দেশের সবগুলো আদালতে এখনো পর্যন্ত জামিনপ্রার্থী দু’হাত একত্রে করে উপরে তুলে সামনের দিকে দণ্ডায়মান থাকেন। এ ধরনের রীতি-নীতি বিচারকের দাম্ভিকতা ও প্রভূত্বমূলক আচরণকে উসকে দেয়। তখন সে নিজেকে জনগণের মনিব মনে করে। এমন ধরনের ঘটনা নিত্যদিনই ঘটছে। সরকারি কর্মচারীদের এ ধরনের দাম্ভিকতামূলক আচরণ ও প্রভূত্ববাদী মানসিকতা আমাদের দেশের সংবিধানের মূল চেতনা পরিপন্থী।
আমাদের দেশে সরকারি কাজে নিয়োজিত সমস্ত ব্যক্তিই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। সহজ ভাষায় বলা যায়, তারা সমস্ত জনগণের সেবক বা খাদেম। কখনোই জনগণের প্রভূ নয়। অবশ্য তারা সবসময়ই নিজেদেরকে জনগণের প্রভূ ভাবে। সেই অনুয়ায়ীই সাধারণ জনগণের সাথে আচার-আচরণ করে। তারা নিজেদেরকে জনগণের প্রভূ মনে করে এবং সেই অনুযায়ী সরকারি সমস্ত নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে রাস্তাঘাটে ও পরিবহনের চলাফেরা করার সময় তথাকথিত ভিআইপির র্মযাদা নেন। তাদের এ সব সুযোগ-সুবিধার কারণে সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে। জনগণের প্রচুর সময় অপচয় হয় এবং তারা যথার্থ সেবা থেকে বঞ্চিত হন। দিন দিন তাদের আচার -আচরণ, চলা-ফেরা ও সাধারণ জনগণের প্রতি তাচ্ছিল্য ভাব চরম পযার্য়ে পৌঁছেছে। মূলত জনগণের কল্যাণে তথা প্রজাতন্ত্রের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরাই প্রজাতন্ত্রের কমচার্রী, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা নন।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সবসময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা- প্রজাতন্ত্রের কাজে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির দায়িত্ব ও কতর্ব্য। এই কর্তব্যের অংশ হিসেবেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সুন্দরভাবে পালন করতে হয়। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অতিকথা, বেফাঁস বক্তব্য, তাচ্ছিল্য, দাম্ভিকতা, দুর্ববহার ইত্যাদি নেতিবাচক কাজ করার আইনগত বা বিধিগত সুযোগ নেই।সংবিধানের প্রথম ভাগে ৭-এর(১) ধারায় বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতা কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।”
১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন। আমাদের দেশের সংবিধান পৃথিবীর উন্নত দেশের সংবিধান থেকে কোনো অংশে কম নয়; গবেষক ও আইনজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সংবিধান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংবিধানগুলোর মধ্যে অন্যতম। নিঃসন্দেহে একজন বাংলাদেশি হিসেবে গর্ব করার মতো বিষয়। আমাদের সংবিধানের ছত্রে ছত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব, সর্বোচ্চ ক্ষমতা ও অধিকার উচ্চে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ ৪৮ বছর পরও এই দেশে জনগণের সর্বোচ্চ ক্ষমতা বা পাবলিক সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। বরং পাবলিক সার্ভেন্টদের সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এই পাবলিক সার্ভেন্টদের সুপ্রিমেসি এতোটাই বেড়েছে যে, তারা সাধারণ মানুষকে ক্রীতদাসতুল্য মনে করেন।
প্রায় সময়ই তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করার কারণে সাধারণ মানুষের কষ্ট ও যন্ত্রণা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। নিদির্ষ্ট কাজের বাইরেও জনগণের কল্যাণে তাদেরকে অতিরিক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়। যেমন- আমাদের দেশের নাগরিকদের ছবি, বিভিন্নধরনের সার্টিফিকেট, দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদি সত্যায়িত করা এবং আমমোক্তারনামার দলিল এ্যাফিডেভিট করা ইত্যাদি। উক্ত কাজগুলো তারা সব সময়ই এড়িয়ে চলেন। কিন্তু সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী উক্ত কাজগুলো করতে তারা বাধ্য।
২০১৫ সালের জানুয়ারির শেষদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার মধ্যপাড়া মহল্লার আজিজ সরকারের ছেলে আজিম সরকার একটি আমমোক্তারনামা দলিল এ্যাফিডেভিট করানোর জন্য গিয়েছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রথম শ্রেণির ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট। কিন্তু তিনি উক্ত কাজটি করেননি। ছেলেটির অপরাধ ছিলো, সে ম্যজিস্ট্রেটকে স্যার সম্বোধন না করে তার রুমে ঢোকেছিল। উক্ত কাজটি সুসম্পন্ন করতে পারেনি বলেই আজিম সরকার তার একটি দোকান ক্রেতার নিটক হস্তান্তর করতে পারেনি; এতে তার প্রচুর অর্থ, সময় ও শ্রম ক্ষতি হয়। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের প্রথম দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার কাজী পাড়া মহল্লার ইনাম আলী ভূইয়ার পুত্র সফিক উদ্দিন ভূইয়া তার এইচ.এস.সি পরীক্ষার র্সাটিফিকেট, ফলাফলপত্র ও কলেজের ছাড়পত্র সত্যায়িত করার জন্যে গিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রথম শ্রেনীর এক ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট। কিন্তু ছেলেটির পোশাক তেমন সুন্দর ছিল না বিধায় উনি উক্ত কাজটি না করে তাকে তাচ্ছিল্য করে রুম থেকে তাড়িয়ে দেন। অথচ ছেলেটির নিকট সবগুলো সার্টিফিকেটের মূল কপি ছিল।
আমাদের দেশে সবগুলো আদালতে এখনো পর্যন্ত জামিনপ্রার্থী দু’হাত একত্রে করে উপরে তুলে সামনের দিকে দণ্ডায়মান থাকেন। এ ধরনের রীতি-নীতি বিচারকের দাম্ভিকতা ও প্রভূত্বমূলক আচরণকে উসকে দেয়। তখন সে নিজেকে জনগণের মনিব মনে করে। এমন ধরনের ঘটনা নিত্যদিনই ঘটছে। সরকারি কর্মচারীদের এ ধরনের দাম্ভিকতামূলক আচরণ ও প্রভূত্ববাদী মানসিকতা আমাদের দেশের সংবিধানের মূল চেতনা পরিপন্থী।
প্রজাতন্ত্রের প্রকৃত মালিক জনগণ। জনগণ-প্রদত্ত ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্র চলে। সরকারী কমর্চারীরা রাষ্ট্রের কাছ যত ধরনের বেতন-ভাতা, যানবাহন, আবাসনসহ আন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান তা জনগণের প্রদত্ত করের টাকায়। সুইপার,পতিতা, কাজের মহিলা ,রিকশাচালক, দিনমজুরসহ সবার প্রদত্ত ট্যাক্স-ভ্যাটের টাকায় প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি, সেনাপ্রধান, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সব সরকারী কমর্চারী-কর্মকর্তা এবং সরকারি সহায়তাপ্রাপ্তরা বেতন-ভাতা ও বিবিধ সুবিধা পান।
সংবিধান, আইন, নৈতিকতার কোনো দিক থেকেই কোনো জনপ্রতিনিধি বা সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী মহারাজা বা লাটবাহাদুর নন। বেতন নেবেন জনগণের টাকায়, চাকরিতে যোগদানের সময় শপথ নেন সংবিধান সমুন্নত রাখার, অঙ্গীকার করেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কাজ করার; কিন্তু জনগণ স্যার না ডাকলে বা দু’হাত জোর করে না দাঁড়ালে রুষ্ট হবেন, জনগণকে অবহেলা ও তাচ্ছিল্য করবেন তা হতে পারে না। এ অবস্থা স্ববিরোধী। সুতরাং নিজেদেরকে জনগণের মনিব না ভেবে সেবক ভাবুন এবং সেই অনুযায়ী নিরন্তর কাজ করুন। তাহলে জনগণ আপনাদেরকে সব সময় শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখবেন। দেশ ও জাতির কল্যাণে এটা অত্যন্ত জরুরি।
খায়রুর আকরাম খান: ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: মতামত
[sharethis-inline-buttons]