রবিবার দুপুর ২:১৪, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ বিতর্ক বিশ্লেষণ

জাকির মাহদিন

ড. আবুল বারাকাত ও মোনায়েম সরকার যা লিখেছেন তা খুবই প্রাসঙ্গিক এবং ‘শ্রেণিবিশেষে’ মূল্যবান হলেও আমার দৃষ্টিতে তা কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় নয়। পত্র-পত্রিকায় আরও যেসব লেখা ও কলাম প্রতিদিন আমরা পাই তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ আছে। সম্ভবত এই প্রশ্নগুলো না তুলে কেন্দ্রীয় আলোচনায় যাওয়া কঠিন।

বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ শব্দ দুটি এখন চরমভাবে বিতর্কিত। এমনকি এ দুটো শব্দ ও শ্রেণি নিয়ে স্বয়ং এদের মাঝেই তর্ক-বিতর্ক অনেক পুরনো। কেউ কেউ এরই মধ্যে নিজেদের ‘বংশগত বিবর্তন’ নিয়েও মাথা ঘামিয়েছেন, ঘামাচ্ছেন। কিন্তু ইদানিং সমাজ-রাষ্ট্র বহুমুখী সংকটে নিপতিত হওয়ায় এ বিতর্ক কমার কথা থাকলেও না কমে বরং বাড়ছে। বলা যায় এদের ঘিরে প্রতি মৌসুমেই নতুন করে বিতর্ক ঘনীভূত হয়। এ ‘কূলকিনারাহীন’ বিতর্কগুলো যদি নির্দিষ্ট দুয়েকটি পয়েন্টে ঘনায়িত করা যায় তবে অন্তত একপ্রকার সমাধানের আশা জাগে।

সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও সুশীলসমাজ তাদের ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের ক্যাটাগরিতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের আলোকে নিজেদের বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দায় এড়াতে চাইলেও সাধারণ মানুষের কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। থাকার কথাও নয়। তাই যখন তাদের একশ্রেণি আরেক শ্রেণিকে, এক মতবাদী আরেক মতবাদীকে, এক দলের বুদ্ধিজীবী অন্য দলের বুদ্ধিজীবী বা সুশীলসমাজকে ‘সহিংস’ সমালোচনা করেন, কাঠগড়ায় দাঁড় করান, তখন ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের সবার মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা সমানভাবে কমে, যা জাতীয় চিন্তার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী সংকট ও শূন্যতা সৃষ্টি করছে। তাই আমি মনে করি, এভাবে দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে আক্রমণাত্মক ও সহিংস সমালোচনার আশ্রয় না নিয়ে বরং সামগ্রিক ও সমন্বয়ধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আরো গঠনমূলক, যৌক্তিক, আত্মসমালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণে মনোনিবেশ করা উচিত।

একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাতের লেখা “সুশীলসমাজের উদ্দেশ্যে একটি খোলাচিঠি” এবং অন্য একটি দৈনিকে প্রকাশিত আওয়ামী-সমর্থিত বুদ্ধিজীবী মোনায়েম সরকারের লেখা “বাংলাদেশের সুশীলসমাজ ও বিদ্যুৎ বিতর্ক” শিরোনামে কলাম দুটি আমি পড়েছি। কলাম দুটি সরকার-সমর্থিত সুবিধাভোগী দুজন বুদ্ধিজীবীকর্তৃক লেখা। সচেতন পাঠকমাত্রই জানবেন, কেন কী উদ্দেশ্যে কাদের টার্গেট করে কী ধরনের সহিংস আক্রমণাত্মক ভাষা এরা প্রয়োগ করেন। এক্ষেত্রে এরা এদের বিপরীত মতবাদ ও চিন্তাধারার বাইরের সবাইকে একসারিতে ফেলেই কথা বলেন, বিচার করেন। যদিও সবাইকে এক সারিতে ফেলে বিচারের কোনো যৌক্তিকতা নেই এবং সরকারি নীতি ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনামাত্রই অগ্রহণযোগ্য- এমনটাও ভাবার কোনো কারণ নেই। অন্যদিকে সুশীলসমাজের মূল চিন্তা-দর্শন এবং অতীত ভূমিকা ও সাম্প্রতিক বিভিন্ন ষড়যন্ত্র নিয়ে লেখা এ সমালোচনাগুলো একেবারেই ফেলনা নয়, যদিও তা ‘সরকার-সমর্থক’ কেউ করেন। সরকার-সমর্থকের বাইরের প্রচুর সচেতন মানুষও আমাদের কথিত বুদ্ধিজীবীশ্রেণি ও  সুশীলসমাজের কঠোর সমালোচনা করেন। ঠিক এভাবে না হলেও অন্যভাবে।

