বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের অন্তগর্ত উচু-নীচু ও হাইল-হাওর এলাকা জুড়ে শ্রীমঙ্গল উপজেলার অবস্থান। এর মোট আয়তন ১৬৪.১৫ বর্গমাইল। এই শহরের চারদিকে সবুজের সমারোহ; পাহাড় ও উচু টিলার যেন শেষ নেই। চোখ ঘোরালেই শুধু সবুজ আর সবুজ।
পাহাড়, রেইন ফরেস্ট, সবুজ চা বাগান রেয়েছে শ্রীমঙ্গলে। এছাড়াও রাবার, লেবু, আনারস চাষ হয় শ্রীমঙ্গলে। সাধারণত পাহাড়ী ও ঘন বনাঞ্চল এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হয় আর পাহাড় ও ঘন বনাঞ্চল থাকায় পুরো শ্রীমঙ্গল অঞ্চল বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত ও ঠান্ড এলাকার তালিকাভুক্ত।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার চৌহদ্দী খুবই সুন্দর ও চমৎকার। এই উপজেলার উত্তরে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে কমলগঞ্জ উপজেলা এবং পশ্চিমে হবিগরঞ্জের চুনারুঘাট ও বাহুবল উপজেলা। এই শহরে বিলাস ও গোপলা নামে দুইটি উপনদী প্রবাহমান রয়েছে। গবেষকদের মতে, ` শ্রীদাস ` ও `মঙ্গলদাস` নামে দু`জন ব্যক্তি প্রথমে এসে এখানে হাইল-হাওরের তীরে বসতি স্থাপন করেছিলো। এ দু`ব্যক্তির নামানুসারে শ্রীমঙ্গল নামকরন করা হয় এ জনবসতির।
প্রকৃতির সুরম্য নিকেতন শ্রীমঙ্গলে রয়েছে-অসংখ্য চা বাগান, চা গবেষণা কেন্দ্র, লাউয়ারছড়া রেইনফরেস্ট, খাসিয়াপুঞ্জি, মনিপুরিপাড়া, ডিনস্টন সিমেট্রি, বৃহত্তর সিলেটের বিশাল মৎস্যভাণ্ডার বাইক্কা বিল, শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান নিমাই শিববাড়ি, ভাড়াউড়া লেক, পাহাড়ি ঝর্ণা। চারদিকে নজরকাড়া সৌন্দর্য আর হাজারো প্রজাতির গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালী।
এই মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর শ্রীমঙ্গল শহরে আমারা সপরিবারে অবস্থান করেছি ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। আমাদের বাবা মোঃ শমসের খান সাহেব চাকরি করতেন রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগে। আমাদের বাসা ছিলো রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিম-উত্তর দিকে। এখানে আসার পর গভীর বন্ধুত্ব হয়-বখতিয়ার, অপু, কাওসার ও কিরনের সঙ্গে। আমারা ছিলাম মানিকজোড়। উল্লেখ্য, বখতিয়ারের বাবা সারোয়ার আলম খান রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ছিলেন, অপুর বাবা শ্রী ললিত মোহন রায় মনোহরী ব্যবসায়ী ছিলেন, কাওসারের বাবা মনির হোসেন হাবিব ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন আর কিরনের বাবা রাজ নারায়ন চক্রবর্তী পৌরসভার ঠিকাদারি ব্যবসায়ী ছিলেন।
শ্রীমঙ্গল শহরে আমার বাল্যকালের প্রায় ৫/ ৬ বছর কেটেছে। এই শহরে অবস্থিত বিভিন্ন চা বাগান, চা গবেষনা কেন্দ্র, লাউয়ারছড়া রেইনফরেস্ট, ভাড়াউড়া লেক, বাইক্কা বিল, পাহাড়ি ঝর্ণা, ডিনস্টন সিমেট্রি, নিমাই শিববাড়ি, হাকালুকি হাওয়র ইত্যাদি এলাকায় বল্যসখাদেরকে নিয়ে সিনিয়রভাইদের সহযোগিতায় প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছি এবং প্রচুর আনন্দ উপভোগ করেছি। এছাড়াও আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় এই শহরের চিন্তামনী পাঠশালায়। এখানকার ছোট-বড় জলাশয়ে আমি মাছ শিকার করেছি বিভিন্ন পদ্ধতিতে।
যেসব সিনিয়রভাইদের সহযোগিতায় এখানকার বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করেছি তারা সবাই ছিলেন আব্বার জুনিয়র কলিক ও শ্রীমঙ্গলের স্থায়ী বাসিন্দা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন-সাজ্জাদ হোসাইন, মোঃ আলী খান, ইসহাক মিয়া, জুবায়েদ আলী। বাল্যকালে বিভিন্ন ঘটনা আমার স্মৃতির ভান্ডারকে করেছে পরিপূর্ণ। আর ওই সময়ে ছোট ছিলাম বলে তৎকালীন সময়কার প্রতিটি ঘটনা আমার পরিবারের সিনিয়রদের মাধ্যমে যাচাই করে ঘটনাগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করেছি। আমার স্মৃতির ভান্ডার থেকে বাল্যকালের কিছু কিছু ঘটনা এখানে আলোকপাত করবো। প্রথমেই আমি মাছ শিকারের স্মৃতিকথা বলবো।
সেই প্রাচীনকাল থেকে আবাহমান বাংলায় লোকমুখে একটি প্রবাদ বহুল প্রচলিত হয়ে আসছে, `মৎস্য মারিব, খাইব সুখে`- কথাটি বাঙালির ক্ষেত্রে ১০০% সত্য। বাঙালির আরেকটি প্রবাদ আছে `ভাতে-মাছে বাঙালি। সুতরাং বাঙালি ও মাছ একে অন্যের পরিপূরক। মাছ নিয়ে বাঙালির মনের কোনে আছে তীব্র আবেগ ও ভালোবাসা। একজন বাঙালি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, মাছ তাকে কাছে টেনে নেবেই। তাই মাছ শিকারও যেন বাঙালির জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
গ্রামাঞ্চলে মৌসুমী জলাশয় বা বিলে নানা সরঞ্জাম দিয়ে মাছধরা একটি সুপরিচিত দৃশ্য। বাংলাদেশে মাছধরার চিরায়ত প্রধান পদ্ধতিগুলো হলো-চাই, বুচনা, বেগা, দারকি, উল্টা, তেফলা, বর্শা, টেটা, তেপাই, ধলি, চেং, বানা, পলো, চারো,আন্তা, পেলুন, লারটানা, টানা বড়শি, ছিপ, বেরজাল, ভাসাজাল, ধর্মজাল, কাকিজাল ইত্যাদি। তবে শহরে যেখানে নদী-নালা-খাল-বিল নেই সেখানে সৌখীন মাছ শিকারীরা পুকুর বা লেকে সারা বছরই টিকেট কেটে ছিপ দিয়ে মাছ ধরে থাকেন। তবে মৌসুমী জলাশয় বা হাওয়রে মাছ ধরে যে আনন্দ পাওয়া যায় শহরের লেকে বা পুকুরে মাছ ধরে সেই আনন্দ পাওয়া যায় না।
তারপরও গ্রাম বা শহর যেখানেই হউক বিভিন্ন পদ্ধতি দিয়ে মাছ শিকারের হাজার হাজার গল্প বহন করে চলছে বাঙালি জীবন। এমনি মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে আমার এ ক্ষুদ্রজীবনেও রয়েছে বেশ কয়েকটি স্মৃতি। শ্রীমঙ্গলে আমাদের বাসার পেছনে ছিলো বিলাস নদী। নদীটি আকারে ছিলো বেশ ছোট। দেখতে অনেকটা বড় খালের মতো। তাই স্থানীয়রা এটাকে কালিঘাট খাল বলে অভিহিত করতো। নদীটি ১৫ মাইল দূরে মৌলভীবাজার থানায় অবস্থিত মনু নদীতে গিয়ে মিশেছে। ভরা বৃষ্টির সময় বিলাস নদী নতুন যৌবন ফিরে পেতো। চারদিকে পানি থৈ থৈ করতো। তখন উজান এলাকা তথা ত্রিপুরার পাহাড়ি এলাকা থেকে জলের স্রোতে প্রচুর মাছ ভেসে আসতো।
তখন জেলেরা ধর্মজাল,বেরজাল,কুনিজাল দিয়ে মাছ ধরতো। আর রাত্রিকালে তারা অনেকগুলো বড়শি একটি দীর্ঘ নাইনলের শক্ত সুতায় আদা হাত পর পর আদারসহ বড়শি বেধে সুতার শেষ প্রান্তটি নৌকার মাথায় আটকিয়ে রাখতো। আর বড়শির বরাবর থাকতো বোডাঙ্গ যা, বড়শিকে পানিতে ভাসিয়ে রাখতো। খাবারের লোভে মাছ ফেসে যেতো পড়শিতে। এ টাকে টানাবড়শি বলা হতো। জেলেরা রাতব্যাপী এই পদ্ধতিতে মাছ শিকার করতো। ওই সময় প্রতিটি নৌকায় কুফি বাতি জ্বালানো থাকতো। রেলওয়ে ব্রিজ থেকে এই অপূর্ব দৃশ্য দেখে মনে হতো পুরো বিলাস নদীত যেন,সারি সারি ভাবে বিজলীবাতি জ্বলছে। আমাদের বাসায় মাছ ধরার সব সরঞ্জাম থাকতো। আমাদের বড় দুই ভাই যথাক্রমে মোঃ শামসুল আবরার খান ও মোঃ নূরুল আফছার খান মাছ শিকারে বেশ পটু ছিলেন।
বর্ষাকালে রাত্রিবালেয় তারা টেটা নিয়ে বিলাস নদীর তীরে মাছ শিকার করতে আসতেন। সাথে থাকতো হারিকেন। তাদের সাথে আমিও থাকতাম। এসময় বাইন,কাইক্কা,বাইলা,শইল,শিং ইত্যাদি মাছ প্রচুর পাওয়া যেতো। নদীতে স্রোতের গতি কিছুটা কমে আসলে নদীর তীরে বসে আমি ও আমার বাল্যসখারা ছিপ দিয়ে মাছ শিকার করতাম। আমাদের ছিপে ধরা পরতো-শিং,মাগুর,লাটি, টেংরা,বাইলা সহ নানা রকমের মাছ। বর্ষার পানি শুকিয়ে যাবার পর পরই অত্রএলকায় পলো দিয়ে মাছ ধরার ধুমপরে যেতো।
বড়ভাইদের সাথে আমিও মাছ শিকার করতে আসতাম।তখন সবাই মহাআনন্দে মাছ শিকার করতো বিলাস নদীতে। চারদিকে চলতো তুমুল কোলাহল। এভাবে মাছ শিকার উৎসব চলতো প্রায় সাত দিন পর্যন্ত।
এ সময় কাতল, মৃগেল, রুই, কালাবাউশ ইত্যাদি মাছ প্রচুর ধরা পড়তো। তারপর মাছ শিকারীরা ১৫ মাইল দূরে অবস্থিত বাইক্কা বিলে যেতো মাছ ধরার জন্যে। কিন্তু বড়রা এসময় এতো দূরে ছোটদেরকে নিতেন না। এটা আমাদের ছোটদের জন্যে বিরাট আক্ষেপের বিষয় ছিলো! তখন মনে মনে ভাবতাম ইশ! যদি তারাতারি বড় হয়ে যেতো পারি, তাহলে সিনিয়রদের মতো বাইক্কা বিলে বা হাকালুকি হাওয়রে গিয়ে মাছ শিকার করতে যেতো পারবো!
চলবে…
লেখক: খায়রুল আকরাম খান
Some text
ক্যাটাগরি: আত্মজীবনী, স্মৃতিচারণ
[sharethis-inline-buttons]