দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষক ও অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ নোমানের ২৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো চলতি বছরের ৬ সেপ্টেম্বর। দেশ বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ-ভারতের ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার বাঞ্চারামপুর থানার উলুকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবা ছিলেন একজন আইনজীবী ও মা গৃহিনী ।মোহাম্মদ নোমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি অন্নদা হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট সরকারি কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে ভর্তি হন। ছাত্র জীবনে তিনি খুবই মেধাবী ছিলেন। শৈশবকাল থেকেই তার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে।
ব্যক্তিগত জীবনে অধ্যাপক মোহাম্মদ নোমান ছিলেন শান্ত প্রকৃতির ও স্বল্পভাষী। তার অমায়িক ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হতো। সাহিত্য ও জীবন সম্পর্কে তার ছিলো গভীর মমত্ববোধ। একজন চমৎকার ভদ্রলোক হিসেবে তার ছিলো বিস্তৃত পরিচিতি। ব্যক্তিগতভাবে ছেলের বন্ধু ও ছাত্র হিসেবে তার সাথে মোটামুটি পরিচয় ছিলো। কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সৌভাগ্য আমার হয়নি,তবুও যখনই তার সাথে দেখা হয়েছে তার আন্তরিক ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। যারা নোমান স্যারকে জানতেন তারা সবাই তার মাঝে এক জ্ঞানতাপসকে খুঁজে পেতেন।
দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে তিনি সাফল্য ও সুনাম অর্জন করেছিলেন। তার সহকর্মী এবং ছাত্ররা তাকে গভীরভাবে সম্মান করত। বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সর্বস্তরেই এক করুন অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, অরাজকতা ও দুর্নীতি ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। শিক্ষা এবং সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ধ্বংসের সম্মুখীন। এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে সৎ,জ্ঞানী,নিষ্ঠাবান ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে। নোমান স্যার ছিলেন এ অঙ্গনের একজন অনুকরনীয় ব্যক্তিত্ব। এমন মানুষের সংখ্যা দিনদিনই হ্রাস পাচ্ছে।
আমি ১৯৮১ সালে এসএসসি পাস করি এবং যথাযথ নিয়মানুযায়ী ওই বছরই ঢাকা কলেজে কলা বিভাগে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হই। আমি খুব ভাগ্যবান ছাত্র যে, তখন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ নোমান। প্রতিযশা একজন শিক্ষক হিসেবে তার নাম অনেক শুনছি। কিন্তু তার কাছ থেকে পাঠ নেওয়ার সুভাগ্য আমার হয়নি। তবে আমার পিতা মোঃ শমসের খান সাহেবের সাথে নোমান স্যারের পরিচয় ছিলো সেই ১৯৫১ সাল থেকে। তখন আমার বাবা চাকরি করতেন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগে আর নোমান স্যার চাকির করতেন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে। সেই সুবাদে আব্বার কাছ থেকে নোমান স্যারের অনেক গল্প শুনেছি। নোমান স্যার এমন ব্যক্তিত্ব, যিনি প্রথম দর্শনেই সবার শ্রদ্ধা আদায় করে নেন। নোমান স্যার দেখতে ছিলেন মেজাজী লোক, কিন্তু কনিষ্ঠদের প্রতি ছিলেন স্নেহশীল। বড়দের ও ছাত্রদের অভিভাবকদেরকে যথেষ্ট সম্মান করতেন। আমাদের দেশে স্কুল-কলেজের কাজ খুবই স্পশর্কাতর। আর ঢাকা কলেজ তো হলো ছাত্র রাজনীতির উর্বরস্থান।
তিনি বিচক্ষনতা ও দক্ষতার সাথে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে পরিচালনা করে গিয়েছেন। নোমান স্যার চলে যাওয়ার পর ঢাকা কলেজের পরিবেশ দিনদিনই অবনতি হতে থাকে। তার সময় কলেজে কোনো ধরনের ভর্তি বাণিজ্য ছিলো না। এ সময়ে সরাসরি ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে ও উক্ত পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে একজন ছাত্রকে এই কলেজে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হতো। এই ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপসহীন; কোনো রক্তচক্ষু বা প্রলোভন তাকে ন্যায়-নীতির পথ থেকে কখনো বিচ্যুত করতে পারেনি। শিক্ষকতা তার অগত্যার ছিলো না। তিনি জেনে শুনে এই পেশাকে জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে বেছে নেন। ইচ্ছা করলে তিনি অন্য পেশায়ও যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি।
১৯৫১ সালে ইংরেজীতে এমএ পাস করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগ দেন। তার পরের বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে সরকারি কলেজে যোগ দেন। তৎকালীন সময়ে অনেক মেধাবী শিক্ষকই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার কাজ ছেড়ে সরকারি কলেজে যোগদান করতেন। এর মুল কারণ ছিলো দু`টো-তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকদের বেতন ছিলো ১২৫ টাকা আর সরকারি কলেজে একজন প্রভাষকদের বেতন ছিলো ১৫০ টাকা। তৎকালীন সময়ে ২৫ টাকা একটি বিরাট অংকের ব্যাপর ছিলো। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর শিক্ষরা পেনশন পেতেন না,কিন্তু সরকারি চাকিরতে পেনশনের ব্যবস্থা ছিলো। এই কারণে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও সরকারি কলেজগুলোতে চাকরি বেশ পছন্দ করতেন।
মোহাম্মদ নোমান স্যার সরকারি কলেজগুলোর মধ্যে ঢাকা কলেজেই বেশি কাজ করেছেন। এছাড়াও বলা যেতে পারে-সর্ব প্রথম তিনি ছাত্র হিসেবে, তারপর শিক্ষক হিসেবে এবং শেষে অধ্যক্ষ হিসেবে এই কলেজে তিন বার এসেছেন। এটা খুব কম লোকের ভাগ্যেই জুটে। সরকারি চাকরির সুবাদে তিনি চট্রগ্রাম কলেজ,রাজশাহী কলেজ,সিলেটের এমসি কলেজেও ছাত্রদেরকে পড়িয়েছেন। তিনি ঢাকা কলেজে পাঁচ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়াও তিনি কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও ঢাকা রেসিডেনশিয়াল কলেজেরও অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি গনশিক্ষা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ছিলেন। তিনি কিছু কাল বাংলা একাডেমির সচিবের দায়িত্বও পালন করেছিলেন । পরবর্তীকালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ও উক্ত বিশ্ব বিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করে ছিলেন। আজীবন তিনি শিক্ষকতা ও শিক্ষা সংক্রান্ত কাজই করেছেন। এর স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছে ১৯৭০ সালে সারা পাকিস্তানে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদক ও ১৯৯৪ সালে একুশে পদক।
নোমান স্যার সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। স্যার অর্থ সাশ্রয়ের জন্যে নিজের কোয়াটারে না থেকে অবস্থান করেছেন স্ত্রীর নীলক্ষেতের সরকারি বাসভবনে। স্যারের স্ত্রী তখন গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের উপাধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। স্যারের একমাত্র ছেলে সাকিব নোমান আমাদের গ্রুপে পড়তেন। নোমান স্যারের ছেলে হিসেবে তার মধ্যে ন্যূনতম কোন অহমিকা ছিলো না। সে ছিলো আমার মতো গান পাগল লোক। সেই সুবাদে অতি দ্রুত তার সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে তাকে নিয়ে এলিফেনরোডের গানের দোকানে ঘুরতে যেতাম;আর তখন নোমান স্যারের সাথে টুকটাক কথাবার্তা হতো। নোমান স্যারের সময় ঢাকা কলেজের উপাধ্যক্ষ ছিলেন হাবিবুর রশিদ স্যার। কোন প্রয়োজন হলে হাবিব স্যারের কাছে আমরা যেতাম; পারত পক্ষে নোমান স্যারের কাছে যেতাম না। স্যারকে ছাত্ররা সবাই মনেপ্রাণে শ্রদ্ধা করতেন কিন্তু ভিষণ ভয়ও পেতেন। ছাত্র ও শিক্ষকদের অবস্থা পর্যবেক্ষন করার জন্যে নোমান স্যার মাঝেমধ্যে পুরো কলেজে এক চক্কর দিতেন।
স্যার যখন বারান্দা দিয়ে হেটে যেতেন, তখন কোন শিক্ষক বা ছাত্রকে স্যারের সামনে কখনো আসতে দেখিনি। নোমান কলহ মোটেই পছন্দ করতেন না। সুতরাং ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝে কোন ধরনের সমস্যা হলে তা, সঙ্গে সঙ্গে উত্তম পন্থায় সমাধান করে দিতেন। স্যার কোন দলবাজী রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই ছাত্র ও শিক্ষকরা কোন দলের লেজুড়বৃত্তি করোক তা তিনি কখনো চাইতেন না বা পছন্দ করতেন না।
ইংরেজী সাহিত্যের এই অধ্যাপক ছিলেন রোমান্টিক কবিদের মতো সত্য, সুন্দর ও পরিপূর্নতার পূজারি; জীবনের কোনো ভোগ-লালসা-বিলাসীতা তাকে কখনো ন্যায়,সুন্দর ও সহিষ্ণুতার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষঙ্গনে দারুন অস্থিরতা চলছে। সুতরাং শিক্ষাঙ্গনের বৈরী পরিবেশ দূর করে উদার ও সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ নোমান স্যারের মতো নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকদের খুব প্রয়োজন।
লেখক: খায়রুল আকরাম খান
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Some text
ক্যাটাগরি: সমকালীন ভাবনা, স্মৃতিচারণ
[sharethis-inline-buttons]