যে চামড়া তিন-পাঁচ বছর আগেও দুহাজার-তিনহাজার টাকায় বিক্রি হতো, সে চামড়া এ বছর একশো-দুশো টাকায়ও বিক্রি করা যায়নি। তাই অনেকে চামড়া মাটিতে পুঁতে দিয়েছেন। এতে শুধু মদরাসাশিক্ষা আর গরিব-দুঃখীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতেও এটি যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানীপণ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস চামড়া। চামড়াশিল্প এমনকি বাংলাদেশের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গিয়েছে। প্রতিবছর কোরবানীর ঈদে কয়েক লক্ষ গরু বাংলাদেশে জবাই হয়। এ জবাইকৃত চামড়ার পুরো মূল্যটাই গরিবদের প্রাপ্য। তারা পেয়েও আসছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এতে ভাগ বসিয়েছে দেশের মাদরাসাগুলো। কারণ এ মাদরাসাগুলোয় প্রচুর গরিব ছাত্র পড়াশোনা করছে নামমাত্র মূল্যে অথবা ফ্রিতে। তবে সমস্যা হচ্ছে, গত একযুগে দেশে ছোট-বড় এত মাদরাসা হয়েছে যে, চামড়ার বিশাল একটা মূল্য সে খাতেই চলে যায়। অথচ মাদরাসাগুলোর শিক্ষা-প্রশিক্ষণের তেমন উন্নতি হচ্ছে না। এতে একশ্রেণি বুদ্ধিজীবী, নাস্তিক-বাম-আওয়ামীপন্থী রাজনীতিকসহ অনেকেই মাদরাসাশিক্ষার প্রতি ক্ষুব্ধ। সরকারও স্বার্থ ছাড়া এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু তাই বলে তাদের ‘মাইর’ দিতে বিভিন্নরকম অবহেলা এবং পরিকল্পিতভাবে চামড়াশিল্পে ধ্বস কোনোভাবেই জনসাধারণ মেনে নিতে পারছে না। তারা বলছেন, ‘সোনালী আঁশ’ পাটের মতো চামড়াশিল্পও ধ্বংসের পায়তারা চলছে।
গত ত্রিশ বছরের মধ্যে এ বছরই সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গিয়েছে চামড়ার দর। যে চামড়া তিন-পাঁচ বছর আগেও দুহাজার-তিনহাজার টাকায় বিক্রি হতো, সে চামড়া এ বছর একশো-দুশো টাকায়ও বিক্রি করা যায়নি। তাই অনেকে চামড়া মাটিতে পুঁতে দিয়েছেন। এতে শুধু মদরাসাশিক্ষা আর গরিব-দুঃখীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতেও এটি যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে।
একদিকে মাদরাসাগুলো থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার ছাত্র শিক্ষা সমপ্ত করে বের হয়ে আর কোনো পথ না পেয়ে একটি মাদরাসা খুলে বসে, তারপর বিভিন্ন চাঁদা-অনুদান-কালেকশনে নামে। তাদের চিন্তাগত, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্র ও তাদের মুরব্বিগণ যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অন্যদিকে সরকারও নিজ দলের বাইরে সামগ্রিক নাগরিক স্বার্থ নিয়ে ভাবার সময় পাচ্ছে না। এতে শুধু চামড়া শিল্প নয়, সরকারি যত আয়ের খাত আছে (বিটিসিএল, রেলওয়ে, বিদ্যুৎ ইত্যাদি) সবই ভেঙ্গে পড়েছে। আর বিশাল বহরের মন্ত্রী-এমপিদের ভোগ-বিলাসের খরচ যোগাতে বেসরকারি খাত ও জনগণের একান্ত ক্ষুদ্র পুঁজিগুলোও সরকারের হস্তক্ষেপ থেকে রেহাই পায়নি।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ধর্মীয় ‘দলীয়’ গোষ্ঠীগুলোর প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ধর্মের আড়ালে তাদের দলীয় মনোবৃত্তি, ক্ষমতার লোভ ও স্বার্থবাদী চিন্তা, সর্বত্র বিভেদ-বিশৃঙ্খলাগুলো শিক্ষিত জনগণ ভালোভাবে নিচ্ছে না। বরং তাদের দাবি, আজকের চামড়াশিল্পে ধ্বসের জন্য এ কথিত ধর্মীয় আচরণ ও বাড়াবাড়িগুলোই দায়ি। তারা বলছেন, এরা যদি প্রকৃত ধর্মচর্চা করত, নিজেদের ব্যক্তিগত ও দলীয় সঙ্কীর্ণ স্বার্থ থেকে বের হতে পারত, তবে কোনো ষড়যন্ত্রই কাজে আসত না। আজকের চামড়াশিল্পে ধ্বসের পেছনে বিশ্লেষকগণও একযুগে সরকার ও এসব স্বার্থবাদী ধর্মীয় জনগোষ্ঠীগুলোকে দায়ি করছে।
ক্যাটাগরি: অপরাধ-দুর্নীতি, বিশেষ প্রতিবেদন
[sharethis-inline-buttons]