বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪) হলো নওয়াব মীরকাসিম ও তাঁর মিত্রশক্তির সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ। পলাশীর যুদ্ধ এর (১৭৫৭) পর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকেরা মনে করত যে, বাংলার ঐশ্বর্য অফুরন্ত। ফলে তাদের লোভ-লালসার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সে কারণেই কোম্পানির পরিচালকগণ আদেশ দেন যে, বাংলার আয় থেকে বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ব্যয় নির্বাহ এবং এর রাজস্ব আয় দ্বারা ভারত হতে কোম্পানির রপ্তানি পণ্য ক্রয় করতে হবে। বাংলার সম্পদ পাচারের উদ্দেশ্যে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নওয়াবের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়সঙ্কল্প ছিল। বাংলার নতুন নওয়াব মীরজাফর বুঝতে পারেন যে, তাঁর পক্ষে ইংরেজ কোম্পানি ও এর কর্মচারীদের দাবি সম্পূর্ণরূপে পূরণ করা সম্ভব নয়। এদিকে কোম্পানির কর্মকর্তাগণ তাঁদের দাবি পূরণে নওয়াবের ব্যর্থতার সমালোচনা করতে থাকেন। কাজেই কোম্পানি নওয়াবকে তাঁর জামাতা মীরকাসিম এর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। মীর কাসিম কোম্পানির কর্মকর্তাদের প্রচুর অর্থ প্রদান করেন। কিন্তু তিনি ইংরেজদের প্রত্যাশা পূরণের বিষয়টি কৌশলে পরিহার করেন এবং অচিরেই বাংলায় ইংরেজদের অবস্থান ও উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার পথে হুমকি হয়ে দাঁড়ান। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, যেহেতু তাঁকে বাংলার মসনদে বসানোর জন্য তিনি কোম্পানি ও এর কর্মকর্তাদের যথেষ্ট উপঢৌকন দিয়েছেন, কাজেই তারা তাঁকে স্বাধীনভাবে বাংলার শাসনকার্য চালাবার সুযোগ দেবেন। ইংরেজ কোম্পানির কর্মকর্তাগণ কর্তৃক ১৭১৭ সালে বাদশাহী ফরমান এর অপব্যবহার রোধে নওয়াবের প্রয়াসকে ইংরেজরা মোটেও পছন্দ করে নি। এসব ইংরেজ কর্মকর্তারা বিদেশে রপ্তানিযোগ্য কিংবা অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য তাদের মালামাল শুল্কমুক্ত করার দাবি জানায়। ইংরেজ বণিকগণ শুল্কমুক্ত ব্যবসায়ের অনুমতিপত্র বা ‘দস্তক’ বন্ধুপ্রতিম ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে অবৈধভাবে বিক্রয় করার ফলে ঐসব ব্যবসায়ী অভ্যন্তরীণ শুল্ক ফাঁকি দিত। ফলে সৎ ভারতীয় ব্যবসায়ীরা অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতেন। নওয়াব কোম্পানির কর্মচারী কর্তৃক দস্তকের অপব্যবহার রোধে সক্রিয় হন। তিনি ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা ও জমিদারদের কোম্পানির কর্মচারীদের উপহার ও ঘুষ প্রদানের চাপ থেকে রেহাই দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেকে মুক্ত করে বাংলাকে শক্তিশালী করে তুলতে সচেষ্ট হন। এসব ইংরেজদের পছন্দনীয় ছিল না। বিদেশী ব্যবসায়ীরা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সমপর্যায়ভুক্ত হতে কিছুতেই রাজি ছিল না। বাস্তব সত্য ছিল এই যে, বাংলায় দুই প্রভুর শাসন সম্ভব ছিল না। মীর কাসিম মনে করতেন যে, তিনি একজন স্বাধীন শাসক, আর ইংরেজরা চাইত তিনি যেন তাদের হাতের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেন, যেহেতু তারাই তাঁকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ফলে উভয় পক্ষে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় পাটনা থেকে। সেখানে এক ইংরেজ কর্মকর্তা এবং নওয়াব পরস্পরকে উত্তেজিত করে নিজেদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটান। ১৭৬৩ সালের গ্রীষ্মে যুদ্ধ শুরু হয়। পরপর চারটি খন্ডযুদ্ধে নওয়াবের নতুন বাহিনী পরাজিত হয়। মীর কাসিম প্রথমে পাটনা ও পরে অযোধ্যায় পালিয়ে যান। অযোধ্যায় তিনি নওয়াব সুজাউদ্দৌলার সমর্থন লাভ করেন। এঁদের সঙ্গে মিলিত হন পলাতক মুগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম। ১৭৬৪ সালের শরৎকালে পুনরায় যুদ্ধ হয়। ২২ অক্টোবর বিহারের বক্সার নামক স্থানে সংঘটিত এ যুদ্ধে ইংরেজরা জয়লাভ করে। বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম পুনরায় ইংরেজ শিবিরে আশ্রয় নেন। সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখন্ডে পালিয়ে যান এবং অযোধ্যা ইংরেজ বাহিনীর পদানত হয়। মীর কাসিম নিরুদ্দেশ হন এবং এরপর তাঁর সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় নি।
বক্সার ছিল একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পর বাংলা ইংরেজ কোম্পানির শাসনের অধীনে আবদ্ধ হয়। এতদিন পর্যন্ত ইংরেজরা ছিল ক্ষমতার ভাগাভাগি ও সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য শাসকের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং তাদের ক্ষমতালাভ ছিল নিতান্তই আকস্মিক ও অনিশ্চিত। বক্সারের যুদ্ধের পর ইংরেজদের ক্ষমতা হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য এবং তারা রাজকীয় স্বীকৃতি লাভের কাছাকাছি এসে পৌঁছে। এ যুদ্ধের পর অযোধ্যার ভাগ্যও কোম্পানির অনুকম্পার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং বাংলায় ব্রিটিশদের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। বাংলার নওয়াব তাঁর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নিরাপত্তার জন্য ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ১৭৬৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক বাংলার নামমাত্র নওয়াবকে তাঁর সেনাবাহিনীর অধিকাংশই ভেঙ্গে দিতে হয় এবং কোম্পানি কর্তৃক মনোনীত একজন ডেপুটি সুবাহদারের মাধ্যমে বাংলার শাসনকার্য চালাতে হয়। কোম্পানির অনুমোদন ব্যতীত সেই ডেপুটি সুবাহদারকে বরখাস্ত করার ক্ষমতাও নওয়াবের ছিল না। এরূপে কোম্পানি বাংলার প্রশাসনিক ব্যবস্থার (নিজামতের) ওপর সর্বময় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। কোম্পানি মুগল সাম্রাজ্যের নামমাত্র সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের নিকট থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দীউয়ানি বা রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। এভাবে বাংলার ওপর কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ বৈধতা পায় এবং তৎকালীন ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রদেশ বাংলার রাজস্বের এখতিয়ার কোম্পানির ওপর ন্যস্ত হয়। দীউয়ান হিসেবে কোম্পানি সরাসরি রাজস্ব আদায় করত, আর অন্যদিকে নওয়াবের পক্ষে ডেপুটি সুবাহদার মনোনীত করার অধিকার লাভের মাধ্যমে কোম্পানি প্রশাসনিক ব্যাপারেও হস্তক্ষেপের সুযোগ পায়। তারা প্রত্যক্ষভাবে প্রদেশের রাজস্ব ও সেনাবাহিনীর ওপর এবং পরোক্ষভাবে প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে ইংরেজরা কোন দায়দায়িত্ব গ্রহণ ছাড়াই দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। নওয়াব ও তার কর্মচারীদের প্রশাসনিক দায়িত্ব থাকল বটে, কিন্তু তা বাস্তবায়নের কোন ক্ষমতা থাকল না।
গোলাম কিবরিয়া, লেখক ও প্রাবন্ধিক।
.
.
Some text
ক্যাটাগরি: নাগরিক সাংবাদিকতা, বিবিধ
[sharethis-inline-buttons]