শনিবার রাত ১১:৫৪, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

আলোর পথের সন্ধানে

৭১৩ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

“রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ”, বাংলাদেশের সব জেলখানায় বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকে এই ব্যাক্যটি। বাংলাদেশের জেলখানা বন্দীদের নিরাপদে রাখলেও আলোর পথ দেখায় তা সব সময় সত্য নয়।

আমাদের দেশে জেলখানা আশ্চর্য এক জায়গা। নিরাপরাধ মানুষ কোন কারণে একবার জেলে ঢুকলে সে অপরাধী হয়ে বের হয়। ছোটখাটো অপরাধ করে কেউ জেলে গেলে, বের হয়ে আরো বড় বড় অপরাধের সাথে যুক্ত হয়। নিজে আরেক অপরাধী গ্রুপ তৈরী করে।

ছোট নেতা একবার জেলে গেলে, জেল থেকে বের হয়ে সে বড় নেতা হয়ে যায়। বড় বড় নেতাদের জেলখাটার নজির থাকলে তিনি আরও বড় নেতা হয়ে যান। দলীয় বড় পাদ পান। বড় বড় রাজনৈতিক নেতা এবং ধর্মীয় নেতারা যত অন্যায় করেই জেলে যাক না কেন তার অনুসারীরা কখনো তার অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখে না। দেখে প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র হিসেবে।

জেলে থাকা অপরাধী নিজে নির্ভয়ে থাকলেও তাকে জেলে পাঠানোর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা বাড়িতে নিরাপদে ঘুমাতে পারে না; অপরাধীদের সাঙ্গ পাঙ্গদের আক্রমণের ভয়ে বা জেলের থাকা অপরাধী পুনরায় জেল থেকে বের হয়ে তাকে আবার ক্ষতি করতে পারে এই ভয়ে।

বাংলাদেশে এবং বিশ্বের বড় বড় নেতারা জেল খেটে জাতীয় নেতা হয়েছেন। কাজেই জেলবন্দী করা সব সময় সবার ক্ষেত্রে নেতিবাচক হয় না। অনেকের জন্য ইতিবাচক ভূমিকাও রাখে। জেলখানায় বসে অনেক ছোট বড় চুক্তিও বাস্তবায়ন হয়।

তাই কোন সমস্যা বিশেষত জাতীয় কোন সমস্যার সমাধানে জেলবন্দি করা প্রকৃত বা স্থায়ী সমাধান নয়। সাময়িক সমাধান মাত্র।

আমাদের দেশের অন্যতম একটি জাতীয় সমস্যা হচ্ছে ধর্মকেন্দ্রিক (যেমন ধর্ম অনুভূতি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, ধর্মের ব্যবহার, ধর্মের অপব্যবহার, সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, ধর্ম কেন্দ্রিক রাজনীতি, ধর্ম নিয়ে ব্যবসা, রাষ্ট্র, সরকার সংবিধান, আইন ও বিচার প্রভৃতি বিষয় গুলোকে ধর্মের মানদণ্ডে যাচাই করা, ঠিক বা বেঠিক ভাবা প্রভৃতি)

সেক্ষেত্রে সমাধানটা ভাবতে হবে ভিন্নভাবে, সকল দলের, মতের বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে সম্মিলিত ভাবে। সময় নিয়ে। এই জন্য একটি জাতীয় পরামর্শ ও বাস্তবায়ন কমিটি করা যেতে পারে। অন্তত কয়েকটি বিষয়ে জাতি-ধর্ম, দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ না থাকলে জাতি হিসেবে আমাদের স্বকীয়তা থাকবে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে ধর্ম বসবাস করে মানুষের অন্তরে। আর মানুষের অন্তর থেকে কখনো ধর্মকে মিটিয়ে ফেলা যায় না। উচিৎও নয়। যে অন্তরে ধর্ম নাই সে অন্তরে অধর্ম এসে বসবাস করে। ধর্মান্ধতা যেমন মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর, ধর্মহীনতাও মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর।

তবে পৃথিবীতে ধর্মের সৃষ্টি ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করার জন্য হলেও ধর্ম অনুসারীরা অনেক সময় ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যটা বুঝতে পারেনা। জ্ঞানহীন ধর্মচর্চাকারীরা ধর্মকে এমন ভাবে বিশ্বাস করে যে ধর্মের ভিতর তখন অর্ধম ঢুকলে গেলে সে আর ন্যায় আর অন্যায়ের পার্থক্য তৈরী করতে পারে না। তখন ধর্মীয় গুরুদেরকে ঈশ্বরের সমকক্ষ মনে করেন অথবা ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে এমনটা মনে করেন। কাজেই ধর্মীয় নেতাদের করা প্রত্যেকটি কাজকে মনে হয় নৈতিকভাবে বৈধ। তাদের বলা প্রতিটি কথাই ধর্মীয় গোষ্ঠীদের অত্যাবশ্যকীয় পালনীয় বিধান।

ইসলাম ধর্ম মতে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে অনেক আসমানী কিতাব প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু সেসব ধর্মের গুরু ও অনুসারীরা সেই গ্রন্থ গুলিকে বিকৃত করে ফেলেছে। তাই আল্লাহ তায়ালা অন্য নবী ও ধর্মগ্রন্থ প্রেরণ করেছিলেন, যেমন তাওরাত-যাবুর-ইঞ্জিল।সর্বশেষ তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে প্রেরণ করেছেন পবিত্র ইসলাম ধর্ম দিয়ে। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) অসংখ্য হাদিস বলে গেছেন। যার মধ্যে অন্যতম একটি হাদিস হচ্ছে “আমার অনুসারীরা ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, যার মধ্যে ৭২ দলই হবে জাহান্নামি”। অর্থ্যৎ ইসলাম ধর্মের অনুসারি ৭২টি দলই হবে জাহান্নামি।

হাদিসটি এরূপ: হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-আমার উম্মত তা’ই করবে যা করেছে বনী ইসরাঈলের লোকেরা। এক জুতা অপর জুতার সমান হওয়ার মত। এমনকি যদি ওদের মাঝে কেউ মায়ের সাথে প্রকাশ্যে জিনা করে থাকে, তাহলে এই উম্মতের মাঝেও এরকম ব্যক্তি হবে যে একাজটি করবে। আর নিশ্চয় বনী ইসরাঈল ছিল ৭২ দলে বিভক্ত। আর আমার উম্মত হবে ৭৩ দলে বিভক্ত। এই সব দলই হবে জাহান্নামী একটি দল ছাড়া। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন-সেই দলটি কারা? নবীজী (সাঃ) বললেন-যারা আমার ও আমার সাহাবাদের মত ও পথ অনুসরণ করবে।

(সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-২৬৪১)

এই ৭২টি দলেরর সবকটিই কিন্তু ইয়াহুদী, মুশরেক, কাফেরা তৈরী করবে না। করবে ইসলামের অনুসারী একদল জ্ঞানী বা আলেম। কারণ সাধারণ মানুষের পক্ষে কোন মতবাদ সৃষ্টি করার জ্ঞান থাকে না। এবার আমাদের দেশে কতগুলি ধর্মীয় উপদল আছে চিন্তা করে দেখুন। আল্লাহ তায়ালাই ভালো বলতে পারবেন কোন জান্নাতি কোন দল জাহান্নামি।

একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের সবসময় অনুসন্ধান করতে হবে কোন দলটি জান্নাতি। নিজ দলের নীতি আদর্শের প্রতি অটল থাকার পরও আমাদের সবসময় অনুসন্ধান করতে হবে আমরা যা করছি বা যা ভাবছি তা কি সত্যি সঠিক কিনা। পাশাপাশি সত্য পথ অনুসন্ধানের জন্য মহান আল্লাহতালার কাছে দোয়া করতে হবে “হে আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথ দেখান- আমাদেরকে সব সময় সঠিক পথে পরিচালিত করুন। ”

অপর এক হাদিসে জানাযায় যে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম আল্লাহ তায়ালা একদল আলেমকে দোজখে নিক্ষেপ করবেন। অপর আরেক হাদিসে নবী (সাঃ) বলেন কিছু আলেম এমন হবেন যে নিজেও জাহান্নামে যাবেন আবার তার সকল অনুসারীকে নিয়ে যাবেন।

আবূ জার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “আমি নবীজী(স) এর নিকট একদিন উপস্থিত ছিলাম এবং তাকে বলতে শুনেছি,“এমন কিছু রয়েছে যেটির ব্যাপারে আমি আমার উম্মাহ্-এর জন্য দাজ্জাল অপেক্ষাও অধিক ভয় করি।’ তখন আমি ভীত হয়ে পড়লাম,তাই আমি বললাম, ‘ হে আল্লাহর রসূল(স)! এটি কোন জিনিস, যার ব্যাপারে আপনি আপনার উম্মাহ্-এর জন্য দাজ্জালের চাইতেও অধিক ভয় করেন। তিনি (নবীজী-(সাঃ) বললেন,“পথভ্রষ্ট আলেমগণ।”

—মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২০৩৩৫

তাবেঈ যিয়াদ ইবনু হুদাইর (রাঃ) বলেন, ওমর (রাঃ) আমাকে বলেছেন, তুমি কি জান, ইসলামকে কিসে ধ্বংস করে? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, আলেমদের পদস্খলন, আল্লাহর কিতাব নিয়ে মুনাফিকের বাদ-প্রতিবাদ এবং নেতাদের শোষণ’ (দারেমী, মিশকাত হা/১৬৯, সনদ ছহীহ)।

হযরত মুয়াজ (রা.) রাসূল (সা.) এর কাছ থেকে কিয়ামতের দিন প্রথম তিনজন জাহান্নামে প্রবেশকারী ব্যক্তির উল্লেখ করে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এই তিনজন ব্যক্তির মধ্যে একজন আলেম, একজন দানবীর ও একজন শহীদ থাকবে। যারা দুনিয়াতে তাদের কর্মের জন্য খুবই উচ্চ মর্যাদার অধিকারী থাকবে। কিন্তু তাদের কাজের নিয়তের ত্রুটির কারণে তারা জাহান্নামী হিসেবে গণ্য হবে। হাদীসটি সহীহ মুসলিম ও জামি তিরমিযিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইসলাম ধর্মকে সঠিক ভাবে বোজার জন্য একজন আলেমের কাছে যাওয়ার যেমন বিকল্প নেই, তেমনি ভাবে কাউকে অন্ধভাবে অনুসরণ করার সুযোগও নেই। একজন আলেম কে আপনি ততক্ষণ অনুসরণ করতে পারবেন যতক্ষণ তিনি প্রকৃত ইসলামের উপর থাকবেন। আর একজন আলেম ইসলামের উপর আছেন কিনা তা জানতে আপনাকে কোরআন হাদিসের দলিল দিয়ে মাপতে হবে।

নিজের ব্যক্তিগত মত, দলের অন্ধ অনুসরণ, নেতার অন্ধ অনুসরণের মাধ্যমে একজন আলেমের প্রকৃত স্বরূপ অনুধাবন করতে পারবেন না। তাই নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে জাগ্রত করুন, জ্ঞানকে প্রসারিত করুন, আর ভাবুন আপনি সঠিক পথে আছেন কি’না।

(চলবে)
“আলোর পথের সন্ধানে”
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
২০ এপ্রিল ২০২১খি.
ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

Some text

ক্যাটাগরি: মতামত, সমকালীন ভাবনা

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি