বর্ষার শেষের দিকে বড়রা যখন শ্রীমঙ্গলের বিলাস নদীর মাছ শিকার সম্পন্ন করে ১৫ মাইল দূরে অবস্থিত বাক্কাই বিলে মাছ ধরার জন্য চলে যেতেন, তখন পুরো এলাকাটি সুনসান নীরতবা বিরাজ করতো। আর আমরা ছোটরা এই সুযোগে দলবেঁধে নদীতে গোসল করতে যেতাম এবং খুঁজতে থাকতাম মাছের ছোট ছোট গর্ত। বর্ষার শেষের দিকে বড়রা যখন দল বেঁধে পলো ও পেলুইন দিয়ে বিলাস নদীতে বড় বড় মাছ শিকার করতো, তখন তাদের পায়ের আঘাতে নদীতে অগনিত গর্তের সৃষ্টি হতো। আর এসব গর্তে লুকিয়ে থাকতো বাইলা ও মেনি মাছ। ছোট মাছের মধ্যে এদু`টো মাছকে হাবলা মাছ বা বোকা মাছ বলা হয়। বুকপানিতে শরীর ডুবিয়ে পা দিয়ে আস্তে আস্তে মাছের গর্ত খুঁজতাম।পায়ের আঙ্গুলের মাথায় মাছের স্পর্শ লাগার সঙ্গে সঙ্গেই টুপ করে ডুব দিয়ে মছিটি ধরতাম। আবার অনেক সময় হাত পিছলে মাছ ফসকে যেতো। যেদিন আমাদে হাতে মাছ কম ধরা পড়তো, সেদিন হাটুপানিতে নিজেরা পা দিয়ে নদীতে গর্ত সৃষ্টি করতাম। তারপর দু`হাত দিয়ে পানি টেনে কৃত্রিম স্রোতের সৃষ্টি করতাম আর মুখে জোরে জোরে উচ্চারন করতাম,”আয় আয়রে মাছ আয়রে”। পানি স্রোতে ও শব্দের আওয়াজ শোনে মাছ ভয়ে পেয়ে গর্তে এসে আশ্রয় নিতো। এ পদ্ধিতে মাছ আমাদের পাতানো ফাঁদে ফেঁসে যেতো।
এইভাবে শুধু খালি হাতে মাছ ধরতাম প্রায় ১০/১২ দিন পর্যন্ত। তারপর আমার ছিপ দিয়ে মাছ শিকার শুরু করতাম। এটা ছিলো আমাদের প্রিয় পদ্ধতি। প্রাচীনকাল থেকে আমাদের দেশের মানুষ এই পদ্ধতিতে মাছ শিকার করে আসছেন । ছিপ তৈরি করতে সর্ব প্রথম লাগে বাঁশের শক্ত ও দৃঢ় কাঠি। তারপর উক্ত কাঠিতে সূতা বেঁধে পনিতে ছেড়ে দেয়া হয়। সূতার অন্য প্রান্তে থাকে লোহার তৈরি বেকানো বড়শী। বড়শীতে টোপ (খাবার) লাগিয়ে ছিপ জলাশয়ে ফেলা হয়। মাছ টোপগিললে সূতায় টান পড়ে এবং তখন ছিপ দ্রুত টেনে তুলতে হয়। সূতার মাঝামাঝি জায়গায় থাকে ফাৎনা(বোডাঙ্গ) যা পানিতে ভেসে থাকে। টোপে মাছ ঠোকর দিলে ফাৎনা লড়ে ওঠে। টোপ-গিলা মাছ নড়াচড়া শুরু করলে ফাৎনা নড়তে থাকে, ডুবু ডুবু হয়। তাতে বোঝা যায় মাছ টোপ গিলেছে এবং ছিপের ফাঁদে আটকা পড়েছে। আর তখনই সময় নষ্ট না করে মাছসহ ছিপ পানি থেকে দ্রুত ডাঙ্গায় তুলে নিতে হয়।
ছিপ বা জাল দিয়ে প্রচুর মাছ ধরার জন্যে জেলে বা পেশাধারী শিকারীরা দুই ধরনের হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ব্যবহার করে আসছেন দীর্ঘ দিন যাবৎ। এই ঔষধ দুটির মধ্যে একটির নাম হলো-এমিল নাইট্রেট ও অপরটি ককুলাস। এই দুইটি ঔষধের মাদার টিংচার কিনে মাছের খাবারের সাথে মিশিয়ে নিতে হয়। তারপর সেই ঔষধ-মিশ্রিত খাবার জলাশয়ের যেকোন এক জায়গায় ছিটিয়ে দিতে হয়। প্রায় ২০/২৫মিনিট সেই জায়গায় জাল বা ছিপ ফেল প্রচুর মাছ শিকার করা যায়। কারণ উক্ত ঔষধের গন্ধটা মাছের খুব প্রিয়। তাই গন্ধে আকৃষ্ট হয়েই মাছ খাদ্য খেতে এক জায়গায় জমা হয়। অনেকে আবার উক্ত ঔষধের পরিবর্তে এহাঙ্গি নামে এক ধরনের সুগন্ধি মশলা মাছের খাদ্যে ব্যবহার করে থাকেন। উক্ত মশলার গন্ধও মাছের খুব প্রিয়। আমারা ছোটরা অবশ্য ছিপ দিয়ে মাছ শিকার করার সময় এধরনের ঔষধ বা মশলাপাতি ব্যবহার করতাম না। তবে অনেক সৌখিন শিকারীরা বা সিনিয়রা মাঝেমধ্যে তা ব্যবহার করতেন।
শ্রীমঙ্গলে আমাদের বাসার বারবার পূর্ব পাশে ছিলো বখতিয়াদের বাসা আর তাদের বাসার লাগোয়া পুর্ব পাশেই ছিলো একটি বিশাল বড় পুকুর। পুকুরটির পূর্ব ও উত্তর পারে একটা বিশাল টিলা ছিলো। টিলাটি বিভিন্ন ধনের গাছগাছালি ও পাখপাখালীতে পূর্ণ ছিলো। আর পশ্চিম পাশে ছিলো বিশাল আকারের ২/৩ টি শিরিষ গাছ এবং দক্ষিণ পাশে ছিলো রেলওয়ে থানা। রেলওয়ে থানা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানের এই পুকুরে বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষাবাদ করা হতো। পুকুরটিকে ‘থানা পুকুর’ বলা হতো। রেলওয়ে স্টাফ ছাড়া অন্যদের এখানে মাছ ধরা নিষেধ ছিলো। আমাদের ছোটদের জন্য মাছ শিকারের জন্য এই পুকুরটি ছিলো সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। তারপরও আমারা ভয়াতুর অবস্থায় থানা পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতাম। এর অন্যতম কারণ এই পুকুরে বিশাল আকারের ২/৩ টি গজার মাছ ছিলো। এই মাছগুলোকে রাক্ষুসে মাছ বলা হতো। কারণ উক্ত তিনটি মাছ অন্যান্য মাছগুলোকে খেয়ে ফেলতো। আবার অনেক সময় কেউ পুকুরে গোসল করতে আসলে তাদেরকেও মাঝেমধ্যে কামড় দিতো। দীর্ঘ দিন যাবৎ রাক্ষুরস মাছগুলো থানা পুকুরে অবস্থান করছিলো। জেলেদের অনেক প্রচেষ্টার পর দু`টো মাছ ধারা পরে। আর অন্যটি আত্মগোপন করে। অনেক খুঁজা খোঁজীর পরও উক্ত মাছটিকে পাওয়া যাচ্ছিল না।
একদিন বর্ষাকালের প্রথমদিকে দুপুর ১২ টার দিকে সহপাঠিদেরসহ আমি থানা পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ শিকার করছিলাম। হঠাৎ দেখী আমার ছিপে বেশ টান পড়েছ, ফাৎনা ডুবু ডুবু অবস্থায় জোরে জোরে নরছে। আর দেরী না করে সবাই মিলে ছিপে দিলাম টান, কিন্তু কিছুতেই ছিপটি স্থির রাখতে পারছিলাম না। অবশেষে আমাদের পরিশ্রম পন্ড করে বৃহৎ আকারে একটি মাছ সূতা ছিড়ে পালিয়ে যায়। খানিকক্ষন পর দেখী সেই রাক্ষুসে গজার মাছ যাকে, সবাই খুঁজছে! এই মাছটিই আমাদের ছিপে ফেঁসে ছিলো! আমার দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করি ও থানায় গিয়ে খবর দেই। অতঃপর অতি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে থানা থেকে কুনিজাল সহ দুইজন লোক আসেন। কিন্তু তারাও আপ্রণে চেষ্টা করে মাছটিকে ধরতে পারেনি,বরং মাছটির কামড় খেয়ে তারা সাংঘাতিকভাবে আহত হন। এই অবস্থায় থানা থেকে রাইফেলসহ একজন পুলিশ আসেন এবং মাছটি ধরার জন্য অনেকক্ষন অপেক্ষা করতে থাকেন। প্রায় আদা ঘণ্টা পর মাছটি জলে ভেসে ওঠে। তারপর উক্ত রাইফেলধারী পুলিশ নির্ভুলভাবে পর পর দুইটি গুলি করে রাক্ষুসে মাছটিকে হত্যা করে। এভাবে পুকুরটি রাক্ষুসে মাছ থেকে মুক্তি লাভ করে।
এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার পর আমরা ছোটরা নির্বিঘ্নে থানা পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ শিকার করতে থাকি। আমরা মাছের টোপ হিসেবে ব্যবহার করতাম-কেচু,বল্লার বাচ্চা ও শুটকি মিশ্রিত আটার কাই। আমাদের ছিপে শুধু ধরা পরতো-কাইক্কা, বাইলা, লাটি, শিং ইত্যাদি মাছ। তবে মাঝেমধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল, বাউশ মাছের বাচ্চা ধরা পরতো। এধরনের মাছকে সাধারনত নলামাছ বলা হয়। কিন্তু হ্যায়! কখনো বড় সাইজের কোনো মাছ ধরা পরতো না। এই নিয়ে আমরা সারাক্ষনই আপসোস করতাম!
ওই বছরই বর্ষাকালের শেষের দিকে আমরা ছোটরা আলী আহমেদ নামে এক অভিজ্ঞ মাছ শিকারীর পরামর্শ মতো, ২৫ পয়সা দিয়ে মুদি দোকান থেকে এহাঙ্গি ক্রয় করে আনি। এজন্য সবাইকে ৫ পয়সা করে চাঁদা দিতে হয়েছিলো। তারপর উক্ত মশালার সঙ্গে আটার ভুষি ও সরিষার খৈল মিশ্রিত করে মাছের খাবার তৈরি করি। তখন দুপুর প্রায় ৪ টা বাজে। সবার হাতে একটি করে শক্ত, দৃঢ় ও ছিকন বাঁশের তৈরি ছিপ যা, আমরা নিজেরা তৈরি করেছি। তবে বড় মাছ শিকার করতে হলে হুইল ছিপ হলে ভালো হয়। কিন্তু কারো বাড়িতে হুইল ছিপ নেই, কেবলমাত্র আমাদের বাড়ি ছাড়া। এখন কি করা? অবশেষে সিদ্ধান্ত হয়-আমি, বখতিয়ার ও অপু আমাদের বাসার স্টোর রুম থেকে চুপিসারে হুইল ছিপ এনে বড় মাছ শিকার করবো আর কাওসার ও কিরন থানা পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় মাছের খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিবে। আমারা বাসায় এসে তন্ন তন্ন করে খোঁজেও কোনো ধরনের হুইল ছিপ পাইনি। হয়তো বড়রা অন্যত্র লুকিয়ে রেখেছেন। তাই শূন্য হাতেই আসতে হলো। অতঃপর পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমরা পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় পানিতে এহাঙ্গি মিশ্রিত মাছের খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেই এবং আদা ঘণ্টা অপেক্ষা করি।
তারপর মাছের টোপসহ ছিপ পুকুরে ফেলি এবং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকি। প্রায় ঘণ্টা খানেক পর দেখী আমার ছিপের ফাৎনা ডুবু ডুবু অবস্থায় এদিক-ওদিক নড়ছে এবং ছিপের সূতায়ও জোরে জোরে টান পড়ছে। তখন আমারা মোটামুটি নিশ্চিত হলাম, নিশ্চয় কোন বড় মাছ টোপ গিলেছে। প্রায় ৫/৬ মিনিট প্রচেষ্টার পর আমরা মাছটি ডাঙ্গায় তুলি। মাছটি দেখে সবাই হতবাক হয়ে যাই। মাছটি বৃহত আকারের কাতল মাছ যার, ওজন হবে প্রায় ১২ সেরের মতো। এতো বড় মাছ আমরা ছোটরা পূর্বে কখনো দেখিনি! এই ঘটনটি অত্র এলাকায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। চারদিকে হুলস্থুল পরে গেলো! আমাদেরকে দেখতে রেলওয়ে কোয়াটারের অনেক লোক পুকুর পারে ভিড় করতে থাকেন। আমাদেরকে তখন সিনেমার নায়ক মনে হচ্ছিল! এই অভূতপূর্ব ঘটনার পর আমারা নির্ভয় ও নির্ভীকভাবে থানা পুকুর ও কাছেপিঠের ছোট ছোট জলাশয়গুলোতে অবাধে মাছ শিকার করতে থাকি এবং মাছ শিকারের নয়া নয়া কৌশল রপ্ত করতে থাকি। (চলবে)
লেখক: খায়রুল আকরাম খান
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
Some text
ক্যাটাগরি: আত্মজীবনী, স্মৃতিচারণ
[sharethis-inline-buttons]