২ আগস্ট), মীরপুর-মাধবপুর অভিযান (২৪ ও ২৫ আগস্ট), কলামুড়া ব্রিজ অ্যামবুশ (আগস্ট), দেউশ মন্দভাগ অভিযান (১৪ অক্টোবর), কাইমপুর আক্রমণ (২ নভেম্বর), মন্দভাগ আক্রমণ (৭ নভেম্বর) ইত্যাদি।
#তথ্যঋণ:
[১] বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস–সেক্টর এক ও সেক্টর দুই, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত
[২] বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মুজিবনগর সরকার, Sector Boundaries সংক্রান্ত পত্র, এইচ.কিউ/এক্স/সেক্টর, তাং ১৮ জুলাই ‘৭১
[৩] একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধঃ এগারটি সেক্টরের বিজয় কাহিনী, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
[৪] মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, এ এস এম সামছুল আরেফিন, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৮
[৫] সেক্টর কমান্ডারস এবং বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টা মণ্ডলীর কনফারেন্স-এর মিনিটস, ১২-১৫ জুলাই ‘৭১, বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার
[৬] মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত, অনন্যা প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৮
[৭] মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল (অব:) কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম
[৮] ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা ও কয়েকটি যুদ্ধের ঘটনা -জয়দুল হোসেন, দীপক চৌধুরী রচিত
কালোত্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়া মনসুর কামাল সম্পাদিত গ্রস্থ।
Some text
ক্যাটাগরি: বিবিধ
[sharethis-inline-buttons]