লেখকের কথা
কলকাতার জোড়া সাঁকোতে রবীন্দ্রনাথের জন্ম হলেও কবির মানস নির্মাণে বাংলাদেশের পরিবেশ প্রকৃতি মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। তিনি বাংলাদেশে বালকরূপে এসেছেন। এসেছেন জমিদাররূপে। কবি হয়ে এসেছেন। মৃণালিনী দেবীর সংসারের কর্তারূপে এসেছেন। এসেছেন নোবেল বিজয়ীরূপে।
বাংলাদেশের নানান জেলার নদী, হাওড় ; পদ্মা, গড়াই, ইছামতি, নাগর, আত্রাই, করতোয়ার সাথে মিশে আছে রবীন্দ্র জীবনের শত সহস্র স্মৃতি। বাঙালির চেতনায় রবীন্দ্রনাথ অম্লান। তাঁর রচিত গান, গল্প কবিতা ও নাটকে পাঠকমাত্রই খুঁজে পান শ্যামলিমা এক বাংলাদেশ। রবীন্দ্রনাথের পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে এই বাংলা। তাঁর চোঁখেই প্রথম এদেশ ধরা দিয়েছে সোনার বাংলা রূপে। আশা করি রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত ‘রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বাংলাদেশ’ পাঠকের ভাল লাগবে।
এস এম শাহনূর
১৬ ডিসেম্বর ২০
সূচীপত্র:
রবীন্দ্র জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাল-তারিখ:
কসবার অখিলচন্দ্র দত্ত ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক:র
রবীন্দ্র জীবনে ৭বার আগরতলা ভ্রমণকালে ৫ বারই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পদচিহ্ন রেখে গেছেন:
ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর দুর্ভাগ্য!
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত ব্রাহ্মণবাড়িয়া:
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য শিলাইদহ:
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য কাচারি বাড়ি (শাহজাদপুর):
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য কুঠিবাড়ি (পতিসর):
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য বরিশাল:
রবীন্দ্রনাথর স্মৃতিধন্য চট্টগ্রাম:
লালন ও রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথা:
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য খুলনার দক্ষিণডিহি:
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য পিঠাভোগ:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য সিলেট:
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য ঢাকা:
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য বলধা গার্ডেন:
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহ:
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য ঈশ্বরগঞ্জ:
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য কুমিল্লা:
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য চাঁদপুর:
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য নারায়ণগঞ্জ:
রবীন্দ্র জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাল-তারিখ:
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতে রবীন্দ্রনাথ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। তিনি গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল ফাউন্ডেশন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটিকে বর্ণনা করেছিল একটি “গভীরভাবে সংবেদনশীল, উজ্জ্বল ও সুন্দর কাব্যগ্রন্থ” রূপে। তিনি একাধারে বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, সংগীতস্রষ্টা, নট ও নাট্যকার, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তিনি বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’, ‘বিশ্বকবি’ ও ‘কবিগুরু’ অভিধায় অভিহিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর মোট ৯৫টি ছোটগল্প এবং ১৯১৫টি গান যথাক্রমে ‘গল্পগুচ্ছ’ ও ‘গীতবিতান’ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত এবং গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২টি খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য ১৯ খণ্ডে ‘চিঠিপত্র’ সংকলনে ও অন্য চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। ৭০ বছর বয়সে লেখার কাটাকুটিকে একটা চেহারা দেবার চেষ্টা থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার শুরু। তারপরেও তিনি প্রায় দু হাজার ছবি এঁকেছিলেন।রবীন্দ্রনাথের লেখা ইংরেজি, ডাচ, জার্মান, স্প্যানিশসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় ভাষায় অনুদিত হয়েছিল। তাঁর রচনা আজ বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। তাঁর সমসাময়িক বহু বিদেশি কবি, সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিককে তিনি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদি শৈলীর দুরূহতাকে চূর্ণ করে বাংলার শিল্পকলাকে আধুনিক করে তোলেন।রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক মতাদর্শ বিমূর্ত রয়েছে বহুবর্ণী সৃষ্টিকর্ম ও প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতীর মধ্যে।
জীবনের শেষ চার পাঁচ বছর ধারাবাহিকভাবে নানা অসুস্থতায় ভুগেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু লেখালেখি তিনি কখনও থামাননি। মৃত্যুর সাতদিন আগে পর্যন্তও তিনি ছিলেন সৃষ্টিশীল।
১৮৬১ সালের ৭ মে; (২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
গবেষকদের মতে, রবীন্দ্রনাথ মাত্র ৭ বছর বয়সে স্বকণ্ঠে জীবনের প্রথম গানটি গান। সে গানটি হলো তার খুড়তুতো দাদা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম আননে’ গানটি।
১৮৬৯ সালে ৮ বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন।
১৮৭৩ সালে ১২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি পিতার সঙ্গে কয়েক মাসের জন্য কলকাতার বাইরে (শান্তিনিকেতনের পারিবারিক এস্টেটে।) যাওয়ার সুযোগ হয় রবীন্দ্রনাথের।
১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়-তার প্রথম প্রকাশিত রচনা “অভিলাষ” কবিতাটি প্রকাশিত হয়।
১৮৭৫ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের
মাতৃবিয়োগ ঘটে।
১৬ বছর বয়সে জীবনের প্রথম মঞ্চ অভিনয় করেছিলেন। নিজের লেখা নাটকে প্রথম অভিনয় করেছিলেন ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় বাল্মীকির ভূমিকায়। অভিনয়ের জন্যে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং মঞ্চে অবতীর্ণ হন মোট ১০১ বার।
১৮৭৭ সালে ভারতী পত্রিকায় তরুণ রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। এগুলি হল মাইকেল মধুসূদনের “মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা”, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী এবং “ভিখারিণী” ও “করুণা” নামে দুটি গল্প। এর মধ্যে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কবিতাগুলি রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলির অনুকরণে “ভানুসিংহ” ভণিতায় রচিত।
রবীন্দ্রনাথের “ভিখারিণী” গল্পটি (১৮৭৭) বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটগল্প।
১৮৭৮ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ব্যারিস্টার হওয়ার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে।
১৮৭৮ সালে ৫ নভেম্বর প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ তথা প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ ‘কবিকাহিনী’। কবিবন্ধু প্রবোধচন্দ্র ঘোষ কবির অজান্তে বইটি প্রকাশ করে বিদেশে কবির কাছে পাঠিয়েছিলেন।
১৮৭৮ সালে বড়োদিনটি পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কাটানোর পর রবীন্দ্রনাথ দাদার এক বন্ধুর সঙ্গে চলে আসেন লন্ডনে।
১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি।
১৮৮০ সালে প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে এবং ব্যারিস্টারি পড়া শুরু না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।
১৮৮১ সালে পত্রাবলি ইউরোপ-প্রবাসীর পত্র নামে গ্রন্থাকারে ছাপা হয়। এটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যগ্রন্থ তথা প্রথম চলিত ভাষায় লেখা গ্রন্থ।
১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর (১৮৭৩–১৯০২ )।সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ সম্পন্ন হয়।বিবাহিত জীবনে ভবতারিণীর নামকরণ হয়েছিল মৃণালিনী দেবী।
১৮৮৪ সালে নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু বহু বছর রবীন্দ্রনাথের মনকে অশান্ত করে রেখেছিল। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও এই মৃত্যু চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যায়।
১৮৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জন্মদিন পালন করা হয়েছিল। পার্ক স্ট্রিটে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে। সেই প্রথম জন্মোৎসব পালনের কৃতিত্ব দাবি করেছেন রবীন্দ্রনাথের ভাগনি, সরলা দেবী চৌধুরাণী।
১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন।
১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে পারিবারিক জমিদারির তত্ত্বাবধান শুরু করেন। বর্তমানে এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত।
১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথের অপর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ মানসী প্রকাশিত হয়। কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে তার আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ও গীতিসংকলন প্রকাশিত হয়েছিল।
১৮৯১ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত নিজের সম্পাদিত সাধনা পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু উৎকৃষ্ট রচনা প্রকাশিত হয়। তার সাহিত্যজীবনের এই পর্যায়টি তাই “সাধনা পর্যায়” নামে পরিচিত।
১৮৯৮ সালে তার স্ত্রী ও সন্তানেরাও চলে আসেন শিলাইদহে। “জমিদার বাবু” নামে পরিচিত হন রবীন্দ্রনাথ।
১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহ ছেড়ে চলে আসেন বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের উপকণ্ঠে শান্তিনিকেতনে।(এখানে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৮ সালে একটি আশ্রম ও ১৮৯১ সালে একটি ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।আশ্রমের আম্রকুঞ্জ উদ্যানে একটি গ্রন্থাগার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালু করলেন “ব্রহ্মবিদ্যালয়” বা “ব্রহ্মচর্যাশ্র” নামে একটি পরীক্ষামূলক স্কুল। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।
৬৭ বছর বয়স থেকে নিয়মিত ছবি আঁকতে শুরু করেন। ১৯০১ থেকে ১৯৪০, এই চল্লিশ বছরে সাদা কালো ও গাঢ় রঙে ছোট বড় মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ ছবি এঁকেছিলেন প্রায় ৩ হাজার।
১৯০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী মারা যান।
১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কন্যা রেণুকার মৃত্যু হয়।
১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হয়।
১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়।
১৯০১ সালে নৈবেদ্য ও ১৯০৬ সালে খেয়া কাব্যগ্রন্থের পর ১৯১০ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়
১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
➤১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথের গাওয়া প্রথম ডিস্ক বের হয়। একপিঠে ছবি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বান্দেমাতরম’ অন্যপিঠে স্বরচিত ‘সোনার তরী’ কবিতার আবৃত্তি।
➤১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ স্থাপন করেন ‘পতিসর কৃষি ব্যাংক’। রবীন্দ্রনাথ তার নোবেল প্রাইজের এক লক্ষাধিক টাকা সেই ব্যাংকেই ঢালেন। সেখান থেকে কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হতো। ব্যাংকটি চলেছিল কুড়ি বছর।
১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ তার জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান আধুনিক কৃষি ও গোপালন বিদ্যা শেখার জন্য।
১৯০৭ সালে কনিষ্ঠা জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কেও কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
১৯১২ সালে ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্য তৃতীয়বার ইংল্যান্ডে গিয়ে ইয়েটস প্রমুখ কয়েকজন ইংরেজ কবি ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে সদ্যরচিত গীতাঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে শোনান।
১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি (ইংরেজি অনুবাদ, ১৯১২) কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য সুইডিশ অ্যাকাডেমি রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে।গ
১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৯১৬-১৭ সালে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কতকগুলি বক্তৃতা দেন।এই বক্তৃতাগুলি সংকলিত হয় তার ন্যাশনালিজম (১৯১৭) গ্রন্থে।
১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনের অদূরে সুরুল গ্রামে মার্কিন কৃষি-অর্থনীতিবিদ লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতনের আরও কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রের সহায়তায় রবীন্দ্রনাথ “পল্লীসংগঠন কেন্দ্র” নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ”পল্লীসংগঠন কেন্দ্র”এই সংস্থার নাম পরিবর্তন করে রাখেন “শ্রীনিকেতন”
১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়।
দীর্ঘজীবনে তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন।
১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ বিহার প্রদেশে ভূমিকম্পে শতাধিক মানুষের মৃত্যুকে গান্ধীজি “ঈশ্বরের রোষ” বলে অভিহিত করলে, রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজির এহেন বক্তব্যকে অবৈজ্ঞানিক বলে চিহ্নিত করেন এবং প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করেন।
১৯২০-২১ সাল নাগাদ আবার ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান কবি।এই সফরের সময় পাশ্চাত্য দেশগুলিতে তিনি সংবর্ধিত হয়েছিলেন।
১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যান চীন সফরে।এরপর চীন থেকে জাপানে গিয়ে সেখানেও জাতীয়তাবাদবিরোধী বক্তৃতা দেন কবি।
১৯২৪ সালের শেষের দিকে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশে যাওয়ার পথে আর্জেন্টিনায় অসুস্থ হয়ে কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্যে তিন মাস কাটান।স্বাস্থ্যের কারণে পেরু ভ্রমণ তিনি স্থগিত করে দেন।
১৯২৬ সালে বেনিতো মুসোলিনির আমন্ত্রণে ইতালি সফরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।প্রথমে মুসোলিনির আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলেও, পরে লোকমুখে তার স্বৈরাচারের কথা জানতে পেরে, মুসোলিনির কাজকর্মের সমালোচনা করেন কবি।
১৯২৭ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ চার সঙ্গীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরে। এই সময় তিনি ভ্রমণ করেন বালি, জাভা, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম ও সিঙ্গাপুর।
১৯৩০ সালে কবি শেষবার ইংল্যান্ডে যান অক্সফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতা দেওয়ার জন্য।এরপর তিনি ভ্রমণ করেন ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৩২ সালে ইরাক ও পারস্য ভ্রমণে গিয়েছিলেন কবি।
১৯৩৪ সালে সিংহলে যান রবীন্দ্রনাথ। এটিই ছিল তার সর্বশেষ বিদেশ সফর।
১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তার বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন বিশ্বপরিচয়।এই গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিকতম সিদ্ধান্তগুলি সরল বাংলা গদ্যে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল কবির।
১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সেরে উঠতে পারেননি।
১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) দীর্ঘ রোগ ভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই তাঁর মৃত্যু হয়।
কসবার অখিলচন্দ্র দত্ত ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক:
অবিভক্ত ভারতবর্ষে কুমিল্লার খ্যাতনামা রাজনীতিক কংগ্রেস নেতা অখিলচন্দ্র দত্ত। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলাধীন চারগাছ গ্রামে তাঁর জন্ম।তিনি এক সময় ভারতীয় বিধান সভার স্পিকার ছিলেন।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবি পরিবারের সাথে অখিলচন্দ্র দত্তের ছিল এক রসালো বন্ধন।কবি ও কবি পরিবারের সাথে অখিলচন্দ্র দত্তের এ সম্পর্ক একজন সাহিত্যপ্রেমী হিসাবে আমাকে আবেগতাড়িত করে।ব্রাহ্মণবাড়িয়া তথা কসবাবাসীকে গৌরবান্বিত করে।শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও সমগ্র বিশ্বের রবীন্দ্র গবেষকদের কাছে ‘অখিলচন্দ্র দত্ত’ নামটির মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক অনন্য পরিচয় ফুটে উঠে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তির পর তিনি হয়ে উঠেন বিশ্বকবি। পৃথিবীর নানা প্রান্তে তাঁর ডাক পড়ে।তাঁর মুখের কথা ও বক্তৃতা শোনার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রণ পত্র আসতে শুরু করে। বছরের পর বছর ঘুরেঘুরে শুনিয়েছেন অমিয় বানী। বিশ্বভ্রমণের অংশ হিসাবে ১৯২৬ সালে ঢাকাবাসী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রনে তিনি বাংলাদেশে আসেন।
১৯ ফেব্রুয়ারি কবি কুমিল্লায় আসেন। কুমিল্লা ‘অভয় আশ্রমে’ র প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি (পরে পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী) সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৭-১৯৬১) কবিকে কুমিল্লায় আসার আমন্ত্রণ জানান।
কবিগুরু কুমিল্লায় আসার পূর্বে কবির কুমিল্লা সফরের ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্ভবত কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ অখিল দত্তকে তার (টেলিগ্রাম) করেছিলেন। অখিলবাবু তখন কুমিল্লায় ছিলেন না। তবে টেলিগ্রাম পেয়েই মিসেস দত্ত অভয় আশ্রমের সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে খবর দিয়ে সব জানিয়েছিলেন। অখিলবাবু কুমিল্লায় প্রত্যাবর্তন করে কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথের তারবার্তা প্রেরণের জবাবে ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬-এ কুমিল্লা থেকে একটি চিঠি লেখেন।
এই চিঠিতে জানান যে, ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাউন্সিলের সভা চলবে। তাই কবি ও তাঁর সফরসঙ্গীদের কুমিল্লায় ‘শুভাগমনের সময়’ অখিলবাবু কুমিল্লায় থাকতে পারবেন না। তবে কলকাতায় যাওয়ার আগে অখিলবাবু কুমিল্লায় কবির অনুষ্ঠানসূচি ঠিক করে যাবেন।
কুমিল্লায় রবীন্দ্রনাথের অবস্থানকালে ২১ ফেব্রুয়ারী অভয় আশ্রমে সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রী গৌরাঙ্গ মঞ্চস্থ হয়েছিল। কবি অভিনয় উপভোগ করেন। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সফর-সঙ্গীদের অখিল বাবুর দত্তবাড়িতে আপ্যায়ন করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ ও রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরেও অখিলচন্দ্রের যোগাযোগের কথা জানা যায়। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর মহাফেজখানায় (রেকর্ড রুম) ৮ জানুয়ারি ১৯৪০ তারিখে অখিলচন্দ্রকে লেখা কবির একটি চিঠির সচিবকৃত অনুলিপি, ১৯৩৭-এর ১৪ সেপ্টেম্বর সিমলা থেকে শান্তিনিকেতনে প্রেরিত একটি এবং ১৯৪১-এর ৯ মে কুমিল্লা থেকে বোলপুরে প্রেরিত আরেকটি টেলিগ্রাম রক্ষিত আছে।
প্রথম তারে অখিল দত্ত রথীবাবুকে বার্তা পাঠালেন, ‘Anxious poet’s health. Praying recovery.’
দ্বিতীয় তারে কবির নিকট মিসেস দত্ত ও অখিলবাবুর বার্তা, ‘Our fervent prayer for many more birthdays. India needs inspiration from you in all spheres.’
পত্র :
Legislative Council কুমিল্লা
Bengal ১০/২/২৬
প্রিয় রথীন্দ্রবাবু,
আমি আজ ৫ দিন পর এখানে আসিয়া আপনার টেলিগ্রাম পাইলাম। কিন্তু আমার স্ত্রী আপনার টেলিগ্রাম পাইয়াই অভয়াশ্রমের শ্রীযুক্ত সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে খবর দিয়া সব কথা জানাইয়াছেন। সুরেশ বাবু ইতিমধ্যে অবশ্য পত্র লিখিয়াছেন। আশা করি তাঁদের অনুরোধ রক্ষা করা অসম্ভব হইবে না।
১৬ই ফেব্র“য়ারি কাউন্সিলের মিটিং আরম্ভ হইবে। ২০শে ফেব্র“য়ারি হইতে Bengal Tenancy Amendment Bill-এর Select committee-এর মিটিং আরম্ভ হইয়া ২৭শে তারিখ পর্যন্ত চলিবে। কাজেই কুমিল্লায় আপনাদের শুভাগমনের সময় আমি কুমিল্লায় থাকিতে পারিব না। ইহা আমার পক্ষে নিতান্ত ক্ষোভের বিষয়। একথা বলাই বাহুল্য। আশা করি আপনারা আমার এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি মার্জ্জনা করিবেন।
আমি কলিকাতায় যাওয়ার পূর্ব্বে এখানকার প্রোগ্রাম ঠিক করিয়া যাইব এবং আপনাকে পুনরায় পত্র লিখিব।
ইতি
ভবদীয়
শ্রী অখিলচন্দ্র দত্ত
তথ্য ঋণ:
[১] অপ্রকাশিত পত্রগুচ্ছ: ভূঁইয়া ইকবাল
কালি ও কলম এ প্রকাশিত।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
রবীন্দ্রভবন, ড. শ্যামল চন্দ ও অর্জুন দত্ত।
রবীন্দ্র জীবনে ৭বার আগরতলা ভ্রমণকালে ৫ বারই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পদচিহ্ন রেখে গেছেন:
১৮৬২ সালে মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর পর বীরচন্দ্র সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ১৮৯৮ সালে মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের পুত্র রাধা কিশোর মহারাজ কলকাতা ও ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হন। ১৯০০ সালের শেষের দিকে রাধা কিশোরের নিমন্ত্রণে কবি প্রথম আগরতলা আসেন । ১৯ ফাল্গুন ১৩০৬ বঙ্গাব্দে কবি তৎকালীন মোগরা কসবা– বর্তমান আখাউড়া গঙ্গাসাগর রেলস্টেশনে নেমে আগরতলায় আসেন।
১৯০২ সাল ১৩০৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে কবি দ্বিতীয়বার আগরতলায় আসেন।
১৯০৫ সালের,বাংলা ১৬ আষাঢ়ে তিনি তৃতীয়বার আগরতলায় আসেন।পরদিন সাহিত্য সম্মিলনে সভাপতিত্ব করেন।
চার মাস পর চতুর্থবার কবি চৈত্র মাসে আগরতলায় আসেন।ত্রিপুরার বাজেটে পরামর্শ ও কবির শাসননীতি রাজা পরবর্তীতে প্রয়োগ করেন।
২৫ চৈত্র ১৩১২ বঙ্গাব্দে ১৯০৬ সালে পঞ্চমবার তিনি আগরতলায় আসেন।বরিশালে সাহিত্য সম্মিলনিতে সভাপতিত্ব করার জন্য।
১৯১৯ সালের ৯ নভেম্বর সিলেট থেকে কবি ষষ্ঠবারের মত আগরতলায় আসেন।
সপ্তমবার ১৯২৬ সালে ঢাকা, ময়মনসিংহ, আঠারো বাড়ি হয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় অভয় আশ্রমে আসেন।২২ ফেব্রুয়ারি রাত ৯ টায় আখাউড়া স্টেশনে তাঁকে শোভাযাত্রার মাধ্যমে আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয়।মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর কবিকে আমন্ত্রণ জানান।কবিকে ভারত ভাস্কর উপাধি প্রদান করেন।১৫ মে রাজকুমারের সঙ্গে ইউরোপ ভ্রমণে যান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর দুর্ভাগ্য!
বাংলা সাহিত্যের দিকপাল নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলিতে দুইবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি ধন্য হলেও সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত ব্রাহ্মণবাড়ির সচেতন জনগণ কবিকে কোনো প্রকার সংবর্ধনা/ সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রথমবার
ত্রিপুরার আঞ্চলিক রবীন্দ্রশতবার্ষিকী উদযাপন পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত “রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা” নামে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে না হলেও এ জেলায় কবিগুরুর পদস্পর্শ সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। ত্রিপুরা মহারাজার আমন্ত্রনে প্রথমবার তিনি ত্রিপুরা আসেন ১৮৯৯ সালের ২৮ মার্চ,। কবিগুরু এসেছিলেন রেলে। তখনো আখাউড়া জংশন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আসাম বেংগল রেলের ছোট একটা স্টেশন মোগরা স্টেশন হয়ে তিনি আগরতলা পৌঁছে ছিলেন।১৮৯৬ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির অধীনে কুমিল্লা থেকে আখাউড়া রেলপথ সম্প্রসারণ করা হলে এখানে একটি রেলওয়ে স্টেশন স্থাপন করা হয় যা মোগড়া স্টেশন নামে পরিচিত ছিলো।এখন এটি গঙ্গাসাগর স্টেশন। গ্রন্থটির ৪৯ পৃষ্ঠায় বলা আছে “রেল স্টেশন মোগরা হইতে একমাত্র পথ । নৌকায়,হাতীর পিঠে অথবা পাল্কীতে পাঁচ মাইল পথ অতিক্রম করিতে হইবে। আখাউড়া রাস্তা বা আখাউড়া স্টেশন তখন ছিলনা। রাজধানীতে দুইটি মাত্র উল্লেখযোগ্য রাস্তা। রাজবাড়ীর পশ্চিমের দিঘীর পশ্চিমপাড় বাহী শকুন্তলা রাস্তা। ইহাই বর্তমান প্রসাদ তোরণের সম্মুখ দিয়া দক্ষিনবাহী রাস্তার পূর্ব্বদিকে শ্রীপাট।মহারানী তুলসীবতি বিদ্যালয়কে দক্ষিনে রাখিয়া পুরাতন পুলের উপরদিয়া বাজারে পৌঁছে। এই রাস্তা পূর্বদিকে পুরনো আগরতলার দিকে আর পশ্চিমবাহী মোগরার দিকে গিয়াছে।“ বর্তমান গঙ্গাসাগর স্টেশনকেই তখন মোগরা স্টেশন নামে ডাকা হত।
দ্বিতীয়বার
১৯১৯ সালের ৫ – ৮ নভেম্বর সিলেটে সংবর্ধিত হয়ে ৯ নভেম্বর নোবেলজয়ী কবি সিলেট থেকে রেলযোগে আখাউড়া হয়ে আগরতলা পোঁছেন।তখনও ঘুমিয়েছিল এতদ এলাকার সাহিত্যপ্রেমিগণ!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বাংলাদেশ:
অখন্ড ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী এক জনপদ আগরতলা। এই শহরেই একদিন অখণ্ড বাংলা থেকে তরুণ রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। সেটি ছিল বঙ্গাব্ধ ১৩০৬। নেমেছিলেন মোগড়ার রেল স্টেশনে, বর্তমান বাংলাদেশের আখাউড়া বা তার কাছাকাছি। কিশোর রবীন্দ্রনাথকে সর্বপ্রথম ‘কবি’ হিসেবে স্বীকৃতিদান করেন ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য।যাঁর কাব্যখ্যাতি তখন কেবলই পরিচিতজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষায়, “যে অপরিণত বয়স্ক কবির খ্যাতির পথ সম্পূর্ণ সংশয়সঙ্কুল ছিল, তার সঙ্গে কোন রাজত্ব গৌরবের অধিকারীর এমন অবারিত ও অহেতুক সখ্য-সম্বন্ধের বিবরণ সাহিত্যের ইতিহাসে অভূতপূর্ব।”
✪ ত্রিপুরার আঞ্চলিক রবীন্দ্রশতবার্ষিকী উদযাপন পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত “রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা” নামে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে না হলেও এ জেলায় কবিগুরুর পদস্পর্শ সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। ত্রিপুরা মহারাজার আমন্ত্রনে প্রথমবার তিনি ত্রিপুরা আসেন ১৮৯৯ সালের ২৮ মার্চ,। কবিগুরু এসেছিলেন রেলে। তখনো আখাউড়া জংশন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আসাম বেংগল রেলের ছোট একটা স্টেশন মোগরা স্টেশন হয়ে তিনি আগরতলা পৌঁছে ছিলেন।১৮৯৬ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির অধীনে কুমিল্লা থেকে আখাউড়া রেলপথ সম্প্রসারণ করা হলে এখানে একটি রেলওয়ে স্টেশন স্থাপন করা হয় যা মোগড়া স্টেশন নামে পরিচিত ছিলো।এখন এটি গঙ্গাসাগর স্টেশন। গ্রন্থটির ৪৯ পৃষ্ঠায় বলা আছে “রেল স্টেশন মোগরা হইতে একমাত্র পথ । নৌকায়,হাতীর পিঠে অথবা পাল্কীতে পাঁচ মাইল পথ অতিক্রম করিতে হইবে। আখাউড়া রাস্তা বা আখাউড়া স্টেশন তখন ছিলনা। রাজধানীতে দুইটি মাত্র উল্লেখযোগ্য রাস্তা। রাজবাড়ীর পশ্চিমের দিঘীর পশ্চিমপাড় বাহী শকুন্তলা রাস্তা। ইহাই বর্তমান প্রসাদ তোরণের সম্মুখ দিয়া দক্ষিনবাহী রাস্তার পূর্ব্বদিকে শ্রীপাট।মহারানী তুলসীবতি বিদ্যালয়কে দক্ষিনে রাখিয়া পুরাতন পুলের উপরদিয়া বাজারে পৌঁছে। এই রাস্তা পূর্বদিকে পুরনো আগরতলার দিকে আর পশ্চিমবাহী মোগরার দিকে গিয়াছে।“ বর্তমান গঙ্গাসাগর স্টেশনকেই তখন মোগরা স্টেশন নামে ডাকা হত।
✪ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৮ সালে প্রথম ঢাকায় আসেন। প্রথমবারের সফর ছিল মাত্র তিন দিনের। দ্বিতীয় দিন বিক্রমপুরের ভাগ্যকুলের জমিদারদের সৌজন্যে বুড়িগঙ্গায় বিশাল এক স্টিমার পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত হয়ে ভাগ্যকুলের ধনাঢ্য জমিদারদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন।
জীবদ্দশায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৮ ও ১৯২৬ সালে ঢাকায় আসেন। প্রথমবার তিনি এসেছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের দশম অধিবেশনে যোগদান করতে। এই সফরকালে ঢাকা ক্রাউন থিয়েটার হলে ৩০ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত মোট তিন দিন অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি অংশ নেন সম্মেলনে। বিশ্বকবির এই আগমন নিয়ে খুব একটা মাতামাতির খবর জানা যায়না।
গোপালচন্দ্র রায়ের ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৬ সালের ৭ জানুয়ারি কলকাতা থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ, সেখান থেকে স্টিমারযোগে নারায়ণগঞ্জ এবং মোটর শোভাযাত্রা করে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তাঁর সফরসূচি ছিল ৯ দিনের। রবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় আনার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (পরে উপাচার্য হন) ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের বিশেষ অবদান ছিল।
রবীন্দ্রনাথ শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেহমান নন, সারা ঢাকাবাসীর মেহমান হয়ে আসেন। তিনি বুড়িগঙ্গা নদীর ওয়াইজ ঘাটে বাঁধা ঢাকার নবাবদের রাজকীয় জলযান তুরাগ হাউস বোটে ওঠেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ১৯৩৬ সালে ডি লিট উপাধি প্রদান করলেও সেবার তিনি আসেননি। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬-এর ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল নর্থব্রুক হলে সংবর্ধনা গ্রহণ দিয়ে ঢাকা কর্মসূচি শুরু করলেও ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের (এখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) কর্মসূচি দিয়েই মূলত তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কর্মসূচির সূচনা। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে তিনি ময়মনসিংহের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। মূলত ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর—সাড়ে চার দিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়মণ্ডলীর কেন্দ্রীয় অতিথি ছিলেন।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় এসেছিলেন দুইবার। প্রথম বার ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দিতে; দ্বিতীয়বার এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ঢাকাবাসীদের আমন্ত্রণে।
এক.
১৮৯৮ সাল (বাংলা ১৩০৫)। ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন। সে বছরই ২১ মে (৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৫, শনিবার) ভারতীয় ত্রাণ সমিতি (ইন্ডিয়ান রিলিফ সোসাইটি)-এর সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে ছিলেন আশুতোষ চৌধুরী, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, গগনেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ প্রমুখ। সম্মেলনের সভাপতি মনোনীত হন রেভারেন্ড কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ৩০ মে – ১ জুন, ১৮৯৮(১৭-১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৫) এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের আয়োজন হয়েছিল ঢাকার ক্রাউন থিয়েটারে।
সম্মেলনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যান্য প্রতিনিধির সঙ্গে ২৯ মে (১৬ জ্যৈষ্ঠ, রবিবার) কলকাতা থেকে ঢাকা আসেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ, যোগেন্দ্রনাথ চৌধূরী প্রমুখ।
সম্মেলন শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১ জুন (১৯ জ্যৈষ্ঠ, বুধবার) রাতেই শিলাইদহের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন।
দুই.
১৯২৬ সাল (বাংলা ১৩৩২)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। একই সময়ে ঢাকাবাসী এবং ঢাকার বিভিন্ন সংগঠনও তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানায় ।
৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬ সাল (২৪ মাঘ, ১৩৩২)। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসেন। ঢাকা সফরে তার সফরসঙ্গী ছিলেন রথীন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ, কালীমোহন ঘোষ, হিরজিভাই মরিস ফর্মিকি ও তুচ্চি প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, মুসলিম হল ছাত্র সংসদ, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, ঢাকা পৌরসভা, হিন্দু-মোসলেম সেবা সংঘ, পিপলস এসোসিয়েশন, রেটপেয়ার্স এসোসিয়েশন, দিপালী সংঘ, পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্ম সমাজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় সংবর্ধনা দেয়। অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ, ঢাকা হল সমিতি, লালেগ্রা ক্লাব, ইডেন গার্লস স্কুল ও কলেজ, সাহিত্য পরিষদ ঢাকা শাখা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আয়োজিত নৈশভোজে যোগ দিতে পারেনি। সংবর্ধনার জবাবে দেওয়া ভাষণেও তিনি অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেছেন। সে সময় আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃতবাজার পত্রিকা, দ্য মুসলমান, দ্যা স্টেটম্যন, দ্য বেঙ্গলী ইত্যাদি পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনার খবর ছাপা হয়। তাছাড়া বুদ্ধদেব বসু, ভবতোষ দত্ত, আবুল ফজল, রমেশচন্দ্র মজুমদার, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, গোপালচন্দ্র রায়, সুখরঞ্জন রায় প্রমুখের লেখায়ও কবি রবীন্দ্রনাথের ঢাকা সফর ও সংবর্ধনার বিবরণ পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সফরসঙ্গী সহ ৭ ফেব্রুয়ারী (২৪ মাঘ) ঢাকার উদ্দেশ্যে স্টীমার যোগে নারায়ণগঞ্জে পৌঁছেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য স্টীমার ঘাটে উপস্থিত ছিল বিপুল জনগণ। নারায়ণগঞ্জ থেকে মোটরগাড়ি করে রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় আসেন। ঢাকা শহরের সীমান্তে স্কাউট ও সেচ্ছাসেবকরা কবি রবীন্দ্রনাথকে অর্ভ্যথনা জানায়। সেখান থেকে শোভাযাত্রা সহকারে তাঁকে নিয়ে আসা হয় বুড়িগঙ্গা নদী তীরে। তিনি নদীবক্ষে ঢাকার নবাবের বোট ‘তুরাগ’-এ আতিথ্য গ্রহণ করেন।
বুদ্ধদেব বসু ‘আমার ছেলেবেলা’ (কলকাতা, ১৯৭৩) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের বোটে অবস্থানের চমৎকার স্মৃতিচারণ করেছেন।
ঢাকায় কবি রবীন্দ্রনাথকে প্রথম সংবর্ধনা দেয় ঢাকা পৌরসভা ও পিপলস এসোসিয়েশন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয় ফরাসগঞ্জে নর্থব্রুক হলে। রবীন্দ্রনাথকে ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে মানপত্র দেওয়া হয়। মানপত্র পাঠ করেন আর. কে. দাস। মানপত্রটি ঢাকা মনোমোহন প্রেসে ছাপা হয়।
তারপর ঢাকা করোনেশন পার্কে আরেকটি অভিনন্দন সভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসাধারণ, রেটপেয়ার্স এসোসিয়েশন ও হিন্দু-মোসলেম সেবক সমিতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন পত্র পাঠ করা হয়। করোনেশন পার্কের অভিনন্দন পত্র পাঠ করা হয়। করোনেশন পার্কের অভিনন্দনের জবাবে রবীন্দ্রনাথ ভাষণ দেন এবং সকলকে ধন্যবাদ জানান।
দ্বিতীয় দিন ৮ ফেব্রুয়ারী (২৫ মাঘ) রবীন্দ্রনাথের সন্মানে ঢাকার নবাব বাড়ি আহসান মঞ্জিলে চা-চক্রের আয়োজন করা হয়।সন্ধ্যায় দীপালী সংঘের উদ্যোগে পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরে আয়োজিত এক রবীন্দ্রনাথ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথকে মানপত্র দেওয়া হয়। সংবর্ধনার জবাবে কবি প্রায় এক ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে প্রায় দু’হাজার নারী উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এত মহিলা এমন শান্তভাবে আমাকে কোথাও অভ্যর্থনা করে নাই।’
তৃতীয় দিন ৯ ফেব্রুয়ারি (২৬ মাঘ) বিশ্বভারতী সম্মিলনীর ঢাকা শাখা রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দেয়। এরপর জগন্নাথ কলেজে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
সন্ধ্যায় ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রাঙ্গণে এক জনসভায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃৃতি ও সভ্যতার ন্বরূপ’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করেন।
১০ ফেব্রুয়ারি (২৭ মাঘ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে বক্তৃতা করেন। দুপুরে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্ররা কবিকে সংবর্ধনা দেয়।
বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ কর্জন হলে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দেয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জি. এইচ. ল্যাংলি। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার সংবর্ধনা পত্র পাঠ করেন। মুসলিম হল ছাত্র ইউনিয়ন কবিকে সংবর্ধনা জানায়। সংবর্ধনার জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-
‘প্রাচীনকালে আমাদের দেশে রাজারা দিগি¦জয় করে ফিরলে তাঁদের উপর পুষ্পবৃষ্টি অর্পণ করা হতো, আমি কি আমার দেশের জন্য তেমন কিছু জয় করে এনেছি যার জন্য আজ আমাকেও পুষ্প বর্ষণ করে সংবর্ধনা জানানো হচ্ছে।’
সন্ধ্যায় কার্জন হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাষণ দেন। ভাষণের বিষয় ছিল ‘আর্টের অর্থ’।
১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি (২৭ ও ২৮ মাঘ) অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন নি।
১৩ ফেব্রুয়ারি (১ ফাগুন) রবীন্দ্রনাথ কার্জন হলে বক্তৃতার করেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল- ‘দ্য রুল অফ দ্য জায়ান্ট’।
১৪ ফেব্রুয়ারি (২ ফাল্গুন) রবীন্দ্রনাথ ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যক্ষ অপূর্ব কুমার চন্দ্রের বাসায় এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ কবিতা আবৃত্তি করেন। দিনেন্দ্রনাথ গান শোনান। কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, বুদ্বদেব বসু, বিশ্বভারতী সম্মিলনীর সদস্য এবং রবীন্দ্রনাথের অনেক ভক্ত এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগন্নাথ হলে ছাত্রদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যেতে পারেন নি। ১৫ ফেব্র“য়ারি (৩ ফাল্গুন) বিদায়ী দিনে জগন্নাথ হলের ছাত্রদের অনুরোধে হল বার্ষিকী ‘বাসন্তিকা’র জন্য একটি গান লিখে দেন। গানটি ছিল-
এই কথাটি মনে রেখো,-
তোমাদের এই হাসি খেলায়
আমি ত গান গেয়েছিলেম
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।
শুকনো ঘাসে শূন্য বনে, আপন মনে,
অনাদরে অবহেলায়
আমি ত গান গেয়েছিলেম
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।।
দিনের পথিক মনে রেখো,-
আমি চলেছিলেম রাতে
সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে।
যখন আমায় ওপার থেকে গেল ডেকে,
ভেসেছিলেম ভাঙা ভেলায়,
আমি ত গান গেয়েছিলেম
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।।
১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬ (৩ ফাল্গুন, ১৩৩২) ছিল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঢাকা সফরের শেষ দিন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন।
✪ কুঠিবাড়ি: শিলাইদহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলায় অবস্থিত একটি এলাকা। এখানে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর স্মৃতি বিজড়িত কুঠিবাড়ি অবস্থিত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর যৌবনকালের একটি উল্লেখযোগ্য সময় এখানে কাটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এ অঞ্চলের জমিদারি পান। পরবর্তিতে ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে জমিদার হয়ে আসেন। এখানে তিনি ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারী পরিচালনা করেন। এ সময় এখানে বসেই তিনি রচনা করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, গীতাঞ্জলি ইত্যাদি। এখানে রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে এসেছেন জগদীশ চন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরীসহ আরো অনেকে।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সবচেয়ে প্রতিভাবান সন্তান কনিষ্ঠ পুত্রকে বিয়ের দুই দিন আগে ২২ অগ্রহায়ণ ১২৯০ বঙ্গাব্দে একটি চিঠিতে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলে ’১ তারও ছয় বছর পর ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে ২৮ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের জমিদারির দায়িত্ব পালন শুরু করেন।২ সে বছরের নভেম্বরে সপরিবারে শিলাইদহে নৌকাবাস করেন, যার উল্লেখ রয়েছে ছিন্নপত্র-এর তৃতীয় চিঠিতে, যা ছিন্নপত্রাবলীতে চতুর্থ চিঠি। পড়ে বোঝা যায়, প্রকৃতির এই অবাধ মুক্ত রাজ্যে তাঁর মন একদিকে বিশালতার বোধে পরিতৃপ্ত, অপর দিকে এর অনিশ্চয়তা ও বৈচিত্র্যের নাটকীয়তায় কৌতুকে-কৌতূহলে প্রাণবন্ত। ৩
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ২১ অগ্রহায়ণ (১৮৮২ বঙ্গাব্দ) তারিখে বোটে করে শিলাইদহ যাত্রা করেন। এ যাত্রায় তিনি চতুর্দশবর্ষীয় কনিষ্ঠ পুত্রকেও তাঁর সঙ্গী করেন। এই ভ্রমণের একটি বিবরণী তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, যা রবিজীবনী প্রথম খণ্ডে উদ্ধৃত হয়েছে। ’৪
একই বছর ফাল্গুনে আবারও শিলাইদহে যান রবীন্দ্রনাথ, এবার সঙ্গী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।’৫
তবে ঠাকুরদের আদি নিবাস যশোহর খাঁটি পূর্ববঙ্গ না হলেও ’৪৭-এর দেশভাগের পর থেকে এই বঙ্গেরই অংশ। সে হিসেবে রবীন্দ্রনাথের আদি নিবাস এই বাংলাদেশ। রবীন্দ্রনাথদের পূর্বপুরুষ ‘পঞ্চানন (ঠাকুর) জ্ঞাতিকলহে দেশ ত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় উপস্থিত হন।’৭ সেটা সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ, অর্থাৎ জোব চার্নকের কলকাতা নগর পত্তনের সমসাময়িক কাল। সেই থেকে পাথুরিয়াঘাটা ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি তাঁদের ঠিকানা।
রবীন্দ্রনাথ বিয়েও করেছিলেন যশোহর থেকে, যদিও তাঁর শ্বশুরের বাস ছিল খুলনায়, দক্ষিণ ডিহিতে।৮
১৮৮৯ থেকে ১৯১৫ পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর বারবার তিনি জমিদারিতে এসেছেন, জমিদারি দেখার চেয়ে মনের ক্লান্তি কিংবা দেহের অবসাদ কাটানোর জন্যই তিনি ছুটে এসেছেন শিলাইদহ, পদ্মা, শাহজাদপুর, যমুনা, পতিসর, সোরাই, আত্রাই, চলনবিল। ১৯৩৭ সনে শেষবার পুণ্যাহ উপলক্ষে জমিদারি ঘুরে যান তিনি। তবে ১৯১৯ থেকে তিনি জমিদারির দায়িত্বের বাইরে বিশ্ববরেণ্য কবি ও বাঙালি সারস্বত সমাজের অগ্রনায়ক হিসেবে পূর্ববঙ্গের অন্যান্য জেলায় নানা উপলক্ষে এসেছেন। ১৯০৭ সালে একবার চট্টগ্রামে এসেছিলেন। সেবারে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা ও চাঁদপুর হয়ে আগরতলা যান। পরে সিলেট, ঢাকা, ময়মনসিংহ, পাবনা, খুলনা, কুমিল্লা, রাজশাহী সফর করেছেন। ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথের সপ্তাহব্যাপী ঢাকা সফরের বিস্তারিত বর্ণনা আছে চিন্তাবিদ আবুল ফজলের আত্মজীবনী রেখাচিত্র-তে। ’৯
অসংখ্য গান এবং রাজা ও অচলায়তন-এর মতো সংগীত-সমৃদ্ধ নাটকও তিনি লিখেছেন পূর্ববঙ্গের জমিদারিতে, কখনো কুঠিবাড়িতে বসে, কখনো বা বোটে ভেসে। এর সঙ্গে আমাদের জাতীয় সংগীতের কথাও যেন না ভুলি। রবীন্দ্রস্নেহধন্য শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন—‘“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গানটি তিনি রচনা করেছেন গগন হরকরার রচনা “আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে/হারায়ে সে মানুষে তার উদ্দিশে দেশ বিদেশে আমি দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে” গানটির সঙ্গে মিলিয়ে।’১৩
১৯০৫ সালে রচিত এই গানের প্রথম দশ পঙিক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে গৃহীত হয়েছে। এই গানে বাংলা দেশমাতৃকা; মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা, অঙ্গীকার ও চিরবন্ধনের প্রকাশ ঘটেছে এতে। আমাদের জাতীয় সংগীতের অংশটুকুতে একবার চোখ বুলিয়ে নেব আমরা:
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
১৯৩২ সালে নজরুল নবযুগে লিখলেন ‘বাঙালীর বাংলা’। তাতে স্বভাবসিদ্ধ চড়া সুরেই বললেন—‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও—এই পবিত্র বাংলাদেশ/বাঙালীর—আমাদের… বাংলা বাঙালীর হোক বাংলার জয় হোক! বাঙালীর জয় হোক।’২২ পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ভাষার প্রশ্নে বিরোধ ও বিতর্কের ফলে সৃষ্ট তপ্ত আবহের মধ্যে বহুভাষাবিদ পণ্ডিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে আরও স্পষ্ট ও ব্যাপ্তভাবে প্রসঙ্গটা তুলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ দিয়েছেন যে, তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জোটি নেই।’২৩
তথ্যসূত্র:
১. উদ্ধৃত, প্রশান্তচন্দ্র পাল: রবিজীবনী, তৃতীয় খণ্ড (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০৯) ১১৯।
২. ঐ, ১২৭।
৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ছিন্নপত্রাবলী, নূতন সংস্কারণ (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, চৈত্র ১৩৯৯), ১৭।
৪. উদ্ধৃত, প্রশান্তচন্দ্র পাল: রবিজীবনী, প্রথম খণ্ড (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০৭) ২১৪।
৫. ‘ছেলেবেলা’, রবীন্দ্ররচনাবলী, ১৩শ খণ্ড, দ্বিতীয় মুদ্রণ (ঢাকা: ঐতিহ্য, আষাঢ় ১৪১১), ৭৭১-৭৭২।
৬. ঐ, ৭৭২।
৭. উদ্ধৃত, প্রশান্তচন্দ্র পাল: রবিজীবনী, প্রথম খণ্ড (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০৭), ২১৪।
৮. সতীশচন্দ্র মিত্র: যশোহর-খুলনার ইতিহাস, প্রথম খণ্ড (কলকাতা: দেজ পাবলিশিং, ২০১০), ২২৩।
৯. আবুল ফজল: রেখাচিত্র, তৃতীয় সংস্করণ (চট্টগ্রাম: বইঘর, ১৯৮৫), ১৪২।
১০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ছিন্নপত্রাবলী, নূতন সংস্করণ (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, চৈত্র ১৩৯৯), ৩৪৩-৩৪৪।
১১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: গল্পগুচ্ছ (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, শ্রাবণ ১৩৭৫), ৩৪০।
১২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ছিন্নপত্রাবলী, নূতন সংস্কারণ (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, চৈত্র ১৩৯৯), ১০৬।
১৩. শান্তিদেব ঘোষ: রবীন্দ্রসংগীত (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বাংলা ১৩৭৬), ১২৭-১২৮।
১৪. ‘শিক্ষার আন্দোলন’, রবীন্দ্ররচনাবলী ষষ্ঠ খণ্ড দ্বিতীয় মুদ্রণ (ঢাকা: ঐতিহ্য, আষাঢ় ১৪১১), ৭৫৭।
১৫. ‘খেয়া’, রবীন্দ্ররচনাবলী পঞ্চম খণ্ড দ্বিতীয় মুদ্রণ ঐ, ১৮৯।
১৬. ‘ঘরে-বাইরে’, রবীন্দ্ররচনাবলী চতুর্থ খণ্ড দ্বিতীয় মুদ্রণ ঐ, ৫০২।
১৭. প্রবোধচন্দ্র সেন: ‘হিন্দু-মুসলমান সমস্যা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ’, রবীন্দ্রপ্রসঙ্গে, রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রবন্ধ সংকলন, সম্পাদনা: ক্ষুদিরাম দাস ও অন্যান্য (কলকাতা: তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, বৈশাখ ১৩৯৫), ৭।
১৮. ঐ, ১০।
১৯. ‘পূর্ব ও পশ্চিম’, সমাজ, রবীন্দ্ররচনাবলী ষষ্ঠ খণ্ড, দ্বিতীয় মুদ্রণ (ঢাকা: ঐতিহ্য, আষাঢ় ১৪১১), ৫৭০।
২০. ‘বিদ্যাসাগর চরিত’, চারিত্রপূজা, রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড, ঐ, ৮৩৭।
২১. এস ওয়াজেদ আলী: ‘ভবিষ্যতের বাঙালি’, দুশ বছরের বাংলা প্রবন্ধসাহিত্য, দ্বিতীয় খণ্ড, সম্পাদনা: অলোক রায়, পবিত্র সরকার, অভ্র ঘোষ (কলকাতা: সাহিত্য আকাদেমি, ২০০৭), ১৭৬।
২২. আবদুল কাদির (সম্পাদিত): নজরুল রচনাবলী চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় প্রকাশ, (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৮৪), ৭১২।
২৩. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে প্রদত্ত মূল সভাপতির ভাষণ, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮। সেরা সুন্দরম, সম্পাদনা: মুস্তাফা নূর উল ইসলাম (ঢাকা: ইউপিএল, ২০০৪), ৩১-৩২।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য শিলাইদহ
১৮৯১ সালে বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে ঠাকুর পরিবারের জমিদারী পরিচালনার জন্য কুষ্টিয়ার শিলাইদহে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য ও ছায়াঘেরা নিভৃত পল্লী কবিচিত্তকে আকৃষ্ট করেছিল। প্রমত্তা পদ্মা নদী ও পদ্মার বুক থেকে বেরিয়ে আসা গড়াই নদী আর নীলকর সাহেব শেলীর নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত শিলাইদহের কুঠিবাড়ি কবিগুরুর পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে।
তারও আগে বালক রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার সহযাত্রী হয়ে ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে শিলাইদহে অল্প সময়ের জন্য একবার এসেছিলেন। এরপর ১৮৭৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সেজু দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর নতুন বউঠাকরন কাদম্বীনি দেবির সঙ্গে শিলাইদহে বেড়াতে এসেছিলেন।[ছেলেবেলা ১] পরবর্তীতে ৩০ বছর বয়সে জমিদারির পুরো দায়িত্ব নেবার পর ১৮৯১ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় কাটিয়াছেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, পাবনার শাহজাদপুর এবং রাজশাহীর পতিসরে।
শিলাইদহ গ্রামের উত্তরে পদ্মা এবং পশ্চিমে গড়াই নদী প্রবাহিত। দুটি নদী শিলাইদহকে অর্ধ-চন্দ্রাকারে ঘিরে রেখেছে। সপরিবারে তিনি ১৮৯৮ সালে শিলাইদহের এই কুঠিবাড়ীতে উঠে এসেছেন এবং থেকেছেন দীর্ঘ সময়। এই কুঠিবাড়ি থেকে তিনি পতিসর ও শাহজাদপুরের জমিদারী দেখাশুনা করতেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে পদ্মা নদীর তীরে মস্ত বড় বড় নীলকুঠি তৈরি করা হয়েছিল। ওই সময় নীলের ব্যবসা ছেড়ে সাহেবরা চলে গেলে নীলকুঠির নীচতলা কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারীর কাচারি ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
নদীর ভাঙ্গনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীলকুঠি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে ১৮৯২ সালে পদ্মার তীর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে শিলাইদহ গ্রামে ৩২ বিঘা জায়গা নিয়ে পৌনে চার বিঘা জমির উপর ঢেউ আকৃতির প্রাচীর বেষ্টিত তিন তলার বর্তমান এই কুঠিবাড়িটি নির্মাণ করা হয়। পদ্মা-গড়াইয়ের মধ্যবর্তী জমিদারী এস্টেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ কবি ১৮৯১ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত শিলাইদহ গ্রামে এই কুঠিবাড়িটিতেই থেকেছেন।
তিনতলা এই কুঠিবাড়ির কামড়ার সংখ্যা ১৮টি। এর নীচতলায় ৯টি, দোতলায় ৭টি ও তিনতলায় দুটি কামড়া রয়েছে। প্রাচীন ঐতিহ্য ও জমিদারী নিদর্শনের অবয়বে গড়ে তোলা কুঠিবাড়ি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও নয়নাভিরাম। এই কুঠিবাড়ির পশ্চিমদিকে অবস্থিত পুকুরপাড়ের শান বাঁধানো বকুলতলার ঘাট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে ফুলের সুগন্ধ ও পাখির কলরবে কবি গান ও কবিতা লিখতেন।
কুঠিবাড়িতে কবির ব্যবহার্য জিনিষ-পত্র ও অন্যান্য সামগ্রী সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৮০টিরও অধিক বিভিন্ন দুর্লভ ছবি ও কবির ব্যবহৃত খাট, ইজি চেয়ার, লেখার টেবিল, স্পিড বোট, দুই বেহারার পালকি, ঘাস কাটা মেশিন, গদি চেয়ার, নৌকাসহ অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিষ-পত্র রয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কুঠিবাড়ি সংরক্ষণ ও দেখাশুনার কাজ করছে।
শিলাইদহ থেকে জমিদারী ছেড়ে যাওয়ার পরও কবি বেশ কয়েকবার শিলাইদহে এসেছেন।
শিলাইদহ পর্বে কবি লিখেছেন সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, ক্ষণিকার অসংখ্য কবিতা৷ লিখেছেন অর্ধশতাধিক ছোটগল্প আর প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রীকে অনন্য পত্রগুচ্ছ৷ ‘পদ্মা’ বোটে ভেসে বেড়িয়েছেন পদ্মা নদীর ওপর৷
নওগাঁয় নাগর নদীর তীরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কালিগ্রাম পরগনায় ১৮৯১ সালে প্রথম এলেও সিরাজগঞ্জে করতোয়া নদীর সংযোগ খালের পাড়ে দাদা প্রিন্স দারকানাথ ঠাকুরের ১৩ টাকা ১০ আনায় কেনা শাহাজাহাদপুর কাছারি বাড়িতে যান ১৮৯০ সালে৷ প্রজাপ্রিয় রবীন্দ্রনাথ শাহজাহাদপুর কাচারি বাড়িতে শেষবারের মতো আসেন ১৮৯৬ সালে। পতিসরে কাচারি বাড়ি থেকে তিনি অসুস্থ অবস্থায় শেষ বিদায় নেন ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই৷
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এখানকার জমিদারির হাত বদল ঘটে। পরে ঢাকার ভাগ্যকুল জমিদার শিলাইদহের এস্টেট কিনে নেন। এরপর ১৯৫২ সালে জমিদারি প্রথা বাতিল হওয়ার পর কুঠিবাড়িসহ অন্যান্য সম্পত্তি সরকারের মালিকানায় আসে।
কুঠিবাড়ির চারিদিকে শুধু গাছ আর গাছ কিন্তু তারপরেও অনেক দূর থেকেই নজরে আসে ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত এই বাড়িটি৷ পাকা পুকুর পাড়ে বকুল ফুলের গাছ তলায় খানিকটা বসলে পদ্মার শীতল বাতাসে নিমেষেই জুড়িয়ে যাবে মন-প্রাণ-শরীর৷
সৌন্দর্যপিপাসু কবি এখানে নতুন নতুন কাব্য ও সাহিত্য চিন্তায় বিভোর থেকেছেন। পাশাপাশি সমাজ উন্নয়ন ও জনহিতকর কাজেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।
এক জায়গায় কবির স্বীকারোক্তি— ‘বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড় ভালবাসি। … এখন পদ্মার জল অনেক কমে গেছে, বেশ কৃশকায় হয়ে এসেছে, একটি পাণ্ডুবর্ণ ছিপছিপে মেয়ের মতো নরম শাড়ী গায়ের সংগে বেশ সংলগ্ন। সুন্দর ভংগীতে চলে যাচ্ছে আর শাড়ীটি বেশ গায়ের গতির সংগে সংগে বেঁকে যাচ্ছে। আমি যখন শিলাইদহে বোটে থাকি তখন পদ্মা আমার পক্ষে সত্যিকার একটি স্বতন্ত্র মানুষের মতো, অতএব তাঁর কথা যদি কিছু বাহুল্য করে লিখি তবে সে কথাগুলো চিঠিতে লিখবার অযোগ্য মনে করা উচিৎ হবে না। ’ শিলাইদহের গ্রাম সম্পর্কে এক জায়গায় লিখেছেন— ‘এতদিন সামনে ঐ দূর গ্রামের গাছপালার মাথাটা সবুজ পল্লবের মেঘের মতো দেখা যেত, আজ সমস্ত বনটা আগাগোড়া আমার সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়েছে। ডাঙ্গা এবং জল দুই লাজুক প্রণয়ীর মত অল্প অল্প করে পরস্পরের কাছে অগ্রসর হচ্ছে। লজ্জার সীমা উপচে এলো বলে প্রায় গলাগলি হয়ে এসেছে। ’
বাংলার গ্রামের গরিব-দুঃখী, সুখ-দুঃখ কাতর মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা, স্নেহ, ভালোবাসা ও সমবেদনা, যদিও তারা শিক্ষিত, সুসভ্য, ধনী এবং মার্জিত ছিলেন তা’ নয়। তাঁর লেখাতে এর প্রকাশ পাওয়া যায়— ‘আমার কাছে এই সব সরল বিশ্বাসপরায়ণ অনুরক্ত প্রজাদের মুখে বড়ো একটা কোমল মাধুর্য প্রকাশ পায়। বাস্তবিক এরা যেন আমার দেশজোড়া এক বৃহৎ পরিবারের লোক। এই সমস্ত নিঃসহায়, নিরুপায় নিতান্ত নির্ভরপর, সরল চাষাভূষোদের আপন লোক মনে করতে একটা সুখ আছে—এরা অনেক দুঃখ অনেক ধৈর্য সহকারে সয়েছে তবু তাদের ভালবাসা কিছুতে ম্লান হয়নি। এদের উপর যে আমার কতখানি শ্রদ্ধা হয়, আপনার চেয়ে যে এদের কতখানি ভাল মনে হয় তা এরা জানে না।
তিনি লিখেছেন —‘এখানকার প্রজাদের ওপর বাস্তবিক মনের স্নেহ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে, এদের সরল ছেলেমানুষের মতো আবদার শুনলে মনটা আর্দ্র হয়ে উঠে, যখন তুমি বলতে তুই বলে, যখন আমাকে ধমকায় ভারী মিষ্টি লাগে। ’
‘ছেলেবেলা’-য়, যেখানে তিনি শিলাইদহের উজ্জ্বল হৃদয়স্পর্শী বর্ণনার মাধ্যমে তাঁর মনের উত্তাপ সবার মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের অনেক ছোট গল্পের বিষয়বস্তু শিলাইদহ অঞ্চলের সংঘটিত ঘটনার থেকে নেওয়া হয়েছে।
তাঁর ছোটগল্প ‘জীবিত ও মৃত’-র ভিত্তি শিলাইদহের একটি ঘটনা। ‘বৈষ্টমী’ গল্পের আখ্যানবস্তু সর্বক্ষেপী নামের এক স্থানীয় বৈষ্ণবীর জীবন থেকে নেওয়া। তাঁর সোনার তরী, মনসা সুন্দরী, উর্বশী, চিত্রা, ক্ষণিকা, গীতাঞ্জলি ও গীতিমাল্যের কবিতা ও গান শিলাইদহে রচিত হয়েছিল। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমার ধারণা বাবার গদ্য ও পদ্য দু’রকম লেখার উৎসই যেন খুলে গিয়েছিল শিলাইদহে। এমন কোথাও আর হয়নি। এই সময় তিনি অনর্গল কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প লিখে গেছেন, একদিনের জন্যও কলম বন্ধ করেননি। ’
১৮৯১ সাল (বাংলা ১২৯৮) থেকে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প রচনার সূত্রপাত এবং তা সাময়িক ছেদ পড়লেও প্রবহমান ছিল ১৯৪০ সাল পর্যন্ত।
কথা ও কাহিনী কাব্যের গানভঙ্গ, পুরাতন ভৃত্য ও দুই বিঘার বক্তব্যে শিলাইদহের প্রভাব অত্যন্ত পরিষ্কার। প্রমথনাথ বিশীর গবেষণায় তিনি লক্ষ্য করেছেন ১৮৯২ (বাংলা ১২৯৮) থেকে রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প লেখার সূত্রপাত ঘটে। ‘ভিখারীনি’ গল্পটি বাদ দিলে তার আগে তিনটি মাত্র গল্প তিনি লিখেছেন, ঘাটের কথা ও রাজপথের কথা ১৮৮৪ সালে, আর মুকুট গল্পটি ১৮৮৫ সালে। তিনি আরও বলেছেন ১৮৯১ থেকে ১৮৯৫, (বাংলা ১২৯৮-১৩০২) এ সময়ে চুয়াল্লিশটি গল্প, সমগ্র গল্পগুছের অর্ধেকের কিছু বেশি, প্রায় প্রত্যেক মাসে একটি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধনা পত্রিকার জন্য লেখা হয়েছে। এই কয়েক বছর সোনার তরী ও চিত্রা কাব্য রচনার সময়। তিনি আরও লক্ষ্য করেছেন ১৮৯৮ (বাংলা ১৩০৫) সালে কাহিনীমূলক কাব্যের বদলে গল্প বলার ধারাটা গদ্যের খাতে ফিরে গেছে এবং এই সময় আমরা সাতটি গল্প পাই। অতঃপর ১৯০০ (বাংলা ১৩০৭) সালে আটটি ছোট গল্প। ১৯০১ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে সবসুদ্ধ আটটি মাত্র গল্প রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। এই স্বল্পতার কারণ— গল্পের টুকরোগুলো জমিয়ে এক জোটে উপন্যাস আকারে রূপ দেওয়া। এই সময় তিনি তিনটি উপন্যাস রচনা করেন— চোখের বালি, নৌকাডুবি ও গোরা। ১৯১৫ ও ১৯১৬ সালে ছোট গল্পের বদলে আমরা উপহার পেয়েছি ঘরে বাইরে এবং চতুরঙ্গ।
গরিব-দুঃখী প্রজারা সামনে এলে ওদের দেখে তিনি ব্যথিত ও পীড়িত হয়েছেন এবং তখনই অন্তর দেবতার কাছে বলেছেন—
‘এই সব ম্লান মূঢ় মুখে দিতে হবে ভাষা,
এই সব শীর্ণ শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা। ’
ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ভাগবাটোয়ারা হয়ে যাওয়ার পর শিলাইদহের সঙ্গে কবির যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায় ১৯২২ সালে। তিনি শেষবারের মতো জমিদারির তৎকালীন মালিক তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে ১৯২৩ সালে শিলাইদহে আসেন। তবে শিলাইদহের স্মৃতি তিনি চিরকাল মনে রেখেছিলেন। মৃত্যুর কিছুকাল আগে (১৯৩৮ সালে) শিলাইদহের একজনের চিঠির জবাবে তিনি লিখেছেন—‘শিলাইদহে দীর্ঘকাল তোমাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে যুক্ত ছিলাম, আজো তোমাদের মন থেকে তা’ ছিন্ন হয়ে যায়নি, তার প্রমাণ পাওয়া গেল তোমার চিঠিখানিতে। শ্রদ্ধার দান নানা স্থান থেকে পেয়েছি, তোমাদের অর্ঘ্য সকলের চেয়ে মনকে স্পর্শ করেছে’।
শিলাইদহের কুঠিবাড়ির দিনগুলো প্রসঙ্গে সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেন, “আমার বুদ্ধি এবং কল্পনা এবং ইচ্ছাকে উন্মুখ করে তুলেছিল এই সময়কার প্রবর্তনা— বিশ্বপ্রকৃতি এবং মানবলোকের মধ্যে নিত্যসচল অভিজ্ঞতার প্রবর্তনা। এই সময়কার প্রথম কাব্যের ফসল ভরা হয়েছিল সোনার তরীতে।তখনই সংশয় প্রকাশ করেছি, এ তরী নিঃশেষে আমার ফসল তুলে নেবে কিন্তু আমাকে নেবে কি। ”
আজ কবি নেই, কিন্তু রয়ে গেছে তার স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ি।
তিনি জমিদারি দেখার ফাঁকে ফাঁকে পদ্মার বুকে ভেসে বেড়াতেন তার বজরা নিয়ে।
বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, মীর মশাররফ হোসেনসহ আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সে সময় নিত্য যাতায়াত ছিল এই শিলাইদহে। রবি ঠাকুর ১৯১২ সালে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ করা শুরু করেন এই শিলাইদহে বসেই। পদ্মার ঢেউ খেলানো প্রাচীরে ঘেরা কুঠি বাড়ির ছাদে বসে সুর্যোদয়, সূর্যাস্ত ও জ্যোৎস্না প্লাবিত প্রকৃতির শোভায় মুগ্ধ হতেন কবি।
কুঠিবাড়িতে রয়েছে কবির নানা বয়সের ছবি। বাল্যকাল থেকে শুরু করে মৃত্যু শয্যার ছবি পর্যন্ত সংরক্ষিত রয়েছে। আছে কবির নিজ হাতের লেখা কবিতা, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর প্রকাশিত কবির ছবি ও সনদপত্র। এমন কি কবি যেসব নাটকে অভিনয় করেছেন সেসব নাম ভূমিকার ছবিও রক্ষিত হয়েছে।
কবির শয়ন কক্ষে রয়েছে একটি পালঙ্ক, ছোট একটা গোল টেবিল, কাঠের আলনা, আলমারি, কবির ব্যবহৃত চঞ্চল ও চপলা নামের দুটো স্পিডবোট। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিভিন্ন মনীষীর ছবি এবং রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে আঁকা ছবি ও লেখা কবিতা।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য কাচারি বাড়ি (শাহজাদপুর):
‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে,
সব গাছ ছাড়িয়ে,
উঁকি মারে আকাশে।’
কবিতাটির সঙ্গে স্মৃতিবিজড়িত স্থানটি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮), পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে ১৮৯০ সালে পূর্ববঙ্গে আসেন। এরপর টানা প্রায় ১০ বছর (১৮৯০-১৯০০) পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসরে জীবন অতিবাহিত করেছেন, গ্রহণ করেছেন নানা কর্মোদ্যোগ, প্রতিষ্ঠা করেছেন অনেক প্রতিষ্ঠান। জমিদারির কাজেই তিনি প্রথম শাহজাদপুরে আসেন, ১৮৯০ সালে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুর কাছারিবাড়ি। (রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ব্যবহার করেছেন সাজাদপুর বানান) এটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে ছিল নীলকরদের কুঠি (‘কুঠিবাড়ি’ বলে পরিচিত)।
১৯৬৯ সনে অত্যন্ত জরাজীর্ণ অবস্থায় ‘কাছারিবাড়ি’ ভবনটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।সেই থেকে বর্তমানে এটি রবীন্দ্র জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৮৪০ সনের আগে এই অঞ্চলটি নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারীর অংশ ছিল।১৮৪০ সনে শাহজাদপুর জমিদারি নিলামে উঠে।সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র তের টাকা দশ
আনায় এ জমিদারী কিনে নেন। সেই থেকে কাছারি বাড়িটিও জমিদারীর অংশ হয়ে উঠে। ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতে পাওয়া যায় যে,১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ৯ জানুয়ারী যখন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রথম বিলাত যাত্রা করেন তার পূর্বেই সাহেবদের নীল কুঠি ঠাকুরদের হাতে আসে।কবি রবীন্দ্রনাথ এই কুঠি বাড়ির দোতলায় বসে সাহিত্য রচনা করতেন।'[১]
কাছারি বাড়িটি ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত ৭ কক্ষ ও ৩১ দরজা বিশিষ্ট একটি দ্বিতল ভবন। নিচের তলাতে তিনটি কক্ষ, দোতালায় ওঠার জন্য একটি প্যাঁচানো সিঁড়ি নিচতলা থেকে উপরে উঠে গেছে।দ্বিতীয় তলায় চারটি কক্ষ রয়েছে।আছে একটি সিঁড়ি ঘর। নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ নীলকর সাহেবদের আদি অবস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
কবিগুরু শিলাইদহ ও পতিসরেই অধিকাংশ সময় অবস্থান করেছেন। কুষ্টিয়া থেকে এখানে মাঝে মাঝে আসতেন।অস্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। স্থায়ী ভাবে বাস করতেন শিলাইদহের কুঠি-বাড়ি ।
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এ অঞ্চলের জমিদারি পান। ১৮৯৭ সালে কবির বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি ভাগাভাগি করে দিলে কাকা জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুর, বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহ এবং কবি নিজে পতিসরের দায়িত্ব পান। এরপর তিনি আর শাহজাদপুরে আসেননি।
কাছারি বাড়িতে রক্ষিত অর্ডার বুক থেকে জানা যায়, জমিদারি দেখা শোনার কাজে কবিগুরু ১৮৯০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম শাহজাদপুর আসেন। ১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত (প্রায় ৭ বছর) বিভিন্ন সময়ে তিনি এখানে এসেছেন।
শাহজাদপুরের বিচ্ছেদ স্মরণ করে কবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ‘যাচনা’ কবিতা।
১৩০৪ বঙ্গাব্দের ৮ আশ্বিন পতিসর যাবার পথে কবির নৌকা ভিড়েছিল কাছারি বাড়ির আঙিনায়। ভালবাসার শাহজাদপুর বিচ্ছেদ স্মরণে এই কাছারি বাড়ির আঙিনায় বসে সেদিন লিখেছিলেন,
“ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো, তোমার মনেরও মন্দিরে।
আমারও পরানে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শিখো, তোমার চরণ মঞ্জিরে।”
এরপর আর কবির পদধূলিতে মুখরিত হয়নি গানের এই সখী রূপী কাচারী বাড়ির প্রাঙ্গণ।
শাহজাদপুর ঘেঁষে বয়ে গেছে করতোয়া নদী। কুঠি বাড়ির সামনে দিয়ে বহমান করতোয়া আর বড়াল নদীর সংযোগ স্থাপনকারী শাখা নদীটি এখন ভরাট। অথচ একসময় এই নদী দিয়ে ‘চিত্রা’ ও ‘পদ্মা’ বোটে কবি যাতায়াত করতেন। এ নদীর রূপ সৌন্দর্য দেখেই একদিন রবীন্দ্রনাথ লিখেন,
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’
এখানকার যমুনা, বড়াল, করতোয়া, হুরাসাগর নদী- অনতিদূরে চলনবিল রবীন্দ্র সাহিত্যের বিশাল স্থান দখল করে আছে।
কবির লেখা ‘ছিন্নপত্র’ ও ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে অত্যন্ত প্রিয় ও ভালোবাসার স্থান শাহজাদপুরের প্রতি গভীর আবেগ ও আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটেছে। ১৮৯৪ সনের ৫ সেপ্টেম্বর শাহজাদপুর থেকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ‘‘ এখানে (শাহজাদপুরে) যেমন আমার মনে লেখার ভাব ও ইচ্ছা আসে এমন কোথাও না।’’ (ছিন্নপত্র- পত্র সংখ্যা-১১৯)।
ছিন্নপত্রাবলীর ১৪৯ নম্বর চিঠিতে কবি লিখেছিলেন, ‘এখানে (শাহজাদপুরে) যেমন আমার মনে লেখবার ভাব এবং লেখবার ইচ্ছা আসে এমন আর কোথাও না।’
এই চিঠিতেই তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘আমার এই শাহজাদপুরের দুপুর বেলা গল্পের দুপুর বেলা।মনে আছে ঠিক এই সময়ে এই টেবিলে বসে আপনার মনে ভোর হয়ে পোস্টমাস্টার গল্পটা লিখেছিলুম। আমিও লিখছিলুম এবং আমার চার দিকের আলো এবং বাতাস এবং তরুশাখার কম্পন তাদের ভাষা যোগ করে দিচ্ছিল। এই রকম চতুর্দিকের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশে গিয়ে নিজের মনের মতো একটা কিছু রচনা করে যাওয়ার যে সুখ তেমন সুখ জগতে খুব অল্পই আছে।’
শাহজাদপুর সম্পর্কে ১৫০ নম্বর চিঠিতে কবি আরও লিখেছিলেন, ‘আমি এর মোহ থেকে কিছুতেই আপনাকে ছাড়াতে পারি নে। এই আলো, এই বাতাস, এই স্তব্ধতা আমার রোমকূপের মধ্যে প্রবেশ করে আমার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। এ আমার প্রতিদিনকার নতুন নেশা, এর ব্যাকুলতা আমি নিঃশেষ করে বলে উঠতে পারি নে।’
১৯৪০ সালে শাহজাদপুরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হরিদাস বসাকের চিঠির জবাবে কবি লিখেছেন,‘শাহজাদপুরের সাথে আমার বাহিরের যোগসূত্র যদিও বিচ্ছিন্ন তবুও অন্তরের যোগ নিবিড়ভাবে আমার স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। আমার প্রতি সেখানকার অধিবাসীদের শ্রদ্ধা এখনো যদি অক্ষুন্ন থাকে তবে আমি পুরস্কার বলে গণ্য করব’’ (শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ-মোহাম্মদ আনসারুজ্জামান)।
✪ শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ
রচনা:
“সোনার তরী” কাব্যের ‘দুই
পাখি’, ‘আকাশের চাঁদ’, ‘লজ্জা’, ‘পুরস্কার’, ‘হৃদয়
যমুনা’, ‘বৈষ্ণব কবিতা’, ‘ব্যর্থ যৌবন’, ‘ভরা
ভাদরে’, ‘প্রত্যাখ্যান’ ইত্যাদি, চিত্রা কাব্যের চিত্রা, শীতে ও বসন্তে, নগর সঙ্গীত। চৈতালী কাব্যের যাত্রী,
তৃণ, ঐশ্বর্য, স্বার্থ, প্রেয়সী, নদীযাত্রা, মৃত্যু
মাধুরী, স্মৃতি, বিলয়, প্রথম চুম্বন, শেষ চুম্বন, শান্তি মন্ত্র, কালিদাসের প্রতি, কুমার সম্ভব গান,
মানসলোক, কাব্য, প্রার্থনা, ইছামতি নদী,
শুশ্রুষা, আশিষ গ্রহণ, বিদায়। “কল্পনা” কাব্যের নর
বিবাহ, লজ্জিতা, মানস প্রতিভা, বিদায়,
হতভাগ্যের গান, যাচনা, কাল্পনিক, সংকোচ।
✪ বিখ্যাত ছোট গল্প:
পোস্ট মাস্টার,
রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা,
ব্যবধান,
তারাপ্রসন্নের কীর্তি,
ছুটি,
সমাপ্তি,
ক্ষুধিত পাষাণ,
অতিথি।
এছাড়াও
চৈত্রালীর ২৮টি কবিতা,
ছিন্ন পত্রাবলীর ৩৮টি
পত্র,
প্রবন্ধ পঞ্চভূত এর অংশ বিশেষ,
বাংলা সাহিত্যের চিরকালের স্মরণীয় কাব্যনাটক বিসর্জন।
রচনা করেছেন বাঙালির প্রেম,সৌন্দর্য ও বেদনার শিল্পিতা স্মরণীয় কিছু গান। এসব গানের মধ্যে আছে ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’,
‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’,
‘যদি বারণ করো’,
‘হেরিয়া সজল ঘন নীল গগনে’,
‘ভালোবেসে সখি নিভৃত যতনে’ ইত্যাদি।
➤শাহজাদপুর বসবাসকালে তিনি একের পর এক রচনা করেছেন উজ্জ্বল সব সাহিত্যকর্ম—বললেন এই কথা, ‘পৃথিবীর অনেক জায়গায় বসে লিখেছি, কিন্তু সাজাদপুরের মতো লেখার প্রেরণা আমি আর কোথাও পাইনি।’
‘‘নদী ভরা কূলে কূলে, ক্ষেত ভরা ধান।
আমি ভাবিতেছি বসে কি গাহিব গান।
কেতকী জলের ধারেফুটিয়াছে ঝোপে ঝাড়ে,
নিরাকুল ফুলভারে বকুল-বাগান।
কানায় কানায় পূর্ণ আমার পরাণ’’
(ভরা ভাদরে- সোনার তরী)
➤কবির ‘ছেলে-ভুলানো ছড়া’য় শাহজাদপুরের তেলিপাড়ায় ছবি শিল্পিতা পেয়েছে।
‘খোকা যাবে বেড়ু করতে তেলিমাগীদের পাড়া।/ তেলিমাগীরা মুখ করেছে কেন রে মাখনচোরা।/ ভাঁড় ভেঙেছে, ননী খেয়েছে, আর কি দেখা পাব।/ কদমতলায় দেখা হলে বাঁশি কেড়ে নেব।’
➤বাংলা গদ্যসাহিত্যের ধারায় চিরকালের স্মরণীয় নির্মাণ ‘ছিন্নপত্র’ বাংলাদেশের এক মানসমূর্তি।
ছিন্নপত্র-এর ১৪৪-সংখ্যক পত্রে ‘অতিথি’ গল্পের প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ শাহজাদপুরকে তুলে ধরেছেন এভাবে:
‘একটু একটু করে লিখছি এবং বাইরের প্রকৃতির সমস্ত ছায়া আলোক বর্ণ ধ্বনি আমার লেখার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আমি যে সকল দৃশ্যলোক ও ঘটনা কল্পনা করছি তারই চারিদিকে এই রৌদ্রবৃষ্টি নদীস্রোত এবং নদীতীরের শরবন, এই বর্ষার আকাশ, এই ছায়াবেষ্টিত গ্রাম, এই জলধারা প্রফুল্ল শস্যের ক্ষেত ঘিরে দাঁড়িয়ে তাদের সত্যে ও সৌন্দর্যে সজীব করে তুলেছে।’
শাহজাদপুরের বাথানভূমির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের নাম। গরু চরানোর মাঠের অভাবের কথা চাষিদের কাছে শুনে রবীন্দ্রনাথ বুড়িপোতাজিয়া ও রামকান্তপুর মৌজার প্রায় ১২০০ একর জমি গোচারণের জন্য লাখেরাজ দান করেন। সে জমিতে এখনো বাথান আছে, আছে শত শত গরু। এই বাথানভূমির একটা অংশে, ২০০ একর জমিতে গড়ে উঠবে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথ যে গোচারণের জন্য জমি দিয়েছেন, তা নয়—উন্নত ভালো জাতের ষাঁড় এনে গাভি প্রজননের মাধ্যমে উন্নত গোসম্পদ সৃষ্টির ব্যবস্থা করেছেন। এখনো সেই গাভির জাত শাহজাদপুরে রয়েছে, যে গাভির দুধ দিয়ে চলছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘মিল্ক ভিটা’।
➤শাহজাদপুর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এখানকার দুপুর বেলাকার মধ্যে বড়ো একটি নিবিড় মোহ আছে। রৌদ্রের উত্তাপ, নিস্তব্ধতা, নির্জনতা, পাখিদের বিশেষত কাকের ডাক, এবং সুদীর্ঘ সুন্দর অবসর—সবসুদ্ধ জড়িয়ে আমাকে ভারি উদাস ও আকুল করে।’ (ছিন্নপত্র)। এই উদাস ও আকুল করা ভূপ্রকৃতিই শাহজাদপুর পর্বে রচিত রবীন্দ্র-সৃষ্টিশীলতায় নিয়ে এসেছে দার্শনিকতার ঋদ্ধি। শাহজাদপুর মানুষের প্রতি ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ করেছে কবি রবীন্দ্রনাথকে। সোনার তরী কাব্যের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
‘এইখানে নির্জন-সজনের নিত্যসংগম চলেছিল আমার জীবনে। অহরহ সুখদুঃখের বাণী নিয়ে মানুষের জীবনধারার বিচিত্র কলরব এসে পৌঁচচ্ছিল আমার হৃদয়ে। মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল। তাদের জন্য চিন্তা করেছি, কাজ করেছি, কর্তব্যের নাগ সংকল্প বেঁধে তুলেছি, সেই সংকল্পের সূত্র আজও বিচ্ছিন্ন হয়নি আমার চিন্তায়।’
কাছারি বাড়ির নিচের তিনটি ঘর এবং উপরের চারটি ঘর রবীন্দ্রনাথের আলোকচিত্র ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। নিচের ৩টি ঘরই আলোকচিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে।প্রথম ঘরে রবীন্দ্রনাথের নিজের এবং তার পরিবারের ছবি দিয়ে সাজানো। এখানে তার শৈশব এবং কৈশোরের ছবি সহ যৌবনের অনেক আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয় ঘরটিতে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বয়সের ছবি এবং হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাথে তার সাক্ষাতের ছবি
দিয়ে সাজানো। উল্লেখযোগ্য ছবি হল তার ব্যবহৃত বোট পদ্মা, মহাত্মা গান্ধীর সাথে রবীন্দ্রনাথ,আমার শেষ বেলার ঘরখানি, পদ্মাসনে উপবিষ্ট রবীন্দ্রনাথ, বার্ধক্যে রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি। তৃতীয় ঘরটি রবীন্দ্রনাথের আঁকা বৃক্ষ রাজী, নৈসর্গিক দৃশ্য, উপবিষ্ট চিত্র,মুখ নিরীক্ষা, বিভিন্ন রকমের প্রতিকৃতি।
দ্বিতীয় তলার প্রথম ঘরে আছে কবির
ব্যবহৃত পালকি, চিঠি লেখার ডেক্স, কাঠের
আলনা, পড়ার টেবিল, দেয়ালে কবির বিভিন্ন সময়ে
তোলা আলোকচিত্র ও পাণ্ডুলিপি, জ্যামিতিক
নকশা ইত্যাদি। এর পরের ঘরে রয়েছে ড্রেসিং
টেবিল,শ্বেত পাথারের গোল টেবিল, টেবিল
বেসিন, কাঠের আলনা, দেবতার আসন, হাতল যুক্ত কাঠের চেয়ার, কবির ব্যবহৃত কাঠের বড় টেবিল। পরের ঘরে রয়েছে সোফা, হাতল যুক্ত কাঠের চেয়ার, কাঠের গোল টেবিল ইত্যাদি। এর পরের ঘরে রয়েছে
বিছানা, হাতল যুক্ত কাঠের চেয়ার ইত্যাদি।
এছাড়াও আরও আছে বিভিন্ন রকমের কেরোসিনের বাতি, মোম দানী, অর্গ্যান, চিনামাটির বাসনকোসন,
দেয়াল ঘড়ি, ব্রোঞ্জের তৈরি বালতি, রান্নার
পাতিল,ঘটি ইত্যাদি।
জাদুঘরে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ২৮ ভাদ্রে লেখা শত বছরের পুরনো একটি চিঠি রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই চিঠি জাদুঘরটিকে সমৃদ্ধ করেছে। চিঠিটি নওগাঁ থেকে সংগৃহীত। ভবনটির পশ্চিমে বকুল গাছের গোড়ায় বৃত্তাকার বাঁধানো একটি মঞ্চ আছে। এটি ‘রবীন্দ্র মঞ্চ’ বলে পরিচিত।
২০১৮ সাল থেকে শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে দেশের ৩৫তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ’-এর যাত্রা শুরু হয়েছে।
তথ্য ঋণ:
[১] শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ।। নরেশচন্দ্র চক্রবর্তী
দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা,জুলাই ১৯৮০ইং
[২] শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধ।। বিশ্বজিৎ ঘোষ
দৈনিক প্রথম আলো,৩ আগস্ট ২০১৮।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য পতিসর
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই’
বাংলা ভাষার এক হিমালয়প্রতিম ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসংখ্য সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে আজও বেঁচে আছেন।আজ আমরা তাঁর টুকরো টুকরো স্মৃতিতে হারিয়ে যাব দেড় হাজার বছর পূর্বের পুণ্ড্রবর্ধনখ্যাত (বগুড়ার)নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার নাগর নদের তীরে পতিসর কুঠিবাড়ির রবীন্দ্রভুবনে।
“বোট ভাসিয়ে চলে যেতুম পদ্মা থেকে কোলের ইছামতিতে, ইছামতি থেকে বড়ালে, হুড়ো সাগরে, চলনবিলে, আত্রাইয়ে, নাগর নদীতে, যমুনা পেরিয়ে সাজাদপুরের খাল বেয়ে সাজাদপুরে।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিন্নপত্রাবলীর চিঠিপত্রে শিলাইদহ থেকে শাহজাদপুর ও পতিসরে যাওয়ার এই বর্ণনা মেলে। ১৮৯১ থেকে ১৯০১ প্রায় ১০ বছর একনাগাড়ে থেকেছেন এই বাংলায়। এরপর ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত জমিদারি দেখতে মাঝে মধ্যেই নওগাঁর পতিসর আসতেন কবি।
আত্রাই নদীর কারণে রেলস্টেশনের নামকরণও হয় আত্রাই রেলস্টেশন। কবি রবীন্দ্রনাথ প্রায়শ ট্রেনে কলকাতা থেকে সরাসরি আত্রাই রেলস্টেশনে এসে নামতেন। এর পর তিনি তাঁর বিখ্যাত পদ্মা বোট`-এ নদীপথে সোজা চলে যেতেন পতিসরের কাচারি বাড়িতে। কখনও কখনও পালকি ব্যবহার করতেন কবি। কিন্তু এখন না আছে পদ্মাবোট, না আছে পালকি। জলপথে তাঁর সঙ্গী ছিল প্রিয় বোট ‘পদ্মা’। আরও একটি ছোট নৌকা ছিল। নাগর নদীতে প্রিয় ‘পদ্মা বোট’-এ বসে তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা
‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে,
সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’।
কবিতার তালগাছটি নেই। তবে তাঁর স্মৃতিঘেরা নাগর নদী আজো প্রবাহমান। পতিসরের তাঁর কাচারিবাড়ির কোল ঘেঁষেই আঁকাবাঁকা বয়ে গেছে নাগর। স্থানীয়রা নাগরকে ডাকে ‘ছোট নদী’। পতিসরে বসে এই নাগর নিয়েই তিনি লিখেছেন তাঁর সেই কবিতা ‘আমাদের ছোটো নদী’।
“আমাদের ছোটো নদী
আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।”
পূর্ববঙ্গে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারির মোট তিনটি পরগণা ছিল।একটি নদীয়া জেলার বিরাহিমপুরে, তার কাচারি ছিল শিলাইদহে; দ্বিতীয়টি রাজশাহী জেলার কালিগ্রামে, তার কাচারি ছিল পতিসরে; তৃতীয়টি ছিল পাবনা জেলার শাজাদপুরে, তার কাচারি শাজাদপুর গ্রামেই ছিল।ক্রয়সূত্রে ১৮৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কালিগ্রাম পরগনাটি জমিদারির অন্তর্ভূক্ত করেন।নওগাঁ, বগুড়া ও নাটোর জেলার ৬ শ টি গ্রাম নিয়ে কালিগ্রাম পরগনা গঠিত। এর আয়তন ছিল ২৩০ বর্গমাইল। রাতোয়াল ও ভান্ডারগ্রামে আরো দুটি সাব কাচারী ছিল। রাতোয়াল পতিসর থেকে ১০ কিলোমিটার আর ভান্ডারগ্রাম ২০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। কালিগ্রাম পরগনার সীমানা ছিল উত্তরে মালশন আদমদিঘী; দক্ষিণে আত্রাই নদী; পূর্বে নাগর নদীর পশ্চিম তীর আর পশ্চিমে নাগর বিধৌত বাঁকা-কাশিয়াবাড়ি গ্রাম।
রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারি দেখা শোনার দায়িত্ব নিয়ে শিলাইদহে এসেছিলেন ১৮৮৯ সালে এবং পতিসরে ১৮৯১ সালের জানুয়ারীতে। গোলাম মুরশিদের মতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে পতিসর আসেন ১৮৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে। আহমদ রফিকের মতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯১ সালের ১৩ জানুয়ারী শাহাজাদপুর হতে পতিসর অভিমুখে রওনা হয়ে সম্ভবত ১৬ জানুয়ারী পতিসর পৌঁছান। পতিসর থেকে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে পত্রে লেখেন-‘‘আজ আমি কালীগ্রামে এসে পৌঁছালুম, তিন দিন সময় লাগল।’’
পতিসরে কবিগুরুর আসা কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবে নয়,অনেকটাই ভাগ্যক্রমে। ১৯২২ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উত্তরসূরীদের মাঝে জমিদারি ভাগ করে দেন। এজমালি সম্পত্তির সবশেষ ভাগে বিরাহিমপুর ও কালিগ্রাম পরগনার মধ্যে সত্যেন্দ্র পুত্র সুরেন্দ্রনাথকে তাঁর পছন্দের অংশ বেছে নিতে বললে সে তখন বিরাহিমপুরকে পছন্দ করে। তখন স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের ভাগে পড়ে কালিগ্রাম পরগনা। যার সদর দপ্তর ছিল পতিসর।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য পতিসরে একটি দো-তলা কুঠিবাড়ি রয়েছে। ভবনে প্রবেশের জন্য রয়েছে নান্দনিক একটি প্রবেশপথ।ভবনের সামনেই রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি আবক্ষ মূর্তি। এছাড়াও কুঠিবাড়ি ঘিরে বেশ কিছু ভবনের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। কাচারী বাড়ির পাশেই রয়েছে একটি পুকুর। কালক্রমে এটি মাটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এই স্থানটির চারপাশেই রবি ঠাকুরের পরিবার কর্তৃক স্থাপিত বেশ কিছু স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, একটি বিদ্যালয়(কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইন্সটিটিউশন), দাতব্য হাসপাতাল ও পুরাতন একটি কৃষি ব্যাংক যা ১৯০৫ সালে স্থাপিত হয়েছিল।
কালীগ্রাম পরগনার প্রজাদেরকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে পতিসর, রাতোয়াল ও কামতা ৩টি বিভাগে ৩টি মধ্য ইংরেজী (এম.ই) স্কুল ও পতিসরে ছেলে রথীন্দ্রনাথের নামে ১টি হাইস্কুল স্থাপন করেন। স্কুলের ভবন, ছাত্রাবাস নির্মাণ ও অন্যান্য খরচ এস্টেট থেকে বহন করা হতো। পতিসরে অবস্থিত কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনষ্টিটিউশনের প্রথমে নাম ছিল পতিসর এম.ই স্কুল। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে বিদ্যালয়টি হাইস্কুলে রুপান্তরিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এটি ছিল নওগাঁর জেলার তৃতীয় হাইস্কুল। ১৯১৩ সালের জানুয়ারী মাসে রাতোয়াল বিভাগে একটি বিদ্যালয় এবং কামতায় আরো একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠান গুলোর প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই।স্বর্গ হইতে বিদায়’ নিয়ে মানুষের কাছে তাঁর অবস্থান নির্ধারণ করে কবি ধূলিধূসরিত মাটির পৃথিবীতে, তাঁর ভাষায় ‘সংসারের তীরে’ নেমে আসেন।এখানকার কৃষকদের কল্যাণে তাঁর নোবেল পুরস্কারের এক লাখ আট হাজার টাকা দিয়ে এখানে একটি ‘কৃষি ব্যাংক’ স্থাপন করেন। গঠন করেছিলেন কৃষি, তাঁত ও মৃৎশিল্পের সমবায় সংগঠন।১৯৩৭ সালে ২৬ জুলাই কবি শেষবারের মতো এসেছিলেন তার পতিসরের কাচারিবাড়িতে।
কবির ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৪ সালে এ এলাকার প্রজাদের জন্য সর্বপ্রথম আধুনিক সময়ের কলের লাঙ্গল এনেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন সরকার ১৯৫২ সালে এক অর্ডিন্যান্স বলে কালিগ্রাম পরগনার জমিদারি কেড়ে নিলে ঠাকুর পরিবারের এ জমিদারি হাতছাড়া হয়ে গেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর সস্ত্রীক পতিসর যাতায়াত বন্ধ করে দেন।
➤পতিসর রবীন্দ্র মিউজিয়াম :
শেষবার ১৯৩৭ সালে বোটে করে কবি পতিসরে আসেন। ফেরার সময় তিনি বোটটি পতিসরে রেখে যান। কবি রেলগাড়িতে কলকাতা ফিরে যান। বোটের খণ্ডিত অংশ এবং নোঙ্গর মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।
মিউজিয়াম বা কুঠিবাড়িতে দুটোঘরে দর্শনার্থীর জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে কবির দেয়াল ঘড়ি, লোহার সিন্দুক, খাট, টি-টেবিল, টি-পট, ট্রাক্টরের ভগ্নাংশ, কবির বাথটাব, চায়ের কেটলি, রাইস ডিশ, কবির বিভিন্ন বয়সের ছবি, কবির স্বহস্তে লিখিত ৬ পৃষ্ঠার চিঠির ফটোকপি, বিশাল আয়না, আরাম কেদারা, ওয়্যারড্রব, গ্লোব, সিন্দুক, খাজনা আদায়ের টেবিল, আলমারি, দরজার পাল্লা, জানালা, কবির বজড়ার রেপ্লিকাসহ নানা সামগ্রী। মিউজিয়ামে সংরক্ষিত পতিসরে লেখা বিশেষ দুটি কবিতা হচ্ছে-
‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’ এবং
‘তালগাছ, এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।
➤পতিসরে রবীন্দ্রনাথের লেখা
‘বিদায় অভিশাপ’, কাব্যগ্রন্থ চিত্রা,
উপন্যাস গোরা ও ঘরে বাইরে উপন্যাস-এর অনেকাংশ। ছোটগল্প
প্রতিহিংসা ও ঠাকুরদা।
প্রবন্ধ ইংরেজ ও ভারতবাসী।
গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার নিভৃত সাধনা, বধূ মিছে রাগ করো না, তুমি নবরূপে এসো প্রাণে ইত্যাদি।
এই পতিসরে বসেই চৈতালী কাব্যের ৫৪টি কবিতা লিখেছেন।
লিখেছেন সন্ধ্যা, দুই বিঘা জমি -এর মতো অনেক বিখ্যাত কবিতা।
➤পূর্ব বাংলায় এসে রবীন্দ্র প্রতিভা সৃজনশীলতার যথার্থ পথ খুঁজে পেয়েছিলো, একথা অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ এবং আহমদ রফিকের মতো গবেষকরা বলেছেন। এটাও একটা আশ্চর্য ব্যাপার যে, রবীন্দ্রনাথের ভাগে জমিদারি দেখার দায়িত্ব পড়েছিলো পূর্ব বাংলায়। আহমদ রফিক বলেন, ‘এক দিকে তাই পদ্মা ইছামতি আত্রাই ও নাগরী নদী এবং এদের তীরবর্তী অঞ্চলের রূপবৈচিত্র্য রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসৃষ্টির ধারায় নতুন, বলিষ্ঠ ও প্রাণবস্তু উৎসমুখ খুলে দিয়েছিলো, তার সৃষ্টিকে বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ করে তুলেছিলো। অন্য দিকে সেখানকার জীবন ও জনপদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রভাব রোমান্টিক কবির চেতনায় গভীর দাগ কাটে, দাগ কাটে কবি মনের সংবেদনশীল পলিস্তরে। কবির উপলব্ধি কর্মী রবীন্দ্রনাথের জন্ম দেয় পল্লী উন্নয়ন ও স্বদেশী সমাজ গঠন তার জন্যে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। কবির স্বপ্ন হয়ে ওঠে আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী গ্রামীণ মানুষের এক স্বনির্ভর সমাজ।’ (রবীন্দ্র ভুবনে পতিসর-সাহিত্য প্রকাশ- ১৯৯৮, পৃ: ১৩-১৪)।
প্রমথ নাথ বিশীও বলেছেন, ‘যে প্রতিভা এতকাল অসহায়ভাবে হাতড়িয়ে যোগ্য আসনটি খুঁজে মরছিল, ভুল আসনে বসতে গিয়ে ‘ভগ্নহৃদয়’ লিখছিল, আঁকছিল সেই সব নরনারী যারা …….. আজ কল্পনা রাজ্যের ছায়া উপচ্ছায়া মাত্র, কিংবা অনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক জগতের অস্পষ্ট প্রেতমূর্তি মাত্র, হঠাৎ তার সম্মুখে উদঘাটিত হয়ে গেল ‘ঐঁসধহ যধনরঃধঃরড়হ ধহফ হধসব’- এর বাস্তব পৃথিবী।’ (ঐ-পৃ: ১৪)।
বিশী মহাশয় আর আহমদ রফিকের কথা মেনে নিলে স্বীকার করতে হয়, রবীন্দ্রনাথের মহৎ প্রতিভা বিকশিত হয়েছে পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের মাটিকে ভিত্তি করে। বাউল সম্রাট লালন ফকিরও এই মাটির প্রতিভা। রবীন্দ্রনাথকেও বলা হয় ‘রবীন্দ্র বাউল’।
লালন ফকিরের মতো লৌকিক প্রতিভাকে রবীন্দ্রনাথ আবিস্কার করেছিলেন। তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘গোরা’র শুরুই লালনের গান দিয়ে। ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।’ ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচনা করেছেন তিনি বাউল সুর দিয়ে। লালনের শিষ্য গগন হরকরার গান, ‘আমার মনের মানুষ যে-রে, কোথায় পাবো তারে,’ যে সুরে রচিত, ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিও সেই সুরে রচিত। বাউল গানের মধ্যে, বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সন্ধান পেয়েছিলেন মানবধর্মের সুর। বাউল ভক্ত রবীন্দ্রনাথকে বলা হতো ‘রবীন্দ্র বাউল।’
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের দিন থেকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হৃদয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বেজে উঠেছিলো। একথা ভাবতে প্রসন্ন পুলক অনুভব করি যে পূর্ব বাংলার মাটিতে এই অমর গানটির সুর প্রোথিত। আর আমাদের রবীন্দ্র প্রেমিক বঙ্গবন্ধু এই গানটিকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্ন পত্রাবলী’র প্রতিটি চিঠি পূর্ব বাংলার কাদামাটি দিয়ে লেখা। সেখানে পাওয়া যাবে জীবন্ত বাংলাদেশ। তার এক চিঠিতে বলেছেন, ‘এই অতি ছোট নদী এবং নিতান্ত ঘোরো রকমের বহিঃপ্রকৃতি আমার কাছে বেশ লাগছে। ঐ অদূরেই নদী বেঁকে গিয়েছে ওখানটিতে একটি ছোটো গ্রাম এবং গুটি কতক গাছ, এক তীরে পরিপক্ব ধানের ক্ষেত …… অন্য তীরে শূন্যমাঠ ধূ ধূ করছে-নদীর জলে শ্যাওলা ভাসছে, ………. আকাশে উজ্জ্বল রৌদ্রে একপাল চিল উড়ছে …… গয়লাদের বাড়ীর কাছে এক খন্ড শর্ষে ক্ষেতে বিকশিত শর্ষে ফুল যেন আগুন করে রয়েছে। নিকোনো আঙিনায় বাঁধা গোরু, …… খড় স্তূপাকার, ……. এখানে সমস্তই খুব কাছাকাছি।’ (আহমদ রফিক-রবীন্দ্র ভুবনে পতিসর)।
না, রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশকে খন্ডিত, সৌখিন দৃষ্টিতে অবলোকন করেন নি। সমগ্র, অখন্ড এবং পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিতে, মন ও মননের চোখ দিয়ে দেখেছিলেন বাংলাদেশকে। সে ভাবেই সামগ্রিক মূর্তিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্রাবলী’-তে আর গল্পগুচ্ছে।
পূর্ব বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ পল্লী উন্নয়ন ভাবনায় মগ্ন হয়েছিলেন। এক চিঠিতে বলেছেন, ‘পতিসরে আমি কিছুকাল হইতে পল্লী সমাজ গড়িবার চেষ্টা করিতেছি যাহাতে দরিদ্রচাষী প্রজারা নিজেরা একত্র মিলিয়া দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্য ও অজ্ঞান দূর করিতে পারে।’ (আহমদ রফিক রবীন্দ্র ভুবনে প্রতিসর)।
এ প্রসঙ্গে আহমদ রফিকের কথাটা মূল্যবান, ‘রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখা শোনার দায়িত্ব নিয়ে শিলাইদহে এসেছিলেন ১৮৮৯ সালে এবং পতিসরে ১৮৯১ সালের জানুয়ারীতে। এখানে এসে অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, চরম অর্থনৈতিক দুর্দশা দেখে কবির মাথায় আসে গ্রাম উন্নয়নের পরিকল্পনা। এটা তার কবি মনের কোনো সাময়িক আবেগের হঠাৎ প্রকাশ ছিল না। দিনের পর দিন অভিজ্ঞতাই বরং তাকে এদিকে দৃঢ় আকর্ষণে টেনে এনেছিলো। এবং শেষ পর্যন্ত, একাজ তার কাছে সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যে পরিণত হয়েছিল।’ (রবীন্দ্র ভুবনে পতিসর, সাহিত্যপ্রকাশ, ১৯৯৮, পৃ: ৭৪-৭৫)।
রবীন্দ্রনাথের মতো আপাদমস্তক কবি বলেন কিনা, ‘আমি গ্রামে গ্রামে যথার্থ ভাবে স্বরাজ স্থাপন করতে চাই।’ বিশ্ব কবি বলেছেন, ‘আজ সকলের চেয়ে বড় দরকার শিক্ষার সাম্য।’ বাংলার শিক্ষা বঞ্চিতদের লক্ষ্য করে কথাটি বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতো কবি বলেছেন, ‘আমি দীর্ঘকাল ভদ্র সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে হাবু ডুবু খেয়েছি। এবার চাষাদের সেবায় মন দিতে হবে।’
রবীন্দ্রনাথের বুকের গভীরে পূর্ববঙ্গের স্মৃতি জড়িত ছিলো। কখনো বিস্মৃত হননি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল প্রাপ্তির পর সর্বশেষ ১৯৩৭ সালে পতিসরে আসেন।১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই পতিসরে ‘পূণাহ্য’ অনুষ্ঠানে।রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিকের বইতে পেয়েছি, ১৯৩৭ সালে পূর্ববঙ্গের পতিসর থেকে শেষ বিদায় নেয়ার সময় কেমন হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিলো। বিদায় জানাতে এসেছিলো অধিকাংশই মুসলমান সম্প্রদায়ের চাষীরা। তারা কবিকে বিদায় সংবর্ধ জানিয়েছিলো। চোখের পানি ফেলেছিলো। এখান থেকে বিদায় নেবার সময় বলেছিলেন, ‘তোমরা নিজের পায়ে দাঁড়াও।’ আরো বলেছিলেন, ‘জন সাধারণের জন্য সবার আগে চাই শিক্ষা।’
১৯৩৭ সালে পতিসর থেকে বিদায়ের শেষ দিনটিতে। কুঠিবাড়ীর সামনের রবীন্দ্র সরোবর ঘাটে সমবেত প্রজাদের উদ্দেশ্যে বলেন,
“আমি অসুস্থ আর হয়তো তোমাদের কাছে আসতে পারবো না। তোমরা আমাকে অনেক দিয়াছো। আমি তোমাদের কিছুই দিতে পারি নাই। আমি প্রার্থনা করি তোমরা সুখী হও – শান্তিতে থাকো”।
➤বালক রবীন্দ্রনাথের স্কুলশিক্ষায় ছিল অনাগ্রহ, তাই তার জন্য বাড়িতেই রাখা হয় গৃহশিক্ষক। তিনি বাড়িতে পড়াশোনা, গান ও আঁকা শেখা ছাড়াও প্রায় প্রতিদিন ভোরে উঠে তখনকার বিখ্যাত কুস্তিগির হিরা সিং এর কাছে কুস্তি শিখতেন।ঘুমাতেন কম।তিনি খুব গভীর রাতে শুতেন। আবার উঠে যেতেন প্রায় শেষ রাতে।
কবির পোশাক : গুরুদেব বাড়িতে সাধারণত গেরুয়া বা সাদা রঙের জোব্বা আর পায়জামা পরতেন। এছাড়া তিনি উপাসনা বা সভা সমিতিতে যাবার সময় জোব্বা ছাড়াও সাদা ধুতি, জামা ও চাদর ব্যবহার করতেন। ঋতু উৎসবে ঋতু অনুযায়ী নানা রঙের রেশমী উত্তরীয় ব্যবহার করতেন। যেমন বর্ষায় কালো বা লাল, শরতে সোনালি, বসন্তে বাসন্তী রঙের। কখনো কখনো জোব্বার রঙও হতো উত্তরীয়র রঙের।
সন্ধ্যায় খেতেন রাতের খাবার। রাতে তিনি বিদেশি খাবার খেতেই পছন্দ করতেন। আর দুপুরে সাধারণত বাঙালি খাবার খেতেন।
➤প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘ঠাকুর গোষ্ঠীর আদি পুরুষ জগন্নাথ কুশারী পীরালি ব্রাহ্মণ শুকদেব রায় চৌধুরীর এক কন্যাকে দক্ষিণ ডিহি গ্রামের (খুলনা) ভূ সম্পত্তি পেয়ে সেখানেই বাস করতে থাকেন; পীরালি ঘরে বিবাহ করে জগন্নাথ সমাজে হলেন পতিত। তুর্কী পাঠানদের শাসনকালে মুসলমানদের সংস্পর্শ আসার জন্য অনেক ব্রাহ্মণ ও কায়েস্ত পতিত হন।’ (রবীন্দ্র জীবন কথা)।
রবীন্দ্রনাথ নিজে এবং তার পত্নী মৃনালিনী দেবী এই ‘পতিত’ পরিবারের মানুষ।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য বরিশাল:
ধান নদী খাল,তিনে বরিশাল। বরিশালের পূর্ব নাম চন্দ্রদ্বীপ।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চন্দ্রদ্বীপ রাজা রামচন্দ্র রায়ের স্ত্রী বিভাবতী বা বিমলাকে নিয়ে বিখ্যাত উপন্যাস বৌ-ঠাকুরানীর হাট’ রচনা করেন।
✪ বরিশালের ইদিলপুর পরগণায় কলকাতার ঠাকুর ষ্টেটের জমিদারী ছিল। এ জমিদারিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অংশ ছিল।বরিশালে অলাভজনক আখের মাড়াই কল ছিল।। রবীন্দ্রনাথ এক পত্রে লিখেছেন: “বরিশালের আখের কলের কাজ সম্পর্কে টাকা বা খবর না পাইয়া উদ্বিগ্ন হইয়া মোকাম পরিদর্শক নগেন্দ্রকে পাঠাইয়াছি। যে রিপোর্ট পাইতেছি তাহাতে উদ্বেগের কারণ বাড়িয়া উঠিয়াছে।”
✪ রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই পুত্র দ্বীপেন্দ্রনাথ ও অরুণেন্দ্রনাথ যথাক্রমে বরিশালের লাখুটিয়ার জমিদার রাখাল চন্দ্র রায়ের সুন্দরী ও বুদ্ধিমতি দুই কন্যা সুশীলা ও চারুশীলাকে বিয়ে করেন।রাখাল চন্দ্র রায়ের একমাত্র পুত্রের নাম ছিল দেবকুমার রায়।
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠা কন্যা ১৪ বছর বয়স্কা মীরা দেবীকে নগেন্দ্র গাঙ্গুলীর সাথে বিয়ে দেন। নগেন্দ্র গাঙ্গুলী তৎকালীন বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের নেতা ও সদর হাসপাতাল সড়কের বাসিন্দা শ্রী বামুন দাশ গাঙ্গুলীর পুত্র। ১৩১৪ সনের ২৮ জ্যেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কন্যা ও জামাতাসহ বরিশালে আসেন। ঐ সময় জামাতার বাড়িতে এক সপ্তাহ অবস্থানকালীন স্থানীয় গুণিজনের সাথে বরিশালে সাহিত্য পরিষদ শাখা খোলার আলোচনা করেন।
[বিয়ের শর্তানুযায়ী ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জামাতাকে উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকায় প্রেরণ করেন।১৯২০ সালে অকৃজ্ঞ নগেন্দ্রনাথের সাথে মীরার দাম্পত্য জীবনের অবসান এবং ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মীরা দেবী মৃত্যু বরণ করেন ]
✪ প্রথম বার বরিশাল আসার পূর্বে ৮ এপ্রিল ১৯০৬ সালে, এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন, “ঘুরিয়া মরিতেছি, সম্প্রতি আগরতলায় আটকা পড়িয়া গেছি। বরিশাল যাইতে হবে….।”
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল বরিশালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সুযোগে কবির একান্ত ভক্ত বরিশালের সুসাহিত্যিক দেবকুমার রায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ বরিশাল শাখার সম্মেলন আহবান করেন।ঐ সম্মেলনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাপতিত্ব ও অভিভাষণ প্রদান করার কথা ছিল। করিগুরু আগরতলা হতে রওনা হয়ে ২ বৈশাখ ১৩১৩ সনে, ১৫ এপ্রিল ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে রবিবার দুপুরে জলপথে বরিশাল পৌঁছেন। ১৪ এপ্রিল কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন শুরু হলে পুলিশ তাতে হামলা চালিয়ে জনতাকে নির্যাতন করেন। পুলিশ জনতার তুমুল সংঘর্ষে সম্মেলন ভেঙ্গে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ শহরে প্রবেশ করেননি। বরিশাল ভাটার খালের কাছে বজরাতে অবস্থান করতে থাকেন।
সন্ধ্যায় সম্মেলনের উদ্যোক্তা দেব কুমার রায় চৌধুরী ব্যথিত মনে নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বজরায় এসে কবির সাথে সাক্ষাৎ করেন।সাহিত্য সম্মেলন অনিশ্চিত।তাই পরের দিন ১৬ এপ্রিল সকালে কবি বরিশাল থেকে রওনা দিয়ে ১৭ এপ্রিল শান্তিনিকেতনে পৌঁছেন।কবিদর্শনে বঞ্চিত হলেন বরিশালবাসী । ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল “The Bengalee” পত্রিকায় লিখেছে : Babu Rabindranath Tagore reached here last noon and left this morning. The literary conference has been given up”.
➤তথ্য সংগ্রাহক ও লেখক:
এস. এম. শাহনূর
১১ নভেম্বর ২০২০ইং
তথ্যসূত্র:
[১] সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (প্রথম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা।
২০১০
[২] The Daily Ittefaq ঢাকা, সোমবার ১০ জুন ২০১৩, ২৭ জৈষ্ঠ্য ১৪২০, ৩০ রজব ১৪৩৪।
রবীন্দ্রনাথর স্মৃতিধন্য চট্টগ্রাম:
বাংলা সাহিত্যে একমাত্র বাঙালি নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর চট্টগ্রাম ভ্রমণের সাথে জড়িয়ে আছে বন্দর নগরীর দুটি বাড়ি। একটি-
জেনারেল হাসপাতাল পাহাড়ের উত্তর দিকের কমলকান্ত সেনের দ্বিতল বাড়ি
এবং অপরটি নগরীর পার্সিভিল হিলের ‘দি প্যারেড’ নামের বাড়িটি।
চট্টলার প্রথম থিয়েটার হল – সদরঘাট এলাকার কমলবাবুর থিয়েটার (অধুনালুপ্ত লায়ন সিনেমা হল), এবং চট্টগ্রাম পুরাতন রেল স্টেশন- বটতলী স্টেশন।পরিতাপের বিষয় বটতলী রেল স্টেশন ছাড়া বাকীগুলোর কোনো অস্তিত্বই এখন আর নেই। এত এত বছরেও তার পদধূলিতে ধন্য স্থানগুলোতে গড়ে উঠেনি কোনো স্মৃতি চিহ্ন,নেই কোনো স্মৃতি স্মারক।
১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর ৩৫তম বর্ষপূর্তিতে ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম নামক সংকলনে লেখা হয়েছে, “রবীন্দ্রনাথ দুদিনের সফরে চট্টগ্রামে এসেছিলেন ১৯০৭ সালের ১৭ জুন সোমবার। তার সফর সঙ্গী ছিলেন ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বন্ধু কেদারনাথ দাশগুপ্ত।”২
বরিশাল সফর শেষে কবি ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭২-১৯৪০), কেদারনাথ দাশগুপ্ত (১৮৭৮-১৯৪২) প্রমুখকে সাথে নিয়ে ১৭ জুন ১৯০৭ তারিখ সকালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছেন।
“রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রাম আসার উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শাখা খোলার জন্য চট্টগ্রামের কবি সাহিত্যিকদের উৎসাহিত করা ও সুহৃদ যামিনীকান্ত সেনের আমন্ত্রণ রক্ষা।”২
কবি সংবর্ধনার অন্যতম উদ্যোক্তা (যামিনীকান্ত সেনের পিতা) সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব উকিল কমলাকান্ত সেন মারা যান ১৯০৬ সালে। তাঁর প্রতি কবিমনে শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হওয়ায় কবিকে চট্টগ্রাম আসতে আরো বেশি আবেগতাড়িত ও অনুপ্রাণিত করেছিল।
রবীন্দ্রনাথকে চট্টগ্রামে অভ্যর্থনা কমিটির প্রধান যামিনীকান্ত সেন ছিলেন চট্টগ্রাম হিতসাধনী সভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।কলকাতা হাই কোর্টের উকিল।পরে শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা করেন।
‘রবীন্দ্র ভুবনে বাংলাদেশ’ এ উল্লেখ আছে, “রবীন্দ্রনাথের আগমন উপলক্ষে চট্টগ্রাম রেল স্টেশন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে ত্রিপুরাচরণ চৌধুরী ও কাজেম আলী মাস্টার প্রমুখের উদ্যোগে রেল স্টেশনটি ফুল ও পাতা দিয়ে সাজানো হয়। স্টেশন থেকে ঘোড়ার গাড়িতে করে কবিকে জেনারেল হাসপাতালের পাহাড়ের উত্তর দিকে যামিনীকান্ত সেনের বাবা কমলাকান্ত সেনের দুইতলা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেই বাড়ির সামনের মাঠে সেদিন কবিকে দেখতে ও কথা বলতে অনেকেই জড়ো হয়েছিলেন। সেই বাড়ি আর নেই। বর্তমান জেমিসন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালের পাশেই ছিল সেই বাড়িটি।”১]
১৭ জুন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম কলেজের আইনের অধ্যাপক সাহিত্যিক রজনীরঞ্জন সেনের (১৮৬৭-১৯৩৪)বাসায় স্থানীয় স্বদেশপ্রেমিক কবি-সাহিত্যিকদের সাথে চট্টগ্রামে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-এর শাখা গঠন সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেন কবি।পার্সিভিল হিলে ‘দ্যা প্যারেড’ নামের যে বাড়িতে সেই সভা হয়েছিল সেই বাড়িটিও এখন নেই।
১৭ তারিখ কমলাকান্তের বাসায় রাত্রিযাপন করে ১৯০৭ সালের ১৮ জুন মঙ্গলবার সকালে কবি কয়েকজন সঙ্গীসহ শহর দেখতে বের হন এবং কর্ণফুলী নদীর তীরে জাহাজঘাটে গিয়ে জাহাজের মাঝি-মাল্লার সাথে কথা বলেন।২
১৮ জুন ১৯০৭। ওইদিন বিকেলে নগরীর সদরঘাটস্থ কমলাবাবুর থিয়েটার হলে হাজারো স্বদেশপ্রেমিক সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের উপস্থিতিতে কবিকে জাঁকজমকপূর্ণ এক সংবর্ধনা দেয়া হয়। বর্ষণমুখর শেষ বিকেলে হাজারো মানুষের স্বতস্পূর্ত উপস্থিতি কবিকে বেশ আনন্দ দিয়েছিল।সংবর্ধনার জবাবে কবিগুরু সেখানে ভাষণ দেন।ওই সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গান গেয়েছিলেন বলেও জানা যায়।
পরবর্তীতে এই থিয়েটার হলটি লায়ন সিনেমা হল,
অধুনালুপ্ত লায়ন সিনেমা হলের স্থানে এখন বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে।
১৮ জুন রাত ৮:৩০ মিনিটে সফরসঙ্গীদের নিয়ে ট্রেনে করে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
নোবেল পাবার ৬ বছর আগেই চট্টগ্রামবাসী কবিকে সংবর্ধনা দিয়েছিল যা সত্যিই চট্টগ্রামবাসীর জন্য গর্বের। এছাড়াও ১৯– সালের ৭ জুলাই চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান কেদারনাথ দাশগুপ্ত লন্ডনে কবিগুরুকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন।
[কবির অনুপ্রেরণায় দেরিতে হলেও ১৯১১ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের চট্টগ্রাম শাখা গঠিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রাম আগমনের ছ’বছর পর ১৯১৩ সালের ২২ ও ২৩ মার্চ চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ষষ্ঠ অধিবেশন। মিউনিসিপ্যাল স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত দুই দিনের অধিবেশনে অবিভক্ত বাংলার খ্যাতিমান ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও সাহিত্যসেবী আচার্য প্রফুল্লকুমার রায়, সাহিত্যিক অক্ষয় চন্দ্র সরকার, প্রখ্যাত কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (ডিএল রায়), ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাাথ দত্ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খ্যাতনামা অধ্যাপক ও সুসাহিত্যিক বিনয় সরকার, প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও সাহিত্যপ্রেমী রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, বাগ্মী-রাজনৈতিক নেতা ও সাহিত্যসেবী বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ।]
১২ নভেম্বর ২০২০ই;
তথ্য ঋণ:
[১] ‘রবীন্দ্র ভুবনে বাংলাদেশ’।। সালাম আজাদ
বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ।
[২] হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ গ্রন্থ
[৩] চট্টগ্রামে রবীন্দ্রনাথ,নজরুল ও অন্নদাশংকর।।নিতাই সেন
প্রথম প্রকাশ-ফেব্রয়ারি ২০১২
অ্যাডর্ন পাবলিকেশন
আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম।
[৪] স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম।।উকিল শ্রী পূর্ণেন্দু দস্তিদার বি. এল.
লালন ও রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথা :
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন লালনের তত্ত্ব ও গানের এক মহান ভক্ত। ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আসেন তখনই কোনো একসময়ে লালন সাঁইজির সাথে তাঁর দেখা হয়। তিনি লালন ফকিরের ২০টি গান প্রবাসী পত্রিকায় হারামনি বিভাগে প্রকাশিত করেছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া তাঁর বক্তৃতায় তিনি লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানের ইংরেজি অনুবাদ বিদেশি শ্রোতাদের শুনিয়েছিলেন। লালনের গানে রবীন্দ্রনাথ দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক লেখায় বলেছেন ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন। আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’ ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়/ধরতে পারলে মনো-বেড়ি দিতাম পাখির পায়’ লালনের এই গানটি শুনে রবীন্দ্রনাথ এমনই মুগ্ধ হলেন, দেহতত্ত্বের এ গানটিকে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন। ১৯২৫ সালের ভারতীয় দর্শন মহাসভায় ইংরেজি বক্তৃতায় এই গানের উদ্ধৃতিও দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ নিজে স্বপ্রণোদিত হয়ে লালনের ২৮৯ টি গান সংগ্রহ করেন। রবীন্দ্রনাথই বাঙালির লালনকে ছড়িয়ে দিয়ে বিশ্বমায়ের লালনে পরিণত করেন।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য খুলনার দক্ষিণডিহি :
রবীন্দ্রনাথ বাইশ বছর বয়সে ১৮৮২ সালে তার মেজবৌদি ও সেজ বৌদির সাথে খুলনা জেলার দক্ষিণডিহি গ্রামে এসেছিলেন। কবির মামাবাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ি উভয়ই খুলনা জেলার ফুলতলা থানার দক্ষিণডিহি গ্রামে। রবীন্দ্রনাথের মা সারদা সুন্দরী দেবী ও কাকীমা ত্রিপুরা সুন্দরী দেবী এই গ্রামেরই মেয়ে। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীও তাই। ১৮৮২ সালে পূজার ছুটির সময় সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী উৎসাহী হয়ে বাস্তুভিটা দেখবার অজুহাতে কাছাকাছি পীরালী পরিবারের কোনো কন্যাকে বধূ হিসেবে বরণের জন্যে আসেন। জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে কাদম্বরী দেবী, বালিকা ইন্দিরা, বালক সুরেন্দ্র নাথ ও রবীন্দ্রনাথ আসেন পুরান ভিটা দেখতে। সে সময় ফুলতলা গ্রামের বেণীমাধব রায় চৌধুরীর কন্যা ভবতারিনীকে তারা নির্বাচন করেন, যার নাম বিয়ের পরে হয় মৃণালিনী। শৈশবে কবি কয়েক বার তাঁর মায়ের সঙ্গে দক্ষিণডিহি গ্রামের মামা বাড়িতে এসেছিলেন। এখানে কবিগুরু ও কবিপত্নীর আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য পিঠাভোগ :
পিঠাভোগ গ্রামটি বাংলাদেশের খুলনা জেলার ভৈরব নদের অববাহিকায় অবস্থিত একটি গ্রাম। এটি রবীন্দ্রনাথের পিতৃপুরুষের ভিটা। একবার খুলনায় সাক্ষ্য দিতে এসে তিনি পিঠাভোগ গ্রামে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তবে তিনি আদৌ পিঠাভোগ গ্রামে যেতে পেরেছিলেন কিনা তা জানা যায়নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য সিলেট:
১৯১৩ সালে বাংলা ভাষায় সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিস্ময়কর প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ।কবির ভাষায় ‘আমাদের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনায় নজরুল’।
‘মমতাবিহীন কালস্রোতে
বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হোতে
নির্বাসিতা তুমি
সুন্দরী শ্রীভূমি।
ভারতী আপন পুণ্যহাতে
বাঙালীর হৃদয়ের সাথে
বাণীমাল্য দিয়া
বাঁধে তব হিয়া।
সে বাঁধনে চিরদিন তরে তব কাছে
বাঙলার আশীর্বাদ গাঁথা হয়ে আছে।’
[রবীন্দ্রনাথের সিলেট ভ্রমণের স্মারক গ্রন্থ, ১৯৪১ সালে প্রকাশিত, ‘কবি প্রণাম’-এ সিলেট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লিখিত এবং ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ স্বাক্ষরিত, কিন্তু তারিখবিহীন উপরোক্ত কবিতাটি পাওয়া যায়। রবীন্দ্র গবেষকদের অনুমান ১৯৩৬ সালে এই কবিতা রচিত হয়েছিল।বর্তমানে কবিতাটির মূল কপি আছে বিড়লা সংগ্রহে।অন্য তথ্য থেকে জানা যায় কবিতাটি লেখা হয়েছিল নগেন্দ্রনাথ চৌধুরীর বাড়িতে।]৫
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শৈলশিখরে অনুপম সাদা মেঘের খেলা করা শিলং এ এসেছিলেন।
নোবেলবিজয়ী বিশ্বকবির শিলং এ আসার বার্তা সিলেটে আসা মাত্রই তৎকালীন শ্রীহট্ট ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক গোবিন্দ নারায়ণ সিংহ কবিকে শ্রীহট্টে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি টেলিগ্রাম পাঠালেন।
প্রতিউত্তরে কবি অপারগতা প্রকাশ করে Journey Long and tedious লিখে ‘তার বার্তা’ পাঠালেন। কবির অসম্মতিসূচক বার্তা পেয়ে ‘আঞ্জুমান ইসলাম, শ্রীহট্ট মহিলা সমিতিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শ্রীহট্টে কবিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠালেন। সিলেট এম সি কলেজের এক শিক্ষকের পাঠানো তারবার্তা ছিল, ‘Sylhet desires India’s greatest son to honour her by his visit’. (ভারতের বরপুত্র শ্রীহট্ট ভ্রমণ করে তাকে গৌরবান্বিত করুন)। অগত্যা কবি শ্রীহট্ট ভ্রমণের সম্মতি জানালেন।
(বাংলা বর্ষপঞ্জিকা তথ্যমতে ১৩২৬ বঙ্গাব্দ)।১৯১৯ সালের ৪ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ সিলেটের উদ্দেশ্যে আসেন এবং কুলাউড়া স্টেশনে রাত যাপন করে ৫ নভেম্বর বাংলা ১৩২৬ সনের কার্তিক। না শীত না গরম। চমৎকার আবহাওয়া। সিলেট এলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।সিলেটে তিনি ৭ নভেম্বর পর্যন্ত অবস্থান করেন ।
তখন শিলং থেকে সড়কপথে সিলেট আসার ব্যবস্থা ছিল না।শিলং তখন আসামের রাজধানী এবং শ্রীহট্ট আসামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর/প্রদেশ। চেরাপুঞ্জি দিয়ে দুর্গম পথে থাবায়/ খাসিয়াদের পিঠে চড়ে আসতে হতো। এ কথা শুনে কবি বলেছিলেন ‘বরং দশ মাইল হেঁটে পাহাড় উৎরাই করতে পারি তবু মানুষের কাঁধে চড়তে পারব না।’ তাই আসাম-বেঙ্গল রেলপথে গুয়াহাটি-লামডিং-বদরপুর-করিমগঞ্জ-কুলাউড়া দিয়েই সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিলেন।
কবির সফরসঙ্গী ছিলেন-তাঁর পুত্র শ্রীযুক্ত রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পুত্রবধূ শ্রীযুক্তা প্রতিমা দেবী।
কবিকে অভ্যর্থনা জানাতে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের একটি অগ্রবর্তী দল- বদরপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কুলাউড়া এসে কবি রাতযাপন করেন ট্রেনে। মাইজগাঁও বরমচাল, ফেঞ্চুগঞ্জ প্রভৃতি স্টেশনেও কবিকে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল।
➤সফরসূচি ৫ নভেম্বর ১৯১৯ ইংরেজী:
৫ নভেম্বর ১৯১৯। ১৩ কার্তিক ১৩২৬ বুধবার। হেমন্তের সকালে কবি ‘শ্রীহট্ট বাজার’ রেলস্টেশন পৌঁছান। কবিকে অভ্যর্থনা জানান মিউনিসিপ্যালটির তৎকালীন চেয়ারম্যান রায় বাহাদুর সুখময় চৌধুরী, আবদুল করিম সাহেব, সাবেক মন্ত্রী খান বাহাদুর আবদুল মজিদ, রায় বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্তসহ শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আতশবাজি, তুমুল হর্ষধ্বনি হাজার জনতার উল্লাসে মুখরিত ছিল শ্রীহট্ট কবির পদার্পণে সঙ্গে সঙ্গেই। তখন সুরমা নদীর ওপর ‘কিনব্রিজ’ ব্রিজ ছিল না। সুরমা ঘাটে ছিল সুসজ্জিত মারবোট ও বজরা। কবি বোটে চড়ে নদী পার হলেন।
নদীর উভয় তীরে বিশাল জনসমুদ্র কবিকে এক নজর দেখতে ছিল উন্মুখ। বন্দে মাতরম, রবীন্দ্রনাথ কী জয় ইত্যাদি ধ্বনিতে মুখরিত ছিল চারদিক। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে হাজার জনতার আনন্দ উল্লাসে প্রকম্পিত ছিল সিলেট নগরী। মৌলবী আবদুল্লা সাহেবের স্বেচ্ছাসেবক দল, মজুমদারবাড়ি, দস্তিদারবাড়ি, আহিয়া সাহেবের বাড়ির প্রতিনিধিসহ হাজারো জনতা কবিকে নদীরপাড়ে চাঁদনীঘাটে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।ওই সময় চাঁদনি ঘাটকেও সুসজ্জিত করা হয়েছিল। মঙ্গলঘটসহ তারকা,পত্র-পুষ্প সম্ভারে লালসালু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল ঘাটের প্রতিটি সিঁড়ি। চাঁদনিঘাটে কবি ঘোড়ায় টানা পুষ্পসজ্জিত ফিটন গাড়িতে ওঠেন। গাড়িতে তাঁর পাশে বসেন সিলেটের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ মৌলভি আবদুল করিম। তিনি কবির পূর্বপরিচিত ছিলেন।(তাঁর লেখা ‘Islam’s Contribution in Science and Civilization’ বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।) প্রায় দশ হাজার লোকের সোয়া মাইল দীর্ঘ মিছিল কবিকে এগিয়ে নিয়ে এসেছিল।
শহরের (নয়া সড়কে) একটি টিলার ওপর ছিল প্রেসবাইটেরিয়ান পাদ্রি টমাস সাহেবের বাংলো।তার অস্তিত্ব আজ নেই। বর্তমানে সেখানে সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং একটি বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে।কবি সিলেট সফরকালীন সময়ে সেখানেই বাস করেছিলেন। সেখানে পৌঁছালে কবিকে সংগীত ও চন্দন তিলকের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানানো হয়।
০৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় শ্রীহট্ট ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে আয়োজিত উপাসনায় কবিগুরু তাঁর নিজের রচিত ব্রাহ্ম সংগীত গেয়ে শোনান ‘বীণা বাজাও হে মম অন্তরে’।
“বীণা বাজাও হে মম অন্তরে/
সজনে বিজনে বন্ধু, সুখে দুখে বিপদে/
আনন্দিত তান শুনাও হে মম অন্তরে” এই গানটি গেয়েছিলেন/ উপনিষদের মন্ত্র উচ্চারণ করে উপাসনা শুরু করেছিলেন।
ইন্দু দেবী গাইলেন- ‘মোর সন্ধ্যায় তুমি সুন্দর বেশে এসেছো তোমায় করি গো নমস্কার।’
ব্রাহ্ম মন্দিরে উপাসনা শেষে কবি চলে যান তার জন্য নির্ধারিত পাদ্রীর বাংলোয় এবং রাত যাপন করেন।
➤সফরসূচি ৬ নভেম্বর ১৯১৯ ইংরেজী:
০৬ নভেম্বর সকালে স্থানীয় লোকনাথ হল, পরে যেটা সারদা হল নামে পরিচিত হয়েছিল সেখানে হাজারো জনতার উপস্থিতিতে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। উকিল অম্বিকা চরন দে রচিত উদ্বোধনী সংগীত গাইলেন যতীন্দ্র মোহন দেব চৌধুরী। সংগীতটি ছিলো এ রকম :
মাতৃভাষার দৈন্য নেহারি কাঁদিল তোমার প্রাণ/
হৃদয় কমলে শ্রেষ্ঠ আসন বাণীরে করিলে দান।
পুরিল বঙ্গ নবীন আনন্দে/
উঠিল বঙ্গ পুলকে শিহরি শুনিয়া নবীন তান।
এ নহে দামামা, নহে রনেভেরী, এ যে বাঁশরীর গান।
সে সুধা লহরী মরমে পশিয়া আকুল করিল প্রাণ।
সপ্ত সাগর সে সুরে ছাইল, চমকি জগৎ সে গান শুনিল।/
বিশ্ব কবির উচ্চ আসন তোমারে করিলে দান।
হেথায় ফুটেনা শ্বেত শতদল, ফুটেনা হেথায় রক্ত কমল, বনফুল দুটি করিয়া চয়ন এনেছি দিতে উপহার।
এ দীন ভূমির ভক্তি অর্ঘ্য চরণে লভুক স্থান।’
আঞ্জুমানে ইসলামিয়া সিলেট জেলার সভাপতি খান বাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ (কাপ্তান মিয়া,আসাম প্রাদেশিক পরিষদের শিক্ষামন্ত্রী) এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা সভায় মানপত্র পাঠ করেছিলেন নগেন্দ্র চন্দ্র দত্ত। সভাপতি কবির পরিচয়(উর্দু ভাষায়)৪ তুলে ধরার পর রতনমনি টাউন হলে কবিগুরু ‘বাঙালির সাধনা’ সম্বন্ধে প্রায় দেড় ঘণ্টা বক্তৃতা করেছিলেন। কবির সেই ভাষণটি অনুলিখন করেন উপেন্দ্র নারায়ণ সিংহ ও মনোরঞ্জন চৌধুরী। যা পরে ১৩২৬ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় ‘বাঙালির সাধনা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।কবি তাঁর বক্তৃতায় বলেন- ‘তাই বলছি, আজ এই সভাতে আপনাদের সঙ্গে আমার এই যে যোগ হলো সে কেবল সাহিত্যের যশ নিয়ে নয়। এর ভিতরে একটি গূঢ় কথা আছে যা খ্যাতির চেয়ে অনেক বড়। সে কথাটি এই যে বাংলাদেশের লোক আপনার মধ্যে একটি শক্তির জাগরণ অনুভব করছে ’। ‘বাঙ্গালীর সাধনা’ শীর্ষক দেড় ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতাটি পরে রবীন্দ্রনাথ নিজেই ইংরেজিতে অনুবাদ করে ‘Towards the future’ নাম দিয়ে মডার্ণ রিভিয়ু পত্রিকায় প্রকাশ করেন।
তার বক্তৃতায় দেশপ্রেম অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার দিক-নির্দেশনা প্রতিফলিত হয়।
অনুষ্ঠান শেষে মুরারি চাঁদ কলেজের বাংলা ও সংস্কৃতির অধ্যাপক নলিনী মোহন শাস্ত্রীর আমন্ত্রণে তাঁর বাসভবনে কিছু সময়ের (মধ্যাহ্নভোজে) আতিথ্য গ্রহণ করেন।
দুপুর দুইটার দিকে ‘শ্রীহট্ট মহিলা সমিতি’ আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় যোগ দিতে দ্বিতীয়বার বন্দরবাজারস্থ ব্রাহ্ম মন্দিরে যান কবি।অভিনন্দন পত্র পাঠ করেন নলিনীবালা দেবী। রূপার পাত্রে মানপত্র দেয়া হয়।
পাদ্রি টমাস সাহেবের বাংলোয় বহির্দ্বারে টাঙানো ছিল মণিপুরীদের তৈরি প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো একটি আচ্ছাদন বস্ত্র। ওই আচ্ছাদন বস্ত্রে মণিপুরী শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় পেয়ে কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই প্রবল আগ্রহ নিয়ে—-৬ নভেম্বর বিকালে শহরের একপ্রান্তে মাছিমপুর মণিপুরী পল্লীতে কবি গিয়েছিলেন। সেদিন মাছিমপুরের মণিপুরীদের পরিবেশিত মণিপুরী নৃত্য দেখে মুগ্ধ হন বিশ্বকবি।সেখানে মণিপুরী সম্প্রদায় কবিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। কবি মণিপুরী মেয়েদের তাঁতে বোনা কাপড়, তাদের শিল্প নৈপুণ্য দেখে মুগ্ধ হন। মণিপুরী ছেলেদের রাখাল নৃত্য দেখে কবি বিমোহিত হলেন। পরবর্তীতে মণিপুরী মেয়েদের ‘গোষ্ঠলীলা’ নৃত্য দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হয়ে শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য বিভাগ চালু করেন। তিনি ”কমলগঞ্জের মণিপুরী গ্রাম বালিগাঁওয়ের নৃত্যগুরু নীলেশ্বর মুখার্জীকে নিয়ে যান শান্তিনিকেতনে। এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি পায় মণিপুরী নৃত্য। খ্যাতি লাভ করে বিশ্বনন্দিত নৃত্য হিসাবে।”৩
চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা, মায়ার খেলা, নটীর পূজা, শাপমোচন নৃত্যনাট্যে মণিপুরি নৃত্যের স্থান দেন। বলা হয়ে থাকে মণিপুরি নৃত্য কে মণ্ডপ প্রাঙ্গন থেকে বের বিশ্বমণ্ডলে স্থান করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
➤সফরসূচি ৭ নভেম্বর ১৯১৯ ইংরেজী:
০৭ নভেম্বর সকালে কবি নগরীর চৌহাট্টা এলাকার এতিহ্যবাহী সিংহ বাড়িতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।গোবিন্দ নারায়ণ সিংহ মহাশয়ের বাড়িতে নবজাতকের নামকরণ অনুষ্ঠানে একটি প্রার্থনা সভায় যোগ দেন।
ওইদিন কবি মুরারীচাঁদ কলেজ (এমসি কলেজ) হোস্টেলে সংবর্ধিত হন এবং হাজারো ছাত্র জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা দান করেন। বক্তৃতার সারমর্ম ১৩২৬ বঙ্গাব্দে ‘আকাঙ্ক্ষা’ নামে শান্তিনিকেতন পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। উত্তরকালে এটি ‘আকাঙ্ক্ষা’ নামে পাঠ্যপুস্তকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এমসি কলেজের বক্তৃতায় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “কোন পাথেয় নিয়ে তোমরা এসেচ? মহৎ আকাক্ষা। তোমারা বিদ্যালয়ে শিখবে বলে ভর্ত্তি হয়েচ। কি শিখতে হবে ভেবে দেখ। পাখী তার বাপ মায়ের কাছে কি শেখে? পাখা মেলতে শেখে, উড়তে শেখে। মানুষকেও তার অন্তরের পাখা মেলতে শিখতে হবে, তাকে শিখতে হবে কি করে বড় করে আকাক্সক্ষা করতে হয়। পেট ভরাতে হবে। এ শেখাবার জন্যে বেশী সাধনা দরকার নেই; কিন্তু পুরোপুরি মানুষ হতে হবে এই শিক্ষার জন্যে যে অপরিমিত আকাক্সক্ষার দরকার তাকেই শেষ পর্যন্ত জাগিয়ে রাখবার জন্যে মানুষের শিক্ষা।”৪
১৭ বছরের এক সিলেটি কিশোর সে বক্তব্য শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলো, ‘আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করতে হলে কী করা প্রয়োজন?’ রবীন্দ্রনাথও উত্তর দিয়েছিলেন। এরপর তৈরি হলো গুরু-শিষ্য যোগাযোগে নতুন ইতিহাস। সেই অনুসন্ধিৎসু কিশোরটি ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী, যিনি শান্তি নিকেতনে কলেজ পর্যায়ে (১৯২১ সালে সেই ছাত্র শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন) প্রথম বিদেশী’ ছাত্র ও পরে শান্তি নিকেতনে-বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন কয়েক বছর।
সভাশেষে এমসি কলেজের অধ্যক্ষ অপূর্বচন্দ্র দত্তের আতিথ্যগ্রহণ করে তার বাসায় (মধ্যাহ্ন ভোজ)পদার্পন করেন।
পরে শহরের গণমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে রায়বাহাদুর নগেন্দ্রনাথ চৌধুরীর বাসায় (চা চক্রে) এক প্রীতিসম্মেলনে যোগ দেন।
রাত ন-টায় কবির বাসস্থানে এসে মণিপুরী ছেলেমেয়েরা কবিকে রাসনৃত্য দেখায়, কবি খুব মুগ্ধ হন।
➤সফরসূচি ৮ নভেম্বর ১৯১৯ ইংরেজী:
পরদিন আট নভেম্বর কবিগুরু সিলেট থেকে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার উদ্দেশ্যে সিলেট ত্যাগ করেন। আর বিমুগ্ধ নয়নে পেছনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকেন তার গুণমুগ্ধরা।
সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে কবি সিলেটকে শ্রীভূমি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। সুন্দরী শ্রীভূমি কবিতাটি রচনা করে কবি সিলেটবাসীকে তার অন্তরে স্থান দিয়েছিলেন।
কবিপ্রণাম’ নামের সুখ্যাত গ্রন্থের সম্পাদক শ্রী নলিনীকুমার ভদ্র তাঁর ‘অবতরনিকা’ নামক সম্পাদকীয় নিবন্ধের শেষাংশে লেখেন-
‘কবির জীবনী থেকে এ তিনটি দিনের কাহিনী (সিলেট ভ্রমণের ৩ দিন) বাদ দিয়ে যদি কোনো শ্রীহট্টের ইতিহাস লেখা হয় তাহলে তা হবে অসম্পূর্ণ। অনাগত যুগে আমাদের ভবিষ্যদ্বংশীয়েরা এ কাহিনী পড়ে গর্ব অনুভব করবে- যদিও ঈর্ষা করবে তারা আমাদের অপরিসীম সৌভাগ্যকে।’৬
সিলেট ভ্রমণের আনন্দ স্মৃতির কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসবিদ ও কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কালিদাস নাগকে ৩ ডিসেম্বর ১৯১৯ সালে এক চিঠিতে লিখেন-
‘আশ্রমে ফিরে এসেছি। পাহাড় (শিলং) থেকে নেমে আসবার পথে গৌহাটি, শিলেট (সিলেট) ও আগরতলা ঘুরে এলুম। বলা বাহুল্য বক্তৃতার ত্রুটি হয়নি। দিনে চারটে করে বেশ প্রমাণসই বক্তৃতা দিয়েছি এমন দুর্ঘটনাও ঘটেছে। এমনতর রসনার অমিতাচারে আমি যে রাজী হয়েছি তার কারণ ওখানকার লোকেরা এখনও আমাকে হৃদয় দিয়ে আদর করে থাকে এটা দেখে বিস্মিত হয়েছিলুম। বুঝলুম কলকাতা অঞ্চলের লোকের মত ওরা এখনো আমাকে এত বেশি চেনেনি ওরা আমাকে যা-তা একটা কিছু মনে করে। তাই সেই সুযোগ পেয়ে খুব করে ওদের আমার মনের কথা শুনিয়ে দিয়ে এলুম।—- (চিঠিপত্র-১২)৫
পাদটীকা:
[১৯১৯ সালের ১১ অক্টোবর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবকাশ যাপনের জন্য আসামের তৎকালীন রাজধানী শৈলশহর শিলং এলেন। তিনি সিলেট আসার দীর্ঘ অথচ বিকল্প পথ গৌহাটী থেকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের লামডিং-বদরপুর সেকশন হয়ে করিমগঞ্জ-কুলাউড়া হয়ে সিলেট পৌছানোর পথে সিলেট আসতে রাজী হন।৩১ অক্টোবর কবিগুরু শিলং থেকে গৌহাটী অভিমূখে যাত্রা করেন। সেখানে কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য বিশাল আয়োজন করা হয়।গৌহাটীতে দিন তিনেক অবস্থান করে কবি ৩ নভেম্বর গৌহাটী থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। গৌহাটী থেকে সিলেটের পথে প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই কবিকে এক পলক দেখার জন্য ভক্তদের ভিড় লেগে যায়। সিলেট থেকে একটি প্রতিনিধিদল কবিগুরুকে এগিয়ে আনতে বদরপুর পর্যন্ত যায়।৪ নভেম্বর ট্রেন কুলাঊড়া জংশনে পৌছালে তাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়। কবি ও তার সহযাত্রীরা কুলাউড়াতে রাত্রিযাপন করেন।]
তথ্য ঋণ:
[১] ভুঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত।।বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংবর্ধনা।
(বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত)
[২] সিলেটে রবীন্দ্রনাথ/সুমন বণিক
বাংলাদেশ প্রতিদিন
১৭ জানুয়ারি ২০২০
[৩] কবিগুরু সিলেটে পদার্পণের ৯৯ বছর,
সিলেট ভয়েজ
৬ নভেম্বর ২০১৮
[৪] আমাদের কালের কথা।। সৈয়দ মুর্তজা আলী
[৫] শ্রীভূমি সিলেটে রবীন্দ্রনাথ।।নৃপেন্দ্রলাল দাশ
[৬] কবি প্রণাম – ১৯৪১ সালে জামতলা বানীচক্র ভবন সিলেট থেকে প্রকাশিত
[৭] রবীন্দ্র জীবনী (৩য় খণ্ড) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
[৮] আত্মকথা – সৈয়দ মোস্তফা আলী।
[৯] মণিপুরি শিল্প-সংস্কৃতির প্রসার এবং রবীন্দ্রনাথ -কুঙ্গ থাঙ । অন্য আলো, সিলেটে রবীন্দ্রনাথের আগমনের শতবর্ষ।
[১০] শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (পূর্বাংশ) – অচ্যুতচরণ চৌধুরী।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য ঢাকা:
(দৈনিক আনন্দবাজারে প্রকাশিত খবর)
রবীন্দ্রনাথ যেবার ঢাকা-নারায়নগঞ্জে সংবর্ধিত হয়েছিলেন তখনকার দৈনিক আনন্দবাজারে প্রকাশিত খবর ও রবীন্দ্রনাথের নিজের অভিব্যক্তি যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তা নিয়েই এই বিশেষ ফিচার। প্রকাশিত ভাষারীতি অনুযায়ী অবিকৃতভাবেই লেখাটি প্রকাশ করা হলো-
ঢাকায় রবীন্দ্রনাথের আগমন উপলক্ষে বেশ একটু দলাদলি ও কোলাহলের সৃষ্টি হইয়াছিল। তিনদিন ক্রমাগত বাক্যুদ্ধের পরে, তাহাতে শান্তির যবনিকা পড়িয়াছে। আমরা এই বিষয় লইয়া আর কোনও আলোচনা করিব না। রবীন্দ্রনাথ ঢাকা আগমন করিয়া কি কি কার্য্য করিবেন, পাঠক সাধারণের অবগতির জন্য এখানে তাহার কর্মসূচী যথাযথরূপে প্রকাশ করিলাম:
৭ই ফেব্রুয়ারি—তিনি ঘটিকার সময় ঢাকা আগমন, জনসাধারণের অভ্যর্থনা। মিউনিসিপ্যালিটি নথব্রুক হলে ৪টার সময় অভিনন্দন দিবেন, তত্পর জনসাধারণ ৫ ঘটিকার সময় করোনেশন পার্কে অভিনন্দন দিবেন, তত্সহ রেট পেয়ার্স পিপলস এসোসিয়েশন প্রভৃতি সাধারণ প্রতিষ্ঠান সমূহও অভিনন্দন দিবেন।
৮ই ফেব্রুয়ারি—প্রাতে কবির সহিত তাঁহার বাসস্থানে জনসাধারণ দেখা সাক্ষাত্ করিবেন। অপরাহ্ন ৬-৩০ মিনিটের সময় ‘দীপালি’র প্রতিষ্ঠান বক্তৃতা দিবেন, কেবলমাত্র মহিলাদের জন্য।
৯ই ফেব্রুয়ারী—প্রাতে মহিলারা দেখা সাক্ষাত্ করিবেন। অপরাহ্ন ৬টায় বিশ্বভারতী সম্মিলনী, ৬-৩০ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রাঙ্গণে বক্তৃতা—সর্বসাধারণের জন্য।
১০ই ফেব্রুয়ারী—প্রাতে ব্রাহ্মসমাজ। অপরাহ্ন ৪-৬টায় মোসেলম হলে প্রীতিসম্মিলনী। ৬-৩০টার সময় কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতা।
১১ই ফেব্রুয়ারী— প্রাতে ৬টা-৯টা ছাত্র সম্মিলনী। অপরাহ্ন ৪-৬টা জগন্নাথ হল, (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ৬টা—৬—৩০ ঘটিকায়। ছাত্রসঙ্ঘের অভিনন্দন গ্রহণ। (বিশ্ববিদ্যালয়) ৬-৩০ মিনিট। অধ্যাপক ফোরমিসি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা প্রদান করিবেন।
১২ই ফেব্রুয়ারী—প্রাতে জনসাধারণের দেখা সাক্ষাত্। ২—৩-৩০ মিনিট। ইডেন বালিকা বিদ্যালয় প্রদর্শন ৪টা—৬টা সাহিত্য-পরিষদের অভিন্দন গ্রহণ। জলযোগের ব্যবস্থা ৬-৩০—৭-৩০ মিনিট; অধ্যাপক তুচ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিবেন।
১৩ই ফেব্রুয়ারী— প্রাতে দেখা সাক্ষাত্—৪টা—৬টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাইসচ্যান্সেলর প্রদত্ত প্রীতিসম্মিলন ৬-৩০ মিনিট কার্জন হলে বক্তৃতা। (বিশ্ববিদ্যালয়)
১৪ই ফেব্রুয়রী ৪টা—৬টা শিক্ষকসঙ্ঘের প্রীতি সম্মিলন। ৮টা—১০টা ঢাকা হল ভোজ দান।
৯ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬/২৬ মাঘ ১৩৩২
ঢাকা রবীন্দ্রনাথ
নারায়ণগঞ্জে বিপুল অভ্যর্থনা
ঢাকা, ৮ই ফেব্রুয়ারী।
গতকল্য রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় পৌঁছিয়াছেন, ঢাকার অধিবাসীবৃন্দ তাঁহাকে বিপুল অভ্যর্থনা করিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে বলিতে গেলে এইবারই রবীন্দ্রনাথ সর্ব্বপ্রথম ঢাকায় আসিয়াছেন। ইতিপূর্ব্বে তিনি ভালরূপে ঢাকা প্রদর্শন করেন নাই। স্থানীয় অভ্যর্থনা-সমিতি নারায়ণগঞ্জে বহুসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক প্রেরণ করিয়াছিলেন। নারায়ণগঞ্জ স্টীমার স্টেশন সেদিন জনসমুদ্রে পরিণত হইয়াছিল। স্টীমার ঘাটে আসিবার বহু পূর্ব্ব হইতেই তথায় জনসমাগম হইতে আরম্ভ হয়। দেখিতে দেখিতে এত লোক জড় হয় যে, কি ঘাটে, কি জেটিতে একটুও স্থান ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ষ্টীমার ঘাটে পৌঁছিলে চতুর্দিক হইতে ঘন ঘন আনন্দধ্বনি উত্থিত হয়। কয়েকজন বিশিষ্ট নেতা অগ্রসর হইয়া তাঁহাকে পুষ্পমাল্যে বিভূষিত করেন এবং ষ্টীমার হইতে নামাইয়া আনেন। ষ্টেশন ঘাটে সুসজ্জিত মোটর অপেক্ষা করিতেছিল। অতঃপর রবীন্দ্রনাথ তাঁহার দলবলসহ সেই মোটরে চড়িয়া ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করেন। ঢাকা শহরের পূর্ব্ব সীমান্তে একদল স্কাউট, বহুসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক ও শহরের বিশিষ্ট ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মোটর দৃষ্টিপথে প্রবিষ্ট হইবামাত্র ঘন ঘন জয়ধ্বনি উত্থিত হয়। রবীন্দ্রনাথ সেই অপূর্ব্ব অভ্যর্থনা লাভ করিয়া ঢাকা শহরে প্রবেশ করেন।
অতঃপর এক বিরাট শোভাযাত্রা করিয়া বুড়ীগঙ্গা নদীর উপর ভাসমান ‘তড়াগ’ নামক বজরাতে তাঁহাকে লইয়া যাওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ নদীর উপর সেই বজরায়ই অবস্থান করিবেন।
মিউনিসিপ্যালিটির অভিনন্দন
অপরাহ্ন চার ঘটিকার সময় নথব্রুক হলে এক বিরাট জনসভায় অধিবেশন হইয়াছিল। ঐ সভায় মিউনিসিপ্যালিটি এবং “পিপলস্ এসোসিয়েশনের” পক্ষ হইতে দুইখানি মানপত্র রবীন্দ্রনাথকে প্রদান করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে দেখিবার জন্য এতলোক জড় হইয়াছিল যে, নর্থব্রুক হলে একটু স্থান ছিল না। বহুলোক বাহিরে দাঁড়াইয়াছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের উত্তর
উপরোক্ত উভয় অভিনন্দনের উত্তর দিতে দণ্ডায়মান হইয়া রবীন্দ্রনাথ বলেন,—‘আমি নিতান্ত দুর্ব্বল ও ক্লান্ত। এইজন্য ঢাকায় আসার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করার পূর্ব্বে আমাকে অনেক কথা চিন্তা করিতে হইয়াছিল। সে যাহাই হউক, অনেক চিন্তার পর আমি ঢাকায় আসা স্থির করি। আপনাদের এখানে আসিয়া আমি বাস্তবিকই সুখী হইয়াছি। তবে একটি কথা বলিয়া রাখি,—কতকগুলি গতানুগতিক নিয়ম রক্ষার জন্য আমি এখানে আসি নাই। আপনাদের হূদয়ের সহিত পরিচিত হওয়াই আমার উদ্দেশ্য। আমি অল্পসময় যাবত্ ঢাকা পৌঁছিয়াছি, কিন্তু ইহার মধ্যেই আপনাদের স্নেহের পরিচয় পাইয়াছি, ইতিপূর্ব্বে আমি আর একবার ঢাকায় আসিয়াছিলাম। সে সময় আমি বলিয়া গিয়াছিলাম যে, ভিক্ষা দ্বারা মুক্তি আসিবে না। অদ্য মিউনিসিপ্যালিটি আমাকে যে মানপত্র দিয়েছেন, তাহাতে সে কথার উল্লেখ আছে। একদল রাজনীতিক ক্ষমতালোভের জন্য উপর্যপরি আবেদন নিবেদন করিতেছিলেন। আমি তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়াই সেই কথা বলিয়াছিলাম। আমি দেশবাসীকে বুঝাইতে চাহিয়াছিলাম যে, সেবা ও আত্মত্যাগ ব্যতীত প্রকৃত কাজ হইতে পারে না।’
অতঃপর রবীন্দ্রনাথ বলেন :—‘অবিরত চেষ্টা এবং আত্মত্যাগের বলে নিজের দেমের উপর যে শক্তির প্রতিষ্ঠা হয় সেই শক্তি যতদিন পর্যন্ত আমরা লাভ করিতে না পারিব, ততদিন পর্যন্ত শাসকবর্গের সহিত আদান-প্রদানে মর্যাদা রক্ষা করিয়া আমরা চলিতেও পারিব না, আর সেই আদান-প্রদানে কোন খাঁটি লাভও আমাদের হইবে না। সম্প্রতি আমি আর একটি কথা বলিয়াছি, তাহাও মিউনিসিপ্যালিটি প্রদত্ত মানপত্রে উল্লেখ করা হইয়াছে। আমি বলিয়াছি যে, লুপ্ত না হইয়া যাওয়াই একটা দেশ বা জাতির পক্ষে যথেষ্ট নহে। স্বীয় অফুরন্ত ধন-ভাণ্ডার হইতে অপরকে কিছু কিছু দিবার ভার তাহাকে লইতে হইবে। অতীত ভারত এই কর্তব্যকে স্বীকার করিয়া, গিরিকন্দর, সাগরপ্রান্তর ভেদ করিয়া স্বকীয় দানের পশরা দূরদেশে বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিল। সেই ভারতের আজ একই নিশ্চয়ই বলা উচিত নহে যে, তাহার ভাণ্ডার আজ শূন্য—সে নিঃস্ব ভিখারী। অন্ততঃ আমি সে কথা বলিবার মত হীন কখনও হইব না। ‘জগতের যে যেথায় আছে, আমার কাছে এস’, ভারতের এই সনাতন আহ্বানের বাণী বহন করিয়া আমি পৃথিবীর শেষপ্রান্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়াছি। নিঃস্ব কৃপণ কখনও এ আহ্বান দিতে পারে না। কিন্তু আমার ভারতের প্রাচুর্য্য এবং চিরন্তন আতিথেয়তার উপর বিশ্বাস আছে বলিয়াই আমি ভারতের নামে ভারতের পক্ষ হইতে একটি অতিথিশালা খুলিয়াছি, যে কোন পর্য্যটক আসিয়া এখানে বিশ্রাম করিতে পারে এবং ভারতের চিরপ্রবাহিত উত্সবের সুধাধারা পান করিতে পারে।
আপনারা আমাকে স্মরণ রাখিয়াছেন দেখিয়া আমি অতীত আনন্দিত হইলাম। আমার প্রতি আপনার যে প্রীতি আছে, সেই প্রীতির এবং আমি চলিয়া গেলে আমার স্মৃতির সহিত যদি আপনারা আমার একান্ত প্রিয়কার্য্যকে স্মরণ রাখেন তবে আমি কৃতজ্ঞ থাকিব।’
তথ্য ঋণ:
নারায়নগঞ্জে রবীন্দ্রনাথ
দৈনিক ইত্তেফাক
৮মে ২০১৫
রবীন্দ্রনাথ ঢাকা আসেন দুইবার।
প্রথমবার তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের সম্মেলনে যোগ দিতে ১৮৯৮ সালের ৩০ মে হতে ১জুন ঢাকা অবস্থান করেন। এ সময় তিনি ঢাকার ক্রাউন থিয়েটারে বক্তব্য প্রদান করেন।
দ্বিতীয়বার কবিগুরু ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৭ তারিখে ঢাকার করোনেশন পার্কে বক্তব্য প্রদান করেন। এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বানে বাংলাদেশে আসেন। তিনি কলকাতা হতে স্টীমারযোগে গোয়ালন্দ ভায়া চাঁদপুর হয়ে নারায়ণগঞ্জ পেঁৗছান। নারায়ণগঞ্জ হতে মোটর শোভাযাত্রায় তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অতঃপর তিনি নবাবের ‘তুরাগ’ বোটে চড়ে প্রমোদ বিহার উপভোগ করেন।
৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা করোনেশন পার্কে গান পরিবেশন করেন।
৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা আহসান মঞ্জিলে চা-চক্রে অংশ নেন।
৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভারতী সম্মিলনী, ঢাকার সংবর্ধনা গ্রহণ করেন।
৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রাঙ্গণে তিনি ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার স্বরূপ’ বিষয়ে বক্তব্য দেন।
১০ ফেব্রুয়ারি সকালে পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্ম সমাজ পাটুয়াটুলি, ঢাকায় বক্তব্য দেন। সন্ধ্যায় কার্জন হলে ‘মিনিং অফ আর্ট’-এর উপর বক্তৃতা প্রদান করেন।
বিকেলে মুসলিম হল ছাত্র ইউনিয়নের সংবর্ধনা গ্রহণ করেন।
১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি কবি অসুস্থ বোধ করায় কোথাও যাননি।
১৩ ফেব্রুয়ারি কার্জন হলে দ্য রুল অফ জায়ান্ট এই বিষয়ে বক্তৃতা দেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবনে সংবর্ধনা ও কবিকণ্ঠে আবৃত্তিতে অংশ নেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ হলের বার্ষিকী ‘বাসন্তিকা’র জন্যে গান লিখে দেন-‘এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের হাসি খেলায় আমি ত গান গেয়েছিলেম’।
১৫ তারিখ দুপুরে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে ট্রেনযোগে ঢাকা ত্যাগ করেন।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য বলধা গার্ডেন:
রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকার ওয়ারীতে অবস্থিত গাজীপুরের বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ‘বলধা’ গার্ডেন পরিদর্শন করেন। তিনি এখানে ‘জয় হাউস’-এ একরাত অবস্থান করেন। বলধা গার্ডেনে তিনি ক্যামেলিয়া ফুল দেখে বিস্ময়াভিভূত হন এবং এর প্রভাবে ঢাকা থেকে ফিরে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ২৭ শ্রাবণ বিখ্যাত ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি রচনা করেন যা ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তী সময়ে এ কবিতা নিয়ে সজল সমদ্দার কর্তৃক চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে।
বলধা গার্ডেন দেখে রবীন্দ্রনাথ বলে উঠেছিলেন, ‘পৃথিবীর বহু রাজা-মহারাজার বাড়িতে কত রকম ফুলের বাগানই তো দেখলাম কিন্তু বলধা গার্ডেনের মতো বাগান কোথাও দেখিনি।’
তিনি একটি কাঁটাওয়ালা ফুল দেখে তাৎক্ষণিক লিখেছিলেন,
‘কাঁটায় আমার অপরাধ আছে
অপরাধ নেই ফুলে
কাঁটা ওগো মোর থাক প্রিয়তম
ফুল নিও তুমি তুলে।’
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহ
“রবীন্দ্রনাথ ময়মনসিংহে যেসব অভিভাষণ প্রদান করেন পরবর্তীতে তা বিশ্বভারতী, শান্তি নিকেতনের গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। ’‘মানসী, পূরবীতেও তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা পত্রস্থ হয়েছে।”
১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় আসেন। এক সপ্তাহ ঢাকায় থাকেন। ১৯২৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি(৩রা ফাল্গুন ১৩৩২ বঙ্গাব্দ) ঢাকা থেকে ট্রেনে চেপে কবির সফর সঙ্গীদের নিয়ে ময়মনসিংহ আসেন বিকেলে। রেলস্টেশনে মুক্তাগাছার মহারাজ শশীকান্ত আচার্য্য চৌধুরী ও অভ্যর্থনা কমিটির সদস্যরা কবিকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানান। এ সময় উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি দেয়া হয়। শতহস্তে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে বিশ্ব কবিকে স্বাগত জানানো হয়। এসময় কবির পাশে ছিলেন তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইতালির অধ্যক্ষ জোসেফ তুচি প্রমুখ।পরে রেলস্টেশন থেকে কবিকে নিয়ে আসা হয় মহারাজ শশীকান্তের অতিথিশালা আলেকজান্দ্রার ক্যাসেলে। এখানে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে কবি সন্ধ্যায় যোগ দেন টাউন হলের নাগরিক সংবর্ধনায়।
মহারাজ শশীকান্তের আমন্ত্রণে রবি ঠাকুরের এটিই ছিল ময়মনসিংহে প্রথম ও শেষ সফর। তিন দিনের সফরে কবি ছিলেন শশীকান্তের বাগান বাড়ি আলেজান্দ্রার ক্যাসেলে মহারাজার রাজসিক অতিথি হয়ে। কবিগুরু আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলে অবস্থানকালে ব্রহ্মপুত্র নদের শীতল বাতাসে,একটি বিশালাকার বৃক্ষতলে বসে অনেক কবিতা রচনা করেছেন । গাছটি এখনো ভ্রমণপিপাষুদের আকৃষ্ট করে।
৪ঠা ফালগুন /১৩৩২ সন মঙ্গলবার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ময়মনসিংহে আগমনের দ্বিতীয় দিনে ব্রাহ্ম মন্দির (বর্তমান ল কলেজের স্থানে প্রতিষ্ঠিত ছিল।)পরিদর্শন করেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী, পরন্তু ব্রাহ্মসমাজে তিনি গুরুপ্রতিম, সুতরাং তার আগমনে ময়মনসিংহের ব্রাহ্মসমাজে উৎসাহ আনন্দ ব্যাকুলতা স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্ট হলো। গুরুদেবকে সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য স্থানীয় ব্রাহ্মসমাজ গাঙ্গিনারপাড় ব্রাহ্মমন্দিরে যথোচিত ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আয়োজন করে।
পূর্বাহ্ণে আটটায় ব্রাহ্মমন্দিরে পৌঁছানোর পর ব্রাহ্ম নেতৃবৃন্দ সেখানে তাঁকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন এবং অভিনন্দন প্রদান করেন। অভিনন্দন প্রদান করার পর কবিবর তার উত্তরে সুদীর্ঘ এক বক্তৃতা করেন।
“কবি ময়মনসিংহ ছিলেন ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি সকাল পর্যন্ত। ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে কবি যোগ দেন আনন্দ মোহন কলেজের সংবর্ধনায়। কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আন্তরিক উৎসাহ ও উদ্দীপনায় কবিকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় বিশ্বভারতীর আদর্শ ও কর্মসূচীর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন ৬২৫ টাকার তোড়া প্রদান করা হয় কলেজের পক্ষ থেকে। সংবর্ধনা সভায় সভাপতি ছিলেন আনন্দ মোহন কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ জে কে ঘোষ।
১৭ ফেব্রুয়ারি কবি যোগ দেন মুক্তাগাছার সাহিত্য সংসদ ত্রয়োদশী সম্মিলনে। বিশ্বভারতীর সাহায্যার্থে কবিকে দেড় হাজার টাকা এবং অভিনন্দনপত্র দেয়া হয় এ সময়। ১৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বিদ্যাময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও সন্ধ্যায় সিটি স্কুলে মহিলা সমিতি আয়োজিত সংবর্ধনায় যোগ দেন কবি। ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে শান্তি নিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায় চৌধুরীর আমন্ত্রণে কবি ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। সেদিন কবির সঙ্গে ছিলেন পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, নাতনি নন্দিনী, ভ্রাতুষ্পুত্র দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালিমোহন ঘোষ ও ব্যক্তিগত সচিব মি. হিরজাই মরিস।”১
তথ্য ঋণ:
[১] ময়মনসিংহে রবীন্দ্রনাথ’।।আহমদ রফিক
[২] রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে রবীন্দ্র পর্ষদের উদ্যোগে প্রকাশিত
একদশক পূর্তি স্মারক-১৪১৫
[৩] কবির আগমনে মেতেছিল তিন নগর
দৈনিক জনকণ্ঠ
প্রকাশিতঃ মে ২১, ২০১৬।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য ঈশ্বরগঞ্জ:
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে, আঠারবাড়ি জমিদার বাড়ির পুকুরঘাটে বসে রবীন্দ্রসংগীতের এই চরণগুলো, কবিগুরু লিখেছিলেন বলে জানা যায়-
‘যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে/
আমি বাইবনা মোর খেয়াতরী এই ঘাটে/
চুকিয়ে দেব বেচাকেনা/
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনাদেনা/
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে’।।
তৎকালীন আঠারবাড়ির জমিদার প্রমোদ চন্দ্ররায় চৌধুরীর আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি(৭ ফাল্গুন ১৩৩২ বঙ্গাব্দ) সকালে তিনি ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে করে আঠারবাড়ি রেলস্টেশনে পৌঁছান। ভ্রমণকালে কবির সঙ্গে ছিলেন, কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী প্রমুখ। উল্লেখ্য, ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৫ ফেব্রুয়ারি আসেন ময়মনসিংহে।
জমিদার প্রমোদ চন্দ্ররায় চৌধুরী শান্তি নিকেতনের শিক্ষার্থী ছিলেন। কবিগুরু ছিলেন তাঁর শিক্ষক। বিশ্বকবি তাঁর এই ছাত্রের আমন্ত্রণ রক্ষার্থেই আঠারবাড়ি এসেছিলেন।
সেদিন তাঁকে এক পলক দেখার জন্য ঈশ্বরগঞ্জ ও গৌরীপুরের হাজারো মানুষ ঈশ্বরগঞ্জ সদরে চলন্ত ট্রেন থামিয়ে দেয়। এরপর আঠারবাড়ি রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে নামার পর, কবিকে হাতির পিঠে চড়িয়ে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে অভিবাদন জানানো হয়।
হাজারো মানুষের জয়ধ্বনিতে জমিদার বাড়ির মূল ফটকের সামনে কবিকে সোনার চাবি উপহার দেন জমিদার প্রমোদ চন্দ্ররায় চৌধুরী। ওই চাবি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কাছারি ঘরের মূল ফটক খোলেন। মধ্যাহ্নভোজের পর কবির সম্মানে সেদিন বাউল ও জারি-সারি গানের আয়োজন করা হয়েছিল।
অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য ও কালের সাক্ষী আঠারবাড়ি জমিদার বাড়িটি আজ জরাজীর্ণ। এক সময়ে যার বাহিরের সৌন্দর্যরূপে উদ্ভাসিত থাকতো চারপাশ, এখন দিনের আলোতেও সেটির ভেতর থাকে অন্ধকার! সোনার চাবি দিয়ে কবির হাতে খোলা সেই কাছারি ঘরটির অবস্থাও খুবই নাজুক।
১৯৬৮ সালে জমিদার বাড়িটিকে আঠারবাড়ি ডিগ্রি কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৪ নভেম্বর ২০২০
তথ্য ঋণ:
[১] ময়মনসিংহে রবীন্দ্রনাথ’।।আহমদ রফিক
[২] রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে রবীন্দ্র পর্ষদের উদ্যোগে প্রকাশিত
একদশক পূর্তি স্মারক-১৪১৫
[৩] কবির আগমনে মেতেছিল তিন নগর
দৈনিক জনকণ্ঠ
প্রকাশিতঃ মে ২১, ২০১৬।
[৪] ভুঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত।।বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংবর্ধনা।
(বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত)
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য কুমিল্লা:
কুমিল্লার অভয় আশ্রম, বীরচন্দ্র গ্রন্থাগার ও মহেশাঙ্গন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে।
১৯২৬ সালের, ১৯ ফেব্রয়ারী অভয় আশ্রমের তিন বৎসর পুর্তিতে তিনি কুমিল্লায় আসেন। রবীন্দ্রনাথ অভয় আশ্রমের ত্রি- বার্ষিক সভায় সভাপতিত্ব করার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।অভয় আশ্রমের ত্রি- বার্ষিক সভায় মহাত্মা গান্ধীও এসেছিলেন।পুরনো এ অভয় আশ্রমটি এখন কেটিসিসিএ লিমিটেড নামেই পরিচিত।
১৯২৩ সালে কুমিল্লায় ‘অভয় আশ্রম’ নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করেন বলে জানা যায়।এতে ডা. সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কুমিল্লার আইনজীবী অখিলচন্দ্র দত্ত, কামিনী কুমার দত্ত, বিদ্বেশ্বর চট্টোপাধ্যায়, দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ও ইন্দুভূষণ দত্তের আর্থিক সহযোগিতা ছিল। চরকায় সুতা কেটে খাদি কাপড়ের প্রচলণ প্রথম এখান থেকেই শুরু হয়।
স্মরণ করার মত তথ্য হচ্ছে, ১৯২০ সালে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে “স্বদেশি পণ্য গ্রহণ ও বিদেশি পণ্য বর্জনে” মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের ডাকদেন।জালিয়ান ওয়ালাবাগ হত্যা কান্ডের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন।
স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকারি স্কুল কলেজে লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। সবাই চরকায় কাটা সুতা দিয়ে তৈরী খাদির কাপড় পরিধান করতে শুরু করেন।
ব্রিটিশ ভারতের “অভয় আশ্রম” শিক্ষা বিস্তার, কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বাস্থ সেবা ও যাবতীয় আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডের মূলে ছিলো– অনুশীলন দলের একটি কেন্দ্র :ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের এক মিলনক্ষেত্র।
কুমিল্লা অভয় আশ্রমের ত্রি- বার্ষিক সভায় যোগদানের আগে কুমিল্লা ভ্রমণকালীন কবি কিছুটা অসুস্থ ছিলেন।অসুস্থতার জন্য তিনি ওই অনুষ্ঠানে যোগদান করতে অনীহা প্রকাশ করলেও পরে তিনি প্রাণের টানে সেখানে যান। তাই আগেই জানিয়েছেন, কোন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন,যেনো না করা হয়।
কবি ১৯, ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি, সন্ধ্যা পর্যন্ত কুমিল্লায় ছিলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি অভয় আশ্রমের কর্মীরা কবিকে একটি মানপত্র দেন। সেই মানপত্রের জবাবে কবি বলেছিলেন:
‘আত্মাই শান্তির উৎস’, এই শক্তির সহিত পরিচয় লাভ করতে হলে আপনাকে সর্ম্পণরূপে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে। অভয় আশ্রমের কর্মীরা এইরূপে আত্মত্যাগ করছেন বলে শারীরিক অসুস্থতা সত্বেও আমি এখানে এসেছি’।
বিকালে অভয় আশ্রমের, ত্রি-বার্ষিক সভায় কবি সভাপতিত্ব করেন। বেশ কয়েকটা ইভেন্ট যেমন নাটক, খেলাধুলা, চরকায় সুতা কাটার প্রতিযোগিতা, সব কয়টা অনুষ্ঠান কবিগুরু উপভোগ করেন। দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন, শহরের বিখ্যাত সবাই কবির সাথে আপ্যায়িত হন। অভয় আশ্রমের কর্মী ছাড়াও, সেই সভায় সাত হাজরেরও বেশী লোকের সমাগম হয়েছিলো।
রবীন্দ্র গবেষক গোপালচন্দ্র রায়ের তথ্য সূত্রে জানা যায়, ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে কবিগুরু কুমিল্লা রেলস্টেশনে পৌঁছেন। স্টেশন থেকে তিনি সরাসরি চলে যান অভয় আশ্রমের নবনির্মিত হাসপাতাল ভবনে। তখন তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতিমা দেবী, নন্দিনী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালীমোহন ঘোষ ও মরিস প্রমুখ।
১৯ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি কুমিল্লা অবস্থান করে ত্রিপুরার আগরতলায় চলে যান। এই চার দিন কুমিল্লা সফরকালে রবীন্দ্রনাথ নিজেই নিজের শর্ত ভঙ্গ করেন। শুধু অভয় আশ্রম নয়, তিনি ঈশ্বর পাঠশালা-রামমালা ছাত্রাবাস, কুমিল্লা মহিলা সমিতির অভ্যর্থনায় যোগদান করেন। একই সঙ্গে তিনি নাগরিকদের সাধারণ সভা, ভিক্টোরিয়া কলেজ, বিশিষ্ট ব্যক্তির বাসভবনে বেড়াতে যান। যার জন্য কবিগুরুকে দুই দিনের পরিবর্তে চার দিন কুমিল্লায় অবস্থান করতে হয়।
ভূঁইয়া ইকবালের ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্র-সংবর্ধনা’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অভয় আশ্রমের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে কবিগুরু বলেন, ‘আত্মাই শক্তির উৎস, এই শক্তির সহিত পরিচয় লাভ করতে হলে আপনাকে সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দিতে হবে। অভয় আশ্রমের কর্মীরা এইরূপ আত্মত্যাগ করছেন বলে শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও আমি এখানে এসেছি।’ কোনো গবেষকদের মতে, ২১ ফেব্রুয়ারি কবিগুরু কুমিল্লা শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এই দিন কুমিল্লা মহিলা সমিতি কবিগুরুকে সংবর্ধনা দেয়। ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি কুমিল্লা শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি অখিলচন্দ্র দত্তের বাড়িতে গিয়ে প্রাতরাশ সম্পন্ন করেন। এরপর ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে শহরের ইন্দুভূষণ দত্তের বাড়িতে চা পান করেন। এখানে তিনি তাঁর রচিত একটি নতুন গান গেয়ে শোনান।[২]
বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন:
ত্রিপুরার মহারাজ ‘বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর’ ১৮৮৫ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এফ এইচ স্ক্রাইন এর অনুরোধে বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন নামে একটি পাঠাগার স্থাপন করেন। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে ১০ বিঘা জমির উপর এটি নির্মাণ করা হয়। ১৮৮৫ সালের ৬ মে প্রতিষ্ঠিত ওই ভবনই কুমিল্লার গনপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন, যা কুমিল্লা টাউন হল নামে পরিচিত। পাঠাগারে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, রাজমালা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মনীষীদের রচনাসমগ্র রয়েছে। এখানে বাংলা ভাষার ২৪ হাজার বই ও ইংরেজি ভাষার ছয় হাজার বই দিয়ে ৬৩টি আলমারি সজ্জিত। টাউন হলের নিচতলায় সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে ৪৪টি জাতীয় আঞ্চলিক, স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকী। টাউন হলে মহাত্মা গান্ধী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমূখ বিশিষ্টজনের আগমন ঘটেছে।
এ পাঠাগারেই বীরচন্দ্রের আমন্ত্রণে ১৯২১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও একবার কুমিল্লায় এসেছিলেন এবং বক্তৃতা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, ১৯০৫ সালেও তরুণ বয়সে বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের আমন্ত্রণে কবিগুরু আগরতলা থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে কুমিল্লা হয়ে যান।First en route to Kolkata from Agartala on July 16, 1905. On this stopover, Tagore was given a reception at the Comilla Town Hall.[৭]
কবির স্মৃতিবিজড়িত মহেশাঙ্গন:
দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৯১৪ সালে মহেশাঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে রামমালা গ্রন্থাগার, নিবেদিতা প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঈশ্বর পাঠশালা, মহেশ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, মহেশ হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয়, ছাত্রাবাস, মন্দিরসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মহাত্মা গান্ধী নিজেও পরিদর্শন করেছিলেন এই মহেশাঙ্গন। ২২ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহেশাঙ্গনে আসেন।রামমালা ছাত্রাবাসে কবিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবি ছাত্র শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য প্রদান করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজ সংস্কৃতি ও ইতিহাস গ্রন্থের লেখক মোঃ জহিরুল ইসলাম স্বপন বলেন, “১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ সালে কুমিল্লায় মহেশ চন্দ্রের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ তিন দিন অবস্থান করেন ।তৃতীয় দিন কবি বলেন, “যাঁর বাড়িতে থাকলুম, খেলুম তাঁর সঙ্গে কথা নেই।” মহেশবাবু বিনয়ে ভয়ে- পাবনার গেঞ্জি, গামছা কাঁধে ফেলে করজোরে হাজির।একজন সাহিত্যে বিশ্বনন্দিত, অন্যজন মহা দানবীর।”
২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ত্রিপুরার মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকুমারের বিশেষ আমন্ত্রণে কবিগুরু আগরতলার উদ্দেশ্যে কুমিল্লা ত্যাগ করেন।
এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও কুমিল্লায় কবিগুরুর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।তাঁর নামে গড়ে উঠেনি কোনো প্রতিষ্ঠান, তৈরি হয়নি কোনো ম্যুরাল! বিষয়টি সত্যিই হতাশাজনক।
তথ্য ঋণ:
[১] কুমিল্লার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি’।। আহসানুল কবীর
[২] ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্র-সংবর্ধনা’।।ভূঁইয়া ইকবাল
[৩] মোঃ জহিরুল ইসলাম স্বপন (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজ সংস্কৃতি ও ইতিহাস গ্রন্থের লেখক)
[৪] কুমিল্লা জেলা তথ্য বাতায়ন
[৫] কুমিল্লার ইতিবৃত্ত
[৬] দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য: কীর্তিমানের মৃত্যু নেই।। এস এম শাহনূর
[৭] Memories of Tagore in Comilla
The daily Star
May 08, 2008
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য চাঁদপুর:
“চাঁদপুর ভরপুর জলেস্থলে,
মাটির মানুষ আর সোনার ফলে।’’
(কবি মরহুম ইদ্রিস মিঞা)
“প্রকৃতির নিবিড় মমতায় পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া বিধৌত চাঁদপুর যেনো এক রুপ নগরের রাজকন্যা। যার রূপের যাদুতে মুগ্ধ হয়ে নেমে আসে আকাশের চাঁদ।
মেঘনা ডাকাতিয়ার জলজ জ্যোৎস্নার বিগলিত স্রোতধারায় পুষ্ট, ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এক নিবিড় শ্যামল জনপদের নাম চাঁদপুর।যার আয়তন প্রায় ১৭০৪.০৬ বর্গ কিলোমিটার।চাঁদপুর হচ্ছে চাঁদের নগর।এ চাঁদ আকাশের বিনিদ্র যামিনী জাগা চাঁদ নয় এ চাঁদ কোন ব্যক্তির কাল বিকীর্ণ নামের বিচ্ছুরণ।
লোককথার বিখ্যাত সওদাগরের বাণিজ্যতরী সপ্তডিঙা মধুকর একদিন এই উর্বর জনপদে ভিড়েছিলে। তাহারি সমৃদ্ধ নামে পরিচিত চাঁদপুর এই লোকবিশ্বাস অনেকেরই মনে দৃঢ় হয়ে গেঁথে আছে। কারো কারো মতে শহরের পুরিন্দপুর বর্তমানে কুড়ালিয়া হলার মহল্লার চাঁদ ফকিরের নাম হতে চাঁদপুর নামের উৎপত্তি। বারো ভূঁইয়াদের আমলেই ভূখণ্ড বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়ের দখলে ছিল এই অঞ্চলে তিনি একটি শাসন কেন্দ্র স্থাপন করেন তাই ইতিহাসবিদ জেএম সেনগুপ্তের মতে চাঁদ রায়ের নামানুসারেই এই অঞ্চলের নাম হয়েছে চাঁদপুর।
লোককথার প্রসিদ্ধ চাঁদ সওদাগরের নাম কিংবা চাঁদ ফকিরের পুণ্য নামের স্মৃতিধন্য মেঘনার স্রোতধারায় পুষ্ট চাঁদপুর পর্যটকদের দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে গেছে আজো।”
চাঁদপুর জেলা শহরের গোড়াপত্তনের অনেক-অনেক বছর আগেই এই জেলার বিভিন্ন পল্লী গ্রামে গড়ে উঠেছিল সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে সেদিন সংশ্লিষ্ট প্রথিতযশা শিল্পী-সাহিত্যিক ও কলাকুশলীগণ। পল্লীর সহজ-সরল মানুষের বাস্তব জীবনের কাছাকাছি ঐ সময়ের শিল্পী সাহিত্যিকদের শিল্প ও সাহিত্য চর্চা অবিভক্ত ভারতবর্ষের সূধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল বিশেষভাবে। ঐ সময়ে শিল্পীদের-সঙ্গীত আর অভিনয় মাতিয়ে তুলেছিল পল্লী গাঁয়ের মানুষের অনাবিল অন্তরকে। এমনিভাবে বাংলা ভাষা ভাষী মানুষের সাহিত্য সংস্কৃতির মহাসাগরের বিপুল স্রোত প্রবাহকে ননা উপাচারে সমৃদ্ধ করেছে এই জেলা।
জেলার পশ্চিমাংশে প্রবাহমানা মেঘনার কলকল ছলছল ঐক্যতান সৃষ্টি করেছে এক সুরেলা আবেশ। সে আবেশের ছোঁয়াচ কালে কালে, যুগে যুগে মাতিয়ে তুলেছে এর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ সমতল ভূমির সরল প্রাণ জনগণের অন্তরকে। জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে মেঘনারই শাখা-স্রোতধারা ডাকাতিয়া।ডাকাতিয়ার রয়েছে অন্য এক মোহনীয় রূপ। ডাকাতিয়া এক অপরূপে সাজিয়েছে এই জনপদকে। তার স্বচ্ছস্রোতধারা দিয়ে প্রাচুর্য। এনেছে প্রাচুর্যপ্রাপ্তির প্রশান্তি। ফুলে ফুলে ভরপুর, গানে গানে সুমধুর এই মহকুমার প্রায় প্রতিটি জনপদ। প্রভাতের সাতরঙ্গা রশ্মিচ্ছটা, মেঘনা-ডাকাতিয়ার কলকল-ছলছল উচ্ছ্বলতান, প্রভাত পাখীর কল-কাকলী মোহনীয় করেছে সুদূর অতীতে- জেলার প্রত্যেক মানুষের অন্তরের সুকোমল তন্ত্রীকে। প্রকৃতির এই মনোমুগ্ধকর বৈচিত্র্যময় পরিবেশে এখানে সাহিত্য-নির্যাসের সুরভীতে আকৃষ্ট হয়ে জন্মেছে কত শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক। কালের আবর্তে তাঁদের অনেকের নাম আজ শুধু স্মৃতি হয়ে রয়েছে মানুষের অন্তরে। মনসা মঙ্গল কাব্যে বর্ণিত উজ্জ্বয়িনী সম্ববতঃএ জেলার কচুয়া থানার উজ্জ্বয়িনী বা উজানী গ্রামের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। উজ্জ্বয়িনীতে প্রাপ্ত বিশেষ বিশেষ নিদর্শন প্রকৃত তথ্যের কাছাকাছি পৌঁছে দেবে তথ্যানুসন্ধানী গবেষককে। উজ্জ্বয়িনীর অদূরে বালুকাময় বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অবস্থান আর এর গঠন প্রকৃতি নির্দ্ধিধায় স্মরণ করিয়ে দেয় প্রাচীন সেই নদীর কথা-যে নদী দিয়ে বয়ে চলতো চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা। কচুয়ার ‘‘মনসা মুড়ার’’ সাথে জড়িয়ে আছে ‘‘বেহুলা সুন্দরী’’র অবিস্মরণীয় কাহিনী। দুলাল রাজার ও থানা বিবির (থানেশ্বরী) দীঘির অবস্থান আজও স্মরণ করিয়ে দেয় অতীতের অনেক স্মৃতিবিজড়িত কাহিনীর কথা। চাঁদপুর নামের সাথে চাঁদ শাহ্ ফকির কিংবা চাঁদ সওদাগরের কীর্তি অমর হয়ে আছে। সেদিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করলে এই মহকুমা যে এক প্রাচীন গৌরবমন্ডিত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী, এ কথা নিঃসংকোচে অথচ সগর্বে বলা যায়। অবিভক্ত ভারতবর্ষের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র যখন ছিল কোলকাতা, ঠিক সেসময় চাঁদপুরের সাথে কোলকাতার ছিল প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের (বাংলাদেশের) কেন্দ্রস্থলে অবস্থান হেতু এতদ অঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই মহকুমার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তখনকার দিনে পূর্বাঞ্চলের প্রায় সকলকেই চাঁদপুরের পথ পেরিয়েই যেতে হতো কোলকাতায়। সেই কারণে কোলকাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা শিল্প সংস্কৃতির স্পর্শে উজ্জীবিত ও আকৃষ্ট হয় এই মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মী।
শান্তিনিকেতনের প্রথম নারী শিল্পী-অধ্যাপিকা ও বাংলাদেশের প্রথম নারী চিত্রশিল্পী চিত্রনিভা। ১৯২৭ সালে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে নোয়াখালীর লামচর গ্রামের জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরীর ছেলে নিরঞ্জন চৌধুরীর সাথে চিত্রনিভার বিয়ে হয়। তখন চিত্রনিভা’র নাম ছিল নিভাননী।চিত্রকলায় অধ্যায়নের অভিপ্রায়ে ১৯২৮ সালে নিভাননী শান্তিনিকেতনের মাটিতে পা রাখেন। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসুর সহচার্যে চিত্রসাধনাকালে তিনি রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসেন।রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত তাঁর ছবি অাঁকার খোঁজখবর নিতেন। বলতেন, ‘কী কী ছবি অাঁকলে? আমায় এনে দেখিও।’ তারপর নিভা তাঁকে ছবি দেখাতে গেলে তিনি বলতেন, ‘তোমার শক্তি আছে, তুমি পারবে, আমি আশীর্বাদ করলুম।’ রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত অর্থেই নিভার শিল্পমুগ্ধ ছিলেন। সেজন্যে তাঁর চিত্রকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ নিভাননীর নাম রাখেন ‘চিত্রনিভা’। নিভাননী আজীবনই কবিগুরুর দেয়া নামটি সযত্নে বহন করে গেছেন। নামরাখা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ স্বভাবসুলভ রসিকতা করতে ভুলতেন না। চিত্রনিভা চৌধুরী জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝেই তাঁকে দেখলে বলতেন, ‘তোমার নামকরণ করলুম, এখন বেশ ঘটা করে আমাদের খাইয়ে দাও।’
রবীন্দ্রনাথ চিত্রনিভাকে তাঁর অাঁকা ছবি উপহার দিয়েছিলেন। তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন কয়েকটি রঙের বাটিও। এমনও হয়েছে নিভাননীর অাঁকা ডিজাইনের মধ্যে কবি নতুন একটি কবিতা লিখেছেন।
তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে স্মৃতিকথা লিখেছেন ১৯৬১ সালে।
প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী চিত্রনিভা’র জন্ম (১৯১৩ – ১৯৯৯) চাঁদপুরের পুরাণবাজারে।একদিন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ চাঁদপুরে এসেছিলেন।
চাঁদপুরে রবীন্দ্রনাথের যেনো নাড়ির টান ছিলো। চাঁদপুর শহর হতে ছয় কিলোমিটার দূরে বাজাপ্তি গ্রামে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন ১৯২৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ এবং পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির সহায়ক কর্মবীর কালীমোহন ঘোষের বাড়িতে। কালীমোহন ঘোষের জ্যেষ্ঠপুত্র শান্তিময় ঘোষের নাম রবীন্দ্রনাথ শান্তিদেব ঘোষ করেন। শান্তিদেব ঘোষ শান্তি নিকেতনে বিশ্বভারতীর অধ্যক্ষ ছিলেন। কালীমোহন ঘোষের কনিষ্ঠ পুত্র সাগরময় ঘোষ রবীন্দ্রনাথের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে চাঁদপুরে বর্তমান নিউমার্কেট এলাকায় তৎকালীন পৌরসভার পার্কে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। রবীন্দ্রনাথ চাঁদপুর হতে ২৮ তারিখ নারায়ণগঞ্জে গমন করেন।
তথ্য ঋণ:
[১] ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর
[২] চাঁদপুরের কথা
[৩] চাঁদপুর জেলা তথ্য বাতায়ন
[৪] বিস্মৃতির চাঁদপুর (সম্পাদনা গ্রন্থ)।।
কাদের পলাশ ও মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
চৈতন্য প্রকাশনী।
[৫] স্মৃতিকথা’।।চিত্রনিভা
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য চারুকলা পর্ষদ। (২০১৫)
রবীন্দ্রস্মৃতি।।চিত্রনিভা
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন,বাংলাদেশ।(২০১৭)
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য নারায়ণগঞ্জ:
প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ জনপদ হিসেবে আজ হতে তিন হাজার বছরের প্রাচীন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে বানিজ্যিক সুবিধার্থে এর যোগাযোগ ঘটে সুদূর প্রাচ্য -পশ্চিম এশিয়ার সাথে।
“নারায়ণগঞ্জ একটি ঐতিহাসিক স্থান। মোগল আমলে এখানে একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল। এ কাঠামোর মূলকেন্দ্র ছিল হাজীগঞ্জ ও সোনাকান্দা কেল্লা। এসব কেল্লাকে কেন্দ্র করে এতদ্বঞ্চলে একসময় গড়ে উঠেছিল এক বিরাট জনপদ। ” [১]
প্রায় সকল ঐতিহাসিকগণ একমত যে হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের শাসকগণ এখান থেকেই বঙ্গদেশকে শাসন করেছিলেন।তৎপর সুলতানি আমলে সুলতানগণও সোনারগাঁও থেকেই শাসন করেছিলেন।বাংলার স্বাধীন বার ভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খানের রাজধানীও ছিল নারায়ণগঞ্জের খিজিরপুরে(খানপুর)।
“জানা যায় যে, ১৭৬৩-১৭৬৬ সালের দিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনৈক নেতা বিকললাল পান্ডে এই অঞ্চলে বসবাস করতেন। যিনি বেণুর ঠাকুর কিংবা লক্ষ্মী নারায়ণ ঠাকুর নামেই সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে এই অঞ্চলের মালিকানা গ্রহন করেন। এরপর তিনি দেবতা প্রভু নারায়ণের সেবার ব্যয়ভার নির্বাহের নিমিত্তে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত বাজারটিকে ইচ্ছাপত্রের মাধ্যমে ‘দেবোত্তর’ সম্পত্তি ঘোষণা করেন। উক্ত দেবতা নারায়ণের নামেই এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় নারায়ণগঞ্জ। কেউ কেউ মনে করেন দেবতার নামে নয় বরং নিজের নামেই এলাকার নাম হয় ‘নারায়ণগঞ্জ’।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে স্থানীয় রাজা দনুজ মর্দন দশরথ দেবের রাজধানী ছিল সুবর্ণ গ্রাম। পরে বাংলার বার ভূইয়াদের নেতা ঈসা খাঁনের স্ত্রী সোনাবিবি নামানুসারে একে সোনারগাঁও নামকরণ করা হয়।
সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজশাহ ১৩০৫ সালে এখানে একটি টাকশাল স্থাপন করেন, ফলে এটি মধ্যযুগীয় বাংলার একটি অন্যতম শহর হিসেবে আর্বিভূত হয়। পরবর্তীকালে একশতকেরও বেশি সময় এটি টাকশাল হিসেবে চালু ছিল। গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহ ১৩২২ সালে এটিকে তার আঞ্চলিক প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।বাংলার সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ ১৩৩৮-১৩৪৯ সালে এবং তার পুত্র ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহের ১৩৪৯-৫২ শাসনামলে এটি একটি স্বাধীন সালতানাতের রাজধানী শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মুগলদের আমলে সুবা বাংলার ১৯টি সরকারের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। সপ্তদশ শতকের দিকে বিখ্যাত বারো ভূইয়ার অর্ন্তভুক্ত ঈসা খান ও পুত্র মুসা খানের (১৬১১খ্রিঃ) অধীনে শহরটি পুনরায় বাংলার রাজধানীর মর্যাদা ফিরে পায়। ঊনিশ শতকের দিকে এখানেই পানাম-নগর নামে আরেকটি শহর গড়ে ওঠে। মধ্যযুগে সোনারগাঁও এ পরিখাসহ দুর্গ-প্রাচীর -বেষ্টিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট ,বাজার ছিল এবং সব ধরনের পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ ও বন্টনের জন্য বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। দক্ষিণ-পূবাঞ্চলীয় দেশগুলোর সঙ্গে এর সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। খাসা নামে পরিচিত একধরনের মসলিন কাপড় এবং দাস ও দাস ও নপুংসকের বিশাল বাজারের জন্য শহরটি বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। বুখারার সুফি সাধক শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা এখানে একটি খানকাহ ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং তারই পৃষ্ঠপোষকতায় শহরটি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠে। ১৩৪৫ সালে বাংলার সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহের শাসনামলে (১৩৩৮-৫০ খ্রিঃ) মরক্কোর বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তৎকালীন বাংলার রাজধানী ও প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র এই সোনারগাঁও ভ্রমন করেছিলেন।পরবর্তী সোনারগাঁও থেকে তিনি জাহাজে চড়ে চীনের পথে বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার জাভা গমন করেন। তাছাড়া পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে চীনদেশীয় দূতগণ সোনারগাঁও ভ্রমন করেছিলেন।বার ভূইয়াদের নেতা ঈসা খান মুগলদের নিকট পরাজিত হলে সোনারগাঁও মুগলদের অধিকারে চলে আসে। পরবর্তীতে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও এর পরিবর্তে ১৬১০ সালে মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে আধুনিক ঢাকা নগরী বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে গড়ে ওঠে। ফলে এই সোনারগাঁও ধীরে ধীরে শ্রীহীন হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে মোগল ও ইংরেজ শাসনামলে বহু সংখ্যক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার এই স্থান ত্যাগ করে অন্যান্য স্থানে চলে যায়। তদস্থলে এই অঞ্চলের হিন্দুরা ধনেমান বিদ্যাবুদ্ধিতে বিশেষ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন। আর তাদের এ সময়ের অসংখ্য ইমারতের অস্তিত্ব সোনারগাঁও এর সবর্ত্র বিশেষ করে পানাম এলাকায় আজও দেখা যায়। [২]
চিরতরুণ ও নতুনের প্রতীক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি শুধু কবিই ছিলেন না, একাধারে ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক ছিলেন।তাঁর গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গান আজো কোটি বাঙালির আত্মার কথা বলে।
১৯২৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন। ২৭ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা নাগাদ তিনি নারায়ণগঞ্জ এসে পৌঁছান। স্থানীয় ছাত্র সংস্থা স্টীমার ঘাটে কবিকে এবং তাঁর দলের সকলকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। ছাত্ররা সেখান থেকে শোভাযাত্রাসহ কবিকে নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে নিয়ে আসেন। নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুল প্রাঙ্গণে এক সভায় কবিকে সংবর্ধনা জ্ঞাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জী’তে তা সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন।
একসময় নারায়ণগঞ্জ ছিল পূর্ববঙ্গের প্রবেশদ্বার। ভারত থেকে বাংলায় প্রবেশের প্রধান যাত্রাপথ ছিল কলকাতা > গোয়ালন্দ > নারায়ণগঞ্জ। ডাক যোগাযোগের জন্য প্রতিদিন গোয়ালন্দ -নারায়ণগঞ্জ স্টিমার আসা যাওয়া করতো। ১৮৮১ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়।ফলে দেশের যেকোনো জায়গায় যাওয়ার জন্য নারায়ণগঞ্জ বন্দরে অবতরণ করতে হতো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গে ভ্রমণকালে অনন্ত ২বার এ নারায়ণগঞ্জ দিয়েই কলকাতা থেকে আসা যাওয়া করেছেন। ব্রিটিশ ভারতে কলকাতার সাথে সমগ্র পূর্ববঙ্গের যোগাযোগ নারায়ণগঞ্জের মাধ্যমে হওয়ার কারণে দেশবরেণ্য নেতাদের পূর্ববঙ্গে আসতে হলে প্রথমে তাকে শিয়ালদা থেকে ট্রেনে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ ঘাট থেকে (১০০ মাইল) স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ এসে নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেনে ঢাকা বা দেশের অন্যান্য স্থানে যেতে হতো। স্টিমার সার্ভিসের কারণেই নারায়ণগঞ্জে আগমন ঘটেছিল উপমহাদেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, শরৎ বোস, উদয় শংকর, পি সি যোশী, কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ।
বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ভূইয়া ইকবাল-এর
‘বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংবর্ধনা’ গ্রন্থে কবিকে নারায়ণগঞ্জের সংবর্ধনাতে প্রদানকৃত মানপত্র ও কবির পূর্ণাঙ্গ ভাষনটি তুলে ধরা হয়েছে। “সেদিন কবির উদ্দেশে ঐতিহ্যবাহী এই স্কুলের শিক্ষার্থী কামাক্ষ্যাচরণ মানপত্র পাঠ করেন। কবিগুরুও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে একটি উপদেশমূলক বক্তব্য দেন। মানপত্রের একটি কপি ও কবিগুরুর উপদেশমূলক বক্তব্যটি নথিভুক্ত করে স্কুলের লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করা আছে।”[৪]
#সংবর্ধনাপত্র :
‘বিশ্ববরেণ্য কবিসম্রাট শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রাথ ঠাকুর মহাশয়ের শ্রীশ্রীচরণকমলেষু। দেব, পূর্ব্ববঙ্গের তোরণ-দ্বারে-পুণ্যসলিলা শীতলক্ষ্যার পবিত্র তীরে- হে কবি! তোমাকে তোমার প্রত্যাবর্ত্তন-পথে স্বাগতম অভিনন্দনের সুযোগ পাইয়া- আমরা আপনাদিগকে কৃতার্থ মনে করিতেছি। ছাত্র আমরা- তোমার শিষ্যানুশিষ্যের যোগ্য নহি! তোমার চরণ-রেণু স্পর্শ করিবার অধিকার লাভের স্পর্দ্ধাও আমাদের নাই- কিন্তু সর্ব্বজনপ্রিয় তুমি- দয়া করিয়া আমাদের ছাত্রসঙ্ঘের ন্যায় দীনতম-ক্ষুদ্রতম প্রতিষ্ঠানের কথাও বিস্মৃত হও নাই- সে আনন্দে সে-গর্ব্বে আমরা স্নেহ-পুলকিত-হৃদয়ে আমাদের দীন আয়োজন- আমাদের বন-ফুলমালা তোমার শ্রীচরণসরোজে অর্পণ করিতে সাহসী হইয়াছি। হে কবি! তুমি তাহা গ্রহণ করিয়া সার্থক কর- কৃতার্থ কর- আমাদিগকে ধন্য কর। আমাদের এ বাংলাদেশ- দেশে দেশে শুধু অন্নই বিতরণ করে না- দেশকে সুজলা সুফলা ও শস্যশ্যামলা করিয়াই শুধু নদীর শুভ্র-রজতধারা তাহার গতিপথে অগ্রসর হয় না- তাহার কল প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানের পবিত্র আলোকধারাও লহরে লহরে দিগ্দিগন্তে ব্যাপ্ত করিয়া দিয়া আপনাকে মহিমান্বিত করিয়াছে- সে লুপ্তধারা- ধূর্জ্জটির জটানিষ্যন্দী পবিত্রধারার ন্যায় তুমিই আবার বিশ্বভারতীর শান্তিনিকেতন হইতে প্রবাহিত করিয়া সমস্ত বিশ্ববাসীকে ভারতের বাণী নূতন করিয়া প্রচার করিতেছ। নালন্দা নাই- তক্ষশীলা নাই- বিক্রম শীলা নাই! তাহাতে দুঃখ কি? তোমার বিশ্ব-ভারতী- অতীত ও বর্ত্তমানকে জাগ্রত করিয়াছে। আমরা তোমার সেই আদর্শ হৃদয়ে গ্রহণ করিয়া- লক্ষ্য পথে চলিতে পারি- আমাদিগকে সে আশীর্ব্বাদ কর। পলীর লুপ্তগৌরব প্রতিষ্ঠা- দেশকে অন্তরের সহিত ভালোবাসার- শিক্ষার প্রদীপ হাতে করিয়া কেমন করিয়া আমরা মানুষ হইব? কেমন করিয়া প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান পাইব? কথায় নহে কাজে- শুধু নয় দীক্ষায়- প্রকৃত কর্ম্মীরূপে দীনভাবে ও দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করিতে পারি- তোমার চরণে উপদেশ-ভিক্ষু আমরা সে আবেদন নিবেদন করিতেছি। আমাদের এই নারায়ণগঞ্জ-বন্দর অতি প্রাচীন বন্দর- অতি প্রাচীন ইতিহাসেও ইহার নাম আছে। দুর্ভাগ্য আমাদের এখানে বাণীর সেবক নাই বলিলেও চলে। এখানকার নীরস শুষ্ক মরুভূমির বুকে কোনদিন বর্ষণ নামে নাই- এই ঊষর মরুভূমিকে সরস করে নাই, সৌভাগ্য আমাদের আজ এই মরুভূমির বুকে সুধাধারা সিঞ্চিত হইবে- নব বসন্তের আবির্ভাব হইবে নব রূপে- নব ভাবে- নব পিককুহরণে- এই বসন্তোদয় চির বসন্তের উজ্জ্বল শ্যামল শ্রীতে মণ্ডিত হউক- এই আশীর্ব্বাদ ভিক্ষা করিয়া তোমাকে অর্ঘ্যডালা সমর্পণ করিতেছি। এই দীর্ঘ নগরের পৌরগণের গর্ব্ব করিবার অতীত ইতিহাস আছে,- ঐ দূরে- লক্ষ্যার তীরে- সোনাকান্দার দুর্গ এখনও বাঁচিয়া আছে। সুবর্ণগ্রামের শত প্রাচীন কীর্ত্তি- সেন পাল ও পাঠান-মোগলের রণ-ভেরী শব্দিত কানন-প্রান্তর ও মগ-বাঙ্গাীর রণ কোলাহল- এখনও এই ভূমির আকাশে বাতাসে শব্দায়মান- সে কাহিনী আমাদিগকে অতীত গর্ব্বে গৌরবান্বিত করে- সেই অতীত কীর্ত্তিগরিমামণ্ডিত- শত শত পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যে-ভূষিত দেশ আজ শুরু স্মৃতির কঙ্কাল লইয়া বাঁচিয়া আছে- তোমার পাদস্পর্শে আবার তাহা নবজীবন লাভ করিয়াছে। কবি তুমি! ঋষি তুমি! বাঙ্গালীর হৃদয়াসনে সুপ্রতিষ্ঠিত উজ্জ্বল রবি তুমি কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাইয়া তোমাকে বলিতেছি- ‘জগৎ কবি-সভার মাঝে তোমার করি গর্ব্ব / বাঙ্গালী আজি গানের রাজা বাঙ্গালী নহে খর্ব্ব।’
প্রণতঃ ছাত্রসঙ্ঘের সভ্যবৃন্দ।
নারায়ণগঞ্জ ১৫/১১/৩২ বঙ্গাব্দ
নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে প্রদত্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষন :
নারায়ণগঞ্জের প্রবেশদ্বার দিয়ে আমি পূর্ববঙ্গে প্রবেশ করেছিলাম। ফেরার পথে আবার এখানে এসেছি। পূর্ববঙ্গের যেখানে গিয়েছি, আমার বলবার কথা বলেছি; কিন্তু বলার দ্বারা ফল হয় বলে আমি বিশ্বাস করিনে। কর্মের মধ্য দিয়েই আমাদের দেশের বিচিত্র সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশের বিদ্যালয়ে চাকুরিই ছিল শিক্ষার উদ্দেশ্য। লোকে চাকরি পাওয়ার জন্য নিজেকে শিক্ষিত করতে স্কুল-কলেজে পড়তে যায়। সৈাভাগ্যক্রমে চাকুরির পথ সংকীর্ণ হয়েছে। তাই শিক্ষিত যুবকগণ স্বাধীন উপায়ে জীবিকার্জনে সচেষ্ট হয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রেও কাজ কর্মে এক পরিবর্তন এসেছে। এমন একটি সময় ছিল, যখন লোকে ভাবতেন বক্তৃতা দিয়েই তাঁরা তাঁদের কাজ উদ্ধার করতে সক্ষম হবেন। তাঁরা পুরাতন অভ্যাসবশতঃ এখনও ঐরূপ কাজ করে বসেন। কিন্তু বর্তমানে যুবসমাজ বাস্তব ও আসল কাজের দিকে তাকায়। বর্তমান আন্দোলন কালে যে উদ্দীপনা এসেছে, তাকে যেন তারা স্থায়ী করে। কবি বলেন- শান্তিনিকেতনে পূর্ববঙ্গের বহু ছেলে পড়ে। তাদরে মধ্যে চরিত্রের দৃঢ়তা, একাগ্রতা ও শ্রদ্ধার ভাব দেখেছি। আমি পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ করে দেখলাম, এটা একটা ভাল কর্মী সংগ্রহের স্থান। এখানকার ছেলেদের যে কাজেই লাগানো যাবে, তারা তাদের একাগ্রতা ও নিষ্ঠার দ্বারা কৃতকার্য হবেই। আমি যদি এখনও যুবক থাকতাম, তাহলে এখানে বক্তৃতা না করে হাত-নাতে কাজে লেগে যেতাম। এখানকার উর্বরা মাটির মতই এখানকার মানুষের উদ্যম আগ্রহও প্রবল। কিন্তু আজ আমার বয়স এবং স্বাস্থ্য দুই-ই নেই। আমার কর্মক্ষেত্র পশ্চিমবাংলার এক সীমান্তে অবস্থিত। সেখানকার মাটি উর্বরা নয় এবং মানুষও অনেকটা উদাসীন। পূর্ববঙ্গের এ অঞ্চলে উপযুক্ত পরিবেশে লোকে যদি তাদের কাজ আরম্ভ করে তাহলে তারা অতি সহজেই সফলকাম হবে। রাজনৈতিক নেতারা গ্রাম থেকে দূর শহরে শহরে খুব ভাল বক্তৃতা দিয়ে থাকে। এই উপায়ে গ্রামের কোন উপকার করাই সম্ভব নয়। পূর্ববঙ্গে পলী উন্নয়ন নিঃসন্দেহে সম্ভবপর। এই প্রসঙ্গে কুমিল্লায় অভয় আশ্রমের কথা আমার মনে পড়ে। ঐ আশ্রমের কর্মীরা স্বার্থত্যাগের মধ্য দিয়ে যে কাজ করে চলেছেন, তা দেখে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছি। তাঁরা খুবই সাহস দেখিয়ে নিম্নবর্ণের মানুষদের নিজেদের মধ্যে নিয়েছেন। আমি এটা ক্বচিৎ কোথাও দেখেছি। নিম্নবর্ণের লোকদের সঙ্গে আমাদের মেলামেশার অভাব, সেটা আমাদের ঐক্যের পথে একটা বড় অন্তরায়। এটা দূর করতে না পারলে দেশের মুক্তি অসম্ভব। আমরা আমাদের মধ্যে এই বিভেদ সৃষ্টি করে দেশকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছি। অভয় আশ্রমে অস্পৃশ্যদের মধ্যে যে আত্মসম্মানবোধ দেখলাম, তা সত্যই প্রশংসার যোগ্য। সাহসের সঙ্গে গ্রামবাসীদের পলী সংস্কারের কাজ করে যাওয়া উচিৎ। তাহলেই দেশের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। পূর্ববঙ্গে প্রকৃতি যেমন সৌন্দর্যে ও প্রাচুর্যে নিজেকে বিকশিত করেছে, এখানকার লোকদের মধ্যেও দেখেছি তেমন প্রাণ-প্রাচুর্য ও প্রাণের উদারতা। পূর্ববঙ্গের যুবকরা যদি তাদের এ অঞ্চলে গ্রামীণ কাজ আরম্ভ করে, তাহলে তারা নিশ্চয়ই সফলকাম হবে। উপসংহারে আমি ছাত্রদের আশীর্বাদ জানিয়ে বলব- তারা তাদের ত্যাগ ও নিষ্ঠার দ্বারা কাজ করলে শুধু বাংলাকেই নয়, সারা ভারতকেও আসল পথের সন্ধান দেবে।
নারায়ণগঞ্জ ১৫/১১/৩২ বঙ্গাব্দ
রবীন্দ্রনাথের সেই ছোট্ট ভাষণটি স্কুলের লাইব্রেরিতে বড় করে টানানো আছে।
তথ্য ঋণ:
[১] নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস
[২] মোঃ আবু সাঈদ।।নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও : ইতিহাস ও ঐতিহ্যর রাজধানী
Mati news.com
২১ ডিসেম্বর ২০১৯
[৩] বিলু কবীর, বাংলাদেশের জেলা: নামকরণের ইতিহাস, গতিধারা, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০১০
[৪] নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
দৈনিক কালের কণ্ঠ
৬ আগস্ট, ২০১৪
[৫] নারায়ণগঞ্জের স্মৃতি বিস্মৃতি।।এস এম শহীদুল্লাহ
Some text
ক্যাটাগরি: সাহিত্য
[sharethis-inline-buttons]