রবিবার সকাল ১১:৫৫, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং

চা শ্রমিক: সভ্যযুগের দাসপ্রথা, আপনিও প্রভু!

৫৪১ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

আধুনিক নগর জীবনে কত ব্যস্ত মানুষ, কত বিচিত্র তার প্রকাশ! প্রতিটা রাতের শেষে সূর্য ওঠার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আরেকটি কর্মমুখর দিন। শুরু হয় নিরন্তর ছুটে চলা। তারই মাঝে একটু অবসর। একটু অবকাশ নেওয়া।

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে- হাসি-কান্না, আনন্দ-বিষাদ-সবখানেই এক কাপ গাঢ় লিকারের চা নিয়ে আসে গভীর তৃপ্তি। শিল্পীর তুলির আঁচড়ের মতো সাজানো সবুজের এই রাজ্য দারুণভাবে টানে আমাদের। কর্মব্যস্ত নাগরিক জীবনের সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় প্রকৃতির নির্মল পরশ। অথচ এত আলোর নিচেই যে আছে এক অন্ধকার জগৎ, সেটা আমরা ক’জন জানি? শৈল্পিক সৌন্দর্যে বিমোহিত ক’জন খোঁজ রাখি কত কান্না, কত আর্তনাদ আছে ভেতরে?

এদেশে চা শিল্প বিকাশের একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। খ্রীস্টপূর্ব সময় থেকে চীনদেশে মূলত চায়ের প্রচলন। ৮০০ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে প্রচলন শুরু হলেও এদেশে চায়ের প্রচলন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরেই। ১৮৩৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের গঠিত কমিটি বিস্তর গবেষণার পর ঘোষণা দেয় যে, আসামের চা চীনা চায়ের চেয়ে অনেক উন্নতমানের।

এ ঘটনা চা শিল্পের জন্য নবদিগন্ত উন্মোচন করে। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানের মাধ্যমে এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের চাষ শুরু হয়। কিন্ত সমস্যা হলো বাগান করতে প্রচুর শ্রমিক প্রয়োজন হয়। এত শ্রমিক আসবে কোথা থেকে? এর সমাধান খুঁজতে গিয়ে তৈরি হয় মানবসভ্যতার এক নির্মম ইতিহাস।

এত আলোর নিচেই যে আছে এক অন্ধকার জগৎ, সেটা আমরা ক’জন জানি? শৈল্পিক সৌন্দর্যে বিমোহিত ক’জন খোঁজ রাখি কত কান্না, কত আর্তনাদ আছে ভেতরে?

আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ, বাকুড়া প্রভৃতি অঞ্চল থেকে গরীব চাষীকে চা শ্রমিক হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। ব্রিটিশরা তাদের সামনে প্রচার করেছিল উন্নত জীবনের নানা গল্প, বলেছিল বাগানের গাছ নাড়া দিলেও নাকি পয়সা পড়বে। শুধুই ছলনা দিয়ে নয়, অনেকক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়-ভীতি দেখিয়েও বাধ্য করা হতো তাদের কথা শুনতে।

অসহায় মানুষগুলো ধূর্ত ইংরেজদের কথায় বিশ্বাস করে নিজেদের পরিচিত আজন্ম পরিবেশ ছেড়ে চলে এসেছিল একটু ভালো জীবনের আশায়। দেড় শতাধিক বছর ধরে কি সীমাহীন আত্নত্যাগ আর কি অপূর্ব মমতায় এই শিল্পীরা গড়ে তুলেছে আজকের এই শিল্প তা বাইরে থেকে কল্পনা করা কঠিন। তখনকার গহীন অরণ্য আর পাহাড়ঘেরা বিস্তীর্ণ প্রান্তরকে চা শিল্পে রূপ দিতে গিয়ে সেদিন মেনে নিতে হয়েছিল প্রায় দাসোচিত জীবন। তারপরও বুকের নিভৃত কোনে জেগে ছিল একটু ভালো থাকার স্বপ্ন।

বর্তমানে চা বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরি ফসল। বিশ্বের প্রায় ২৫ টি দেশে চা রপ্তানি হয় বাংলাদেশ থেকে। প্রায় ১৫ লক্ষাধিক জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শ্রমে সচল হয় দেশের অর্থনীতি। প্রতিদিন তিলে তিলে নিজেকে নিঃশেষ করে তৈরি করা সম্পদ নিজেদের জীবনে কাজে না লাগলেও তাতে প্রতিদিন ফুলে ফেঁপে ওঠে মালিকের ধনভান্ডার।

আজ যখন ১ কেজি চালের দাম ৫০-৬০ টাকা, পেঁয়াজের দাম কিছুদিন পরপর ১০০ ছাড়ায়, তখন চা শ্রমিকের মজুরি মাত্র ১০২ টাকা। কিছুদিন আগেও যা ছিল ৮৫ টাকা। আইএলও- এর প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ৫৫% চা শ্রমিকের মাসিক আয় ১৫০১ টাকা; ৩৩% এর ১৫০০ টাকা এবং মাত্র ২ শতাংশ চা শ্রমিকের আয় ৩ হাজার টাকা।

গত দশ বছরে চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি বেড়েছে ৭০ টাকা। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই আমরা দেখি উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ভাসছে৷ দেশ এই সুইজারল্যান্ড হলো বলে! সত্যিই এ এক উন্নয়ন বটে! এই মজুরি দিয়ে শিক্ষা ও চিকিৎসাতো দূরের থাক, কোনোরকমে বেঁচে থাকাই যায় না৷ যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলে চা শ্রমিকরা বসবাস করলেও ভূমির অধিকার দূরের কথা, ছোট আলো-বাতাসহীন ঘরে কোনোরকমে বসবাস করে তারা। ব্রিটিশ গেল, পাকিস্তানও বিদায় নিল। বারবার আশায় বুক বাঁধলেন চা শ্রমিকরা। কিন্ত হতাশ হতে হলো বারে বারে।

স্বাধীনতার ৪৯ বছর অতিক্রান্ত হলো কিন্ত পূর্বপুরুষের ভিটায় চা শ্রমিকদের কোনো আইনি অধীকার নেই। মালিক চাইলেই যে কোনো শ্রমিককে বাগান থেকে তুলে দিতে পারে৷ আজ চা বাগানে যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা পর্যন্ত নেই। অনিশ্চিত তার ভবিষ্যৎ।

আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ, বাকুড়া প্রভৃতি অঞ্চল থেকে গরীব চাষীকে চা শ্রমিক হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। ব্রিটিশরা তাদের সামনে প্রচার করেছিল উন্নত জীবনের নানা গল্প, বলেছিল বাগানের গাছ নাড়া দিলেও নাকি পয়সা পড়বে। শুধুই ছলনা দিয়ে নয়, অনেকক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়-ভীতি দেখিয়েও বাধ্য করা হতো তাদের কথা শুনতে।

চা শ্রমিকরা যে মজুরি পান এতে তাদের পুষ্টির নূন্যতম চাহিদাও পূরণ হয় না। কর্মক্ষেত্রে বিশ্রাম, পানীয় জল ও স্বাস্থ্যকর সেনিটেশনের অভাবে শ্রমিকরা আছেন চূড়ান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। ১৯৬৬ সালের ‘ট্রি প্ল্যান্টেশন লেবার অর্ডিন্যান্স’ ও ১৯৭৭ সালের ‘প্ল্যান্টেশন রুলস’ অনুযায়ি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাগান কর্তৃপক্ষের। কিন্ত দেশের ১৬৪টি বাগানের মধ্যে ১ জন করে এমবিবিএস ডাক্তার আছে মাত্র ৬টিতে। আইএলও বলছে, ৬৩ শতাংশ শ্রমিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। শ্রমিকদের মধ্যে ৭২ শতাংশ পেটের ব্যাথা, ৮৪ শতাংশ মাথা ব্যাথা ও ৭৪ শতাংশ মাংসপেশির ব্যাথায় ভুগছেন। শ্রমিকদের বড় অংশই ভোগেন রক্তশূন্যতায়। চা শ্রমিকদের ৬৪ শতাংশই নারী শ্রমিক। তাদের অবস্থা আরো করুণ। প্রায় ৯১ ভাগ নারী শ্রমিক তাদের সর্দারদের দ্বারা নিগ্রহের শিকার হন।

আধুনিক গনতান্ত্রিক সমাজে শিক্ষার অধীকার আছে সবার। সংবিধানেও এর স্বীকৃতি আছে। স্বাধীনতার পর ৪৯ বছর অতিবাহিত হয়েছে, কিন্ত আজও চা শ্রমিকরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। সারা দেশের ১৬৬/১৬৭টি বাগানের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে মাত্র ৬টিতে (মতান্তরে ১০/১৩ টিতে)। মাধ্যমিক স্কুল আছে মাত্র ৩ টিতে। শিক্ষার অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা এক অর্থে তাকে সমাজবিচ্যুত করে পশুর স্তরে নামিয়ে দেয়া। তার বিকাশের পথ রুদ্ধ করে অধীনতায় ঠেলে দেয়া। বছরের পর বছর অবহেলা ও অপমানের বোঝা বৃহৎ এ জনগোষ্ঠীকে সভ্যতার আলো থেকেই বঞ্চিত করেনি, নিজেকে মানুষ ভাবার অধিকার থেকেও যেন বঞ্চিত করেছে৷ তাদের এই পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ শিক্ষার অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা।

গত দেড়শ’ বছরে অনেক কিছু পাল্টালেও, চা শ্রমিকদের এ দাসত্বের জীবন পাল্টায়নি। তারা আজো অধিকার বঞ্চিত। আজো সমাজ- সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন তারা। চা শ্রমিকদের এই দীর্ঘ পথচলা মূলত বঞ্চনা আর অপমানের ইতিহাস। ক্রমে তাদের নিঃশেষ হবার ইতিহাস। সভ্যতার এ নির্মমতার অধ্যায় আর কতকাল চলবে তার উত্তর মেলে ভার। তাদের সকল স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে তৈরি হয় মালিকের মুনাফার পাহাড়। আর একেই ঘোষণা দেওয়া হয় উন্নয়ন বলে। এ উন্নয়ন কার উন্নয়ন? এ রাষ্ট্র কার রাষ্ট্র?

এস সাহল আব্দুল্লাহ:

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Some text

ক্যাটাগরি: নাগরিক সাংবাদিকতা, মতামত, সমকালীন ভাবনা

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি