আমরা কমবেশি প্রায় সবাই ছোটবেলা থেকে কিছু কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। যেমন পড়ালেখা করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে। পড়ালেখা না করলে খাবি কি? গাড়ি-ঘোড়া চড়া আর উদরপূর্তিই যেন পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্য। কেউ লেখাপড়া করে টাকা রোজগার করতে পারলেই ধরে নেয়া হয় সে মানুষ হয়েছে। গ্রাস আচ্ছাদনই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। বাস্তবে তা নয়। জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই মানুষ তার চারপাশের পৃথিবীটা পাল্টেছে। প্রকৃতি ও বস্তজগতের অন্তঃস্থ নিয়ম কানুনকে আত্মস্থ করে নিজেদের কাজে লাগিয়েছে। প্রকৃতিকে জানতে গিয়ে আর তাকে কাজে লাগাতে গিয়েই মস্তিষ্ক বিকশিত হয়েছে, চিন্তাশক্তি হয়েছে উন্নত। যা আমাদের করেছে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো সামাজিক ও মানবিক মানুষ হওয়া। কিন্ত এ কেমন শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি করছি আমরা যাদের মধ্যে এ ধরনের কোন বোধই দেখা যায়না। আজ সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে যে নৈতিকতার সংকট শুধু শিক্ষার্থীই নয় আমরা আমাদের চারপাশে যেদিকেই তাকাই না কেন, যে চরম নৈতিকতার সংকট, মূল্যবোধের সংকট দেখতে পাচ্ছি সেটা কেন? আমাদের কি কিছুই করার নেই? এটা কি হবারই ছিল, না এর পেছনে বিজ্ঞানসম্মত ও যৌক্তিক কারণ রয়েছে? আমরা যারা একটু হলেও মানুষের জন্য ভাবি, একটু হলেও চারপাশের ঘটনাগুলো আমাদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায় তাদের এগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করা এবং জানার চেষ্টা করা উচিত।
প্রকৃত মানুষ তৈরির শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন আজ ধুলায় লুণ্ঠিত। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা দিনে দিনে হয়ে উঠছে আত্নকেন্দ্রীক, স্বার্থপর ও যান্ত্রিক। একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। বিবেকানন্দ বলেছিলেন “শিক্ষা গ্রহন বা জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে ছাত্রদের সামনে যদি কোন সামাজিক উদ্দেশ্য না থাকে এবং তার জন্য সংগ্রাম ও ত্যাগের প্রেরণা না থাকে তা কখনও সত্যিকারের শিক্ষার্জন হতে পারেনা”। কিন্ত আমরা চারিদিকে এটাই দেখতে পাচ্ছি। আজ কাল ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা কোন লাইনে পড়বে সেটা নির্ধারণ করে টাকার মাপকাঠিতে। মা-বাবাও সন্তানদের পরামর্শ দেন টাকা যেদিকে বেশী সেদিকে যাও। এসব কারণেই একদিন যে দেশে হারিকেনের আলোয় বসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা হয়েছে এবং জ্ঞানী ও বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়েছে আজ ডিজিটাল যুগে বিদ্যুতের আলোর ছটায়, ঝকঝকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমেও তা করা সম্ভব হচ্ছেনা। শিক্ষার্থীরা দিনদিন হচ্ছে চরম ব্যাক্তিকেন্দ্রিক ও আত্মসর্বস্ব।
বর্তমানে পড়ালেখা হয়ে গিয়েছে শুধুই পরীক্ষায় নম্বর তোলার জন্য। বড় মানুষদের জীবনী, তাদের রচিত সাহিত্য কর্ম ব্যাবহৃত হচ্ছে পরীক্ষায় পাসের প্রয়োজনে। জীবনে তার প্রয়োগ নেই। যেভাবেই হোক নিজেরটা গুছাতে হবে এই চিন্তা নিয়ে কখনও বড় চরিত্র গঠিত হতে পারেনা। এখানে শুধুই তাদের দোষ দিলে চলেনা। তাদের চিন্তা ও মনজগতের যে বিকৃতি তা গড়ে উঠেছে এ পচেঁ যাওয়া সমাজের কারণেই। যে সমাজ চলছে তাতে সুস্থভাবে বাঁচার সুযোগ নেই। একজন মানুষ অমানুষ হিসেবে বেড়ে উঠার সকল আয়োজন এখানে নিশ্চিত করা আছে। সকলেই আমরা এমন অবস্থায় আছি যেখানে সবই অনিশ্চিত। এই যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছি গ্র্যাজুয়েশনের পর কোন চাকরী পাবো কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। যেসব মা বাবা তাদের সন্তানের উপার্জনের আশায় তাদের একটা উপায় হয়েছে এটা দেখে যাওয়ার আশায় দিন গুনছে তাদের আশা আদৌ পূরণ হবে কিনা কোন নিশ্চয়তা নেই। কারো জীবনেরই কোন নিশ্চয়তা নেই। সবাই তার ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশায় ভুগছে।
টাকার অভাব আমাদের সমস্যার সৃষ্টি করে তা ঠিক কিন্ত বিশ্বব্যাপী আজ যে মানবিক সংকট চলছে তা মানুষের সামাজিক সত্তাকে মেরে ফেলছে। ভালোবাসাকে নিয়ে যাচ্ছে স্বার্থপরতার চোরাগলিতে। পত্র-পত্রিকা খুললেই আজ আমরা প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নৃশংসতার বিবরন দেখে কেপে উঠি। মেয়েরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়। স্কুলে-কলেজে, বাসে-ট্রেনে এমনকি নিজ বাড়িতেও নয়। যুবক-যুবতীরা সুস্থ আনন্দের অভাবে অসুস্থ আনন্দ আর নোংরা ঘেটে আনন্দ খুজে নিচ্ছে। যারা এই সমাজের কর্ণধার তাদের আনুকুল্যেই এসব ঘটছে। সমাজের যারা শাসক-শোষক শ্রেনী তারা চায়না এমন কোন মানুষ তৈরি হোক যারা তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, যাদের মনে চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটবে। অত্যন্ত সুকৌশলে মানুষের নিম্নবৃত্তিগুলোকে উস্কানি দেয়া হচ্ছে যাতে মানুষগুলো আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে অপসংস্কৃতি ও বিভ্রান্তিকর সংস্কৃতি আমদানী করে উশৃংখলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে। শুধু আমাদের দেশেই নয় সমস্ত পুঁজিবাদী দুনিয়াতেই একই অবস্থা। পুঁজিবাদী বিশ্বের মোড়ল খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই নিগ্রো দাসদের মুক্তি সংগ্রামের নেতা আব্রাহাম লিংকনের মূর্তি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। কেননা আজ তার তলায় বসেই চলছে নিগ্রো হত্যার পরিকল্পনা, অন্যদের তাদের বিরুদ্ধে উষ্কে দেয়ার পরিকল্পনা। কিছুদিন আগেও আমরা এর উদাহরণ দেখেছি। বিভেদকে ব্যাবহার করা হচ্ছে ভোটের রাজনীতিতে কাজে লাগাবার জন্য।
খাও দাও আর ফূর্তি করো এমন চরিত্র গঠনের সাধনা চলছে। মার্কিন যুবকদের কাছে তাই রাতে Dance Club এ Ball Dance দেখা ছাড়া কোন কাজ নেই৷ সমস্ত দেশ ভরে গেছে যৌন ব্যাধিতে। আমাদের দেশেও সেইসব বিষাক্ত সংস্কৃতি চলে এসেছে আর পুরোদমেই চলছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, মাঠে-ঘাটে, রেস্টুরেন্টে চলছে নোংড়ামির ছড়াছড়ি। আগেও যুবকরা নদীর ধারে, মাঠে-ঘাটে, রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিতো। সেদিনের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা দিক, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, সমাজ, রাষ্ট্রের নানা দিক। সেইসময়েও কিছু ছেলে মেয়ে পরস্পরকে ভালবাসতো। তাদের চরিত্রে, আচারে, ব্যাবহারে তাদের মধ্যে সমাজবোধ দেশাত্মবোধ ফুটে উঠতো। কিন্ত আজ যুবক-যুবতীদের আলোচনার বিষয়বস্তু ফিল্মস্টার, পর্নস্টারদের নিয়ে।
মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রে কে কত পোষাকে, কথায়, ব্যবহারে নোংরা সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করতে পারে। এখনকার যুবক যুবতীরা প্রায়ই ভালোবাসা আর যৌন-সম্পর্ককে এক করে দেখে। এটাই কি ভালবাসা? এটা জন্তু জানোয়ারদের জীবনেও আছে, নিষিদ্ধ পল্লীতেও আছে। যেখানে ভালবাসা আছে সেখানে সৌন্দর্য আছে, যেখানে নেই সেখানে কদর্যতা আছে। যেখানে আদর্শ আছে, কর্তব্য আছে সেখানেই ভালবাসা যথার্থ সুন্দর। যুগে যুগে এরকম ভালবাসা নিয়েই অমর সাহিত্য রচিত হয়েছে। এই ভালবাসা সামনে এগুতে সাহায্য করে, অনুপ্রাণিত করে, মানুষকে বড় করে তোলে। এমন ভালবাসাই জীবনে কাম্য।
আমরা যদি আমাদের দেশের আর্থসামাজিক ব্যাবস্থাটি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবো এটি হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা। এখানে লাভের জন্য, মুনাফার জন্য সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। বড় বড় শিল্পপতি, পুঁজিপতিরাই এককথায় গোটা দেশ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের উগ্র মুনাফা লাভের বাসনা মানুষ বলে আর কিছু রাখছেনা। কয়েকটি বড় বড় কর্পোরেট হাউজই সমস্ত ব্যাবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। সুন্দরবন থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করছে। পুঁজিবাদ তার শোষণ-শাসন নিরবিচ্ছিন্নভাবে চালাতে গিয়ে যা করছে তার পরিণতিই আজকের এ পৃথিবী, আজকের এ সমাজ।
সর্বত্র অস্থিরতা, দূরত্ব, নিষ্ঠুরতা, একাকিত্ব, স্বার্থপরতা, নৈতিকতার চরম অবক্ষয়- সবই এই একটা কারণের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। আর তা হচ্ছে পুঁজিবাদ। সামাজিক সংকট, অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক সংকটের কারণও একই। এই প্রবল ক্ষয়ের স্রোত ঠেকাতে হলে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হতে হবে। দেশে দেশে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার বিরুদ্ধে, নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসাবে ব্যাবহারের বিরুদ্ধে, নাটক-সিনেমা-বিজ্ঞাপনে-সাহিত্যে অশ্লীলতা প্রচারের বিরুদ্ধে, ধনী – গরীবের যে বিশাল বৈষম্য এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। না হলে মনুষ্যত্বের এই ভাঙন রোধ করা যাবে না।
এস সাহল আব্দুল্লাহ
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Some text
ক্যাটাগরি: মতামত
[sharethis-inline-buttons]