হাফেজ মাওলানা অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিন সাহেব রহঃ এর সাথে আমার ব্যক্তিগতভাবে তেমন কোন স্মৃতি নেই, গত ৩০ শে জুন -২০১৯ দেশ থেকে চলে আসার আগেরদিন ২৯ শে জুন – ২০১৯ যুব আন্দোলনের এর জেলা দ্বায়িত্বশীল দের তারবিয়াত প্রোগ্রাম ছিল, নিরাশার দোলায় দুলিত ছিলাম কারো সাথেই কি তাহলে দেখা হবেনা?? আলহামদুলিল্লাহ একে একে পীর সাহেব হুজুর দাঃবাঃ, মহাসচিব সাহেব হুজুর দাঃবাঃ সহ অনেকের সাথেই দেখা হয়ে গিয়েছিল, সর্বশেষ আমাদের আঃকরিম ভাই যখন হাফেজ মাওলানা অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিন সাহেব রহঃ এর সাথে পরিচয় করে দিলেন, উনি তখন খুবই অসুস্থ ক্যামোথেরাপীর কারণে মাথার চুল ও দাঁড়ি গুলো উঠে গিয়েছিল, কিন্তু উনার চেহারায় বা কথায় সামান্যতম পরিবর্তন ও ছিল না, আমাকে উপদেশ দিতে গিয়ে অনেক গুলো কথায়ই বলেছিলেন কাপা কাপা ঠোটে, উনার অনেক গুলো কথা থেকে কিছু কথা সবার জন্য শিক্ষনীয়, যা আমাদের পাথেয় হিসাবে কাজ করবে, উনার শেষ কিছু কথা সবার জন্য প্রনিধান যোগ্য ও বটে, উনি বলেন “আমি হয়তো বাংলাদেশে ইসলামি হুকুমত ক্বায়েম দেখে যেতে পারব না কিন্তু এই বাংলাদেশে ইসলামি হুকুমত ক্বায়েম হবেই”, তাই দেশে থাকুন বা প্রবাসে থাকুন ইসলামি আন্দোলন এর সাথেই সক্রিয় হয়ে থাকবেন, আল্লাহ পাক চাহেতো ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে ইসলামি হুকুমত ক্বায়েম হবে – ইনশাহ আল্লাহ, শেষে উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে গেলাম সবার সাথে কথা হল, পরের দিন ৩০ শে জুন -২০১৯ আমার ফ্লাইট ছিল সকাল বেলায়, আমি চলে আসলাম, কিন্তু ২৯ শে জুন -২০১৯ এর যুব আন্দোলন এর জেলা দ্বায়িত্বশীলদের তারবিয়তে উনার কান্না মাখা কথা গুলো পত্রিকা মারফত জেনেছিলাম, Shahidul Islam Kabir ভাইয়ের মাধ্যমে উনার যে উদারতার কথা জেনেছি তা সারাজীবন হৃদয়ে স্বর্নাক্ষরে লিখা থাকবে,
আজকে ভাবতেই অবাক লাগে এমন উদারতার ধারকগণ দের ই একজন আমাদের সবার “প্রিয় হেমায়েত ভাই ” আর নেই,
হেমায়েত ভাই কেমন ছিলেন তা লিখতে গিয়েও বারবার হোঁচট খেয়েছি,
কিন্তু তারপরও উনার জীবন বৃত্তান্ত নিন্মে দেওয়া হল,
স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামভিত্তিক রাজনীতির ময়দানে প্রথম সারীর নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন হাফেজ মাওলানা অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিন রহঃ। বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জে বাবা আলহাজ্ব মাওলানা আব্দুল আলীর ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। বাবার প্রতিষ্ঠানে ই লেখাপড়ার হাতেখড়ি। তারপর খুলনা শিরোমনি হাফেজিয়া মাদরাসায় পবিত্র কুরআন হেফজ করেন তিনি। এরপরে ঢাকা আলীয়ায় ভর্তি হন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অধ্যয়ন করেন তিনি।
তিনি ঢাকার মালিবাগে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী আবুজর গিফারি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। কিছুদিন তার পিতার প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি রামপুরা একরামুন্নেছা ডিগ্রি কলেজে ও দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন।
এ দেশের ইসলামী রাজনীতির ডায়েরীতে ইতিহাস রচনার যোগ্য অংশীদার আপোষহীন লড়াকু সৈনিক এই দেশপ্রেমিক মানুষটি। তিনি ছাত্র জীবন থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৯ সালে (ব্রিটিশ আমলের) প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছাত্র সংগঠন ‘জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া’র তিন সেশনের (১৯৮১-৮৩) কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিন।
কেন্দ্রীয় সভাপতি হয়েই মাদরাসা ছাত্রদের ১৭ দফা দাবী আদায়ে ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার উদ্যোগে জাতীয় সংসদ ঘেরাও কর্মসূচী ঘোষণা করেন তিনি। এবং সামনে থেকে ভিজ্ঞ নেতৃত্ব দিয়ে সফলও করেন কর্মসূচি।
দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিন বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড-এর স্বায়ত্বশাসনের দাবী পূর্ণ করেন। মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড স্বায়ত্বশাসনের দাবী বাস্তবায়নের পর জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার উদ্যোগে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক হাফেজ মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দিন-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় সংবর্ধনা সভা। সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য রাখেন স্বায়ত্বশাসিত মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান জনাব বাকিবিল্লাহ খান।
১৯৮৭ সালে পশ্চিম রাজাবাজার হেফজখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
৮০-র দশকে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর সাথে যুবকদের নিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে থেকেই হাফেজ্জী হুজুরের রহ.-এর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অটুট। যখন খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠা হয় তখন হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো থাকার কারণে একদম শুরু থেকেই তিনি খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন এবং সেখানে তার সঙ্গে কাজ করেন।
হাফিজ্জী হুজুরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ঝাপিয়ে পড়েন সর্বস্ব দিয়ে। খেলাফতের স্বপ্ন পূরণে ত্যাগ আর কুরবানির নযরানা পেশ করেন। হাফিজ্জী হুজুরের মৃত্যুর পর হাফিজ্জী হুজুরের শীষ্য সৈয়দ ফজলুল করিম (পীর সাহেব চরমোনাই রহ.) এর নেতৃত্বে ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন’র সঙ্গে যুক্ত হন হেমায়েত উদ্দিন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন শ্লোগান “শুধু নেতা নয়, নীতির পরিবর্তন চাই” প্রবর্তক সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই রহ. এর ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিভার ডানা মেলে এটিএম হেমায়েত উদ্দীনের। ১৯৮৭ সালে ১৩ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হওয়া সেই ক্ষুদ্র রাজনৈতিক শক্তিটি আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম ইসলামী শক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে – আলহামদুলিল্লাহ ।
ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ নামক দলটির আজকের এই অবস্থানের পেছনে যতজন লড়াকু ও নিবেদিত কর্মীর অবদান রয়েছে, তাদের মাঝে অন্যতম এটিএম হেমায়েত উদ্দীন, উনার অবদান অনস্বীকার্য৷ তিনি ইসলামী আন্দোলনের রাজনীতির সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে ছিলেন, মনে হতো তার জীবনের লক্ষ্য ও পেশাই ইসলামী আন্দোলন। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করে তিনি আজ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব।
১৯৯১ ও ৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের মিনার প্রতিকে বাগেরহাট ৪ আসন থেকে নির্বাচন করেছেন। ২০০১ সালে ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বাগেরহাট ৩-৪ আসনে নির্বাচন করেছেন। তিনি মসজিদের নগরী খ্যাত অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০০২ এ মেয়র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ঢাকাবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
আন্দোলন-সংগ্রামের প্রথম সারির এক বীরের নাম হাফেজ মাওলানা অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দীন। আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিল মিটিংয়ে পুলিশের টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ উপেক্ষা করে পল্টনের রাজপথে দাঁড়িয়ে থাকতেন সাহসের প্রতীক হিসেবে। সভা, সমাবেশ, সেমিনার, মিছিল-মিটিং প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। তার রক্তে প্রতিবাদের বারুদ এতটাই জাগ্রত ছিল, অন্যায় বিরোধী শ্লোগানে সর্বাগ্রে দেখা যেত তাকে। সারাটা জীবন জাতির কল্যাণে ব্যয় করেছেন।
পীর সাহেব চরমোনাই রহ. এর ডানহাত হয়ে ইসলামী রাজনীতিতে জীবন বিলিয়েছেন লাভ লোকসানের হিসেব মিলানো ছাড়াই। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদ করে জেল খেটেছেন দীর্ঘ সময়। নাস্তিক মুর্তাদ বিরোধী আন্দোলন, বাবরি মসজিদ রক্ষার আন্দোলন, ফতোয়া বিরোধী আন্দোলন সহ এমন কোন আন্দোলন সংগ্রাম নেই যেখানে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করেননি। রাজপথ থেকে যতবার গ্রেফতার হয়েছেন ততবারই দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে ফিরে এসেছেন আবারও রাজপথে। রাজনীতিতে ভয় বলে কোন শব্দ ছিল না তার জীবনে। বহুবার মিছিলের ব্যানার ছিনেয়ে এনেছেন পুলিশের হাত থেকে।
উনি যে কত নিরাংহকার ও মাটির মানুষ ছিলেন তা ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব, গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গাজীপুরে বৃষ্টি ভেজা অবস্থায় ও উনাকে মাইকিং করতে দেখা গেছে, একজন কেন্দ্রীয় নেতার এইসব আত্মত্যাগ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত ই করে,
ইসলাম বিরোধী কোন শক্তির নূন্যতম আস্ফালন মোটেই বরদাশত করতে পারতেন না, শ্লোগানের আওয়াজ শুনলে এটিএম হেমায়েত উদ্দিন নিজেকে ধরে রাখতে পারতেন না। তাঁর পুরো দেহ ও হৃদয়জুড়ে প্রতিবাদের স্রোতধারা বয়ে যেতো। তার শরীরের প্রতিটি রক্তকণায় মিশে ছিল দেশপ্রেম, ইসলাম আর কল্যাণরাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন। নির্মল আদর্শের অকুতোভয় এক সৈনিক তিনি।
ছোট্টো দলটির আজকে ঢাকা মহানগরে লাখো কর্মী আছে। এই যে বিশাল কর্মী বাহিনী গড়ে ওঠেছে এর পিছনের কারিগর যিনি তিনি এটিএম হেমায়েত উদ্দিন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে, কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে রাজধানী ঢাকা ইসলামী আন্দোলনের দূর্গে পরিণত হয়েছে। রাতদিন একাকার করে ঢাকার অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন সংগঠনের কাজে।
ইসলামী বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা তার ভেতরে কাজ করতো সর্বদা। হেঁটে হেঁটে ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্নের ফেরি করেছেন সারাটি জীবন। ছড়িয়ে দিয়েছেন বিপ্লবের কামনা সহকর্মীদের মাঝে। সবার সুখে দুঃখে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রেখেছিলেন সর্বদা।
তাঁর বক্তব্য ও বজ্রকণ্ঠ বাংলাদেশে অদ্বিতীয়।
ন্যায়ের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এটিএম হেমায়েত উদ্দীনের বলিষ্ঠ কণ্ঠ আর প্রতিবাদী শ্লোগান যুগযুগ ধরে স্মরণ রাখবে জাতি। তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে রাজনৈতিক আইডল।
অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া ছিল উনার নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার, নিজের উপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার অনেক নজির বিদ্যমান,
- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দিন আজ ১১/১০/২০১৯রোজ শুক্রবার বেলা সকাল ১০.৪০ মিনিটে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন – ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আল্লাহ তাকে জান্নাতে ফিরদাউস নসিব করুন। আমিন।
Some text
ক্যাটাগরি: নাগরিক সাংবাদিকতা, স্মৃতিচারণ
[sharethis-inline-buttons]