রবিবার বিকাল ৫:২৬, ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ১৭ই নভেম্বর, ২০২৪ ইং

শ্রাবণের শেষ রাত: ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট

৪৩৯ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

শ্রাবণের অঝোর ধারা আর বাঙালির অবারিত চোখের পানি মিলেমিশে বেদনার এক বিস্তৃত মহাসাগরে রূপান্তরিত হতে দেখি দেশটাকে এ মাসে। যার যতটা সাধ্য সেভাবেই স্মরণ করেন তাকে, অন্তরের গভীর তল থেকে। সেদিন বাংলা সন পরিক্রমায় শ্রাবণের শেষ রাত। কেমন ছিল সে রাতের প্রকৃতি?

সে রাতে কি বৃষ্টি হয়েছিল? আকাশ কি কেঁদে উঠেছিল সুশৃঙ্খল বাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে বেরিয়ে আসা ঘাতকদের অস্ত্রের অট্টহাসি শুনে? আক্রোশে গর্জে উঠেছিল? সে রাতে কি কালো মেঘ ছিল আকাশজুড়ে? রাতের আকাশকে আলোয় বন্যায় ভরিয়ে দেয় যে চাঁদ, সে-ও কি মুখ লুকিয়েছিল মেঘের আড়ালে? রাহুর অশুভ ছায়া কি গ্রাস করেছিল অপরূপ জোছনাকে? জানা নেই আমাদের। তবে আমরা জানি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সূর্য উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু সে দিনের সূর্য কোনো সম্ভাবনার কথা বলেনি।

এক স্বপ্নভঙ্গের বিস্ময়-বেদনা নিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের দিন। আমরা কেউ তো ভাবতেই পারিনি, ১৫ আগস্ট সকালের সূর্য কোনো শুভ দিনের সূচনা নয়, একটি বেদনাবিধুর কালো ইতিহাসের জন্ম দিয়ে ফেলেছে? বাঙালির জাতীয় জীবনে অনেক কালো অধ্যায় আছে। কিন্তু ১৫ আগস্ট রাতে রচিত হলো যে কৃষ্ণ অধ্যায়, বাংলার ইতিহাসে তার চেয়ে বেদনার, এর চেয়ে গ্লানিকর আর কিছু নেই। নিজের বাড়িতে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে জাতি মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে বুকের রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার সূর্য, আবার সেই জাতিই কলঙ্কিত হলো পিতৃঘাতক হিসেবে।

শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল জায়গায় ছিল বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়। শাসক শ্রেণি জনগণের ন্যায্য দাবি মানতে অস্বীকার করলে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।

চারদিকে গুলির শব্দ শুনে নিশ্চয়ই ঘুম ভেঙেছিল জাতির পিতার। হয়তো ঘুমের ভেতর তিনি দেখছিলেন দেশের উন্নয়নের স্বপ্ন। ঘুম ভাঙার পর কী অনুভূতি হয়েছিল তাঁর? তিনি আছেন বিরাজমান আমাদের চারপাশে। প্রতিদিন তিনি আরও বড় হচ্ছেন। আরও ব্যাপক হচ্ছেন। কেননা তিনি যে মহৎ প্রাণ! নিজের জন্য তিনি কখনো ভাবেননি। ভেবেছেন বাঙালির জন্য, বিশ্বের পুরো মানবজাতির জন্য।

নিজেই লিখেছেন তিনি, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’)। আজীবন তিনি লড়েছেন মানুষের মুক্তির জন্য। তার সেই লড়াই বিস্তৃত হয়েছিল প্রতিটি বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াই থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম পর্যন্ত।

শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল জায়গায় ছিল বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়। শাসক শ্রেণি জনগণের ন্যায্য দাবি মানতে অস্বীকার করলে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। তিনি বেছে নিয়েছেন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পথ। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটকে পুরোপুরি ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই তো ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আরমানিটোলা ময়দানে এক জনসভায় বলতে পেরেছিলেন, ‘ভাষা-আন্দোলন শুধু ভাষার দাবিতে ছিল না, সেটা ছিল আমাদের জীবন-মরণের লড়াই। আমরা মানুষের মতো বাঁচতে চাই।

“এই স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে যেদিন বাংলাদেশের কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে।”

আমরা খাদ্য চাই, বস্ত্র চাই, আশ্রয় চাই, নাগিরক অধিকার চাই।’ তদানীন্তন পাকিস্তানের দুই অংশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং তার ফলস্বরূপ দুই অংশের ভেতর অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে ‘দুই অর্থনীতি’র তত্ত্বকে ম–খ্য প্রশ্ন হিসাবে সামনে আনেন বঙ্গবন্ধু। আর এরই ভিত্তিতেই গড়ে তোলেন ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি। বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্বের গুণে ছয়-দফার প্রতি প্রবল জনসমর্থনে ভীত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক সরকার। ঊনসত্তরে ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে বের করে আনে এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। সমগ্র জাতির আশা-ভরসার প্রতীকে পরিণত হন তিনি।

‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’-এ প্রশ্নকে স্লোগান করে ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ অর্জন করে ভূমিধস বিজয়। পাকিস্তানের অভিজন শাসকরা তাদের কুক্ষিগত ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিল। কাজেই রাজনৈতিক সংগ্রামকে সশস্ত্র যুদ্ধে রূপান্তরের বিকল্প ছিল না। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে দেশকে নেতৃত্ব দেন এবং অবশেষে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নেতৃত্ব ভার গ্রহণ করেন। শুরু করেন অসামান্য অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম।

লেখকের আরো লেখা

সেই সংগ্রামের মর্মবাণী হিসাবে তিনি উচ্চারণ করেন, “এই স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে যেদিন বাংলাদেশের কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে। … আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আরও শক্তিশালী শত্রু। এই শত্রু হলো অভাব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা, বেকারি ও দুর্নীতি।”

“…এই যুদ্ধে জয় সহজ নয়। অবিরাম এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে এবং একটি সুখী, সুন্দর অভাবমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। তবেই হবে আমাদের সংগ্রাম সফল। আপনাদের শেখ মুজিবের স্বপ্ন ও সাধনার সমাপ্তি।”

আদিত্ব্য কামালসাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Some text

ক্যাটাগরি: ইতিহাস, চিন্তা, দর্শন, মতামত, সমকালীন ভাবনা

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি