প্রসঙ্গ পূর্ব কথা:
সৃষ্টিশীল লেখকেরা অনেক সময় ভাষাবিজ্ঞান আর ব্যাকরণ থেকে স্বাধীনতা নেন, ভাষার ঝর্ণাটি তাদের কলমে ঝরে; কখনো নিজের মতো করে লেখেন,গল্প-কবিতা-উপন্যাসে নতুন নতুন পারিভাষিক শব্দও ব্যবহার করেন। সাহিত্যে পারিভাষিক শব্দ, নতুন শব্দ, সৃষ্ট শব্দ ও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার হবে এটাই স্বাভাবিক। এটি দোষের কিছু নয়। তবে ব্যাকরণ, ভাষাবিজ্ঞান, উচ্চারণরীতি বা বানানের নিয়ম নীতির যথাযথ অনুশীলন ভাষার উৎকর্ষতা সাধনে বিরাট ভুমিকা পালন করে। ভাষার ঝর্ণাটির দুকূলে বাঁধ দিয়ে ঠিকঠাক প্রবাহিত করার মূল দায়িত্বটা কিন্তু ব্যাকরণবিদ ও ভাষাতাত্ত্বিকগণের উপরই বর্তায় । বাংলা একাডেমি প্রতিনিয়ত সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই করে যাচ্ছে।
বাংলা বানান রীতির উদ্গাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে প্রথম ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ প্রণয়ন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মত অনেক প্রতিভাবান লেখক সেই বানান-রীতি মেনে চলবেন বলে অঙ্গীকার করে স্বাক্ষর করেন। সেই বানান-রীতির ধারাবাহিকতাই বাংলা একাডেমির বানানরীতি।
সময়ের সাথে যেসকল শব্দমালা টিকে থাকে এবং মানুষ ও সমাজ যেসকল শব্দরাজি গ্রহণ করে অভিধানে সে সকল শব্দরাজিই ঠাঁই পায়। শব্দের ঠিকুজিঘরে ঠাঁই পাওয়া প্রতিটি শব্দের আদ্যন্ত, ব্যুৎপত্তি, অর্থবৈচিত্র্য,বিবর্তনের রূপরেখা প্রভৃতি সহজভাবে লেখা থাকে।
প্রাসঙ্গিক কথা:
মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ। ঈদ(عید)আরবি শব্দ। এটি ‘আওদ’ শব্দমূল থেকে উদ্ভুত। এটার আভিধানিক অর্থ ما یعاود مرۃ بعد اخر “একের পর এক যা বার বার আসে,প্রত্যাবর্তন করা বা ফিরে আসা।।” ঈদকে শব্দমূল ধরলে এর অর্থ হয় আনন্দ উৎসব। আরবি অভিধান মতে, যদি শব্দটি আরবি ‘আদত’ থেকে উৎপত্তি হয়, তবে এর অর্থ হয় অভ্যাস। আর যদি ‘আদা-ইয়াউদু’ থেকে উৎপত্তি হয় তবে এর অর্থ হয় ফিরে ফিরে আসা। মুসলমানদের জীবনে চান্দ্র বৎসরের নির্দিষ্ট তারিখে প্রতি বৎসরই দুটো উৎসবের দিন ফিরে আসে। বছরে বছরে এটা পালিত হয় তাই তাকে ঈদ বলা হয়। ঈদ এলেই সমগ্র বিশ্বের মুসলমানরা অত্যন্ত চমৎকার একটি শুভেচ্ছা বাক্যের মাধ্যমে একে অপরের প্রতি ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকেন। মুসলিমদের এই ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্যের আরবি ‘عيد مبارك’ ইংরেজী ‘Eid Mubarok’ এবং বাংলা ‘ঈদ মোবারক’। গেল কয়েক বছর ঈদ এলেই বাঙালি মুসলিমদের বহু বছরের ঐতিহ্যের ধারক ‘ঈদ’ বানান নিয়ে নানান মনে নানা প্রশ্নের উদয় হয়। সত্যিকার অর্থে ঐতিহ্যের ‘ঈদ’ কেবল শব্দে সীমাবদ্ধ নেই, এটি আনন্দ-ভালোবাসায় জড়িত,আবেগ এবং ধর্মীয় আচার! বাংলা একাডেমির একটি উল্লেখযোগ্য কর্ম ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ (২০১৬)-এর যে সকল (কিছু) বানান নিয়ে বেশ তর্ক উঠেছে তার মধ্যে অন্যতম হল ঈদ! এবার জানা প্রয়োজন ‘ঈদ’ শব্দের বানান দীর্ঘ ঈ-কার ও হ্রস্ব ই-কারের মধ্যে কোনটি গ্রহণযোগ্য, ইতিহাস না বানানবিধি— কোনটির গুরুত্ব বেশি?
পবিত্র কুরআনে ‘ঈদ’:
কুরআনের সূরা আল মায়েদার একটি স্থানে এই ঈদ শব্দটি ভিন্নভাবে দেখা যায়। যেখানে বলা হয়েছে- ‘মারইয়াম পুত্র ঈসা (আ.) বলল, হে আল্লাহ, আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের জন্য আসমান থেকে খাবার সজ্জিত একটি খাজাঞ্চিখানা পাঠাও, এ হবে আমাদের জন্য, আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জন্য তোমার কাছ থেকে একটি আনন্দ উৎসব (ঈদ) এবং একটি নিদর্শন।’ (৫:১১৪)।
বাংলা একাডেমির ‘আধুনিক বাংলা অভিধানে’ ‘ঈদ’ শব্দটির ভুক্তি রয়েছে দু’টি। এর মধ্যে একটিতে লেখা হয়েছে ‘ঈ’ ব্যবহার করে, অন্যটি ‘ই’ ব্যবহার করে। এর মধ্যে ‘ঈদ’ কে প্রচলিত ও অসংগত বানান এবং ‘ইদ’কে সংগততর ও অপ্রচলিত বানান বলছে বাংলা একাডেমি।
লক্ষ্য করুন, অভিধানে ‘ইদ’ শব্দটির ভুক্তিতে বলা হয়েছে,
➤‘ইদ/ইদ্/[আ.]বি. ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব; (ইদুল ফিতর বা ইদুল আজহা); খুশি, উৎসব; ঈদ-এর সংগততর ও অপ্রচিলত বানান।
➤ইদ মোবারক /ইদ্ মোবারক্/বি. ইদের শুভেচ্ছা বিনিময়কালে উচ্চারিত অভিবাদন।’
➤অন্যদিকে, অভিধানের ‘ঈদ’ ভুক্তিতে বলা হয়েছে, ‘/ইদ/[আ.]বি. ইদ-এর প্রচলিত ও অসংগত বানান।’
➤আবার বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে ‘ইদ’ শব্দের ভুক্তিতে নির্দেশ করা হয়েছে ‘ঈদ’ শব্দকে।
১৯৯৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমির অভিধানে দুটো বানানই আছে। বানানবিধিতে বলা আছে, বিদেশি শব্দ লিখতে ‘ঈ’ বা ‘ঈ’-কারের পরিবর্তে ‘ই’ বা ‘ই’-কার লিখতে হবে। এও বলা আছে, ‘ইতিহাস-ঐতিহ্যনির্ভর বানান পরিবর্তন করা যাবে না।’১
বাংলা একাডেমির ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ এর উপরোক্ত বানান রীতির শেষাংশ ১ অনুসরণ করলে মন আর চোঁখ সায় দেয় ‘ঈদ’ বানানে, কোনো কোনো বানান থাকে, যার পরিবর্তন হলে চোঁখে লাগে। কখনো কখনো আবেগে লাগে, কখনো কখনো বিশ্বাসে লাগে। কিন্তু মস্তিষ্ক বলে ‘ইদ’ সঠিক। অবশ্য তা হবে ভাষাবিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক!
মূলত ‘ঈদ’ শব্দে প্রথম ‘ঈ’ এর যথার্থ ও সর্বাধিক ব্যবহার করেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কবির বিখ্যাত গান “রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ‘ঈদ’ ছাড়াও বহু কবিতায় ঈদ শব্দের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।আরবি-ফারসি ভাষায়ও সমান পারদর্শী ছিলেন কবি। তারও আগে বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান [ প্রথম খন্ড (অ-ঞ) প্রথম প্রকাশ জৌষ্ঠ ১৪২০/ জুন ২০১৩] থেকে আলাওলের লেখায় ঈদ শব্দের প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায়। ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে আলাওল লিখেছেন, “জুম্মা দুই ঈদ আর আরফা সিনান”। ১৮৫০ সালে অক্ষয়কুমার দত্তের নিন্মোক্ত লেখাটিতেও ইদ শব্দের প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায়। তিনি লিখেন,”কি ইদ,কি মহরম কোন মোসলমান…..”।
সঠিক বানান কোনটি ঈদ নাকী ইদ?
বাঙালি মুসলমানদের কাছে এবং ৯৭ ভাগ মুসলিম ধর্মপ্রাণ মানুষের এদেশে ধর্মীয় আবেগের স্মৃতিতে মোড়া ‘ঈদ’ শব্দটি নিন্মোক্ত তিনটি কারণে সঠিক বলে মনে করা হয়। আর তা হল:
এক. ইসলাম ধর্ম যখন থেকে এ দেশে প্রবেশে করেছে তখন থেকেই ঈদ বানানে দীর্ঘ ঈ-কার ব্যবহার করা হয়। তাই ঈদের বানান হ্রস্ব ই-কার হওয়ার কোনো কারণ নেই।
দুই. ঈদ শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ থেকে। এখন সংস্কৃত-আরবি-ফারসি-ইংরেজির অনেক শব্দই বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারের নিজস্ব সম্পদ হয়ে গেছে। সুতরাং বাঙালির মুখ দিয়ে যা বের হয়, তা-ই বাংলা বলে মানতে হবে। এর মধ্যে সংস্কৃত নেই, বিদেশি বলেও কিছু নেই। এটি এখন বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্ত। বিদেশি শব্দ হিসাবে বিবেচনা করা যাবে না। তাই ঈদ বানানই সঠিক।
তিন. ঈদ লেখার সময় আরবী শব্দ আইন-দাল-ইয়া অক্ষর ব্যবহার করে ঈদ লেখা হয়। এ ক্ষেত্রে আইনে একটি দীর্ঘ টান আছে। ‘ঈদ’ শব্দে ‘ই’-এর পরিবর্তে ‘ঈ’ ব্যবহারই সুন্দর। ‘‘ই’ ও ‘ঈ’-এর মধ্যে উচ্চারণগত পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে। ‘ঈদ’ যেহেতু আরবি শব্দ, ফলে এর উচ্চারণটা আরবি ব্যাকরণসম্মত।
আরবি ব্যাকরণ মতে ঈদ বনাম ইদ:
আরবিতে ইয়া দাল ঈদ না, আঈন ইয়া দাল – ঈদ। আঈন গলার ভিতর থেকে উচ্চারণ হয়, আর আলিফ বা ইয়া জিহ্বার সম্মুখভাগ থেকে। আরবি ব্যাকরণে ইয়া অক্ষর সাকিন হলে এবং তার আগের অক্ষরে জের থাকলে সেটাকে টেনে পড়তে হয়। যেটাকে তাজবীদের ভাষায় বলে মাদ। মাদ মানে টেনে পড়া। বাংলাতেও এটি আছে। যেটাকে আমরা দীর্ঘ স্বর বলি। হ্রস্ব মানে না টেনে পড়া তথা মাদ ছাড়া পড়া। আর দীর্ঘ মানে টেনে পড়া তথা মাদসহ পড়া। কাজেই আরবী যে শব্দে মাদ আছে সেখানে দীর্ঘ স্বর হবে। আর যেহেতু عيد শব্দে ইয়া এর আগের অক্ষরে জের আছে তাই এটি টেনে পড়তে হবে। তাই যুক্তিযুক্তভাবে এখানে দীর্ঘ স্বর হবে। তাই ” ঈদ ” হওয়াই যুক্তিযুক্ত।
ধ্বনি ও বর্ণের প্রতিবর্ণীকরণের সমস্যা:
বাংলা ভাষার ব্যাকরণে আরবির মত দীর্ঘ টানে (‘ঈ’) উচ্চারণ নেই। এখানে সব শব্দই ছোট টানের (‘ই’)। তাই শব্দটি বাংলা ভাষার উচ্চারণে সঠিক হয় ‘ইদ’।
বাংলায় কোনো নিয়মিত দীর্ঘস্বর না থাকায় ‘ঈদ’ বা ‘ইদ’ যা-ই লিখি না কেন, আমরা ‘ইদ’-ই উচ্চারণ করে থাকি।
ভাষাবিজ্ঞানের ধ্বনিতত্ত্বের আলোচনা:
আমরা যদি বিশ্বায়নের ভাষার সাথে বানান তুলনা করি তবে দেখা যাবে, বাংলা এবং ইংরেজি উভয়ের জন্য আরবি ‘ঈদ’ একটি বিদেশি শব্দ। ইংরেজিতে ‘ঈদ’ শব্দটি লেখা হয় ‘Eid’। এখানে ‘E’-এর পর ওই ‘I’-টা লেখা হয় দীর্ঘ ‘ঈ’ স্বর বোঝানোর জন্যই। আর ইংরেজিতে দীর্ঘ স্বর হিসেবেই উচ্চারণ করা হচ্ছে, যেটি বাংলা ভাষায় দীর্ঘস্বর বর্ণমালায় থাকলেও উচ্চারণে নেই!
ভাষাবিজ্ঞানের রূপতত্ত্বের আলোকে:
ব্যাকরণের বাক্যাংশের (Parts of speech) দিক থেকে ঈদ একটি বিশেষ্য পদ।ঈদ’ হল এক উৎসবের নাম।
কোনো ভাষাতেই নাম ও ট্রেডমার্ক ইচ্ছামতো বদলানো বা মতাচ্ছন্নতা সমর্থন করা হয় না।
ঈদ শব্দে ‘ঈ’-এর বাঁকানো শেষাংশটুকু আমার কাছেও শাওয়ালের/ জিলহজ্জ মাসের প্রথমদিনের চিকন চাঁদের মত মনে হয়। ভাষা বহতা নদীর মত।বাঁধ দিলে যেমন নদীর গতিপথ বদলে যায়। নিয়মের বাঁধনে ভাষার গতিপথও বদলে যায়। কোনো ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না থাকলে তার গতি একদিন স্থবির হয়ে যেতে পারে। সংস্কৃতের মতো বহু ভাষা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতির কারণেই কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে।
Some text
ক্যাটাগরি: বিবিধ
[sharethis-inline-buttons]