আমি যখন তার কথা ভাবি, তখন আমার চোখে ভেসে ওঠে অমল সুভ্রতা। সেই কবে তাঁকে কোনো এক বিকেলে শুভ্র পাজামা, আর বাদামী পাঞ্জাবী পড়ে হাঁটতে দেখেছিলাম ওই দিন-তারিখ এখন মনে নেই। সফেদ দাড়ি আর শুভ্র কেশের মাঝে সোনালী চেহারার সৌন্দর্যটি সেদিনই প্রথম ধরা পড়ে ছিল আমার চোখে। এখন যখনই চোখ বন্ধ করে তাঁর কথা ভাবি, আমার চোখে ভেসে ওঠে একজন ফেরেশতার প্রতিচ্ছবি।
মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তার ব্যক্তিত্ব। আর তা ব্যাপকভাবেই ধারণ করতেন মাওলানা আবদুল হাকিম রহমতুল্লাহি আলাইহি। তার ব্যক্তিত্বের কিছুটা ধরা গেলেও অনেকটা ছিল অধরা। কিছুটা স্পষ্ট হলেও আমাদের কাছে অনেকটা ছিল অস্পষ্ট। বিনয়ী, মধুরভাষী, স্মিত হাস্য, নিম্ন কন্ঠের মানুষ ছিলেন তিনি। কাউকে কোনদিন ক্ষিপ্ত করেননি। উচ্চকণ্ঠে কারো সাথে তর্ক করতেও কোনদিন কেউ দেখেনি তাঁকে।
তার জীবনটা ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈনিকের মতো। পিতৃ-মাতৃ আর ভিটে-মাটিহীন স্বজনহারা এই মানুষটি জীবনের সংগ্রামে সফল হয়েছিলেন। নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়েই সাজিয়ে ছিলেন চারপাশ।
নানাজীর যেদিন ইন্তেকাল হয়। তাঁর তিনদিন আগে আমি বাড়িতেই ছিলাম। হঠাৎ কেউ একজন সংবাদ পৌঁছালো তিনি খুব অসুস্থ। খবর শুনে আম্মাকে সাথে নিয়ে ছুটে গেলাম দেখতে। গিয়ে দেখি মামা-খালারা পাশে বসে আছেন ভাবলেশহীন অবস্থায়। আম্মা দৌড়ে কাছে গেলেন। আমি পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। তাকিয়ে রইলাম তার চেহারার দিকে। এই শেষ দেখা। নানাজি শুয়ে আছেন চৌকির উপর। বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। আমার দু চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছিল তখন। শেষে চলে আসার সময় নানাজীর চেহারায় যে অপার্থিব একটা আভা দেখেছিলাম, সেটি যেন এখনও আমার চোখে দেদীপ্যমান হয়ে আছে। পরের দিন আমি ঢাকায় চলে এসেছিলাম।
তাঁর দু’দিন পর, খ্রিস্ট-২০২০ সালের আজকের এই দিনের ভোররাতে হঠাৎ জরুরী ফোন পেলাম- তিনি আর নেই। সুবহে সাদিকের সময় ফজরের আযান চলাকালীন তিনি নিজ গৃহে ইন্তেকাল করেন। ফোন পাওয়া মাত্রই আমি বাসা থেকে বের হয়ে পড়েছিলাম। ঢাকা থেকে গাজিপুর, ভালুকা, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ পার হতে হতেও যেন রাস্তা ফুরায় না আমার।
শেষে বেলা ১১টায় এসে পৌঁছলাম। এসে দেখি শত শত নারী-পুরুষের বাড়ি ঘর ভরা। আত্মীয়-স্বজনরা সবাই এলেন। কিন্তু শত শত মানুষের ভীড়েও আমি নিঃসঙ্গতা অনুভব করলাম। পুরো বাড়িটাই যেন অন্ধকার দেখা যাচ্ছিল আমার চোখে। মনে হতে লাগল সাদা কাফনে জড়ানো এই পবিত্র লাশটির সাথে যেন আজ থেকে সব কিছুই বিদায় হয়ে গেল।
তিনি চলে গেলেন। কাঁদিয়ে গেলেন পুরো আঠারোবাড়ী বাসিকে। ময়মনসিংহের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আকাশে উদিত এই তারাটি অম্লান হয়ে জ্বলবে চিরদিন মানুষের মনিকোঠায়। তিনি আঠারোবাড়ী বাসীর জন্য চৈত্রের খরার মাঝে একপশলা বৃষ্টি হয়ে এসেছিলেন, আর চলে গেলেন বোশেখের কালবৈশাখী ঝড় হয়ে। তাঁর চলে যাওয়ায় ছিড়ে লন্ডবন্ড হয়ে গেছে হাজারো মানুষের অন্তর। হাজারো ভক্ত প্রেমিকের হৃদয় ভেসেছে চোখের জলে। সকলের চাওয়া একটাই- ওপারে ভালো থাকুন তিনি।
আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে সর্বোচ্চ মাক্বাম দান করুন। আমীন
Some text
ক্যাটাগরি: আত্মজীবনী, গল্প, মতামত, সাহিত্য, স্মৃতিচারণ
[sharethis-inline-buttons]