ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার দক্ষিণ কাইতলা ইউনিয়নে কাইতলা জমিদার বাড়িটির অবস্থান। ব্রিটিশ আমলে লর্ড কর্ণওয়ালিস কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারী প্রথার প্রবর্তন শুরু হয়। তখন নূরনগর পরগনার কাইতলায় গড়ে উঠে বিশাল এক জমিদারি সাম্রাজ্য।অসংখ্য জ্ঞানী গুণী ও সূফী সাধকদের পদচারণে মুখরিত থাকতো এক সময়কার কাইতলা জমিদার বাড়ি।
✪ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ছোটবেলা কাইতলা জমিদার বাড়িতে এসেছিলেন:
ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা,বামপন্থী রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ জীবন্ত কিংবদন্তী কমরেড জ্যোতি বসু (১৯১৪ – ২০১০) ১৯৭৭ সাল থেকে টানা ২৪ বছর পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
১৯৯৮ সালে লেখা ‘কাইতলা জমিদার বাড়ির ইতিহাস’ শিরোনামে লেখাটি নব সাহিত্যের পাতা নামক সাময়িকীতে প্রকাশিত হলে এলাকার বহু শিক্ষিত ও গুণিজন আমার লেখাটির প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেননি। পরবর্তীকালে গুগলে কাইতলা জমিদার বাড়ি উইকিপিডিয়া লেখাটি হুবহু স্থান দখল করে নেয়। অতপর অসংখ্য পত্রিকা ও বেশ কিছু টিভি চ্যানেল এখান থেকে তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। লেখাটিতে কাইতলা জমিদার বাড়ির সিংহভাগ তথ্য আছে বলে আমার বিশ্বাস। তবু পাঠক মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক কথা থেকে যায়। সময় সময়ে পাঠক মনের সেই সকল প্রশ্নের জবাব দেওয়ারও চেষ্টা করেছি।
সাবেক কুমিল্লা জিলার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার অন্তর্গত নবীনগর থানার কাইতলার জমিদার অবনী রায় চৌধুরীর পুত্র অনঙ রায় চৌধুরী (যিনি পটু বাবু নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন।) আনুমানিক ১৯২৫/২৬ সালের দিকে জ্যোতি বসুর(চাচাত বোন) বড় চাচার মেয়ে জ্যোৎসাময়ী রায় চৌধুরানীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
জমিদার পুত্র অনঙ রায় চৌধুরী ও জ্যোৎসাময়ী রায় চৌধুরানীর তিন সন্তান যথাক্রমে গোপাল চন্দ্র রায় চৌধুরী, ভুনো চন্দ্র রায় চৌধুরী, অতিন্দ্র মোহন রায় চৌধুরী। অতিন্দ্র মোহন রায় চৌধুরী-যিনি এলাকার মানুষের কাছে হারু বাবু বলে পরিচিত ছিলেন।তিনি ২০০৩ সালে নানান অসুস্থতা জনিত কারণে চিকিৎসার প্রয়োজনে কলকাতা যাওয়ার আগের দিন পরলোকগমন করেন।উনার বড় দুই ভাই সপরিবারে কলকাতা শহরে বাস করতেন।এখন আর কেউ বেঁচে নেই। কাইতলা যজ্ঞের উচ্চ বিদ্যালয়ের এক সময়ের মেধাবী ছাত্র,বল্লভপুর গ্রামের কৃতিসন্তান -মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ফরহাদ হোসেন বলেন,”আমার বাবার সাথে হারু বাবুর অত্যন্ত চমৎকার সম্পর্ক ছিল।
আমাকেও তিনি খুব স্নেহ করতেন।নানান গল্প শোনাতেন।১৯৮৭ সালের কথা। ডাঃ নারায়ন সাহার ভাতিজা আমার বন্ধু বিষ্ণু সাহার সাথে দেখা করতে কাইতলার বাড়িতে যাই।তখন ছিল আষাঢ় মাস।মুষলধারে বৃষ্টির কারণে ঐ দিন নিজ গ্রাম বল্লভপুরে ফেরা সম্ভব ছিলনা। তাই রাতে বন্ধুর বাড়িতে থেকে যাই।ঐ দিকে হারু বাবু আমাকে পেয়ে অনেক খুশি হলেন।উনাদের পরিবারের অনেক কথা,বহু গল্প শোনালেন। এক পর্যায়ে এসে বললেন,পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সম্পর্কে উনার (আপন চাচাত) মামা হন।এবং উনার মায়ের বিয়ের সময় জ্যোতি বসুও নাকী কাইতলা জমিদার বাড়িতে এসেছিলেন।”
যদিও জ্যোতি বসু কাইতলা এসেছিলেন কিনা তা বলা মুশকিল!তবে আসেননি এমনটিও বলা যাবেনা।কারণ জ্যোতি বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ছিলেন না।বালক জ্যোতি বসু ছিলেন নিতান্তই জ্যোৎসাময়ী রায় চৌধুরানীর চাচাত(জেঠাত) ভাই।
জ্যোতি বসু স্বর্গীয় হারু বাবুর মামা ছিলেন কীনা জানতে চাইলে (কাইতলা যজ্ঞের উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক সিনিয়র শিক্ষক)শিমরাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ও কাইতলা হিন্দু সমাজের গুনিজন শ্রী নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, “হারু বাবু জমিদার বাড়ি ছেড়ে আমার বাড়িতেই থাকতেন,খাওয়া ঘুম গোসল সবই ছিল আমার বাড়িতে।তাঁর ও তাঁর পরিবারের সব কিছু আমার জানা।হারু বাবুরা তিন ভাই।দুই ভাই গোপাল ও ভুনো কলকাতায় থাকতেন।হারু বাবু পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ির মায়া ছেড়ে কলকাতা যেতে পারেননি।উনার নানার বাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জ জেলার বারদীতে।পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পৈতৃক নিবাস এবং নানার বাড়িও ছিল বারদীতে। হারু বাবুর মা জ্যোৎসাময়ী রায় চৌধুরানী ও জ্যোতি বসু জেঠাত ভাই বোন ছিলেন।সেই সূত্রে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু হারু বাবুর মামা ছিলেন। হারু বাবু মৃত্যুর পর ৯৫/৯৬ বছর বয়স্ক হারু বাবুর এক আপন মামা কলকাতা থেকে কাইতলা এসেছিলেন।তারপর থেকে উনাদের বংশের কারোর সাথেই আর যোগাযোগ নেই।”
সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু কাইতলা জমিদার বাড়িতে এসেছিলেন কিনা জানতে চাইলে শ্রী নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, “এ বিষয়টি আমার জানা নেই।তবে হারু বাবুর পিতা জমিদার পুত্র অনঙ রায় চৌধুরী যখন জ্যোতি বসুর জেঠাত বোন জ্যোৎসাময়ী কে বিয়ে করেন তখনও কাইতলা জমিদারদের জমিদারি ছিল।বাড়ির আভিজাত্য ও জৌলুসও ছিল। তাই ছোটবেলা বোনের শ্বশুর বাড়িতে আসেননি এমনটিও বলা যাবে না।
হারু বাবু বলেছেন,”উনি উনার মায়ের মুখে শুনেছেন- মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ছোটবেলা কাইতলা জমিদার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন।’ এ বিষয়ে আপনার সংক্ষিপ্ত মন্তব্য কি? আমি স্যারের নিকট এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিলে তিনি বলেন,”হারু বাবু যদি নিজে বলে থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে তা সঠিক।”
জ্যোতি বসুর বাবা ডা. নিশিকান্ত বসুর জন্ম নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও থানার বারদীতে।জ্যোতি বসুর পিতা ডা. নিশিকান্ত বসু ছিলেন একজন প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক। পেশা সূত্রে তিনি জ্যোতি বসুর জন্মের পূর্বেই বারদী থেকে কলকাতায় চলে যান। সেখানে চিকিৎসা পেশা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অবিভক্ত বাংলায় বিভিন্ন ছুটি ছাটা ও পুজো পার্বনে নিশিকান্ত বসু সপরিবারে বেড়াতে আসতেন বারদীতে। সেই সুবাদে সোনারগাঁয়ের বারদীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জ্যোতি বসুর অনেক স্মৃতি।জ্যোতি বসুর ছোটবেলার অনেকটা সময়ই কেটেছে বারদীর পৈত্রিক বাড়িতে। বারদীতে অবস্থিত জ্যোতি বসুর এই বাড়ীটি মূলত তার নানার। জ্যোতি বসুর নানা শরৎ চন্দ্র দাস ও নানী খিরদা সুন্দরী। তাদের সংসারে জ্যোতি বসুর মা হেমলতা ছিলেন একাই।
সেই সূত্রে এই বাড়ীর মালিক হন হেমলতা বসু। হেমলতা বসুর সঙ্গে ডা. নিশিকান্ত বসুর বিয়ের হওয়ার সুবাদে এই বাড়ীটির মালিক হন ডা. নিশিকান্ত বসু ও হেমলতা বসুর দুই সন্তান ডা. সুরেন্দ্র কিরণ বসু ও জ্যোতি বসু। ছোটবেলায় জ্যোতি বসু বারদীতে থাকাকালীন সময়ে তার দেখা শোনা করতেন আয়াতুন নেছা নামে এক মহিলা। পরবর্তীতে জ্যোতি বসুর পৈত্রিক বাড়ীটির দেখা শোনার ভার দেন আয়াতুন নেছা ও তার ছেলে হাবিবুল্লার উপর। বর্তমানে ওই বাড়ী দেখা শোনা করছেন আয়াতুন নেছার নাতী ইউসুফ আলী।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে জ্যোতি বসু ১৯৮৭ সালের ২০ জানুয়ারি এবং ১৯৯৭ সালের ১১ নভেম্বর বারদীতে অবস্থিত তার পৈত্রিক বাড়ীটি দেখতে আসেন। ‘শৈশবে গরম ও পূজার ছুটিতে বাংলাদেশ ভ্রমণের স্মৃতি আজো আমাকে আপ্লুত করে। আমার বাবা-মাসহ অনেক আত্মীয় বাংলাদেশে থাকতেন। রেলওয়ে ইউনিয়নের কাজে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও অধুনা বাংলাদেশে আমাকে অনেকবার যেতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আমাকে তিনবার বাংলাদেশে যেতে হয়েছিল।’
✪ ত্রিপুরার মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর ও কাইতলা জমিদার বাড়ি:
মাণিক্য রাজবংশীয় মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য দেববর্মণ বাহাদুর ১৮৬২ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরার রাজা ছিলেন।তিনি একজন উৎসাহী ফটোগ্রাফার ছিলেন। তিনি ভারতের প্রথম রাজা যিনি তার প্রাসাদে বার্ষিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন।মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ফরহাদ হোসেন বলেন,তিনি তাঁর পিতার কাছে শুনেছেন, একবার বর্ষাকালে ত্রিপুরার মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর পানসি বহর নিয়ে ‘প্রজা দর্শন’ ভ্রমণে বের হন।
ঐ ভ্রমণে তিনি তাঁর রাজ্যের বিভিন্ন জমিদারগণের সাক্ষাৎ প্রত্যাশী ছিলেন।রাজা তাঁর পানসি বহর নিয়ে কাইতলা জমিদার বাড়ির দক্ষিণ ও পূর্বের খাল দিয়ে অতিক্রম করার সময় (তিলক চন্দ্র রায় চৌধুরী, অভয় চন্দ্র রায় চৌধুরী ও ঈশান চন্দ্র রায় চৌধুরী) জমিদারগণ সাদামাটা ধূতি ও গায়ে গামছা পরিহিত অবস্থায় হাটু পানিতে নেমে দুই হাত জোড় করে মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন।(কারণ,তাঁরা নিজ এলাকায় জমিদার হলেও মহারাজের কাছে তাঁর নিয়োগকৃত খাজনা আদায়কারী প্রতিনিধি ছাড়া বড় কিছুই ছিলনা) মহারাজকে পানসি থেকে নেমে জমিদার বাড়িতে উঠার বিনিত অনুরোধ করেন।মহারাজ দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য দেখেন।মহারাজ বলেছিলেন, মহারাজ তাঁর নিয়োগকৃত কর্মচারীর বাড়িতে কখনো আমন্ত্রিত অতিথি হয় না। আরো বলে, “তোমার বাড়ির সৌন্দর্য আমি দেখেছি।আমার রাজ প্রাসাদের চেয়ে তোমার বাড়ির সৌন্দর্য কম নয়।” অতপর,মহারাজের পানসি বহর বিটঘরের দিকে চলে যায়। “তোমার বাড়ির সৌন্দর্য আমি দেখেছি।আমার রাজ প্রাসাদের চেয়ে তোমার বাড়ির সৌন্দর্য কম নয়।” ত্রিপুরার মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের মুখে কাইতলা জমিদার বাড়ির সৌন্দর্যের এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রমাণ করে এটি একসময় নূরনগর পরগনার একটি সমৃদ্ধশালী জমিদার বাড়ি ছিল।
✪ বহু ভাষাবিদ আলহাজ্ব আবু মিজান মাকসাদ আলী বল্লভপুরী [রঃ] (১৮৪০ – ১৯১৬)।
তিনি শায়খুল বাঙাল ছৈয়দ আবু মাছাকিন গোলাম মতিউর রহমান লাহিন্দী আল কাদেরী বল্লভপুরী (রঃ)(১৮৭৩ – ১৯৭৮) দুদু মিয়া পীর সাহেবের পিতা।ত্রিপুরার ১৭৭ তম মহারাজ শ্রী শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর মানিক্য বাহাদুর(রাজত্বকাল ১৯০৯ খ্রিঃ- ১৯২৩খ্রিঃ)তাঁর মুসলিম প্রজাদের বিচারের রায় প্রদানের কর্তৃত্ব স্বরুপ তাঁকে (১৯১০ থেকে ১৯১৬ পর্যন্ত) কাজির পদ প্রদান করেন। এর পূর্বে তিনি কিছু কাল কাইতলা জমিদার বাড়িতে দাপ্তরিক কাজে কর্মরত ছিলেন।
✪ ঈশ্বর দাস তর্কসিদ্ধান্ত (১৮২১-১৮৬৩)।
অখন্ড ভারতে জ্ঞান অর্জনের এক অসামান্য বাতিঘর ‘কুমিল্লার রামমালা গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর চরিত্র, বাংলার কৃতি সন্তান মহাত্মা দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের (১৮৫৮ – ১৯৪৪) পিতা ঈশ্বর দাস তর্কসিদ্ধান্ত কাইতলা জমিদার বাড়ির পুরোহিত ছিলেন।দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের ৬ বছর বয়সে মাত্র ৪২ বছরে ঈশ্বর দাস তর্কসিদ্ধান্তের জীবনাবসান হয়।
পরে মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য যখন দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য হন তখন কাইতলা জমিদারদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ১৩ বিঘা জমি দান করেন, স্কুলের চেয়ার টেবিল,বেঞ্চ থেকে শুরু করে সকল নির্মান খরচও বহন করেন।
✪ অমরচন্দ্র চক্রবর্তী ও কাইতলা জমিদার বাড়ি:
বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ তালযন্ত্রী।কাইতলা জমিদার বাড়ির তবলাবাদক তিনি।সারা বঙ্গে তাঁর সুনাম ছিল।
অমরচন্দ্র চক্রবত্তী মহাশয় ১৩৪৭ বাংলায়,পৌষ মাসে ৬৫ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। #তথ্যসূত্র: জয়ন্তী ২ য় বর্ষ, ৮ম সংখ্যা – ১৩৪৭ বাংলা।
✪ সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও কাইতলা জমিদার বাড়ি:
সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ (১৮৬২ – ১৯৭২) একজন বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ। বাবা আলাউদ্দিন খান নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। সেতার ও সানাই এবং রাগ সঙ্গীতে বিখ্যাত ঘরানার গুরু হিসাবে সারা বিশ্বে তিনি প্রখ্যাত। মূলত সরোদই তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাহন হলেও সাক্সোফোন, বেহালা, ট্রাম্পেট সহ আরো অনেক বাদ্যযন্ত্রে তাঁর যোগ্যতা ছিল অপরিসীম। আলাউদ্দিন খাঁর জন্ম তৎকালীন ত্রিপুরা প্রদেশের শিবপুর গ্রামে যা বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজ সংস্কৃতি ও ইতিহাসের লেখক মোঃ জহিরুল ইসলাম স্বপন বলেন, “আশরাফ উদ্দিন ধন মিয়া মাস্টার, বাদৈর ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে জানান, ওস্তাদ আফতাব উদ্দিন খাঁ সহ বঙ্গ- ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও যন্ত্রীরা কাইতলা জমিদার বাড়িতে আসতেন।দুর্গাপুজা ছাড়াও শীতে যাত্রাদলকে লালন,পৃষ্ঠপোষকতা করতেন জমিদাররা।সিংহদ্বার ফটকের পরই প্রথমেই ছিল নাটমন্দির।যেখানে নৃত্য, নৃত্যনাট্যের স্থায়ী মঞ্চ ছিল।১৯১৮ সালের পর একবার এবং ১৯৩৮ সালের পর আরেকবার সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ কাইতলা জমিদার বাড়িতে এসেছিলেন। ”
✪ ওস্তাদ আফতাব উদ্দিন খাঁ(১৮৬২-১৯৩৩)।
তিনি ছিলেন গীতিকার, সুরকার, গায়ক, বংশীবাদক। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে এক বিখ্যাত সঙ্গীত পরিবারে তাঁর জন্ম। আফতাবউদ্দিন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে ব্যুৎপন্ন ছিলেন, তবে বংশীবাদনেই তাঁর খ্যাতি ছিল সর্বাধিক। কথিত হয় যে, তাঁর বংশীবাদন শুনে পাখিরা পর্যন্ত সম্মোহিত হয়ে যেত। তিনি তবলা ও ন্যাসতরঙ্গ বাদনেও দক্ষ ছিলেন। আফতাবউদ্দিনের একটি বিশেষ কৃতিত্ব যে, তিনি একসঙ্গে তিনটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। কখনও তবলা, বাঁশি ও হারমোনিয়াম; আবার কখনও দোতারা, বাঁশি ও বাঁয়া। এভাবে তিনি যখন গান গাইতেন তখন মনে হতো একসঙ্গে অনেকে গান গাইছে আর যন্ত্র বাজাচ্ছে। তিনি ‘মেঘডম্বুর’ ও ‘স্বরসংগ্রহ’ নামে দুটি বাদ্যযন্ত্রও উদ্ভাবন করেন।
✪ পল্লী কবি জসীমউদ্দিন ও কাইতলা জমিদার বাড়ি:
জসীম উদ্দীন (১৯০৩ – ১৯৭৬) একজন বাঙালি কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক ও লেখক। ‘পল্লীকবি’ উপাধিতে ভূষিত, জসীম উদ্দীন আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি।ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরসভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীম উদ্দীনের।তাঁর কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
পল্লী কবি জসীমউদ্দিন আনুমানিক ১৯৬৭ সালে কাইতলা এসেছিলেন। তিনি কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন।ডাঃ মহানন্দ পোদ্দার ও কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জনাব আব্দুল খালেক সাহেবের আমন্ত্রণে তিনি কাইতলা এসেছিলেন।পোদ্দার বাড়িতে বিশ্রাম ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়।সেই সময় তিনি কাইতলা জমিদার বাড়িতেও যান এবং অস্তমিত জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য ঘুরে ঘুরে দেখেন বলা জানা যায়।কাইতলা স্কুলে আসার পথে নভোদীপ কর্মকারের হাপর টানা ও হাতুড়িতে লোহা পেটানোর শব্দ শুনে স্কুলের উত্তর পার্শ্ববর্তী সেই কামারশালায় গিয়ে কিছুসময় তিনি বসে থাকেন। তিনি হাপরের বাতাসে কয়লার আগুনে পোড়ানো লাল রঙের লোহা এবং উড়ে উড়ে বেড়ানো অগ্নি স্ফুলিঙ্গগুলো দেখে পুলকিত হন।কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মরহুম এম এস জামান স্যারের মুখে বেশ কয়েকবার এ গল্প আমি শুনেছি।
✪ স্বদেশী আন্দোলনের সূঁতিকাগার কাইতলা জমিদার বাড়ি:
“কাইতলার জমিদার বাবু অবিনাশ চন্দ্র রায় চৌধুরী ও বাবু প্রফুল্ল চন্দ্র রায় চৌধুরীর বাড়িতে একটি বৃহৎ স্বদেশি সভা হয়।মূখ্য উদ্দেশ্য বিলিতি পণ্য বর্জন ও স্বদেশি পণ্য গ্রহণ।বরিশালে প্রাদেশিক সমিতির উপর অবৈধ আচরণে ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেন।বরিশালের এ সভায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, এ আর রসুল ছিলেন।কাইতলা জমিদার বাড়ির তাঁরা স্বদেশি আন্দোলন পরবর্তীতেও অনেক অবদান রাখেন।”
#তথ্যসূত্র- ত্রিপুরা হিতৈষী – ৫ জুন ১৯০৬ইংরেজী। ৮ ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা নং-৫।
“কাইতলা জমিদার বাড়ির ইতিহাস”
জানতে হলে ক্লিক করুন।
@➤তথ্য ঋণ:
[১] শ্রী নারায়ণ চন্দ্র সাহা
সাবেক প্রধান শিক্ষক,
শিমরাইল উচ্চ বিদ্যালয়।
কসবা,ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
[২] প্রফেসর ফরহাদ হোসেন
বিভাগীয় প্রধান,ইংরেজি বিভাগ।
মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।
ঢাকা।
[৩] মোঃ জহিরুল ইসলাম স্বপন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজ সংস্কৃতি ও ইতিহাস গ্রন্থের লেখক।
[৪] এস এম আশরাফ আলী প্রণীত
কাছিদায়ে শায়খুল বাঙ্গাল
[৫] রাজমালা।। শ্রী কৈলাস চন্দ্র সিংহ
[৬] ইন্দু কুমার সিংহ রচিত
কর্মযোগী মহেশ চন্দ্র ও কুমিল্লা মহেশাঙ্গন গ্রন্থ
[৭] উইকিপিডিয়া।
💻লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক।
Some text
ক্যাটাগরি: বিবিধ
[sharethis-inline-buttons]