বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭:১০, ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

অদ্বৈত মল্লবর্মন এর জীবন বৃত্তান্ত

১০৫৩ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

পুরনো দিনের বই- তিতাস একটি নদীর নাম

অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪ – ১৯৫১) জন্মেছিলেন কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণ গ্রামে। ছেলেবেলাতেই বাবা-মাকে হারান। গ্রামের প্রতিবেশীদের সাহায্য ও আনুকুল্যে ব্রাহ্মণ্বাড়িয়া স্কুল থেকে বৃত্তি পেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেন। কিন্তু পয়সার অভাবে কুমিল্লা কলেজে পড়া শেষ করতে পারেন নি। লেখার অভ্যাস ছেলেবেলাতেই ছিল। কলকাতায় এসে বিভিন্ন সময়ে নবশক্তি, দেশ, বিশ্বভারতী, মাসিক মোহাম্মদী, নবযুগ, আজাদ, ইত্যাদি অনেক পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। বুদ্ধদেব বসু’র ‘এক পয়সায় একটি’ গ্রন্থসিরিজে লিখে তিনি প্রথম পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু ওঁর সুখ্যাতি বিস্তৃত হয় মোহাম্মদী-তে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি হারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে সুরু করলে।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নিঃসন্দেহে অদ্বৈত অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাহিত্যজীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি এবং বাংলা সাহিত্যের একটি মস্ত বড় সম্পদ। প্রতিকুল অবস্থার বিরুদ্ধে দিনের পর দিন যুদ্ধ করে ধীরে ধীরে ধবংস হয়ে যাওয়া মালো (মত্স্যজীবি সম্প্রদায়)-গোষ্ঠীর কাহিনী নিয়ে এই উপন্যাস গড়ে উঠেছে। অদ্বৈত নিজে ছিলেন এই সম্প্রদায়ের লোক; মালোদের গ্রামে তিনি বড় হয়েছেন – তাদের জীবন তাঁর অতি-পরিচিত। বড় হয়েও সেই জীবনকে তিনি ভুলতে পারেন নি; ভুলতে পারেন গ্রামের সেই লোকদের। অদ্বৈত নিজে বিয়ে করেন নি। দায়দায়িত্ব না থাকা সত্বেও চিরদিনই ওঁর অর্থকষ্টের মধ্যে কেটেছে। প্রথম জীবনে অর্থ ছিল না। যখন অর্থ এলো, সেগুলি নিদ্র্বিধায় খরচ করেছেন পরিচিত দুঃস্থ মালোদের অন্ন-সংস্থানের জন্য। নিজের জন্য যে বিলাসিতা তিনি ত্যাগ করতে পারেন নি – সেটা হল বই কেনার। অসম্ভব বই পড়তে ভালোবাসতেন। ওঁর সহস্রাধিক বইয়ের সেই ভাণ্ডার এখন রামমোহন লাইব্রেরিতে শোভা পাচ্ছে।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হতে হতে হঠাত্ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বইটির পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যায় রাস্তায়! বহুদিনের কষ্টের ফসল এইভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ মর্মান্তিক দুঃখ পেয়েছিলেন। কিন্তু বন্ধìদের ও পাঠকদের উত্সাহে তিনি আবার লিখতে বসেন তিতাসের কাহিনী। দিনের বেলার শত কাজ শেষ করে অনেক রাত্রে ষষ্ঠীতলার ভাড়াটে-অধ্যুষিত একটা পুরনো নোংরা বাড়ির চারতলার ছাদে নিজের ছোট্ট ঘরে পৌঁছে তিনি লিখতেন। স্মৃতি খুঁড়ে খুঁড়ে লিখতেন তিতাস নদীর পাশে খোলা আকাশের নিচে মালোদের গ্রামগুলির কথা – সেখানকার লোকদের দৈনন্দিন জীবনের কাহিনী। কিন্তু প্রসাদগুণে সেটা শুধু কাহিনী নয় – অনেক জায়গাতেই হয়ে উঠত প্র্রায় কাব্য। বই হিসেবে এটি প্রকাশিত হয় ১৩৬৩ সালে। কাহিনীর শুরু তিতাসকে দিয়ে:

তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস।
স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়।
ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায় ; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।
মেঘনা পদ্মার বিরাট বিভিষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমু মোড়লের মরাই, যদু পণ্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া যাওয়া শীর্ণা পল্লীতটিনীর চোরা কাঙ্গালপনাও তার নাই। তিতাস মাঝারি নদী। দুষ্ট পল্লীবালক তাকে সাঁতরাইয়া পার হতে পারে না। আবার ছোট নৌকায় ছোট বৌ নিয়া মাঝি কোনদিন ওপারে যাইতে ভয় পায় না।
কাহিনী শেষ হয়েছে তিন প্রজন্মের সময়টুকুর মধ্যে একদা প্রাণবন্ত মালোদের গ্রামের মর্মস্পর্শী নিস্তব্ধতায়:

ধানকটা শেষ হইয়া গিয়াছে। চরে আর একটিও ধান গাছ নাই। সেখানে এখন বর্ষার সাঁতার-জল। চাহিলে কারো মনেই হইবে না যে এখানে একটা চর ছিল। জল থৈ থৈ করিতেছে। যতদূর চোখ যায় কেবল জল। দক্ষিণের সেই সুদূর হইতে ঢেউ উঠিয়া সে ঢেউ এখন মালোপাড়ার মাটিতে আসিয়া লুটাইয়া পড়ে। কিন্তু এখন সেই মালোপাড়ার কেবল মাটিই আছে। সে মালোপাড়া আর নাই। শূন্য ভিটাগুলিতে গাছ-গাছড়া হইয়াছে। তাতে বাতাস লাগিয়া শোঁ শোঁ শব্দ হয়। এখানে পড়িয়া যারা মরিয়াছে, সেই শব্দে তারাই বুঝি বা নিঃশ্বাস ফেলে।
মাত্র ৩৭ বছর বয়সে যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে এই প্রতিভাবান লেখকের মৃত্যু হয়। লেখকের মৃত্যুর বাইশ বছর পরে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশী একটি সংস্থার প্রযোজনায় বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক বইটিকে চিত্রায়িত করেন। ছবিটি জাতীয় পুরস্কারও পায়।
.
.
প্রসঙ্গতঃ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছাড়াও অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘সাদা হাওয়া’ (উপন্যাস), ‘সাগরতীর্থে’, ‘নাটকীয় কাহিনী’, ‘রাঙামাটি’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছেন।

গোলাম কিবরিয়া অনার্স এ অধ্যায়ণরত এবং লেখক ও প্রাবন্ধিক।

.
.

Some text

ক্যাটাগরি: আত্মজীবনী

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি