“ইতিকাফ” কাকে বলে? ইতিকাফ’ আরবি শব্দ, অর্থ হলো অবস্থান করা, আবদ্ধ করা বা আবদ্ধ রাখা। পরিভাষায় ইতিকাফ হলো ইবাদতের উদ্দেশ্যে ইতিকাফের নিয়তে নিজেকে নির্দিষ্ট জায়গায় অর্থাৎ মসজিদে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আবদ্ধ রাখা। যিনি ইতিকাফ করেন তাঁকে ‘মুতাকিফ’ বলে। আল্লাহ তাআলা বলেন:।
وَ اِذۡ جَعَلۡنَا الۡبَیۡتَ مَثَابَۃً لِّلنَّاسِ وَ اَمۡنًا ؕ وَ اتَّخِذُوۡا مِنۡ مَّقَامِ اِبۡرٰہٖمَ مُصَلًّی ؕ وَ عَہِدۡنَاۤ اِلٰۤی اِبۡرٰہٖمَ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ اَنۡ طَہِّرَا بَیۡتِیَ لِلطَّآئِفِیۡنَ وَ الۡعٰکِفِیۡنَ وَ الرُّکَّعِ السُّجُوۡدِ ﴿۱۲۵
ۚ وَ لَا تُبَاشِرُوۡہُنَّ وَ اَنۡتُمۡ عٰکِفُوۡنَ ۙ فِی الۡمَسٰجِدِ (আর স্মরণ কর, যখন আমি কাবাকে মানুষের জন্য মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদ স্থান বানালাম এবং (আদেশ দিলাম যে,) ‘তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর’। আর আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, ‘তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ‘ইতিকাফকারী ও রুকূকারী-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর’। আর যতক্ষণ তোমরা ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করো, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সঙ্গে মিশো না। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৫.১৮৭)
হজরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) আজীবন রমজানের শেষ দশকগুলো ইতিকাফ করেছেন। তাঁর ওফাতের পরও তাঁর বিবিরা ইতিকাফ করতেন। (বুখারি ও মুসলিম; আলফিয়্যাতুল হাদিস: ৫৪৬, পৃষ্ঠা: ১২৯)।
ইতিকাফ কত প্রকার ও কি কি? ইতিকাফ প্রকার ১. ওয়াজিব, মান্নতের কারণে ইতিকাফ ওয়াজিব হয়। সেটার পরিমাণ কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা হতে হবে এবং ইতিকাফের মান্নতের সাথে রোজা রাখাও ওয়াজিব হয়ে যায়। তাই যে কয় দিন ইতিকাফের মান্নত করবে, সে কয় দিন রোজার সাথেই ইতিকাফ করতে হবে। ২. সুন্নাত। সুন্নাত ইতিকাফ হয় রমজানের শেষ দশকে। রমজানের ২০ তারিখের সূর্যাস্তের আগ থেকে তা শুরু করতে হয়। আর তা শেষ হয় রমজান শেষ হলে। অর্থাৎ ২৯ তারিখে চাঁদ দেখা গেলে বা ৩০ তারিখ পূর্ণ হলে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যেহেতু প্রতি বছর রমজানের শেষ দশক অবশ্যই ইতিকাফে অতিবাহিত করতেন এবং এক বছর তা ভঙ্গ করার কারণে পরের বছর ২০ দিন ইতেকাফ করেছিলেন, ৩. নফল। নফল ইতিকাফের সময়সীমা নির্ধারিত নেই। আধা দিন এমনকি কয়েক ঘণ্টার জন্যও নফল ইতিকাফ হতে পারে। সে কারণে ওয়াজিব ও সুন্নাত ইতিকাফের ব্যাপারে রোজা শর্ত হলেও নফল ইতিকাফের ব্যাপারে রোজা শর্ত নয়।
রামাদানের শেষ দশকে ইতিকাফের হুকুম: সুুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া অর্থাৎ প্রতিটি মসজিদে ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা ‘আলাল কিফায়াহ’ কমপক্ষে একজন মুসল্লির ইতিকাফ দ্বারাই মহল্লার সবাই দায়মুক্ত হবে। পান্তরে কেউ ইতিকাফ না করলে ওই মসজিদের আওতাধীন সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে।
ইতিকাফের উদ্দেশ্য : ইতিকাফের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির মাধ্যমে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ। ইতিকাফের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম র: বলেছেন, ‘আল্লাহর প্রতি মন নিবিষ্ট করা, তাঁর সাথে নির্জনে বাস করা এবং স্রষ্টার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি থেকে দূরে অবস্থান করা, যাতে তার চিন্তা ও ভালোবাসা মনে স্থান করে নিতে পারে।’
ইতিকাফের ফজিলত: হজরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করে, আল্লাহ সেই ব্যক্তি ও দোজখের মধ্যে ৩ খন্দক পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করেন।’ (তাবরানি ও হাকেম) প্রতিটি খন্দক পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্বের চেয়ে আরো বহু দূর। আলী বিন হোসাইন রা: নিজ পিতা থেকে বর্ণনা করেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে ১০ দিন ইতিকাফ করে, তা দুই হজ ও দুই ওমরার সমান’ (বায়হাকি)। ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, মহানবী সা: বলেছেন, ‘ইতিকাফকারী গোনাহ থেকে বিরত থাকে। তাকে সব নেক কাজের কর্মী বিবেচনা করে বহু সওয়াব দেয়া হবে’ (ইবনে মাজাহ)।
ইতিকাফের শর্ত: ইতিকাফের শর্ত ৩টি। যথা- ১. যে কোনো মসজিদে নিয়মিত জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা হয়, এরূপ কোনো মসজিদে পুরুষদের অবস্থান করতে হবে। মহিলারা আপন ঘরে পর্দার সঙ্গে ইতিকাফ করবে। হযরত ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে হযরত হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন। لا اعتكاف الا في مسجد جماعة ২. ইতিকাফের নিয়তে ইতিকাফ করতে হবে। কারণ বিনা নিয়তে ইতিকাফ হয় না। ৩.রোজা রাখা কেননা আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এরশাদ করেন لا اعتكاف الا بصوم
ইতিকাফকারীর কর্তব্য: অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করে সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, ইস্তিগফার, দুআ ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকা। তবে পরিবার-পরিজন বা অন্য কারো সাথে অতিপ্রয়োজনীয় কথা বলতে দোষ নেই। ইতিকাফকারী নিজ অন্তরকে সর্বদা আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত রাখতে চেষ্টা করবে।
মহিলাদের ইতিকাফ: পুরুষ যেমনভাবে মসজিদে ইতিকাফ করবে তেমনি মহিলারাও তাদের নিজ নিজ গৃহে ইতিকাফ করবে। নারীদের জন্য ইতিকাফ জায়েজ ও বৈধ। তবে ইসলামের প্রথম যুগে মহিলারা যেমন অবাধে মসজিদে ইতিকাফ করতেন, বর্তমান সময়ে ফেতনার আশঙ্কায় তা জায়েজ নয়। বরং মহিলারা ঘরে নিজ কক্ষে ইতিকাফ করবে।
প্রশ্ন: ইতিকাফরত অবস্থায় বাসায় খাবার আনতে গেলে ইতিকাফ কি ভেঙ্গে যাবে?
উত্তর: মসজিদে খাবার পৌঁছে দেওয়ার মতো কেউ না থাকলে খাবার আনার জন্য বাসায় যাওয়া যাবে। তবে খাবার আনার জন্য মসজিদ থেকে বের হয়ে অন্য কোনো কাজে বিলম্ব করা যাবে না। অন্য কাজে অল্প সময় ব্যয় করলেও ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। -আলবাহরুর রায়েক ২/৩০৩
প্রশ্ন: রমযানের শেষ দশ দিনে এলাকাবাসী কেউ এতেকাফ না করলে অন্য এলাকা থেকে কোনো দরিদ্র ব্যক্তিকে খানা ও পারিশ্রমিক দিয়ে এতেকাফ করানো হলে এলাকাবাসীর সুন্নত তরকের গুনাহ থেকে বাঁচতে পারবে কি না? এবং ইতিকাফকারী ব্যক্তির জন্য এতেকাফকালীন দিনগুলোর পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েয হবে কি না?
উত্তর: রমযান মাসের শেষ দশ দিন এতেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়াহ। যদি কোনো মসজিদে এক জনও ইতেকাফে বসে তাহলে এলাকাবাসী সুন্নত তরকের গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। আর যদি একজনও এতেকাফ না করে তাহলে ঐ এলাকার সকলেই গুনাহগার হবে।
এতেকাফ একটি ইবাদত, যা বিনিময়যোগ্য নয়। তাই এতেকাফের জন্য পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েয নয়। কাউকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এতেকাফ করালে সে এতেকাফ সহীহ হবে না। অতএব এ জাতীয় এতেকাফ দ্বারা এলাকাবাসী দায়িত্বমুক্ত হতে পারবে না। -হেদায়া, ফাতহুল কাদীর ২/৩০৪:
প্রশ্ন: ইতিকাফকারী পেশাব-পায়খানার জন্য মসজিদ থেকে বের হলে পথে সালামের আদান-প্রদান, শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা যাবে কি না?
উত্তর: ইতিকাফরত ব্যক্তি পেশাব-পায়খানার জন্য মসজিদ থেকে বের হলে আসা যাওয়ার পথে পথ চলতে চলতে সালাম আদান-প্রদান করা যাবে, এবং অল্পস্বল্প কথাও বলতে পারবে। এতে ইতিকাফের ক্ষতি হবে না। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনিবলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফ অবস্থায় চলতে চলতে রোগীর হালত জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু এর জন্য রাস্তায় দাঁড়াতেন না। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৭২ তবে কারো সাথে কথা বলা বা হালত জিজ্ঞাসার জন্য মসজিদের বাইরে অল্প সময়ও দাঁড়ানো জায়েয হবে না। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৭:
প্রশ্ন: মসজিদে ইস্তেঞ্জাখানা ব্যবস্থা না থাকলে বাসায় ইস্তেঞ্জা করা যাবে কিনা?
উত্তর: হ্যাঁ, মসজিদে ইস্তেঞ্জাখানা না থাকলে এজন্য বাসা-বাড়িতে যাওয়া জায়েয।
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফরত অবস্থায় ইস্তিঞ্জার প্রয়োজন ব্যতীত ঘরে প্রবেশ করতেন না। -সহীহ বুখারী ১/২৭২:
প্রশ্ন: নাবালেগ ছেলে ইতিকাফ করার দ্বারা মহল্লাবাসী সকলের পক্ষ থেকে ইতিকাফ আদায় হয়ে যাবে কি না?
উত্তর: বুঝমান নাবালেগের ইতিকাফ সহীহ। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্য থেকেই ইতিকাফে বসা উচিত । কেননা রমযানের শেষ দশকের ইতিকাফ অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ ইবাদত। রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা গুরুত্ব সহকারে আদায় করতেন। তাই এ ব্যাপারে উদাসীনতা মোটেই ভালো নয়। বাদায়েউস সানায়ে.
প্রশ্ন: মহিলারা নিজ ঘরে সুন্নত ইতিকাফ শুরু করার পর মাসিক শুরু হয়ে গেলে। পরবর্তী সময়ে এই ইতিকাফের অবশিষ্ট দিনগুলো কাযা করতে হবে কি না?
উত্তর: মাসিক শুরু হওয়ার কারণে তার ইতিকাফ ভেঙ্গে গেছে। যে দিন মাসিক শুরু হয়েছে শুধু সেই একদিনের ইতিকাফ কাযা করে নেওয়া জরুরি। এই এক দিন কাযা করার নিয়ম হল, একদিন সূর্যাস্তের আগে ইতিকাফ শুরু করতে হবে। পরবর্তী দিন রোযা থাকতে হবে। সূর্যাস্তের পর ইতিকাফ শেষ হবে। এভাবে একদিন রোযাসহ ইতিকাফ করলেই কাযা আদায় হয়ে যাবে। পুরো দশ দিনের ইতিকাফ কাযা করতে হবে না। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭;
প্রশ্ন: সুন্নাত ইতিকাফ রোজা ছাড়া আদায় করলে হবে কিনা?
উত্তর: সুন্নাত ইতিকাফ এর জন্য শর্ত হলো রোজা রাখা। রোজা বিহীন এটাকে নফল ইতিকাফ গণ্য করা হবে।
হাফেজ মাওলানা ইসমাইল ভূঁইয়া:
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া মদিনাতুল উলূম
সোনারামপুর, আশুগঞ্জ ব্রাহ্মণবাড়িয়া
Some text
ক্যাটাগরি: মতামত
[sharethis-inline-buttons]