রবিবার বিকাল ৫:০১, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

চীনের উন্নতির গোপন রহস্য কী?

৪৩০ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি
গ্রেট ওয়ালে বীর বাঙালি: শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া: চীনের কাছ থেকে বিস্তর সাহায্য সহযোগিতা নিতে আমাদের আগ্রহের সীমা নেই। কিন্তু চীনের অভাবনীয় উন্নতির পিছনে লুকিয়ে আছে যে রহস্য বা রহস্যমালা, সেগুলো নিয়ে কি ভাবছি আমরা? যত সহজে নগদ সাহায্য পাওয়া যায়, চীনা জনগণের গুণগুলো তো তত সহজে আসে না। চীনাদের প্রথম গুণ- তারা কথা কম বলে এবং কাজ বেশি করে। তাদের নেতারা মাঠে ময়দানে কথার ফুলঝুড়ি বিছায় না। অসম্ভব অবাস্তব প্রতিশ্রুতির বন্যা বহায় না। চীনের জাতীয় কংগ্রেস যেটি দুই অধিবেশন নামে পরিচিত সেখানে নেতারা সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা পেশ করে এবং পরের অধিবেশনে হিসাব দাখিল করে দেখায় কোন্ পরিকল্পনা কতদূর বাস্তবায়িত হয়েছে। তাদের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারিত সময়ের আগেই বাস্তবায়ন করতে পারে তারা। আর সেজন্য একেবারে শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শ্রমিক পর্যন্ত সকলেই কর্মতৎপর থাকে।

চীনদেশে চাকরি করার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, চীনারা অসম্ভব পরিশ্রমী জাতি। গ্রেট হল অব পিপল হলো ওদের পার্লামেন্ট ভবন এবং নয়া চীনের নতুন যাত্রার প্রতীক। এই গ্রেট হল অফ পিপল নামের বিশালাকার ভবনটির আকার আকৃতির হিসেবটা আগে দেই। এটি লম্বায় ৩৫৬ মিটার এবং চওড়ায় ২০৬.৫ মিটার। ১৭১৮০০ বর্গ মিটার ফ্লোর স্পেস বিশিষ্ট এই ভবনটির বড় ভোজন কক্ষে দশ হাজার মানুষ এক সাথে বসে খাবার খেতে পারে। গ্রেট অডিটোরিয়ামেও দশ হাজারের বেশি মানুষ একসাথে বসতে পারে। গ্রেট অডিটোরিয়ামসহ প্রতিটি বিশাল কক্ষের সাজসজ্জা দেখলে চোখ ট্যারা হয়ে যায়।

এবার শুনুন আসল কথা। চীনের বিপ্লবের দশম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে স্থির করা হয় দশটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা তৈরি হবে। এই গ্রেট হল অফ পিপলও সেই দশ স্থাপনার একটি। এই সব স্থাপনার প্রতিটি তৈরি হয়েছিল মাত্র দশ মাস সময়ের মধ্যে। আর প্রতিটি তৈরি হয়েছিল স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। চীনের শ্রমিকশ্রেণী সিদ্ধান্ত দেয় এই দশটি স্থাপনা তারা দেশকে উপহার দিবে। দিনে রাতে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তারা এক ঘন্টার জন্যও কাজ বন্ধ করেনি। শিফট করে শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় এসেছে ও শ্রম দিয়েছে। ভাবা যায়?

বেইজিংয়ে আমি যেখানে থাকতাম সেই এলাকায় দেখেছি বিরাট বড় একটি ভবন তৈরি হয়ে গেল তিন চার মাস সময়ের মধ্যে। এবং হই হট্টগোল ধুম ধাম আওয়াজ, শ্রমিকদের হইহল্লা, কাজে ফাঁকি দেওয়া কিছুই নেই। সকাল সাতটায় কাজ শুরু হতো এবং ঠিক পাঁচটায় কাজ শেষ হতো। মাঝখানে এক ঘন্টার লাঞ্চব্রেক। সব শ্রমিক ঠিক সময়ে কাজে আসছে, ঠিক সময়ে লাঞ্চ করে বিশ্রাম নিচ্ছে এবং পাঁচটা বাজার সাথে সাথে ব্যাগ পত্র গুটিয়ে বাড়ি রওনা হচ্ছে। এই শৃংখলাবোধই তো আমরা অর্জন করতে পারিনি।

চীনাদের সময়নিষ্ঠাও পাশ্চাত্যের মানুষের মতোই। ঠিক ঘড়ির কাঁটায় এরা চলে। ‘বাঙালি টাইম’ এর ধারণাটি ওদের কাছে একেবারে অপরিচিত। চীনের যে কোনো অনুষ্ঠানে বা ডিনারে বা সভায় বা অফিসের দৈনন্দিন মিটিংয়ে সর্বত্রই দেখেছি যে সময়ে শুরু হওয়ার কথা ঠিক সে সময়ই অনুষ্ঠানটি শুরু হচ্ছে। যদি চীনের প্রেসিডেন্টেরও ওই সময়ে আসার কথা থাকে তো তিনি ঠিক সে সময়ই হাজির হন। পাঁচমিনিটও এদিক ওদিক হয় না। ঢাকায় অনেক অনুষ্ঠানে, প্রেস কনফারেন্সে তো সঠিক সময়ে উদ্যোক্তারাই উপস্থিত হতে পারেন না। আমাদের কাছে সময়ের মূল্য শুধু রচনার খাতায়। ছোটবেলায় স্কুলে ‘সময়ের মূল্য’ শিরোনামে রচনা লিখতে লিখতে ক্লাসের সময় পার হয়ে যেত। সময়মতো দীর্ঘ রচনাটি শেষ করতে পারতো না কেউ। আমার ছোটবেলায় সময় অবশ্য ছিল অ্যানালগ। জানি না এখন ডিজিটাল যুগের শিশুরাও সময়ের মূল্য বিষয়ে রচনা লেখে কি না। রচনায় নয়, বাস্তব জীবনে সময়ের মূল্য আমরা যতদিন না বুঝতে শিখব ততো দিন সাফল্য আমাদের কাছে অধরা হয়েই থাকবে।

চীনাদের বিপুল কর্মক্ষমতার একটি প্রধান কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে, তাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা। চীনারা নিজেদের খাবার সময়, বিশ্রামের সময়, ঘুমের সময়, ব্যায়ামের সময়ের সঙ্গে কোনো কম্প্রোমাইজ করে না। আরলি টু বেড অ্যান্ড আরলি টু রাইজ সত্যিই তাদেরকে হেলদি ওয়েলদি অ্যান্ড ওয়াইজ করেছে। ওরা ভোর ছয়টায় ওঠে,ব্রেকফাস্ট করে সকাল ৭টায়। লাঞ্চ করে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে। লাঞ্চের পর ঘন্টাখানেক বিশ্রাম করে। ডিনার করে বিকেল পাচটায়। তারপর ইভনিং ওয়াকে বের হয়। রাত ৯টার মধ্যে তারা ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়। আমাদের মতো রাত ১১টা, ১২টায় খাবার খেয়ে ধুম করে ঘুমিয়ে পড়ে না। যে খাবারটা খেল সেটা যেন শরীরের মধ্যপ্রদেশকে স্ফীত না করে পুরো শরীরের কাজে লাগে, ঠিক মতো হজম হয় সেদিকে ওদের পুরো খেয়াল।

তারা নিয়ম করে জিমে যায় বা থাইচি করে। শত বছরের সুস্থ্য জীবন চীনাদের জন্য বিরল কোনো ঘটনা নয়। সত্তর আশি বছর বয়স পর্যন্ত তারা দিব্যি কর্মক্ষম থাকে। চীনের নারী-পুরুষ সবাই পরিশ্রমী এবং আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দৈহিক শক্তির অধিকারী। ওদের খাবারটাও খুব স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে রান্না করা হয়। ওরা যখন পানি পান করে তখন তারা শুধু পানির বদলে ভেষজ শিকড়-মূল ভেজানো পানি খায়।

চীনারা দুর্নীতিবাজ নয়। সাধারণ জনগণ যথেষ্ট সৎ। অন্তত নিজ দেশের ভিতরে দুর্নীতি, অপরাধ ইত্যাদি করার কথা স্বপ্নেও ঠাঁই দেয় না ওরা। কারণ আইন বড়ই কঠোর। আইনের কাছে ছোট-বড় কেউ নেই। কোন বড় নেতারও যদি দুর্নীতি ধরা পড়ে তো শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। চীনা নারীরা স্বাধীন। পথে ঘাটে হয়রানি তো নেই-ই, পদে পদে ছোট ছোট নিষেধের ডোরেও তাদের বেঁধে রাখা হয়নি। তারা সব দিক থেকেই পুরুষের সমান বা বেশি কর্মক্ষম।

হ্যা, চীনাদের গুণের শেষ নেই। তা, আমাদের, মানে বাঙালিদেরও কি কোনো গুণ নেই? আমাদের একটা বিরাট গুণের কথা কিন্তু চীনারাও স্বীকার করে। বাঙালি খুব আবেগপ্রবণ। আমরা ৯ মাসে দেশ স্বাধীন করা জাতি। বাঙালি যদি আবেগ দিয়ে কোনো কিছু করার কথা ভাবে তাহলে কোনো বাধাই তার কাছে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। ল্যাটিন আমেরিকানদের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে আমরা বেশি আবেগপ্রবণ। আমরা ভালোবাসতে জানি, বন্ধুত্ব করতে জানি।

আমাদের কাছে অতিথি নারায়ণ। এগুলো প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির মহৎ গুণ, বাঙালির বৈশিষ্ট্য। ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং-এর মতো বিখ্যাত পর্যটকরাও বাঙালির প্রশংসা করেছেন শতমুখে। বাঙালির আন্তরিকতা, অতিথি পরায়ণতা, ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব তুলনাহীন। আমাদের এই আবেগ আমাদের বড় সম্পদ। আবেগকে যদি ইতিবাচক পথে প্রবাহিত করা যায় তাহলে আমরা অসাধ্য সাধন করতে পারি। আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পেরেছি, দেশটাকে গড়তে কি পারবো না? দরকার শুধু বাঙালিকে সঠিক ধারার পথটা দেখানো।

লেখিকা: শান্তা মারিয়া

চীন থেকে

Some text

ক্যাটাগরি: মতামত

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি