নজরুল যখন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ করেন তখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ হতে উৎসারিত বাংলা ভাষাটি একটি পূর্ণ বিকাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলাইবাহুল্য এই বিকাশ কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা ভাষার। বাংলা ভাষার এই বিকাশ তখন আবার আরও পরিপূর্ণ আষাঢ়ের ভরা নদীর মতো পূর্ণযৌবনা রবীন্দ্র প্রতিভার দ্বারা। রবি তখন মধ্যগগনে দীপ্যমা, তাঁর প্রখর ও মধুর কিরণ দ্বারাই উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ তখন বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের কুশীলবরা। সেই সময় নজরুল নিয়ে এলেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন ভাষা । যে ভাষার উৎস পুথি, যে ভাষার সাধারণ মানুষেরা শোনো রাধা-কৃষ্ণের গল্প শোনে মহররমের কাহিনী আর বাদশাহ সোলেমানের কিচ্ছা। এই পুথির প্রাণের সঙ্গে আবার বেজে উঠল আরবী-ফারসী শব্দের ঝনঝন ঝংকার। মানুষের চলমান জীবন আর কথা নতুনভাবে সেজে উঠল নজরুলের কলমে। সংস্কৃতিমুখী আর আরবি ফারসিমুক্ত বাংলা ভাষার ভরা যৌবনে একটা দমকা বতাসের একটা ঢেউ উঠল। রবীন্দ্র বলয়ে রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত এ ভাষা নতুন চেতনার, নতুন আকাক্সক্ষার।
এই ভাষা নজরুলের চেতনার, এই ভাষা আর এই প্রকাশ সকল নিপীড়িত মানুষের, মানবতার মুক্তিকামী সকল মানুষের। এই ভাষা এত প্রখর আর এত তীব্র কারণ নজরুল অনুভব করেছিলেন মানুষের মুক্তির ক্রন্দন। বুঝতে পেরেছিলেন তাদের ভেতরের চাপা বেদনা। কোন অব্যক্ত কথার ভারে গুমড়ে মরছে মানুষ আর মানুষের অন্তর। নজরুলের প্রকাশ তাই প্রকাশ ঘটিয়েছিল সাধারণ মানুষের আশা-আনন্দ আর বেদনাকে। এই চেতনা এই ভাষাকে কবিগুরু চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন যথার্থভাবে ‘অরুগ্ন-বলিষ্ঠ-হিংস্র-নগ্ন- বর্ববরতার তার অনবদ্য ভাবমূর্তি রয়েছে কাজীর কবিতায় ও গানে। কৃত্রিমতার ছোঁয়া তাকে কোথাও ম্লান করেনি, জীবন ও যৌবনের সকল ধর্মকে কোথাও তা অস্বীকার করেনি। মানুষের স্বভাব ও সহজাত প্রকৃতির অকুণ্ঠ প্রকাশের ভেতর নজরুল ইসলামের কবিতা সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্বের উর্ধে তার আসন গ্রহণ করেছেন। বিদগ্ধ বাগবিন্যাসের যেমন মূল্য আছে, সহজ সরল তীব্র ও ঋজু বাক্যের মূল্যও কিছু কম নয়। তীব্রতাও রসাত্মক হলেই কাব্য হয়ে ওঠে যেমন উঠেছে নজরুলের বেলায়। কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এসব তোমাদের আবদার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তা প্রকাশ করবে বৈকি! আমি যদি আজ তরুণ হতাম তাহলে আমার কলমেও ওই সুর বাজত। জনপ্রিয়তা কাব্য বিচারের স্থায়ী নিরিখ নয়, কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।
নজরুলের বাণী আর তার চেতনার প্রকাশ যে একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত আর অবিরল, নজরুলের অনুভব, যুগযন্ত্রণা, রক্তাক্ত হৃদয়ের ক্ষরণ যে আবার জীবন ও যৌবনে পূর্ণ, তীক্ষ্ণ তীব্র ও শক্তিময় সেটাও কবিগুরু খুব ভালভাবেই অনুধাবন করেছিলেন। মনের ভেতর ঘটে যাওয়া প্রলয় সেই প্রলয়ের ভয়ঙ্কর সুন্দর আত্মপ্রকাশ যে সময়ের দাবি, কিন্তু এই দাবি কালকে ছাড়িয়ে আবার কালোত্তীর্ণ তা কবিগুরুর বিদগ্ধ অনুভবে উজ্জ্বলভাবেই ধরা পড়েছিল। তাই তার অকপট উচ্চারণ ‘জনপ্রিয়তা কাব্য বিচারের স্থায়ী নিরিখ নয়, কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।
নজরুলের এই প্রাণের প্রকাশ, আমজনতার মুক্তির গান আর সাধারণ মানুষের কাব্যর প্রতি মোহিতলাল মজুমদারের মতো ধ্রুপদী সাহিত্য সমালোচকও দেখিয়েছেন উচ্ছ্বাস।
‘বহুদিন কবিতা পড়িয়া এত আনন্দ পাইনি, এমন প্রশংসার আবেগ অনুভব করিনি। …. আমি এই অবসরে তাঁহাকে বাঙালার সারস্বত-ম-পে স্বাগত সম্ভাষণ জানাইতেছি এবং আমার বিশ্বাস প্রকৃত সাহিত্যামোদী বাঙালী পাঠক ও লেখক-সাধারণের পক্ষ হইতেই আমি এই সুখের কর্তব্য সম্পাদনে অগ্রসর হইয়াছি।
এই উচ্ছ্বাসের কারণ ছিল কারণ নজরুল সময়কে আঘাত করেছিলেন। ভবিষ্যতে তিনি কি হবেন। কাল তাকে কতটুকু ধারণ করবে। কবিতার শরীরকে কতটা শৈল্পিক সুষমায় বিন্যস্ত করবেন এগুলো কোনটাই নজরুলকে তাড়িত করেনি, নজরুলকে তাড়িত করেছিল মানুষের ক্ষুধা, দৈন্য, মানুষের প্রতি নিপীড়ন, নিষ্পেষণ শোষণ, পরধীনতার গ্লানি, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব আর হানাহানি।
নজরুলের এই অশান্ত মনের বিক্ষুব্ধ প্রকাশ, সেই প্রকাশ ভঙ্গির দৃঢ়তা ও তীক্ষ্ণতা সকলের অন্তরকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। নজরুলের আসন তাই যেমন পোক্ত হয়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষের অন্তরে তেমনি সাহিত্য মহলের সকলের অন্তরে সে আলোড়ন তুলেছিল ভিন্ন এক শক্তি ও মায়ায়। তার প্রতি অগ্রজদের সম্ভ্রম আর মোহ দুটোই জেগে উঠেছিল।
লীলানাগ গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা এক চিঠিতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেন, ‘হুগলি জেলে আমাদের কবি কাজী নজরুল উপোস করিয়া মর-মর হইয়াছে। বেলা একটার গাড়িতে যাইতেছি। দেখি, যদি দেখা করিতে দেয় ও দিলে আমার অনুরোধে যদি সে আবার খাইতে রাজি হয়। না হইলে আর কোন আশা দেখি না। একজন সত্যকার কবি। রবিবাবু ছাড়া আর বোধহয় এখন কেহ এত বড় কবিনি।
এখন এই যে আমজনতা থেকে শুরু করে বিদগ্ধ সাহিত্যিক আর সাহিত্য সেবকের কাছে তিনি পুজনীয় হয়ে উঠলেন সে কোন চেতনার বলে? সে চেতনা ছিল মানুষের কল্যাণের, আর মানবতার। যার মাধ্যমে নজরুল গেয়েছিলেন এমন গান সে গান সুন্দরের জয়ের আর সুন্দরকে ধারণের। তিনি নিজেই বলেছেন সেই চেতনার কথা, সেই সুন্দরের কথা।
সাহিত্য ব্যক্তিত্বেরই প্রকাশ। আমি সাহিত্যে কি করেছি, তার পরিচয় আমার ব্যক্তিত্বের ভেতর। পদ্মা যেমন সূর্যের ধ্যান করে তারই জন্য তার দল মেলে, আমিও আমার ধ্যানের প্রিঢতমের দিকে চেয়েই গড়ে উঠেছি। আমি কোন বাধা-বন্ধন স্বীকার করিনি বিস্মৃত দিনের স্মৃতি আমার পথ ভুলায়ন, আমি আমার বেগে পথ কেটে চলেছি।
নজরুল তার নিজের বোধ, নিজের বিবেক এবং চেতনা থেকে নিজের পথ কেটে নিয়েছিলেন। মানুষ থেকে মানুুষের দ্বারে হাত পেতে ছিলেন। আর সেখান থেকেই তিনি মুঠোভর্তি করে নিয়েছিলেন আপনার শক্তি ও বিশ্বাস। যে বিশ্বাস ও শক্তি তাকে করেছিল ভিন্ন পথের পথিক। সাধারণ্যে থেকেও নজরুল তাই অসাধারণ, অদম্য, অনন্য।
এখানে উল্লেখ করতেই হয় নজরুলের এই নবভাষা মুসলমানদের প্রাণের মাঝে বেজে উঠেছিল। কারণ বাঙালী মুসলমান সমাজের কথা ও ভাষায় আরবী ও ফারসী শব্দ ছিল। যা ছিল একটি ভাষায় শব্দ অন্য ভাষার শব্দ মিশে যাবার প্রকৃতিক বিবর্তন। এই শব্দগুলো বাংলাভাষার শব্দ হয়ে উঠেছিল। বাংলাভাষা শব্দগুলো গ্রহণ করেছিল। যা পৃথিবীর সব ভাষাতেই দেখা যায়। এটা কোন আরোপিত ছিল না। ফলে নজরুলের এই নব ভাষা ছিল মুসলমান সমাজেরও সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা। বঙ্কিমীয় বা আলালের ঘরের দুলালের যে সাহিত্য ভাষা সেটা যেন নজরুলই প্রথম ভেঙ্গে দেন। কবি নজরুরের এই কৃতিত্বকে প্রথম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন আহমদ ছফা।
‘নজরুল পুঁথি সাহিত্যের প্রাণের আগুনটুকু গ্রহণ করেছেন, তার জীর্ণ কঙ্কাল বহন করেননি। তাই নজরুলসাহিত্যে পুঁথিসাহিত্যের জীবাশ্ম দৃষ্টিগোচর হলেও, সেই ভাষা কাঠামো খুঁজে পাওয়া যাবে না। নজরুলের কাছে বাঙালী মুসলমান সমাজের অন্যতম প্রধান ও প্রণিধানযোগ্য ঋণ এই যে, নজরুলতাদের ‘ভাষাদীন পরিচয় ঘুচিয়ে দিয়ে তাদের সামাজিক ভাষাকে সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দান করলেন এবং স্বীকৃতি অর্জন করে দিলেন। আর নজরুলের কাছে সমগ্র বাঙালী সমাজের ঋণ এই যে, নজরুল বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে বাংলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করে, নব বিকাশধারায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে অনেক দূর পর্যন্ত গাঁথুনি নির্মাণ করেছিলেন।
কিন্তু নজরুলের এই ভাষা আর চেতনার প্রতি কি হিন্দু সমাজ মুখ ফিরিয়ে থাকতে পেরেছিল? অথবা তাদের কাছে কি নবভাষা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল? হয়নি। কারণ নজরুল ভাষায় নব জোয়ার আনলেও তাঁর চেতনা ছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। ভেতরে ক্ষোভ, জ্বালা আর অসহায়ত্বের যে প্রকাশ। মুক্তির যে চিরায়ত আকাক্সক্ষা ঝনঝন করে উঠেছিল তার ভাষা ও প্রকাশে। সে মুক্তি আকাঙ্ক্ষা শুধু মুসলমানের জন্য ছিল না, সেটা ছিল মানবতার মুক্তি কামনা। তবে নজরুল বোধহীন ছিলেন না, তার বোধ এবং সজাগ দৃষ্টি বুঝে নিয়েছিল মানবতার যে গান, সকল অন্যায় ও শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে যে গান তাকে সার্বজনীন করতে হলে এই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে নজরুলের নিজের বয়ান ‘একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভেতরের ন্যাজকে কাটবে কে?
হিন্দু-মুসলমানদের কথা মনে উঠলে আমার বারেবারে গুরুদেবের ওই কথাটাই মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও উদয় হয় মনে, যে এ-ন্যাজ গজাল কি করে? এর আদি উদ্ভব কোথায়? ওই সঙ্গে এটাও মনে হয়, ন্যাজ যাদেরই গজায় তা ভেতরেই হোক আর বাইরেই হোক তারাই হয়ে ওঠে পশু। যে সব ন্যাজওয়ালা পশুর হিংস্রতা সরল হয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে শৃঙ্গরূপে, তাদের তত ভয়ের কারণ নেই, যত ভয় হয় সেই সব পশুদের দেখে যাদের হিংস্রতা ভেতরে, যাদের শিং মাথা ফু’টে বেরোয়নি।
এই সাম্প্রদায়িকতার শিংটিকে গুড়িয়ে ফেলার চেতনা নিয়েই জেগে উঠেছিল তার ভাষা ও বাণী। নজরুলের লেখায় আমরা বিভিন্ন পুরাণের ব্যবহার দেখি সেই পুরাণের ব্যবহারেও পাওয়া যায় তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা-
“দাও দুশমন দুর্গ-বিদারী দুধারী জুলফিকার” অথবা “আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার”
যেমন তিনি ব্যবহার করেছেন জুলফিকার তেমনি পরশুরামের কুঠার। তার প্রেমের গভীর অনুভূতির প্রকাশও কি সার্বজনীন।
“ছিল একদিন আমার সোহাগ গিলয়া যমুনা হতে” “নিবেদিত নীল পদ্মের মত ভাসিতে প্রেমের স্রোতে। অথবা “নহরের পানি লোনা হয়ে যায় আমার অশ্রুজলে,
তশবীর তার জড়াইয়া ধরি বক্ষের অঞ্চলে।
১৯২৬ সালের দাঙ্গা কবিকে বিচলিত করেছিল। তাই কৃষ্ণনগরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে উদ্বোধনী গান রচনার জন্য তাঁকে অনুরোধ করা হলে তিনি লিখলেন ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতাটি। সার্বজনীনবোধ আর অসাম্প্রদায়িক মনন থেকেই তাঁর ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় লিখেছিলেন-
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ, কান্ডারী আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!
নজরুল সম্পর্কে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় এর মূল্যায়ন- ‘তাহার সততা আজও আমার দুর্বল চোখে অন্তত ম্লান মনে হইতেছে না। অনেক ভাল কবির মধ্যে নজরুল শুধু একজন ভাল কবি নয়, অনেক ভাল গায়কের মধ্যে নজরুল শুধু একজন ভাল গায়ক নয়, অনেক ভাল সুরকারের মধ্যে নজরুল শুধু একজন ভাল সুরকার নয়; বাংলা কাব্য-সাহিত্যে, বাংলার সঙ্গীতে, বাংলার সুর-সৃজন-লোকে নজরুলের নেই কোন পিতৃ-পুরুষ, নেই কোন উত্তরাধিকারী। সে দাঁড়িয়ে আছে স্বতন্ত্র, একক, একটা সম্পূর্ণ নূতন ব্যক্তিত্ব ও শক্তি।
নৃপেন্দ্রকৃষ্ণের আরও গভীর ‘নজরুলের প্রতিভার বৈশিষ্ট্যকে বুঝতে হলে, তার প্রকৃত মূল্য ও মর্যাদা দিতে হলে, আমাদের সর্বপ্রথম মনে রাখতে হবে সে কথাকে, নজরুল জন্মেছিল রবীন্দ্রনাথের সর্বব্যাপী প্রতিভার পূর্ণ প্রভাবের যুগে ও সে যুগের প্রত্যেক তরুণ সাহিত্য-প্রয়াসীর মতো সে আকণ্ঠ পান করেছিল রবীন্দ্রনাথের কাব্য সুধা। শুধু তাই নয়, সর্বাঙ্গ ভাসিয়ে সে ডুব দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের গানে আর রবীন্দ্রনাথের সুরের গভীরে, তেমন করে আজকের যুগের তরুণদের দেখি না। কিন্তু নজরুল প্রতিভার অনন্য সাধারণত্ব ও স্বাতন্ত্র্য হলো, যখন সে কবিতা লিখল, যখন সে নিজে গান রচনা করলো, সুর সৃষ্টি করল, তখন তার কবিতার একটি অক্ষরের মধ্যে, তার গানের একটা আন্দোলনের মধ্যে, তার সুরের একটা দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে, তার প্রকাশের ক্ষীণতম ভঙ্গির মধ্যে, এমন কি তার ভাষারীতির মধ্যে কোথাও দেখা গেল না রবীন্দ্র-প্রতিভার বিন্দুমাত্র প্রভাবের লক্ষণ।
নজরুলের এত বিচিত্র ঢঙের গান বাংলা দেশের আর কোন সুরকার আজ পর্যন্ত রচনা করেননি। কাজী নজরুল ইসলাম সবশুদ্ধ আনুমানিক তিন হাজার গান লিখে ছিলেন। পৃথিবীর সঙ্গীত রচনার ইতিহাসে এইটেই বোধহয় সর্বোচ্চ রেকর্ড’।
তবে এটা অবশ্যই স্বীকার্য যে, নজরুল মুসলিম সমাজের জড়তা ও স্থবিরতা কাটাতে চেয়েছিলেন। তাদের মানসিকভাবে ক্রিয়াশীল করতে চেয়েছিলেন। তাদের মনের জগতেকে বিস্তৃত ও উদার করতে চেয়েছিলেন। নানা করলে মুসলিম সমাজে জন্ম নেয়া হীনম্মন্যতাকে দূর করতে চেয়েছিলেন। মুসলিম সমাজের এই জেগে উঠার প্রত্যাশার ভেতরেও কোনো হিন্দু- মুসলিম ধারণা ছিল না অথবা হিন্দু মুসলিম প্রতিদ্বন্দ্বীতার বিষবাষ্প ছিল না। সেখানে ছিল সমাজকে অভিশাপ মুক্ত করার প্রয়াস।
‘নজরুলের একটা স্থির লক্ষ্য ছিল। নজরুল ইসলাম, ইসলাম ধর্ম এবং বাঙালী সংস্কৃতির মধ্যবর্তী ঐতিহাসিক ব্যবধানটুকু যথাসম্ভব কমিয়ে আনার একটা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলামের আপন জবানেও তাঁর প্রতিধ্বনি শোনা যায়। ১৯২৭ সালের এক চিঠিতে নজরুল লিখিলেন- ‘আমি জানি যে, বাঙলার মুসলমানকে উন্নত করার মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এদের আত্ম-জাগরণ হয়নি বলেই ভারতের স্বাধীনতার পথ আজ রুদ্ধ!’
তাঁর একক চেষ্টায় মুসলিম সমাজের ভেতরে যে ভাবাবেগ তিনি জাগাতে পেরেছিলেন, যে আত্মবিশ্বাসের আগুন জ্বালিয়ে তুলতে সফল হয়েছিলেন, সেক্ষেত্রে তার সঙ্গে অন্য কোন মুসলিম চিন্তাশীল ব্যক্তির তুলনা হয় না। এই সমাজটিকে ভেতর থেকে বিকশিত করে তোলার জন্য একজন আত্মভোলা খেয়ালি, দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রামরত কবির পক্ষে যতটুকু দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত ছিল, তার চাইতে অনেক গুরুদায়িত্ব তিনি পালন করে গেছেন।
নজরুলের এই মুসলমান আত্মজাগরণের মূল ছিল সমাজ গঠন, ভারত বর্ষের স্বাধীনতা আর দেশগঠন। সমাজের একটি অংশকে দুর্বল রেখে অনগ্রসর এবং দমিয়ে রেখেও যে পুরো সমাজ বা জাতির উন্নতি কখনোই হয় না, সে কঠিন সত্য নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন। নজরুলের এই অনুধাবনে যেন অনূরণিত হয় বেগম রোকেয়ার সেই অসাধারণ উক্তি- আমরা সমাজের অর্ধঅঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ কিরূপে উঠিবে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিয়ে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ ও আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে একই।
রোকেয়াও যেমন বুঝতে পেরছিলেন সমাজের অর্ধেক অংশ নারীকে দুর্বল ও গৃহবন্দী করে কখনই সমাজ উন্নত হতে পারে না। সে জন্য রোকেয়া সমাজকে শকটের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। যে শকটের দুটি চাকা, নারী ও পুরুষ। তাদের উভয়কে সমানভাবে পরিচালনা না করলে সেটি পথে শুধু আটকেই যাবে কখনই সঠিক গতি খুঁজে পাবে না। তেমনি নজরুল লিখেছিলেন- ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’ ‘মুসলিম তার নয়ন মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ। ‘এক সে আকাশ মায়ের কোলে’ যেন রবি শশী দোলে”
নজরুল সমাজ সংস্কার করতে আসেননি। এসেছিলেন গানের বীণা হাতে। সুষ্টি করেছিলেন সুর আর বাণী। কিন্তু তার প্রতি চিন্তা চেতনায় বেজে উঠেছে সমাজকে কুসংস্কার, অন্যায়-অবিচার শোষণ, নিপীড়ন আর নিষ্পেষণ থেকে মুক্ত করার প্রয়াস। দলিত আর নিপীড়িত জনতার মুক্তির কথা। সম্প্রদায়কতা মুক্ত সমাজের কথা । তাই তাঁর দৃঢ় উচ্চারণ ছিল- কিসের ধর্ম? আমার বাঁচাই আমার ধর্ম। দেবতার জল ঝড়কে আমি বাঁধব, প্রকৃতিকে আমি প্রতিঘাত দেব। আচারের বোঝা ঠেলে ফেলে দেবো, সমাজকে ধ্বংস করব। সব ছারেখারে দিয়েও আমি বাঁচব।
আমার আবার ধর্ম কি? যার ঘরে বসে কথা কইবার অধিকার নাই, দুপুর রাতে দুঃস্বপ্নে যার ঘুম ভেঙ্গে যায়, অত্যাচারকে চোখ রাঙাবার যার শক্তি নাই, তার আবার ধর্ম কি? যাকে নিজের ঘরে পরে এসে অবহেলায় পশুর মতো মেরে ফেলতে পারে, যার ভাই-বোন-বাপ-মাকে মেরে ফেললেও বাক্যস্ফুট করবার আশা নেই, তার আবার ধর্ম কি? দুই বেলা দুটি খাবার জন্যই যার বাঁচা, একটু আরাম করে কাল কাটিয়ে দেয়ার জন্যই যার থাকা, তার আবার ধর্ম কি?
মূলত নজরুলের ধর্ম ছিল মানবতার ধর্ম, তার বাণী ছিল মিলনের বাণী ও তার চেতনা ছিল সবার উর্ধে মানুষের কল্যাণ, সমাজের ও দেশের কল্যাণ।
আমরা যখন যুদ্ধে যাব তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব।
নজরুল তার শেষ ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। “বর্তমানের কবি আমি ভাই ভবিষ্যতের নই নবী’ কবি ও অকবি যাহা বল মোরে’ মুখ বুজে তা সই সবই”
নজরুল ভবিষ্যতের নবী হতে চাননি। বর্তমানের কবি হতে চেয়েছেন। তিনি সচেতন ভাবেই বলেছিলেন, ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি তাই যাহা আসে কই মুখে’। আর খুব জেনে বুঝেই হিন্দু মুসলমানের গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। কালজয়ী হওয়ার চেয়েও তার কাছে প্রাধান্য পেয়েছিল শোষিত নিপীড়িত মানুষের ক্রন্দন। তার কাছে কাছে জরুরী ছিল তার সময় আর সময়ের সঙ্কট। তার কাছে জরুরী তার জাতি তার দেশকে আর পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করা। সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলা। তিনি কালজয়ী হতে চাননি। কিন্তু তাঁর কাল যেমন তাঁকে ধারণ করেছে, বর্তমান সময়ও তাঁকে ঠিক তেমনি ধারণ করে। সাম্প্রতিক বিশ্ব যেভাবে অসহিষ্ণুতার বিষবাষ্পে কুলুষিত হচ্ছে। যেখাবে মানবতা আজ পদদলিত। যেভাবে মানুষ আজ শোষিত, যেভাবে অন্যায় আর জুলুমের জয় স্তব্ধ করে দিচ্ছে বিবেক আর বোধ। ভঙ্গুর এই সময়ে অস্থির এই সময়ে নজরুলই সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক আর চেতনায় নজরুলকে ধারণ করাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরী।
আদিত্ব্য কামাল: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Some text
ক্যাটাগরি: নাগরিক সাংবাদিকতা
[sharethis-inline-buttons]