২০০৭ সালে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবীদের কড়া সমালোচনা করে লেখা একটি বই “বাংলাদেশের রাজনীতিতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা”। লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান আবুল কাসেম ফজলুল হক। এতে তিনি কথিত বুদ্ধিজীবী ও  সুশীল সমাজের মুখোশ কিছুটা উন্মোচনের প্রয়াস পেয়েছেন। আসলে কেউই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তাই দেখা যাচ্ছে, প্রতিপক্ষের তো অবশ্যই, এমনকি নিজশ্রেণির সমালোচনাও অনেকেই করেন, করছেন। সমালোচনা হচ্ছে সবাইকে নিয়ে, সব শ্রেণি-গোষ্ঠীকে নিয়ে। কিন্তু প্রধান যে সমস্যা- ‘আত্মসমালোচনা’ ও ‘আত্মবিশ্লেষণ’ নেই। সমালোচনার আহ্বান নেই। সমালোচনা গ্রহণের মানসিকতা নেই। নিজেদের দায়-দায়িত্ব ও ভুল-ত্রুটির চুলচেরা বিশ্লেষণ নেই। ঠেকায় পড়ে বা স্বার্থে আঘাত পেয়ে নিজশ্রেণির সমালোচনা করলেও নিজের সমালোচনা নেই। কিংবা অন্যদের কেন্দ্র করে করা সমালোচনাগুলোয় নিজের সরব বা নীরব উপস্থিতি নেই। মোটকথা, অন্য সবাই দোষী; ‘আমি’ এবং ক্ষেত্রবিশেষে ‘আমরা’ ছাড়া। হ্যাঁ, তা তো বটেই! আমি এবং আমরা দোষী, এই এই ক্ষেত্রে এই এইভাবে দোষী- এটা উপলব্ধি ও স্বীকার করা সম্ভব হলে তো সংশোধনই হয়ে যেতাম! বাঙালির পক্ষে এটা কি সম্ভব? একটা ঐতিহ্য আছে না!

অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের লেখা অনেকটাই মার্জিত। রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত। যদিও  ব্যক্তিগতভাবে তিনি প্রতিক্রিয়ামুক্ত নন। “বাংলাদেশের রাজনীতিতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা” নামক বইয়ের ১২নং পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “আমাদের জীবনের, সমাজের, জাতির ও রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সমস্যাগুলোর আলোচনাই এ বইয়ের প্রবন্ধগুলোতে আছে। যদিও তা খুবই অপর্যাপ্ত এবং বিভিন্ন প্রবন্ধে বিক্ষিপ্ত। সহজ করে সুন্দর করে লিখতে পারি না। তার চেষ্টাও করি না। আমার লেখার উদ্দেশ্য কাজের প্রয়োজনে চিন্তা ও মত প্রকাশ করা, আনন্দ দেওয়া নয়।” লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অপরিহার্য ও প্রয়োজনীয় কিছু কথা এবং গাইড লাইন এ সামান্য কয়েক বাক্যে আমরা পাই।

প্রধান যে সমস্যা- ‘আত্মসমালোচনা’ ও ‘আত্মবিশ্লেষণ’ নেই। সমালোচনার আহ্বান নেই। সমালোচনা গ্রহণের মানসিকতা নেই। নিজেদের দায়-দায়িত্ব ও ভুল-ত্রুটির চুলচেরা বিশ্লেষণ নেই। ঠেকায় পড়ে বা স্বার্থে আঘাত পেয়ে নিজশ্রেণির সমালোচনা করলেও নিজের সমালোচনা নেই। কিংবা অন্যদের কেন্দ্র করে করা সমালোচনাগুলোয় নিজের সরব বা নীরব উপস্থিতি নেই।

তিনি আমাকে বলেছিলেন দৈনিকে কলাম লিখতে। বর্তমান দৈনিকগুলোর ব্যবসায়িক ও সাম্প্রদায়িক নীতি এবং ‘শ্রেণিচরিত্র’ আমরা সবাই জানি। তিনি নিজেও এর শিকার। তাছাড়া জাতীয় দৈনিকের কলাম কজন পড়ে? পড়ার ও চিন্তা করার সময় এবং মানসিকতাই বা কজনের আছে? মানুষ দৈনিক কিনে খবর পড়তে, কলাম নয়। সাপ্তাহিকসহ বর্তমানের অন্যান্য কাগজগুলোও একই চরিত্রের। সে জন্য গতানুতিক বিতর্ক-বিশ্লেষণে আমি জড়াতে চাই না। মূল সমস্যা বা জীবনের, সমাজের, জাতির ও রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সমস্যা নিয়েই পড়ে থাকতে চাই জীবনভর। নিজের সঙ্গে নিজের একটা গভীর সংযোগ পেতে চাই। গতানুগতিক সমালোচনা-বিতর্কে জড়ানো যতটা সহজ, বের হওয়া ততটাই কঠিন। চূড়ান্ত বিচারে এতে কোনো লাভ নেই।0

ড. আবুল বারাকাত ও মোনায়েম সরকার যা লিখেছেন তা খুবই প্রাসঙ্গিক এবং ‘শ্রেণিবিশেষে’ মূল্যবান হলেও আমার দৃষ্টিতে তা কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় নয়। পত্র-পত্রিকায় আরও যেসব লেখা ও কলাম প্রতিদিন আমরা পাই তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ আছে। সম্ভবত এই প্রশ্নগুলো না তুলে কেন্দ্রীয় আলোচনায় যাওয়া কঠিন। আবার এ জাতীয় প্রশ্ন তোলাও আমার মতো কারো জন্য যতটুকু না কঠিন, তারচেয়ে বেশি বেয়াদবী ও অহমিকার প্রকাশ। আমরা দিনের পর দিন কার সমালোচনা করছি, কাদের উপদেশ দিচ্ছি? তারা কি আমাদের কথা আদৌ শোনে? আমরা কি বেহায়া বেলাজা নই? আমরা কি ‘আমার’ এবং ‘আমাদের’ সমালোচনা কিছুটাও করতে পারি না?

আজকের এই বহুমুখী সংকটে দল-মত নির্বিশেষে সবার উপকারার্থে যথার্থ ঐক্য, শান্তি ও সমঝোতার আহ্বান নিয়ে দেশের সমস্ত শিক্ষক-অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ, লেখক, শিল্পী-সাহিত্যিকের এক টেবিলে বসার প্রয়াস কি প্রলাপ? আমি মনে করি, নোংরা রাজনীতির মতো এর কোনো পূর্ব ঘোষণা বা আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন নেই। সময় ও ইস্যু নির্ধারণেরও প্রয়োজন নেই। জরুরি মুহূর্তে এসবের বালাই নেই। খাঁটি আন্তরিকতা নিয়ে আহ্বান এবং দলীয় স্বার্থমুক্ত যথার্থ পদ্ধতি অনুসরণ করলে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আসবেই।

 

জাকির মাহদিন : সম্পাদক, দেশ দর্শন
zakirmahdin@yahoo.com

ক্যাটাগরি: প্রধান কলাম,  সম্পাদকের কলাম

ট্যাগ:

[sharethis-inline-buttons]

২ responses to “বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ বিতর্ক বিশ্লেষণ”

  1. ফুয়াদ উদ্দিন says:

    জনাব,
    জাকির মাহদিন
    সম্পাদক, দেশ দর্শন

    সুন্দর বিশ্লেষণ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়। সর্বক্ষেত্রে বিভক্তি বিরাজমান।
    সহমত পোষন করছি।

Leave a Reply