ত্রাণ ত্রাণ ত্রাণ। চোর চোর চোর।ধর্ ধর্ ধর্। ‘ত্রাণচোর ধর্।’ বাহ্ কী চমৎকার শব্দ! ত্রাণ আর চোর শব্দ দুটি এমনভাবে সমাসবদ্ধ হয়েছে যে এর মধ্যে কোন ফাঁক নেই। বরং আমি বলতে পছন্দ করি এটি এক সত্তাগত একটি শব্দ হয়ে গেছে।
এতো ব্যাপক পরিচিত আর চর্চিত শব্দ এটি। যেখানেই ত্রাণ সেখানেই চোর! যখনই ত্রাণ তখনই চোর। বিষয়টা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, ত্রাণ যেনো তারই প্রাপ্য যাকে বিতরণ করতে দেওয়া হয়েছে। এখন সে তা অন্যকে কীভাবে দিয়ে দেয়। তাই চুরি করে নিজের প্রাপ্য নিয়ে নেয় আগেভাগেই।
‘এটা মনে হয় দোষের নয়’, দোষ মনে করেও না চোরেরা!’ মূলত ত্রাণ কী? আমি মনে করি একপ্রকার ‘সরকারি ভিক্ষা।’ যা রাষ্ট্রের অসহায়, নিঃস্ব, গরীব, অভুক্ত, অভাবী, অনাহারী
পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, আঁতুড়, কর্মক্ষম বৃদ্ধ ভিটাবাস্তু হারা মানুষেরাই প্রাপ্য। এই ‘রাষ্ট্রীয় ভিক্ষা’ কীভাবে চুরি হয়ে যায় তা আমি ভাবতেই পারি না। মানুষের অসহায়ত্ব যখন চরম সীমা ছুঁয়ে যায় তখনই সরকার কিছু ‘রাষ্ট্রীয় ভিক্ষা’ পাঠায় মানুষের অসহায়ত্বটুকু একটু স্বান্তনা যেনো পায়। খুব অল্প পরিমাণে। আমাদের দেওখোলা ইউনিয়নে দুই কিংবা তিন ধাপে এক টন করে চাল এসেছে।
সেগুলো দশ কেজি করে একশোজন মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।শুধু দশ কেজি চাল লক ডাউনের স্বান্তনা বৈ কিছুই নয়। সর্বোচ্চ চারজনের একটি পরিবার দশদিন খেলো! তারপর হাহাকার সেই আগের মতোই। এর ভেতর থেকে যদি আবার চুরি হয়ে যায় তাহলে গরীব কী পাবে? অনেকে বলছে সেই চালে ভাত ভালো হয় না। গন্ধ আসে রান্নার পর। আবার কেউ কেউ সেই চাল একশো টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছে।
খেতে পারে না তাই। সস্তা পাওয়ায় কোন গরীব কিনেও নিচ্ছে। খাচ্ছে, খেয়ে নিচ্ছে নাকে ধরে। কখনো কখনো একটু ভালো চালও আসে। সমস্যা বহুমুখী। সমাধান নেই। বাস্তব অর্থে, যদি চুরি না হয় আর প্রকৃত অভাবীরাই শুধু ত্রাণ নিতে আসে তাহলে সরকারি ত্রাণ গড়াগড়ি খাবে কিন্তু নেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। ময়মনসিংহ শহরে দুধ মহলে একজন বৃদ্ধ তিনি চুলা ইত্যাদি বানান। ঠিকও করেন।
একদিন ওনার সাথে কথা হয়। এক ফাঁকে দেখি ওনার কয়টি আঙুল কাটা।জিজ্ঞেস করলে জানান একাত্তরে গুলি লেগেছিলো।যুদ্ধ করার সময়। তিনি একজন মুক্তিযুদ্ধা। বললাম, আপনার মুক্তিযুদ্ধের সনদ আছে কি না? আপনি মুক্তিযুদ্ধা ভাতা পান কি না? একরকম গতি মুখে এনে বললেন, ‘বেট্টি, বেট্টি আমারে কী দিবো? বেট্টির টেহা খাওন লাগতো না। যা কামাই করি তা-ই তো খাইয়া শেষ করবার পাইনা! দ্যাশের লাইগ্যা যুদ্ধ করছি। টেহা খাবার লাইগ্যা যুদ্ধ করছি না!’
গত বুধবার বাজার করে ফিরছিলাম। তখনো এক ঘন্টা বাকি আছে বাজার টাইম শেষ হতে। সেনাবাহিনীর গাড়ি ঢুকলো বাজারে। গাড়ি ঢুকতে দেখেই মানুষ হুটহাট শাটার নামিয়ে দিলো ভয়ে।যদিও সেনারা কিছু বলেনি, সময়ও শেষ হয়নি।এটাই বাঙালি, সঠিক বিষয় কোনসময়ই বুঝতে চাইবে না। সেনারা বাজারে ঢুকার সময় একটি দোকানে একজন ভিখারি মহিলাকে ভিক্ষা করতে দেখে তাকে ডাকে।মহিলা ভয়ে কাছে যায়নি অনেক ডাকাডাকির পরও।তারপর একজন সেনা নেমে এলেন ত্রাণসামগ্রীর একটি প্যাকেটসহ।
মহিলাকে দিলেন। মহিলা নিতেই চায় না। কিছুক্ষণ বুঝানোর চেষ্টা করে সেনা সদস্য ফিরে এলেন। তারপর লোকেরা মহিলাকে বুঝাতে চাইলো এটা তাকে দেওয়া হয়েছে। তবুও মহিলা নিতে চায় না।তারপর একটি ভ্যানে প্যাকেটটি তুলে দিয়ে মহিলাকে উঠতে বলে, না, সে উঠবে না, প্যাকেট নিবে না। অনেক চেষ্টার পর হয়তো শেষ পর্যন্ত নিয়েছে। কেউ কেউ প্রাপ্য হয়েও নিতে চায় না।আর অনেকে চুরি করে। সর্বশেষ বলি ত্রাণকে ভিক্ষা বলছি এইজন্য যারা সত্যিই প্রাপ্য তারা যেনো পায়, যারা প্রাপ্য নয় তারা যেনো ঘৃণা করে না নেয়।আর জাতির ঐসব চোর যারা অসহায়ের আহার চুরি করে তারা যেনো সরকারের এইসমস্ত ত্রাণসামগ্রী কে ভিক্ষা ভেবে অন্তত চুরি না করে। যদিও প্রবাদ আছে ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।’ তারপরও আমার বিশ্বাস কোন চোর অন্তত ‘ভিক্ষা’ চুরি করে না।
Some text
ক্যাটাগরি: মতামত
[sharethis-inline-buttons]