সাধারণ মানুষ হুজুগে এবং গুজবে হয়। এরা চট করে মিথ্যাকে বিশ্বাস করে। সত্যকে খুব সহজে বিশ্বাস করে না। যতই তথ্য-প্রমাণ বা যুক্তি দেওয়া হোক সত্যকে সহজে স্বীকার করতে চায় না।
সাধারণ মানুষের মনের ভিতর লুকিয়ে থাকে হিংসা, বিদ্ধেষ, ধর্মীয় অনুভুতি, দেশপ্রেম, জাতীয়তা বোধ, গোষ্ঠী চেতনা এবং সরলতা। সাধারণ মানুষদের এসব ইতিবাচক ও নেতিবাচক বোধ সমূহকে কাজে লাগিয়ে যেকোনো কাজ করানো সম্ভব। ভালো কাজ করানো যেমন সম্ভব, তেমনি খারাপ কাজ করানোও সম্ভব। অর্থাৎ তাদের মধ্যে একবার কোন বিষয়ে একটি চেতনা জাগ্রত করাতে পারলে আপনার আর কিছু করার দরকার নেই। বাকিটা তারা নিজেরাই করে নিবে। তখন এরা মরতেও ভয় পায়, না মারতেও পিছপা হয়না।
এদেরকে যদি কেউ একবার বোঝাতে পারে তাহলে এরা পাহাড় কেটে নদী বানাবে। আর কাটা পাহাড়ের মাটি দিয়ে অন্য কোন নদী ভরাট করে আবার পাহাড় বানাবে। আপনি তাদেরকে বোঝাতে পারবেন না যে, এতে তোমাদের কি লাভ হলো ? এই যে তোমরা পাহাড় কেটে নদী বানালে আর নদী ভরাট করে আবার পাহাড় বানালে এতো তোমার কোন লাভ হলো না। তোমাদের হিসেবের খাতায় একটি পাহাড় আর একটি নদীই থাকলো। শুধু শুধু প্ররিশ্রম করলে, ত্যাগ স্বীকার করলে। তখন তারা বলবে আমাদের নেতা বলেছে তাই আমরা করেছি। আপনি কি আমাদের নেতা থেকে বেশি বোঝেন। না আপনি তাদের নেতা থেকে বেশি বোঝেন না। তাই আপনি আর কথা বাড়াতে পারবেন। বললে নেতা ভক্ত এই জনতা আপনাকে হত্যা করতেও বিন্দুমাত্র চিন্তা করবে না।
আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা এবং ধর্মীয় নেতারা এবিষয়টি ভালো করেই বোঝেন। এজন্যই তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি, প্রচার-প্রচারণা, ওয়াজ-মাহফিলের বিরাট একটি অংশ থাকে শুধু সাধারণ মানুষকে বোঝানো আর কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা। কারণ তারা জানেন সমাজের জ্ঞানীদেরকে সহজে কোনো ভালো কাজ বা খারাপ কাজে লাগানো যায় না। কারণ জ্ঞানীরা প্রমাণ খোঁজেন, যুক্তি খোঁজেন, লাভ-ক্ষতির হিসেব করেন, অতীত ও বর্তমানের কথা চিন্তা করেন। একটু বেশি জ্ঞানী হলে সুদূর-অদূর ভবিষ্যতের কথাও চিন্তা করেন।
নানান যুক্তি,তথ্য প্রমাণ দিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে বোজানোর চেষ্টা করেন যে, তিনি যেটা বলছেন সেটাই সত্য ও সঠিক পথ এবং সেই পথেই আমাদের সকলকে চলতে হবে। সেই চেষ্টা তারা সমপর্যায়ের ভিন্ন মতালম্বী কোন জ্ঞানীকে বোজানোর চেষ্টা করেন না। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক মতাদর্শের এতোযে ভিন্নতা এই ভিন্নতা কিন্তু সাধারণ মানুষ তৈরী করেনি, করেছে নিজেদের জ্ঞানী দাবি করা ব্যক্তিরাই। আবার তারাই সাধারণ মানুষদের ঐক্যর ডাক দেয়।
লেখকের অন্যান্য লেখা
অতীত থেকে বর্তমান সাধারণ মানুষের এই ইতিবাচক ও নেতিবাচক বোধ সমূহকে কাজে লাগিয়ে, গুজবে স্বভাব, সরলতা, ধর্মবিশ্বাস বা জাতিগত চেতনা ও দেশ প্রেম কে কাজে লাগিয়ে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, যুদ্ধ-বিগ্রহ করা হয়েছে। আমাদের উপমাদেশের গত আড়াইশত বছরের বিভিন্ন আন্দোলনের ইতিহাস সে কথাই প্রমাণ করে।
সে সবের মধ্যে যাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য মহৎ ছিল। যারা ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কল্যাণের কথা চিন্তা করেছে তাদের দ্বারা সংগঠিত আন্দোলন দেশ জাতি ও সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছে। কিন্তুু যাদের উদ্দেশ্য ছিল খারাপ বা ব্যক্তি স্বার্থ সংযুক্ত ছিলো সেগুলো দেশ-জাতির জন্য অকল্যাণ করে গেছে।
সাধারণ মানুষদের ব্যবহার করে আন্দোলন সংগ্রামের এই ধারাবাহিকতা চলতেই থাকবে। কারণ সাধারণ মানুষ চিরকাল সাধারণই থেকে যাবে। আর অসাধারণ মানুষগুলি তাদের ব্যবহার করতেই থাকবে। সাধারণ মানুষ চিরোকালই ভাঙ্গা গড়ার খেলোয়ার আর অসাধরণরাই হবে সেই খেলার পরিচালক।
এই অবস্থার পরিবর্তন ততক্ষণ পর্যন্ত হবে না যতকক্ষণ পর্যন্ত কোন দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী পরিপূর্ণ শিক্ষায় শিক্ষিত না হবে। “পরিপূর্ণ শিক্ষা” বলতে আধুনিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর এবং নৈতিকতা বা ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থাকে বোজাচ্ছি।
আধুনিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যতিত শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা যেমন সমাজের জন্য মঙ্গল জনক নয়, তেমনি নৈতিকতা বা ধর্মীয় মূল্যবাধ না থাকলে আধুনিক শিক্ষাও সমাজের জন্য মঙ্গল জনক নয়। দুটি ব্যবস্থার সমন্বয় না থাকলে কোন জাতী নিজেই তার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে।
সংযুক্তি
আমার মাঝেমধ্যে আফসোস হয় এই ভেবে আমি কিছু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদেরকে চিনি তারাও খুব সহজে হুজুগে মাতাল হন, গুজবে মাতেন। মিথ্যাটাকে সহজেই বিশ্বাস করেন। আবার সত্যকে বিশ্বাস করার জন্য তথ্য খোঁজেন। সর্বোপরি বৃহৎ লাভের চিন্তা না করে ক্ষুদ্রতম স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দেন। তাদেরকে আসলে “সাধারণ” না “অসাধারণ” কি বলা যায় তা আর ভেবে পাইনা।
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ: কবি, সংস্কৃতিকর্মী
০৭ এপ্রিল ২০২১ খি.
ব্রাহ্মণবাাড়িয়া
Some text
ক্যাটাগরি: সমকালীন ভাবনা
[sharethis-inline-buttons]