শনিবার রাত ১১:০৪, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

সন্তানের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের নাম ‘বাবা’

৪৬৪ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

রক্তের বাঁধনে জড়ানো সন্তানের কাছে প্রত্যেক বাবাই একজন রোল মডেল। শুধু বাবা দিবসেই নয়,বাবার গল্প প্রতি মুহুর্তের। একটা সময় ছিল বাবার ভয়ে পুত্র-কন্যা থরথর করে কাঁপত। সন্তান থাকতো দুধে-ভাতে। খেলার সাথী নির্বাচন থেকে শুরু করে বিদ্যার্জন-সব কিছুতে দিকনির্দেশনা বাবারাই দিতেন। কোন সন্তানই বাবার চোখের আড়াল হতো না। সন্তানের কাজ শুধু ‘জো আজ্ঞা জাহাপনা’ বলে পালন করা। সন্তানের জন্য যত আদর ভালবাসা বাবারা তার সবটুকু মনের ভিতর পোষণ করতেন। আর বাহ্যিক কোমলতা ছিল মায়ের আঁচল তলে। সন্তানের আর্থিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও মানবিক বিকাশে বাবাই ছিল একমাত্র সহায়ক। আজ সময়ের বিবর্তনে বাবারা নিজেদের শাসনকে ক্ষয়িষ্ণু করে ফেলেছেন। শহুরে বাবাদের সাথে তাদের সন্তানের শুধুমাত্র ছুটির দিনে দেখা হয়, খোঁজ-খবরের ঝাঁপি নিয়ে বসা হয়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দৌরাত্ব্যে সন্তানের সময় কোথায়? প্রযুক্তির সাথে পরিচিতি না থাকায় অনেক বাবারা, বাবা এর সাথে একটা এ-কার যুক্ত করে বোবা! হয়ে বসে থাকেন। মনে রাখবেন এই এ-কার যোগ করে বসে থাকার জন্য অনেক বেশী মূল্য দিতে হবে আপনাকে।সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে না পারলে সন্তানের কারণে উভয় জগতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

যে সব কাজ করলে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিত হয়, পিতা তার ছেলেকে সে বিষয়ে উপদেশ দিবেন। উপদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে তাওহীদের উপর অটল ও অবিচল থাকতে এবং শিরক থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেবেন।

হযরত লোকমান (আ.) তাঁর ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা এতই সুন্দর ও গ্রহণ যোগ্য যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা তা কুরআনে করীমে উল্লেখ করে কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত উম্মতের জন্য তিলাওয়াতের উপযোগী করে দিয়েছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা আদর্শ করে রেখেছেন।

➤প্রথম উপদেশ: তিনি তার ছেলেকে বলেন,
“হে প্রিয় বৎস আল্লাহর সাথে শিরক করো না, নিশ্চয় শিরক হল বড় যুলুম।”

➤দ্বিতীয় উপদেশ:
“আর আমি মানুষকে তার মাতাপিতার ব্যাপারে [সদাচরণের] নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে, তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। প্রত্যাবর্তন-তো আমার কাছেই।” [সূরা লোকমান: ১৪]

➤তৃতীয় উপদেশ:
“আর যদি তারা তোমাকে আমার সাথে শিরক করতে জোর চেষ্টা করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না। এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে করবে সদ্ভাবে। আর আমার অনুসরণ কর তার পথ, যে আমার অভিমুখী হয়। তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব, যা তোমরা করতে।” [সূরা লোকমান: ১৫]

➤চতুর্থ উপদেশ:
“হে আমার প্রিয় বৎস! নিশ্চয় তা [পাপ-পুণ্য] যদি সরিষা দানার পরিমাণও হয়, অত:পর তা থাকে পাথরের মধ্যে কিংবা আসমান সমূহে বা জমিনের মধ্যে, আল্লাহ তাও নিয়ে আসবেন; নিশ্চয় আল্লাহ সুক্ষ্মদর্শী সর্বজ্ঞ।” [সূরা লোকমান: ১৬]

➤পঞ্চম উপদেশ:
লোকমান হাকিম তার ছেলেকে সালাত কায়েমের উপদেশ দেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ﴿يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ﴾ অর্থাৎ, “হে আমার প্রিয় বৎস সালাত কায়েম কর”, তুমি সালাতকে তার ওয়াজিবসমূহ ও রোকনসমূহ সহ আদায় কর।

➤ষষ্ঠ উপদেশ:
“তুমি ভালো কাজের আদেশ দাও এবং মন্দ কাজ হতে মানুষকে নিষেধ কর।” বিনম্র ভাষায় তাদের দাওয়াত দাও, যাদের তুমি দাওয়াত দেবে তাদের সাথে কোন প্রকার কঠোরতা করো না।

➤সপ্তম উপদেশ:
আল্লাহ বলেন, ﴿وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ﴾ “যে তোমাকে কষ্ট দেয় তার উপর তুমি ধৈর্য ধারণ কর।”

➤অষ্টম উপদেশ:
“আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না।”
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, ‘যখন তুমি কথা বল অথবা তোমার সাথে মানুষ কথা বলে, তখন তুমি মানুষকে ঘৃণা করে অথবা তাদের উপর অহংকার করে, তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবে না। তাদের সাথে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে কথা বলবে। তাদের জন্য উদার হবে এবং তাদের প্রতি বিনয়ী হবে।’

➤নবম উপদেশ: আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَلا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحاً﴾

“অহংকার ও হঠকারিতা প্রদর্শন করে জমিনে হাটা চলা করবে না।” কারণ, এ ধরনের কাজের কারণে আল্লাহ তোমাকে অপছন্দ করবে। এ কারণেই মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ﴾

“নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।”

➤দশম উপদেশ:
নমনীয় হয়ে হাটা চলা করা। মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে বলেন: ﴿وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ﴾ “আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর।” তুমি তোমার চলাচলে স্বাভাবিক চলাচল কর। খুব দ্রুত হাঁটবে না আবার একেবারে মন্থর গতিতেও না। মধ্যম পন্থায় চলাচল করবে। তোমার চলাচলে যেন কোন প্রকার সীমালঙ্ঘন না হয়।

➤একাদশ উপদেশ:
নরম সূরে কথা বলা। লোকমান হাকীম তার ছেলেকে নরম সূরে কথা বলতে আদেশ দেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ﴾ “তোমার আওয়াজ নিচু কর।” আর কথায় তুমি কোন প্রকার বাড়াবাড়ি করবে না। বিনা প্রয়োজনে তুমি তোমার আওয়াজকে উঁচু করো না। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ﴾

“নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল, গাধার আওয়াজ।”

পবিত্র হাদিসের আলোকে একজন বাবা তার প্রাণাধিক সন্তানের জন্য আরো যা করবেন তা হল:

✔সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার কানে আজান পৌঁছে দেয়া পিতার কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ সা: হাসান ইবনে আলী রা: এর কানে আজান দিয়েছেন। (আবু দাউদ : ৫১০৫)
✔তাহনিক করা অর্থ খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় কিছু চিবিয়ে সন্তানের মুখে দেয়া। আয়েশা রা: বলেন : ‘রাসূল সা:-এর কাছে শিশুদেরকে আনা হতো। তিনি তাদের জন্য বরকতের দোয়া করতেন এবং তাহনিক করতেন।’ (মুসলিম : ১০৬৯)
✔সুন্দর ও অর্থবহ নাম রাখা। রাসূল সা: বলেন : ‘তোমরা যখন আমার কাছে কোনো দূত পাঠাবে তখন সুন্দর চেহারা ও সুন্দর নামবিশিষ্ট ব্যক্তিকে পাঠাবে।’ (তিরমিজি : ২৮৩৯)
✔আকিকা করা : রাসূলুল্লাহ সা: বলেন : প্রত্যেক নবজাতক তার আকিকার সাথে আবদ্ধ। জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে জবেহ করা হবে। ঐ দিন তার নাম রাখা হবে। আর তার মাথার চুল কামানো হবে। (আবু দাউদ : ২৮৩৮)
✔ কুরআন ও সুশিক্ষা দেওয়া। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন : ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে সালাতের নির্দেশ দাও। আর আট বছর বয়সে সালাতের জন্য মৃদু প্রহার করো এবং শোয়ার স্থানে ভিন্নতা আনো। (আবু দাউদ:৪৯৫)
✔ আদব বা শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া  রাসূলুল্লাহ সা: বলেন : তোমরা নিজেদের ও পরিবার পরিজনদের আল্লাহ ভীতির ব্যাপারে উপদেশ দাও এবং শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।’ (বুখারি : ২৮১) ওমর রা: জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন : ‘তোমার সন্তানকে আদব শিক্ষা দাও। কারণ তুমি তোমার সন্তানের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে যে, তুমি তাকে কী আদব শিখিয়েছ, তুমি তাকে কী শিক্ষাদান করেছ? (বায়হাকি : ৪৮৭৭)
✔সক্ষম করে তোলা : সন্তানদের এমনভাবে সক্ষম করে গড়ে তোলা, তারা যেন উপার্জন করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : ‘তোমরা সন্তানদের সক্ষম ও স্বাবলম্বী করে রেখে যাওয়া, অভাবী ও মানুষের কাছে হাতপাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম। (বুুখারি : ১২৯৫)
✔সন্তানের উপযুক্ত সময়ে বিয়ের ব্যবস্থা করা। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : ‘নিশ্চয় পিতার ওপর সন্তানের হকের মধ্যে রয়েছে, সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে তকে বিয়ে দিবে।’
✔রাসূলুল্লাহ সা: এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করে বলেছেন : ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করো। (বুখারি :২৫৮৭)

আল্লাহ অসীম অনুগ্রহ করে সন্তান দান করে
থাকেন। পিতা মাতার জন্য সন্তান আল্লাহ তাআলার এক অমূল্য নেয়ামত। পৃথিবীতে মা বাবা ডাক শোনার সৌভাগ্য সবার হয়না । আর এ সৌভাগ্যের কারণে ওনাদের ঐকান্তিক চাওয়া হবে সন্তানের দুনিয়ার জীবন ও পরকালের জীবন যেন কল্যাণময় ও গৌরবের হয়।
তাই আসুন আল্লাহর শেখানো দোয়ার মাধ্যমে সন্তানের মঙ্গল কামনা করি। ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তান দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি তাদের মুত্তাকিদের নেতা বানিয়ে দিন।’ (আল কুরআন, ২৫:৭৪)। আমিন।

Some text

ক্যাটাগরি: দর্শন

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি