রবিবার সন্ধ্যা ৬:৪১, ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ১৭ই নভেম্বর, ২০২৪ ইং

দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য: কীর্তিমানের মৃত্যু নেই

১১৯৯ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

‘আত্মনির্ভরশীলতা পরম সুখ, আর পরনির্ভশীলতা পরম দুঃখ।’

অখন্ড ভারতে জ্ঞান অর্জনের এক অসামান্য বাতিঘর কুমিল্লার রামমালা গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর চরিত্র, বাংলার কৃতি সন্তান মহাত্মা দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য(১৮৫৮- ১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৪) ।”মানব জীবনে মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশ ও জনগণের মঙ্গলের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাদের অন্যতম। কঠোর শ্রম, ন্যায়পরায়ণতা, অধ্যবসায়, আত্মবিশ্বাস এবং মহৎ আদর্শের ওপর নির্ভর করে তিনি নিতান্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে জীবন সাধনায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।”১ একদা কঠোর দারিদ্র্যের জন্য লেখাপড়া করার সুযোগ না পেয়েও নিজের শ্রম আর মেধাকে ব্যবহার করে তিনি আলাদীনের চেরাগের গল্পের মতো দেখতে দেখতে প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হন।পরবর্তীতে শিক্ষা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ায় মনোনিবেশ করেন।

মানবিক আদর্শের গুণাগুণ সম্পন্ন সম্পুর্ণ মানুষ মহাত্মা মহেশ চন্দ্র কে জীবদ্দশায় দেখা হয়নি আমার কিন্তু সেই তেজস্বী পুরুষের জীবন ও কর্ম- কান্ডের উত্তাপ দেহ মনে ছড়িয়ে গেছে সেই কৈশোরে।আমি দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য কে ৭ বছর ধরে দেখেছি।যদি চিত্র শিল্পী হতাম এঁকে দিতাম তাঁর সেই ছবি।টানাটানা ভ্রমর কালো দুটো ভ্র,হালকা ক্রিমকালার ফতুয়া আর মোটা সাদা রঙের ধূতি পরিহিত বিজ্ঞচিত ভাব, পিড়িতে আসন পেতে বসে থাকা Oil Painting করা ছবিটি কাইতলা যঁজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে রক্ষিত ছিল।স্কুল জীবনে প্রতিক্লাসে প্রথম হওয়ার সুবাদে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের স্নেহভাজন ছিলাম।প্রায় প্রতিদিনই প্রধান শিক্ষক মরহুম এম এস জামান স্যারের সাথে অফিস কক্ষে দেখা করতে যেতাম (কখনো সখনো স্যার আমাকে ডেকে পাঠাতেন)।

স্যারের চেয়ারের পিছনেই টানানো ছিল কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবিটি।প্রিয় স্যার আমাকে হোম ওয়ার্ক দিতেন,নানান উপদেশমূলক গল্প শুনাতেন।শুনাতেন নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, কাইতলা জমিদার বাড়ির ইতিহাস। কথার ফাঁকে আমিও ছবির মানুষটির সাথে কিছু কথা বলে নিতাম।দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের জীবনী লেখার জন্য তথ্য সংগ্রহ ও পড়াশোনা শুরু করার আগে সেই ছবিটির ছবি সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে গিয়ে বড় দুঃখ পেলাম।অফিস কক্ষের পুরানো দেওয়াল চুষে বৃষ্টির পানি,অযত্ন আর অবহেলায় ছবিটি নাকী নষ্ট হয়ে গেছে! জ্ঞানী, দয়ালু ও মহৎ প্রাণ মহেশ চন্দ্র আমার মানস পটে আঁকা।

বিংশ শতকের প্রথম দিকে উপমহাদেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চার অবাধ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল  কুমিল্লার মহেশাঙ্গন।শিক্ষা বিষয়ে মহেশ চন্দ্রের নিজস্ব দর্শন ছিল। তিনি মনে করতেন, একমাত্র শিক্ষাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে, করে তুলতে পারে আত্মনির্ভর। ” মহেশ চন্দ্র ‘স্বাবলম্বন’ কথাটিকে অন্তরের স্বাধীন ভাব হিসেবেই বুঝতেন এবং সেই স্বাধীন ভাব অর্জনের পরম উপায় হিসেবে শিক্ষালাভ করা ও জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখাকে অবিকল্প মানতেন।”

বৈষয়িক উন্নতির চেয়ে জ্ঞানচর্চার উন্নতিকেই তিনি মানুষের মুক্তির প্রকৃত উপায় হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তাই নিজের আয়ের অর্ধেক নিয়মিতভাবে তিনি দান করে গেছেন প্রজন্মের শিক্ষাবিস্তারের পেছনে। এমনকি তাঁর কুমিল্লার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি, ব্যবসা—সবই দান করে গেছেন শিক্ষাজ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখতে।

নিজের এই ঔদার্যের কথা তিনি কাউকে জানতে দিতে চাননি। নিজের চিন্তাদর্শন প্রকাশ করাও তাঁর কাছে অহংকার প্রচারের শামিল ছিল। কাজের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেছেন নিজেকে।সে কারণেই হয়তো আজও বাংলাদেশের মানুষ তাঁর সম্পর্কে অবগত নয়। অথচ ভারতে ও কুমিল্লাসহ নূরনগর পরগনার মানুষের জন্য  সেই আমলে তিনি যা করেছেন, অন্তত তাঁর মৃত্যুর পর সে তথ্য প্রচারণার প্রয়োজন ছিল।রূপকথার কল্পের মত তাঁর মহৎ কর্ম নিয়ে আলোচনা বাঙালি জাতিকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাবে বলে আমার দৃঢ়  বিশ্বাস।মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রচুর লেখালেখি ও বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন।তাতে মহেশ চন্দ্রের মতো একজন মহান শিক্ষানুরাগীর প্রতি জাতির ঋণ সামান্য হলেও লাঘব হবে।

➤জন্ম ও বংশ পরিচয়:

এই পুণ্যলোক মহাপুরুষ (জন্ম ১৮৫৮ – মৃত্যু ১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৪) ১২৬৫ বঙ্গাব্দের ১৭ অগ্রহায়ণ বুধবার দিন তদানীন্তন ত্রিপুরা (কুমিল্লা) জিলার ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মহকুমার (অধুনা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার) নূরনগর পরগনার  নবীনগর থানাধীন বিটঘর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহন করেন।তাঁর জন্মকালীন ১৭/১৮ দিন অনবরত বৃষ্টি বাদল হয়েছিল।এ জন্য সকলে তাঁকে বাদল বলে ডাকত। তার পিতা ঈশ্বরদাস তর্কসিদ্ধান্ত  (১৮২২-১৮৬৪) সুপণ্ডিত ছিলেন এবং মাতা রামমালা দেবী দেব দ্বিজে ভক্তিপরায়ণ সাধ্বী নারী ছিলেন।

➤পিতৃ- মাতৃ পরিচয়:
বহুদিন আগের কথা।যশোহর জেলার সারল গ্রাম।সেখানে সমবেদান্তগত কুথুম শাখীয় বাৎসল্য গোত্রীয় কেশব পঞ্চাননের সন্তান কার্ত্তিক চন্দ্র ভট্টাচার্য্যের জন্ম। পরবর্তী সময়ে জীবিকার তাগিদে তিনি ঢাকা জেলার পাইকারচর গ্রামে এসে বসবাস করেন।লোকনাথ দত্ত তদানীন্তন ত্রিপুরা কুমিল্লার চাঁদেরচর গ্রামে গিয়ে বসবাস করেন।লোকনাথ দত্ত হতে অধস্তন ৮ম পুরুষ মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের পিতা  ঈশ্বর দাস তর্কসিদ্ধান্ত।তবে কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালা সহ সকল গ্রন্থে পিতার নাম ঈশ্বর চন্দ্র ভট্টাচার্য্য পাওয়া যায়।দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের পিতৃদেব ঈশ্বর দাস তর্কসিদ্ধান্ত শৈশবাস্থায় পিতৃহীন হলে বাল্যকালে তার পিতার মামারবাড়ি সুলতানপুর ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ড)   হাবলা উচ্চ (হাবলুচ) গ্রামে গিয়ে বাস করেন।

তারপর তিনি তদানীন্তন ত্রিপুরা জেলার অন্তর্গত বিটঘর নিবাসী পাপড়াশী বংশীয় প্রাণকৃষ্ণ শিরোমনির একমাত্র কন্যা রামমালা দেবীকে(মহেশচন্দ্রের মা) বিয়ে করেন। প্রাণকৃষ্ণ শিরোমনির আর কোনো সন্তানাদি না থাকায় মেয়ের জামাইকে বিটঘরে ঘরজামাই করে রেখে দেন।এতে প্রমাণিত হয় বিটঘর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের জন্মভিটা ও মাতুলালয়। তাঁর পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার চাঁদের চর গ্রাম।লোকনাথের বংশধর এখনো পাইকারচর এবং চাঁদের চরে আছে বলে জানা যায়।ঈশ্বর দাস তর্কসিদ্ধান্ত ও রামমালাদেবীর ঘরে দুই ছেলে দুই মেয়ে। তারা হলেন,আনন্দ ভট্টাচার্য্য,মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যে,মোক্ষদাদেবী ও মুক্তিদেবী।

মহেশচন্দ্রের মাতৃদেবী রামমালা দেবী ও পিতা ঈশ্বরদাস তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয় প্রতিভাশালী পন্ডিত ছিলেন। ঈশ্বর দাস তর্কসিদ্ধান্ত নিতান্তই এক দারিদ্র ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি বিটঘর গ্রামস্থ নিজ বাড়ীতে টোল খোলেন। টোলে আন্দাজ ৪৫ জন শিক্ষার্থী ছিলেন।তন্মধ্যে আনুমানিক ১৫ জনকে নিজ গৃহে রাখতেন। তাঁর আর্থিক অবস্থা মোটেই সচ্ছল ছিলনা,টোলে পাঠদান শেষে বাড়ি ফিরে প্রায়ই দেখত ঘরে চাল ডাল লাকড়ি কিছুই নেই।প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে কিছু চেয়ে অথবা নিজে কাঠ কেটে ঐ দিনের সকল প্রয়োজন মিটাতেন। তথাপি তিনি বিদ্যার্থীকে অন্ন ও বিদ্যাদানের ব্রত হতে কখনও বিরত হননি।আগামীকালের চিন্তা কখনো করতেন না। তিনি সৎ ও কড়ালোক ছিলেন। তাঁর আন্তরিক আকাঙ্খা ছিল তিনি যেন অধ্যাপনায় সতত নিমগ্ন থাকেন।মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর লেখা ‘আত্মকথা’য় পিতার মুখে বলা উক্তি লেখেন, “আমি যেন আজীবন অধ্যাপনা করিয়া যাই,ইহাই আমার আকাঙ্খা। ” বাস্তবিকই তিনি ঘরে সকল পড়ুয়া রেখে ৪২ বৎসর বয়সে ৩দিনের জ্বরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন মহেশচন্দ্রের বয়স মাত্র ৬ বৎসর।

এ অকাল মৃত্যু মহেশচন্দ্রের পরিবারকে অথৈ দুঃখ
কষ্টে ফেলে দেয়। মাতা রামমালা দেবী লিখতে বা পড়তে জানতেন না, কিন্তু বহু সংস্কৃত শ্লোক ও বচন তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল।রামমালা দেবী অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির ছিলেন। তিনি বলতেন, ”আমি বাপের কোলে বসিয়া চন্ডালের সাক্ষ্য দিতে পারি।” (বাপের কোলে বসিয়া বাপের বিরুদ্ধে চন্ডালের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে পারেন)। মহেশ বাবু গৃহস্থালির কাজে মাকে সার্বিক সহযোগিতা করতেন।বিত্তশালী হওয়ার পরও তার মা পূর্বের মত পরিশ্রম করতেন।তিনি বলতেন,”কর্মই ধর্ম “। এতে মা আনন্দ পেতেন।মহেশচন্দ্রের ৩৫ বছর বয়সে তাঁর মাতা রামমালা দেবীও দেহত্যাগ করেন।তাঁর জীবন কাহিনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,পিতা-মাতার সত্য ও ন্যায়ের আদর্শ তাঁর জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছে সবচেয়ে বেশী।

➤শৈশবকাল:
মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের বাল্যকালে লেখাপড়ার প্রতি ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ, ৫ বৎসর বয়সে মহেশচন্দ্রের হাতে খড়ি হয়।তাঁর ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শিখে বিদ্বান হবেন, প্রচুর জ্ঞান অর্জন করবেন, কিন্তু অর্থের অভাবে সেই ইচ্ছা তাঁর পূরণ হয়নি। পিতা ‘ঈশ্বর দাস আজীবন নিজবাড়ির চতুষ্পাঠীতে নিরন্তর অধ্যাপনা করতেন। এক দিনের জন্যও জ্ঞানচর্চা থেকে বিরত হন নি। জ্যেষ্ঠভ্রাতা আনন্দচন্দ্র ভট্টাচার্য্য স্মৃতি , ব্যাকরণ ও ক্রিয়াকাণ্ডে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। এরূপ পারিবারিক আবেষ্টনহেতু মহেশচন্দ্রের চরিত্রেও শাস্ত্রানুশীলন ও জ্ঞান বিস্তারের প্রতি একটি গভীর শ্রদ্ধা এবং প্রবল অনুরাগ পরিলক্ষিত হয়।’১

প্রখ্যাত জ্যোতিষী রামায়ণ আচার্য্য কোষ্ঠি করে বলেন,” ১১ বছর পর্যন্ত মহেশের পড়ালেখা হবেনা। কিন্তু ভাগ্য হবে রাজার মত।” তাই ১০/১১বছর পর্যন্ত তিনি পড়ালেখা না করে সংসারের কাজ ও ভ্রমণ করে বেড়াতেন। হঠাৎ একদিন মনে হল সমবয়সীরা লেখাপড়া করে আমিও লেখাপড়া করব।গোপাল রায়ের অবৈতনিক পাঠশালায় ২ মাস কলাপাতায় লেখালেখি করলেন।বিপিন বাবুর স্কুলে ভর্তি হলেন কিন্তু বিদ্যালয়ে কলম চুরির মিথ্যে অপবাদে তাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হল।এ অপবাদ ও অপমানে তিনি ১ বছর পড়াশোনায় মন বসাতে পারেননি।সবসময় বাড়িতে বসে থাকতেন। কৈলাস বাবু স্কুলের দায়িত্ব নেওয়ার পর ৩ বছর পড়ালেখা করলেন।বাড়িতে প্রদীপের তৈল না থাকায় তিনি শিক্ষকের বৈঠকখানায় পড়ালেখা করতেন।মহেশ বাবুর যখন জন্ম হয় তখন ঘরে প্রদীপের আলো ছিলনা।কারণ বাতি জ্বালোর মত কেরোসিনও ঘরে ছিলনা।

মহেশ চন্দ্র যখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। একদিন ঢাকা  ও চট্টগ্রাম বিভাগের স্কুল পরিদর্শক Mr. C B Clarke বিটঘর টোল পরিদর্শনে এসেছিলেন। ক্লাসে পরিদর্শকের সকল প্রশ্নের উত্তর একমাত্র মহেশই দিতে পেরেছিল।গ্রামের লোকজন এ প্রথমবার শান্ত বালক মহেশের উপর আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিল।তার বোনের শ্বশুর বাড়ি শ্যামগ্রাম ফ্রি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি ৭/৮ মাস পড়ালেখা করেন বলেও জানা যায়।

১৮৭১ সালের দিকে দারিদ্র্যের কারণে ভাগ্যান্বেষনে তিনি কুমিল্লা শহরে চলে আসেন।বাড়ি থেকে অন্য কোথাও যাক বাড়ির কেহই তা চাননি। ১৮৭১ -১৮৭৭ কুমিল্লায় পড়তে যাবে শুনে শিক্ষক  কৈলাস চন্দ্র এবং তার মা অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।মাকে বললেন,”কুমিল্লায় পরীক্ষা আছে” আর শিক্ষক কৈলাস চন্দ্র কে বললেন,”শ্যামগ্রাম ভগ্নিপতির বাড়িতে কাজ আছে” এ কথা বলে বালক মহেশ কুমিল্লায় চলে আসেন।সেখানে তাকে অন্যের বাসায় পাচকের কাজ করতে হতো। মহেশচন্দ্রের লেখাপড়ার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে বাড়ির কর্তা তাকে প্রথমে স্থানীয় প্রাইমারী স্কুল এবং পরে কুমিল্লা জেলাস্কুলে ভর্তি করে দেন। রাজা ও জমিদারদের ছাত্রবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা চালাতেন।পূজার সময় যজমানে কয়েকটি ধুতি পেতেন।তা পরে অতি কষ্টে দিন কাটাতেন।ছোটবলা গ্রামের লোকজন ও আত্মীয় স্বজন মহেশকে নিয়ে উপহাস করত।ছেলেবেলায় মহেশ খুব কৃপণ স্বভাবের ছিল।একবার তিনি ত্রিপুরা জেলা জজ  F C Folwi এর কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। উত্তরে জজ সাহেব লিখলেন, “গরীব হলে লেখাপড়ার চেষ্টা না করে ব্যবসা করা উচিৎ। ”
“গ্রামে নিতান্ত বালক বয়েসে দারিদ্রে জর্জরিত মহেশ চন্দ্র যজমান বাড়ীতে ভোজন ও দক্ষিণা যা পেতেন তা  মাকে না দিয়ে নিজের কাছে জমা রেখে শহর থেকে খাতা -পত্র,ইত্যাদি ক্রয় করে এনে তা গ্রামে বিক্রি করে তিনি কিছুটা লাভ করতেন।লাভের অংশ দিয়ে তিনি তাঁর প্রয়োজনীয় বইপত্র কিনতেন।”২

➤কর্মযোগী মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য:
বারবার ব্যর্থতাই মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের জীবনে সফলতার গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৮৮৯/৮০ সালে তিনি কর্মের সন্ধানে প্রথম কলকাতা গিয়ে ১৬ আহিরিটোলা স্ট্রিটে চন্দ্রকান্ত মুখোপাধ্যায়ের বাসায় উঠেন।সে সময় ২৮ নং মেছুয়াবাজার স্ট্রিটে ত্রিপুরা ছাত্রদের মেসে ২ দিন থাকলেন।কোনো কাজের সন্ধান না করতে পেরে বাড়িতে চলে আসেন।

আজ যেমন কাজের জন্য সারা দেশের মানুষ রাজধানী ঢাকা শহরে ছুটে। তখন লোকে কাজের জন্য আকিয়াবে চলে যেত।মহেশ চন্দ্র ভাল একটি কাজের আশায় আকিয়াবে গিয়েও ব্যর্থ হলেন।আকিয়াব থেকে কাজের খোঁজে ২য় বার কতকাতায় যান।সেখান থেকে বহুস্থান ঘুরে আবারও বাড়িতে চলে আসেন। তখন গ্রামের লোকজন কথায় কথায় বলত,তুইও কী বাদলী ঠাকুরের মতো দেশে দেশে ফিরবি নাকি?
বারবার ব্যর্থ হয়ে পুনরায়  কুমিল্লায় মহারাজ স্কুলে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হন।বঙ্গ স্কুলে ইংরেজি শিক্ষক নিযুক্ত হন।

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় চিরতরে [অন্য একটি তথ্যমতে (১৮৮২/৮৩) ১২৮৬ বাংলায় কুমিল্লা জিলা স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায়] পড়াশোনা ছেড়ে অর্থের অন্বেষণে তিনি (তৃতীয় বারের মত) চলে যান মহানগর কলকাতাতে। কলকাতা শহরের একাধিক দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তিনি কর্মচারী হয়ে কাজ করেছেন।

➤বর্নাঢ্য কর্ম জীবন:
প্রথমে তিনি কলকাতা বন্দরে শ্রমিকের কাজ নেন। বন্দরের কাজ ছেড়ে কাপড়ের দোকানে চাকুরী করেন।কিছুদিন মুদি দোকানে কাজ করেন।নিজে মনোহারি দোকান খোলেন। সকল কাজে ব্যর্থ! আবার পুস্তকের দোকানে কিছুদিন চাকুরী করলেন।কোনো কাজেই উন্নতি করতে পারছেন না। ব্যবসা করেও ধনী হতে পারবেন না ভেবে মনে মনে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন।এ সময় রাধামোহন কুন্ড কোম্পানির দোকানে চাকুরী নিলেন। এখান থেকে ব্যবসা বিষয়ে কিছুটা অভিজ্ঞতা বাড়ল।কলকাতা থেকে কুমিল্লায় গুরুদয়াল সিংহের দোকানে দ্রব্যাদি সরবরাহ করতেন। লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করে তিনি খেয়ে না খেয়ে দারিদ্র্যতার যত দুর্ভোগ আছে তার স্বাদ ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। হতাশ না হয়ে জেদী এবং সংকল্পে অটল মহেশ চন্দ্র ২৪ বছরের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম ও একাগ্র সাধনবলে সফল ব্যবসায়ীতে নিজেকে উন্নীত করতে সক্ষম হন।

১৮৮২/১৮৮৩ সালে মাত্র পঞ্চান্ন টাকা পুঁজি নিয়ে কুমিল্লা থেকে আসা এক আত্মপ্রত্যয়ী যুবক কলকাতার ৮২ নং কলেজ স্ট্রিটে স্টেশনারী ও বইয়ের দোকান দিয়ে প্রথম ব্যবসা শুরু করেন।পাশাপাশি পাইকারী হারে কাগজ ও বিক্রি করতেন তিনি।বাংলা ১২৯৬(১৮৮৯) সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালীকচ্ছ নিবাসী হোমিও চিকিৎসক ডা: শরৎ চন্দ্র দত্তের পরামর্শে ৮১ নং কলেজ স্ট্রিটে হোমিও স্টোর খোলেন।তাঁর সততার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে দোকানের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় তিনি আশুগঞ্জের তালশহর গ্রামের হরসুন্দরী দেবীকে বিয়ে করেন।
এরপর ১২৯৯ (১৮৯২) সালে এলোপেথিক ঔষধের দোকান খোলেন।১৩০২ (১৮৯৫) সালে ১১ নং বনফিল্ড লেনে ক্ষুদ্রাকারে ইকোনোমিক ফার্মেসী খুলে হোমিও ঔষধের মুল্য চার আনার জায়গায় পাঁচ পয়সায় বিক্রি করতে লাগলেন। এতে করে দরিদ্র দেশের সাধারণ মানুষের হোমিও চিকিৎসা করাতে সুবিধা হয়।ক্রমে ঢাকা, কুমিল্লা, কাশী শহরে অনুরূপ দোকান খুলতে থাকেন।ঔষধ ব্যবসায় সাফল্য লাভের পর মহেশ চন্দ্র লোহার সিন্দুক তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন, পাশাপাশি তিনি কাঠের করাত কল স্থাপন করেন।তিনি কুমিল্লায় একদর বিশিষ্ট কাপড়ের দোকানও খুলে ছিলেন।এর পর শেষ ব্যবসা হিসেবে একদল সৎ ও অভিজ্ঞ কবিরাজের তত্ত্বাবধানে কুমিল্লায় আয়ুর্বেদীয় ঔষধ তৈরির ভেষজ কারখানা স্থাপন করে সেখানে পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করণের জন্যে তিনি ‘বৈদিক ঔষধালয়’ এবং “এম,ভট্টাচার্য এন্ড কোং  নামের হোমিওপ্যাথিক ঔষধের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।যা এখনো মহেশাঙ্গনে বিদ্যমান।’তিনি বঙ্গ বিদ্যালয়ে কিছুদিন ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।’-বাংলা পিডিয়া
কলকাতায় ব্যবসা করে বহু বাঙালি ধনী বণিক হয়েছেন।কিন্তু বিটঘরের মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর অতীত কে মোটেও ভুলেননি। তাই ইতিহাসও তাকে ভুলেনি।ভুলেছে শুধু অকৃতজ্ঞ আমজনতা।

➤অমর  কীর্তি:
পিতৃদেব ঈশ্বর দাসের পুণ্যস্মৃতি ও মাতৃদেবী রামমালার পুন্যস্মৃতি  সংরক্ষণকল্পে মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য কুমিল্লায় বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মহেশ চন্দ্রের শেষ ভাব শিষ্য আদর্শ শিক্ষক ইন্দ্র কুমার সিংহ সব মিলিয়ে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে গেছেন।তৎকালীন সময়ে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সমমান এত গুলো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করে নিজের ধন সম্পত্তি দিয়ে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে সুন্দর ভাবে পরিচালিত করে গেছেন যা ভাবলে আজ ও হৃদয়ে বিস্ময় জাগে।

(১)ঈশ্বর পাঠশালা টোল ও টোল বোর্ডিং ,প্রতিষ্ঠিত – ১৯১২সালে।
(২)ঈশ্বর পাঠশালা স্কুল ও রীচ হোস্টেল, প্রতিষ্ঠিত ১৯১৪ সালে ।
(৩)রামমালা ছাত্রাবাস,(শাকতলাতে ২৪ একর জমির উপর) প্রতিষ্ঠিত ১৯১৬ সালে।
(৪)রামমালা গ্রন্থাগার, প্রতিষ্ঠিত ১৯১২ সালে।
(৫)রামমালা জাদুঘর ।
(৬)রামমালা রোড, (রাণীর বাজার থেকে শাকতলা পর্যন্ত )১৯৩৫
( ৭)রামমালা পোস্ট অফিস ।১৯৩৫
(৮)নিবেদিতা ছাত্রীনিবাস, প্রতিষ্ঠিত – ১৯১৯ সালে।
(৯)নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয় (ছয় ক্লাস পর্যন্ত )১৯১৯ সালে।
(১০)এম,ভট্টাচার্য এন্ড কোং , মহেশাঙ্গন, কুমিল্লার হোমিও ঔষধের দোকান।
(১১)বৈদিক ঔষধালয় ।
(১২)কাশী হরসুন্দরী ধর্মশালা, কাশী, ইউ, পি, ভারত।
(১৩)ঈশ্বর পাঠশালা ব্যায়ামাগার।
(১৪)মন্দির, প্রতিষ্ঠিত – ১৯১৭ সালে ।
(১৫)নাট মন্দির, প্রতিষ্ঠিত -১৯২৫ সালে।

কসবা বিজনী নদীর উপর লোহার পুল।
কাইতলা থেকে কুড়িঘর পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ কিঃ মিঃ মহেশ রোড।
বিটঘর রাধানাথ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সিংহভাগ  আর্থিক অনুদান।
বিটঘরে বালিকা বিদ্যালয়(দক্ষ পরিচালনার অভাবে অঙ্কুরেই বিলুপ্তি হয়)
মহেশ রোড থেকে বিটঘর বাজার পর্যন্ত সংযোগ রাস্তা।
কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সিংহভাগ সহযোগিতা।
ফতেহপুর কে কে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আর্থিক অনুদান।
চট্টগ্রামে সীতাকুন্ডে গিরিশ ধর্মশালা ও সেবা আশ্রম প্রতিষ্ঠা।
কলিকাতায় সেবা আশ্রম
কুমিল্লার ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীদের পত্রিকা ‘ত্রিপুরা হিতৈষী’ জন্য  তাৎক্ষণিক আর্থিক সহযোগিতায়।
তীর্থস্থান কাশীতে রামমালা ধর্মশালা, হরসুন্দরী ধর্মশালা,
বারানসীতে তার সহধর্মিণী হরসুন্দরী দেবীর নামে একটি ধর্মশালা।
গয়ায় ভারত সেবাশ্রমের জন্য জমি কিনে দান করে ধর্মানুরাগের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
গরিবদের বিনা অর্থে চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা শহরে প্রতিষ্ঠা করেন হোমিওপ্যাথিক ও আয়ূর্বেদ চিকিৎসা কেন্দ্র।
তাঁর নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষা সংসদ। তিনি কাশীধামে প্রতিষ্ঠা করেন ঈশ্বর পাঠশালা টোল।
গ্রামের লোকের পানীয় জলের অভাব দূরীকরণের জন্য প্রায় ৫০ বছর পূর্বে তাঁর নিজ গ্রামে একটি পুকুর খনন করেন এবং জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই এখান থেকে পানীয় জল নেওয়ার অনুমতি ছিল।
তীর্থ-ভ্রমণের সময় এক পর্যায়ে বৈদ্যনাথে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি দরিদ্র লোকদের সাহায্য করেন। তিনি এ সময় প্রতিদিন ৪০০/৫০০ জন মানুষকে খাওয়াতেন।
১৯৩৫ সালে তিনি কালীঘাটে যাত্রীদের সুবিধার্থে একুশ নম্বর টালিগঞ্জে কালীঘাট যাত্রীনিবাস নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য যে, এ যাত্রী নিবাসে যাত্রীরা ৪/৫ দিন বিনা ভাড়ায় থাকতে পারত।
আরো অজানা অসংখ্য কাজ করে গেছেন।

➤সর্বজনীন পাঠাগার রামমালা:
কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালা টোল স্থাপনের পরই প্রতিষ্ঠাতা মহাশয়ের কুমিল্লা বাড়ির বৈঠকখানায় ১৯১২ সালে টোলের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সংস্কৃত গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। টোলের অন্যতম পণ্ডিত সূর্যকান্ত স্মৃতিতীর্থ মহাশয় গ্রন্থাগারের কার্য পরিচালনা করতেন। এ সময় ৪/৫ টি আলমারিতে গ্রন্থগুলি রক্ষিত হতো। সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গ্রন্থাদি সাধারণ পাঠকদের বোধগম্য হতো না বিধায় স্থানীয় কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তির অনুরোধে কিছু কিছু বাংলা পুস্তক এবং ‘প্রবাসী’ ও ‘ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি প্রধান প্রধান মাসিক পত্রিকা রাখা হত থাকে।
দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জ্ঞান পিপাসা পূরণ কল্পে গড়ে তুলেছিলেন  ব্যয়বহুল অনেক প্রাচীন দুর্লভ ও মহামূল্য গ্রন্থাদির সংগ্রহশালা।তিনি যে একজন খাঁটি স্বদেশী ছিলেন তার প্রমাণ হলো আট হাজার আঞ্চলিক পুঁথি সংগ্রহ।এই পুঁথিগুলো আজকে স্বদেশ ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বের খ্যাতিমান উচ্চবিদ্যাপীঠগুলোতে গবেষিত হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে বাংলার লোকজ তথা প্রকৃত সংস্কৃতির ইতিহাস। পুঁথির এত বড় সংগ্রহ সম্ভবত উপমহাদেশে আর কোথাও নেই। সেই ঐতিহ্যবাহী রামমালা গ্রন্থাগারে সুদূর ব্রিটিশ লাইব্রেরীসহ দেশ-বিদেশের গবেষকরা তথ্য সংগ্রহ করতে আসেন। খুঁজে নেন আগ্রহের দুলর্ভ তথ্য।
বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও  রামমালা গ্রন্থাগারে তুলনামূলক ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান চর্চা করার জন্যে তিনি হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, ইহুদী, খৃষ্টান, ইসলাম, পার্শি,কনফুসিয়ান,তাও, মিশরীয়,বেবিলনীয়, আসিরীয় প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থাদির বিশাল সংগ্রহ শালা গড়ে তুলেছিলেন।রামমালা গ্রন্থাগারের তিনটি বিভাগ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন:

(১) গবেষণা বিভাগ
(২) সাধারণ বিভাগ
(৩) হস্ত লিখিত প্রাচীন পুঁথি বিভাগ।

 

➤মহেশাঙ্গন পূর্ববঙ্গের শান্তি নিকেতন:
১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গের শান্তিনিকেতন খ্যাত কুমিল্লার মহেশাঙ্গন ইতিহাসে আজ বিস্মৃত প্রায়।স্বাধীনতার আগে সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে ৮ একর জমির উপর ১০/১১টি প্রতিষ্ঠানের কমপ্লেক্স  মহেশাঙ্গনের সুখ্যাতি ছিল।এখানে রয়েছে এখন ঈশ্বর পাঠশালা, রামমালা গ্রন্থাগার, রামমালা ছাত্রাবাস, নিবেদিতা ছাত্রী নিবাস, নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়, পুঁথি সংগ্রহশালা, নাটমন্দির, আয়ুর্বেদ ভেষজ গবেষণাগার, হোমিওপ্যাথ স্টোর, সংস্কৃত কলেজ ও ঈশ্বর পাঠশালা ব্যায়ামাগার। এছাড়া আছে একটি পুকুর। একটি ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে সরকারি সাহায্য ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এটি ছিল উপমহাদেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চার অবাধ কেন্দ্র। যা দু’বাংলা মিলিয়ে একটিই মাত্র।

➤যে সকল বিখ্যাতরা মহেশাঙ্গনে এসেছিলেন:
কুমিল্লা মহেশাঙ্গনের ইতিহাস সমগ্র বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। ১৯০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ তথা সমগ্র ভারতবর্ষের সকল পরিবর্তনের ইতিহাস মহেশাঙ্গণের সঙ্গে জড়িত।ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা আলোড়ন তুলেছেন এবং পরিবর্তনের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তাঁদের অধিকাংশই মহেশাঙ্গনে পদার্পণ করেছেন, সভা করেছেন তাঁরা হলেন,
তৎকালীন ভারত বর্ষ ত্রিপুরা রাজ্যের উল্লেখযোগ্য সভা-সমিতি সংগীত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,উল্লেখযোগ্য বক্তৃতাসমূহ এখানেই নাকি সম্পাদিত হয়েছিল! এখানে এসেছিলেন -এ. রসুল, নৃপেন বসু, মহাত্মা গান্ধী,সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,বিপিন পাল, সুভাষচন্দ্র বসু,চিত্তরঞ্জন দাশ,যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, অরবিন্দ ঘোষ, কস্তরীবাই গান্ধী,মৌলভী লিয়াকত হোসেন,রাজা গোপাল আচারিয়া,শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ড.দীনেশচন্দ্র সেন,সরলাদেবী চৌধুরী,নরেন্দ্রনাথ দেব, ড.নলিনী ভট্টশালী, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,শরৎচন্দ্র বসু, ক্ষিতিমোহন সেন,কালীমোহন ঘোষ, কাজী নজরুল ইসলাম ,মহারাজা মহীন্দ্র চন্দ্র নন্দী, সরোজিনী নাইডু,আশ্রাফ উদ্দিন চৌধুরী,ত্রিপুরার মহারাজা মানিক্য বাহাদুর,  হেমপ্রভা মজুমদার ,মহেন্দ্রনাথ দাস, ভীম ভবানী, এ.ভি থ্যাককার, প্রাণগোপাল গোস্বামী, রামদাস বাবাজী,ভোলানাথ গিরি,আলোক বাবা,শ্রী আনন্দময়ী মা, ড.নীহার রঞ্জন রায়, সীমান্ত গান্ধী, শশীভূষণ বিদ্যালংকার,ডাব্লিউ এম ক্লার্ক,বিধুশেখর শাস্ত্রী, পারিমোহন ভট্রাচার্য,ড. ধীরেন্দ্রনাথ সেন,ড. সুধীর সেন,আবদুল গাফফার খান, মেঘনাদ সাহা,আইসিএস আলী ব্রাদার্স,মেজর এ সি চ্যাটার্জি,আচার্য এ.বি.কৃপালনি, সুচেতা কৃপালনি, মেঘনাদ সাহা, আনন্দশঙ্কর রায়, হুমায়ুন কবির প্রমুখ।

➤ঐতিহাসিক বহু সভা-সম্মেলনের সাক্ষী মহেশাঙ্গন:
তৎকালীন ভারত বর্ষ ত্রিপুরা রাজ্যের উল্লেখযোগ্য সভা-সমিতি সংগীত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,উল্লেখযোগ্য বক্তৃতাসমূহ এখানেই নাকি সম্পাদিত হয়েছিল!
এই মহেশাঙ্গনে স্বদেশী যুগের সম্মেলন, নিখিল বঙ্গ আইনজীবী সম্মেলন, অল বেঙ্গল পেট্রোল কনফারেন্স, অল বেঙ্গল  পোস্টার কনফারেন্স, অল বেঙ্গল টিচার্স কনফারেন্স, ওলেমা কনফারেন্সসহ সর্ববিধ নিখিল বঙ্গ সম্মেলনের আদর্শ স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল। তাছাড়া সেইসময় ভাগবৎ গীতাপাঠ, মিলাদ মাহফিল, ইসলামিক ওয়াজ মাহফিল, মুকুন্দ দাশের যাত্রাগান, রামকমল ভট্টাচার্য্যরে কীর্তন, বৈষ্ণব সম্মেলন কতকিছু যে এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার ইতিহাস কে লিখবে?

➤মহেশাঙ্গনের সঙ্গে একাত্ম ব্যক্তিবর্গ:
সেইসময় নামকরা শিক্ষকরা ঈশ্বর পাঠশালায় শিক্ষকতা করেছেন। মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের সকল কাজে  একাত্মতা স্থাপন করেছিলেন বৃহত্তর কুমিল্লার বিশিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, তাঁরা হলেন, জাতীয় তথা কংগ্রেস নেতা অখিলচন্দ্র দত্ত, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, এ. রসুল, মথুরামোহন দেব, কৈলাশচন্দ্র দত্ত, রায়বাহাদুর ভূধর দাশগুপ্ত, কামিনীকুমার দত্ত, রায়বাহাদুর অনঙ্গমোহন নাহা, বিশ্বেশ্বর চট্টোপাধ্যায়, প্রতুল দাশ ভৌমিক, গোবিন্দ সাহা, রাখাল রায়, অতীন্দ্রমোহন রায়, যতীন ভদ্র, অক্ষয় পাল, অতীন্দ্রমোহন ভদ্র, অধ্যক্ষ রেজাউর রহমান (কুমিল্লার প্রথম ল কলেজ), মজিবুর রহমান, ডাঃ সুলতান আহম্মদ, আশ্রাফ উদ্দিন চৌধুরী, ভুবন ধর, হাবিবুর রহমান, সুরেশ সিংহ রায়, প্রকাশ সিংহ রায় (ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভাতৃদ্বয়), বসন্ত মজুমদার, গুরুদয়াল সিংহ, ঊর্মিলা সিংহ প্রমুখ। এছাড়া অধ্যাপকবৃন্দ, ব্যবসায়ীবৃন্দ, কুমিল্লা অভয় আশ্রমের নেতৃবৃন্দও মহেশচন্দ্রকে সর্বদা সমীহ করতেন এবং উৎসাহ দিতেন।

➤মুক্তি যুদ্ধ কালীল অক্ষত মহেশাঙ্গন:
বলা বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠানটি পাকসেনাদের নির্ঘাৎ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে আইনজীবী রেজাউর রহমান, ডাঃ সুলতান আহম্মদ, আইনজীবী মজিবুর রহমান প্রমুখের বদৌলতে।

➤একজন সম্পূর্ণ মানুষ মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য :
তাঁর আত্মজীবনী প্রমাণ করে অতিসুক্ষ কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ, সময়জ্ঞান এবং সংবেদনশীলতা কখনো তাঁর দৃষ্টি এড়াত না। সম্পূর্ণ মানুষ তিনি হতে পেরেছিলেন বলেই ছাত্ররা যাতে মানবিক আদর্শে নিজেকে আদর্শায়িত করে জীবন গড়ে তুলতে পারে সে বিষয়ে তিনি সর্বদা সজাগ ছিলেন এবং শিক্ষক ও কর্মচারীদের সেভাবে নির্দেশ দিতেন। খুঁজে খুঁজে তিনি শিক্ষক নিয়োগ করতেন। নীতি থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত হওয়া ছিল যার প্রবল অনীহা।সেই আদর্শ বাঙালি মহেশচন্দ্রের
সাধারণ কোনো ছাত্রাবাস ছিল না রামমালা! ইন্দ্র কুমার সিংহ রচিত  গ্রন্থের ভূমিকাতেই তিনি তা সুস্পষ্ট করেছেন। রামমালা ছাত্রাবাসের মূল আদর্শ ছিল: সর্ব্বম আত্মবশং সুখম্ সর্ব্বং পরবশং দুঃখম্ অর্থাৎ আত্মনির্ভরতা পরম সুখ ও পরনির্ভরতা পরম দুঃখ। এখানে ছিল ১) কৃষি বিভাগ ২) সেবা বিভাগ ২) খাদ্য বিভাগ ৪) মুদিদোকান ৫) সভা-সমিতি ৬) ক্রীড়া ও আমোদ প্রমোদ ৭) রামমালা পল্লীমঙ্গল সমিতি ৮) ধর্মশিক্ষা। সকাল বিকাল প্রার্থনা পরিচালিত হত ছাত্রাবাসের অধ্যক্ষ পন্ডিতপ্রবর ড.রাসমোহন চক্রবর্তীর তীক্ষ্ণ তত্ত্বাবধানে। সুস্থ ও স্বাভাবিক মানবজীবন গড়ে তোলার জন্য জরুরি সব শিক্ষাই ছাত্রাবাসে অন্তর্ভুক্ত ছিল। মহেশচন্দ্র রামমালা ছাত্রাবাসকে তাই নিজের মানসপুত্র বলে বিবেচনা করতেন।

➤১৯২৬ সালে রামমালা ছাত্রাবাসের ছাত্ররা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধনা দেয়।মহেশাঙ্গনে শেষদিন ২২ ফেব্রুয়ারী কুমিল্লাবাসীর উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মারক বক্তব্য প্রদান করেন।সেই স্থানটি রবীন্দ্র স্মৃতিস্তম্ভ হিসাবে এখনো চিহ্নিত।

➤ঈশ্বর পাঠশালার প্রখ্যাত শিক্ষার্থী যাঁরা:
তাঁর প্রতিষ্ঠিত ঈশ্বর পাঠশালা ভারত ভাগের পূর্বে দীর্ঘ সোনালি যুগের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল প্রথম প্রধান শিক্ষক পন্ডিত জানকীনাথ সরকারের কল্যাণে। পাকিস্তান আমলেও এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম ছিল সর্বত্র। স্বাধীনতার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে দ্রুত এর ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে থাকে। এই বিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্র দেশ-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করেন। যেমন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড.অম্লান দত্ত, কবি অমিয় চক্রবর্তী, চিত্রশিল্পী অজিত চক্রবর্তী, চিত্রশিল্পী বিমল কর, প্রফেসর আব্দুল খালেক রহ, ব্যাকরণবিদ অধ্যাপক ড.হরলাল রায়, শিক্ষাবিদ অজিতকুমার গুহ, ত্রিপুরার শিক্ষামন্ত্রী কবি অনিল সরকার, নজরুলসঙ্গীতশিল্পী ও গবেষক সুধীন দাশ প্রমুখ।

➤শিক্ষানুরাগী  মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য:

শিক্ষিত জাতি গঠনের জন্য তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে সর্বমোট ৩৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থরাজি, পত্র-পত্রিকা ও পান্ডুলিপিতে সমৃদ্ধ কুমিল্লা রামমালা লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করে তিনি বিদ্যানুরাগের এক অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। হয়ে উঠেন জীবন্ত কিংবদন্তি সত্যিকারের এক শিক্ষানুরাগী।

➤দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য:
তিনি এতটাই দানশীল ছিলেন যে, দান সম্পর্কে তিনি নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করেন।গোপনে দান করা ছিল তাঁর নীতিগত কাজ।নিজেকে প্রচার করা তিনি আত্মহত্যার সামিল বলে বিশ্বাস করতেন।তিনি বা হাত দিয়ে কি দান করেছেন তা ওনার নিজের ডান হাত ও জানতে পারতো না। বিপুল অর্থ খরচ করে তিনি রাস্তা -ঘাট, মন্দির, সেতু, ধর্মশালা, টোল প্রতিষ্ঠা করেছেন বিটঘরে,কুমিল্লা, কলকাতা ও কাশিতে তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে ছিলেন। কত দরিদ্র ছাত্র – ছাত্রীদের ,কন্যাদায়গ্রন্থ পিতা, অসুস্থ মানুষ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , সংস্থা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে তিনি মানুষের প্রচুর পরিমাণে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া কলেজ, অভয় আশ্রম, ত্রিপুরার ব্রাহ্ম ধর্মালম্বীদের হিতৈষী পত্রিকার মুদ্রিত সংস্থা সিংহ প্রেস তাঁর তাৎক্ষণিক সহযোগিতায় সমৃদ্ধ হয়েছেন।

➤ভারতে সস্তায় হোমিওপ্যাথ চিকিৎসা সংক্রান্ত ওষুধ বিস্তারের পথিকৃৎ:
বাংলা ১২৯৬ (১৮৮৯) সালের দিকে মহেশচন্দ্র তৎকালীন ভারতে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসার ক্ষেত্রে সুপরিচিত হন এবং প্রতিষ্ঠা পেতে থাকেন।বিজ্ঞ ডাক্তার প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, চন্দ্রশেখর কালী প্রমুখ তাঁকে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সহযোগিতা করেন। তিনি  ব্যয়বহুল জার্মানির ফার্মাকোপিয়ার ফর্মূলাসহ বিভিন্ন পুস্তক ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি, উর্দু, অহমীয়, উড়িয়া, গুজরাটি প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ করিয়ে সস্তায় ছাপিয়ে সমগ্র ভারতব্যাপী গ্রাহক ও অনুগ্রাহকদের বিলি করতে থাকেন। তখন বাংলা ভাষায় হোমিওপ্যাথ চিকিৎসার ভালো কোনো গ্রন্থ নেই দেখে উপযুক্ত মানুষের সহায়তায় পারিবারিক চিকিৎসা গ্রন্থ নাম দিয়ে হোমিওপ্যাথের প্রচার করেন।

➤মিত ব্যয়ী মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য:
মহেশ চন্দ্রের মিতব্যয়ী এবং নীতি জ্ঞান জীবনাচার এ যুগের মানুষের জন্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে এক অনন্য উদাহরণ।
ব্যয়বহুল গাড়ির মালিক হওয়া সত্ত্বেও প্রয়োজন ছাড়া তাতে চলতেন না তিনি।মোটা সস্তা কাপড়ের ধুতি ও ফতুয়া ছিল তাঁর নিত্য পরিধানের বস্ত্র।

➤সৎ ও মানব দরদী মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য:
একবার বিষম ঠান্ডা লেগে পায়ে মোজা ও গরম কাপড় পরে জনসম্মুখে আসতে দারুণ কুণ্ঠাবোধ করেছিলেন।
ব্যক্তি জীবনে এতো সৎ ছিলেন যে, দান করার সময় যাতে তাঁর নাম প্রকাশ না পায় তাঁর জন্যে বার বার অনুরোধ জানাতেন।তিনি ছবি তোলা ও প্রকাশ করাও ছিলেন ঘোর বিরোধী।তার পর ও একবার ” চুন্টা প্রকাশ ” পত্রিকায় তাঁর নাম ও ছবি প্রকাশিত হলে তিনি দারুণ ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং গভীর দুঃখে কাতর হয়ে পড়েন।

➤খাঁটি দেশপ্রেমিক মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য:
একবার যে কোনো ভাবে হোক রেল যোগে তাঁর কোম্পানির মালামাল চলে এলে তাতে মাশুল ছিল না দেখে তিনি তাঁর কর্মচারীকে দুই টাকার টিকিট কিনে তা ছিঁড়ে ফেলতে নির্দেশনা দেন।রাষ্ট্রীয় পরিশোধিত কর দেওয়াতে তাঁর ছিল সজাগ দৃষ্টি।

➤রচিত গ্রন্থাবলী:
মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ব্যবসায়িক ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও লেখালেখি করতেন।তবে সর্বদা আড়ালে থাকাই ছিল যাঁর স্বভাব। নিজের জীবনবৃত্তান্ত লেখারও পক্ষপাতি ছিলেন না। কিন্তু একবার তাঁর পরিচয়ের মিথ্যা অপ্রপচার জানতে পেরে জীবনবৃত্তান্ত লেখায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ব্যবসায়ী প্রকাশিত হয় ১৩১২ বঙ্গাব্দে। আত্মকথা নামে তাঁর একটি আত্মজীবনী রয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম ফার্মাকোপিয়া প্রকাশ করেন।গ্রন্থগুলো হলো-
✪ পারিবারিক চিকিৎসা,
✪ স্ত্রীরোগ চিকিৎসা,
✪ হোমিওপ্যাথিক ওলাওঠা চিকিৎসা।

তিনি সর্বমোট চারটি গ্রন্থ লিখে রেখে গেছেন,
(১) ব্যবসায়ী
(২) দানবিধি
(৩) ঋণবিধি এবং
(৪) আত্মকথা।

➤একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর পর তিনি ব্যবসায় অর্জিত সেই আমলের প্রায় কোটি টাকার সম্পত্তি জনহিতকর কাজে দান করেন।

➤নবীনগরের বিটঘর: ভাগ্যাহত এক জনপদের নাম

দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের (১৮৫৮-১৯৪৪) পৈতৃক নিবাস ও জন্মগ্রাম নবীনগরের বিটঘর সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিদ্যাশিক্ষায় অগ্রণী ছিল। বিশিষ্ট লোকদের বসবাস ছিল।ছিল উচু বিটি,ছিল বড় বড় ঘর।(বিটঘর নামকরণের ইতিকথা – https://bbariafinder.com/bitghar/)
মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর জীবদ্দশায় বিটঘর গ্রামে মা বাবা ও নিজের নামে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন।কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় এবং ১৯৪৪ সালে পরলোকগমনের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও এ দানবীরের নামে বিটঘর গ্রামে গড়ে উঠেনি কোনো প্রতিষ্ঠান! কেন গড়ে উঠেনি? পাঠকের এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে তৎকালীন সময়ের সামাজিক প্রতিহিংসা ও হীনমন্যতার এক জঘন্যতম চিত্র। দারিদ্রতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় বেশী দূর অগ্রসর হতে না পারলেও বৈষয়িক উন্নতির চেয়ে জ্ঞান চর্চার উন্নতিকেই তিনি মানুষের মুক্তির প্রকৃত উপায় হিসাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন।তাই নিজের আয়ের অর্ধেক নিয়মিত ভাবে তিনি দান করে গেছেন প্রজন্মের শিক্ষাবিস্তারের পিছনে। তিনি জনকল্যাণে দান করে গেছেন অত্যন্ত নিরবে নিভৃতে।যা আজকের দিনের মানুষেরা কল্পনা ও করতে পারবে না।অথচ এমন মহৎ ব্যক্তি সম্পর্কে আজকের প্রজন্ম,বিটঘরের সাধারণ মানুষ কিছুই জানে না।
হাজার হাজার গরীব ছাত্র/ছাত্রীর জীবন গড়ে তিনি আজ ইতিহাসের পাতায় আমৃত্যু লাভ করেছেন।নানাবিধ ব্যবসায় সফলতার কারণে মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য একসময় কোটি কোটি টাকার মালিক হন। দু’হাতে মানব কল্যাণে দান করেন। তখন জমিদারদের অত্যাচার আর নিপীড়নে সাধারণ প্রজাদের অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। একজন সাধারণ প্রজা হয়ে মহেশ চন্দ্র মানব কল্যাণে প্রবৃত্ত হয়ে কাজ করার কারণে এলাকার জমিদারগণ বিব্রত বোধ করতেন।তাই শত ইচ্ছে থাকা সত্বেও জমিদারদের অসহযোগিতার কারণে নিজ গ্রাম বিটঘরসহ নূরনগর এলাকায় তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ করতে পারেননি।জানা যায়,বিটঘর রাধানাথ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন সকল ব্যয়ভার মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বহন করলেও স্কুলটির নামকরণে জমিদারের ইচ্ছে অনুযায়ী তাদের এক নিকটাত্মীয় রাধানাথের নামে নামকরণ করা হয়।এলাকার নারী শিক্ষার প্রসারে মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর নিজ বাড়ির পাশে ১৯১৫-১৬ সালের দিকে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।প্রভাবশালীদের অসহযোগিতার কারণে সেটিও অকালেই বিলুপ্ত হয়।এই বালিকা বিদ্যালয়ের সকল আসবাবপত্র ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কাইতলা ইংলিশ মাইনর স্কুলে(কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়) স্থানান্তর করা হয়।বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’। দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের বেলাও তাই ঘটেছে। তবে এমন প্রতিকূল পরিবেশেও তিনি দমে যাননি।
১৯৩৫ সালে কাইতলা থেকে কুড়িঘর পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ কিঃ মিঃ মহেশ রোড। মহেশ রোড থেকে বিটঘর বাজার পর্যন্ত সংযোগ রাস্তা। নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষা সংসদ।
বিটঘর গ্রামের সাধারণ মানুষের পানীয় জলের অভাব দূরীকরণের জন্য নিজ বাড়ির পাশে একটি পুকুর খনন করেন এবং জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই এখান থেকে পানীয় জল নেওয়ার অনুমতি ছিল। পাকিস্তান আমলে বিটঘর ছিল নূরনগর পরগনার একমাত্র গ্রাম যেখানে বর্ষাকালে নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য তিনটি লোহার ব্রিজ ছিল। এছাড়াও প্রকাশ্যে গোপনে বহু গরীব অসহায় ও কন্যা দায়গ্রস্থ পিতার শেষ আশ্রয়স্থল ছিলেন মহর্ষি মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। জীবদ্দশায় উপযুক্ত সহযোগিতা পেলে তাঁর জন্মভিটা, শৈশব-কৈশরের বহু স্মৃতিবিজড়িত বিটঘরে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দাতব্য সংস্থা গড়ে তোলতেন বলে আজ অনেকেই মত প্রকাশ করেন।

শিক্ষা বিষয়ে মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের দর্শন ছিল, ‘একমাত্র শিক্ষাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে, করে তুলতে পারে আত্মনির্ভর।’ আশার কথা হচ্ছে, বিলম্বিত হলেও এই কিংবদন্তীর দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছেন ওই গ্রামেরই আরেক কৃতিসন্তান ও সমাজ সেবক মোঃ মুন্তাসির মহিউদ্দিন অপু। প্রয়াণের প্রায় ছয় যুগ পর চলতি বছর ২০২০ সালে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কীর্তিমান এ মনীষীর জন্মভূমিতে নৈসর্গিক ও মনোরম পরিবেশে তারই নামানুসারে ‘বিটঘর দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বিদ্যাপীঠ’ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি পাঠদানের অনুমোদনও পেয়েছে। ‘বিটঘর দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বিদ্যাপীঠ’ এখন শিক্ষা সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়া জনপদ বিটঘর তথা এলাকার সাধারণ জনগণের মাঝে আঁধারে আলোর দিশা।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে সবিনয়ে একটা কথাই বলতে চাই,এমন মহৎ শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির জীবনী ও তাঁর কর্ম যদি পাঠ্যপুস্তকে অন্তভুক্তি করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরেক মহেশ চন্দ্রের জন্ম এই বাংলাদেশে আর নাও হতে পারে।মানুষকে যদি তাঁর কাজের মূল্যায়ন না করা হয় তাহলে ভালো কাজে মানুষ কখনো উৎসাহী হবে না।

➤পন্ডিত ইন্দ্র কুমার সিংহ ‘কর্মযোগী মহেশচন্দ্র ও কুমিল্লা মহেশাঙ্গন’ নামক ইতিহাস গ্রন্থে। অবশ্য গ্রন্থটিতে ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত পন্ডিত ড. রাসমোহন চক্রবর্তী লিখিত ‘মহাপ্রাণ মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য’ (প্রথম খন্ড) গ্রন্থটির সরব প্রতিধ্বনি বর্তমান।

➤ রামমালা ছাত্রাবাসের অধ্যক্ষ রাসমোহন চক্রবর্তী মনেপ্রাণে স্বদেশী ছিলেন ফলে আন্দোলনে জড়িত এমন সন্দেহে ৬ মাস রাজবন্দি হিসেবে ঢাকা ও কুমিল্লায় জেল খেটেছেন।

➤কে এই শচীনদেব বর্মণ বা অজয় ভট্টাচার্য্য?
এইসব দুর্লভ তথ্য ইন্দ্র কুমার সিংহ প্রকাশ করে নতুন গবেষণার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছেন।৪০-৫০-৬০ এর দশকে সিনেমার গান ও কাহিনী লিখে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন কবি ও সাহিত্যিক অজয় ভট্টাচার্য্য। তাঁর অনুজ কবি ও প্রাবন্ধিক সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য ১৯৩২ সালে কুমিল্লা থেকে সাড়াজাগানো সাহিত্য কাগজ ‘পূর্ব্বাশা’র প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন। অজয় ভট্টাচার্য্যরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ত্রিপুরা রাজবংশের সন্তান সঙ্গীতজ্ঞ শচীনদেব বর্মণ, অজয়ের লিখিত অনেক গানের সুর করেছেন আবার গেয়েছেনও। অজয় ভট্টাচার্য্য ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য উভয়েই ঈশ্বর পাঠশালার ছাত্র ছিলেন। তাঁরা যে এখনো কুমিল্লার গৌরব সেই ইতিহাস পুনরুদ্ধারে সংস্কৃতি গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন গ্রন্থকার।[ ‘কবি ও গীতিকার অজয়কুমার ভট্টাচার্য্য’ প্রবন্ধ  থেকে]

➤মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ও মিথ:
১৯৩৫ সালে জনহিতার্থে বিজনা নদীর উপর লোহার ব্রিজ ও কসবা থেকে বিদ্যাকুট পর্যন্ত মহেশ রোড নির্মাণ করেন।
কসবার ডম্বুর মাঝি এক পয়সার জন্য মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের ছাতা রেখে দেন।আগরতলার রাজা বিজনা নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণের জন্য তাঁর নামে জায়গা লিখে দেন এবং ব্রিজ নির্মাণের অনুমতি দেন।বিজনা নদীর এ ব্রিজের নাম মহেশ ব্রিজ।

➤পরলোক:
১৯৪৪ সালে ভারতের কাশীধামে এ পুণ্যলোক মহাপুরুষ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

@➤তথ্য ঋণ:

[১] -গ্রন্থবর্ষ স্মারক গ্রন্থ ২০০২ , বাংলা একাডেমী, ইন্দু কুমার সিংহ লিখিত “রামমালা গ্রন্থাগারঃ কুমিল্লা” নিবন্ধ থেকে।
[২] মহাপ্রাণ মহেশচন্দ্র ভট্রাচার্য্য।।পন্ডিত ড. রাসমোহন চক্রবর্তী।

ইংরেজী ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত।

[৩] শান্ত নূরুননবীর লেখা ‘মহেশাঙ্গন ও রামমালা পাঠাগার’ নিবন্ধ থেকে।দৈনিক প্রথম আলো।
প্রকাশ ১৭ মার্চ ২০১৪ ইং।

[৪] ‘ইমরান মাহফুজের ‘অজানা ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘রামমালা গ্রন্থাগার’ নিবন্ধ।
The Daily Star Bangla
অক্টোবর ১৮, ২০২০

[৫] কর্মযোগী মহেশচন্দ্র ও কুমিল্লা মহেশাঙ্গন।।পন্ডিত ইন্দ্র কুমার সিংহ
প্রচ্ছদ।। ঈশ্বর পাঠশালার প্রাক্তন ছাত্র স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী অধ্যাপক সমরজিৎ রায় চৌধুরী।
পৃষ্ঠা সংখ্যা:  ২০০
প্রকাশকাল: আগস্ট ২০১১।

☆জাপান প্রবাসী লেখকঃ প্রবীর বিকাশ সরকার,গবেষক ও মাসিক কিশোরচিত্র সম্পাদক।

[৬] যাঁদের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া ধন্য।। রেজাউল করিম

[৭] নবীনগরের আলোকিত মানুষের কথা।।সম্পাদনায়: স্বপন মিয়া
প্রকাশনী: নব প্রকাশ।

💻লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক।

🚫 সতর্কবার্তা: মূল লেখকের অনুমতি ব্যতীত উপরোক্ত লেখার আংশিক কিংবা সম্পুর্ণ লেখাটি অন্য কোনো নামে প্রকাশ আইনত অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

Some text

ক্যাটাগরি: আত্মজীবনী

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি