রবিবার রাত ১০:৪০, ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ. ১৭ই নভেম্বর, ২০২৪ ইং

খুলাফায়ে রাশেদীন সম্পর্কে ইতিকথা

৯৫৪ বার পড়া হয়েছে
মন্তব্য ০ টি

খুলাফায় রাশেদিন এর শাব্দিক অর্থ ন্যায়পরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ, সঠিকভাবে পথনির্দেশপ্রাপ্ত খলিফ|। ইসলাম ধর্মের শেষ বাণীবাহক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সহচরদের মধ্যে চারজনকে খুলাফায়ে রাশেদিন বলা হয়। তারা মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ইসলামের নেতৃত্ব দেন। এই চারজন হলেন:

আবু বকর (রাঃ) (৬৩২-৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দ), উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) (প্রথম ওমর) (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ), উসমান ইবন আফ্‌ফান (রাঃ) (৬৪৪-৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দ), আলী ইবনে আবু তালিব(রাঃ) (৬৫৬-৬৬১ খ্রিষ্টাব্দ)। এছাড়া উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রাাঃ)কে অনেকে ইসলামের পঞ্চম খলিফা হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।

সহজ-সরলভাবে জীবনাতিপাত করাই ইসলামের নির্দেশনা।নীতিগতভাবে যেমন ইসলাম অতিরিক্ত জাকজমক ও আড়ম্বরতাকে সমর্থন করে না, তেমনি প্রায়োগিক ক্ষেত্রেও ইসলামে এর বাস্তব উদাহরণ ভুরি ভুরি বিদ্যমান। ইসলামের মূল প্রণেতা নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনধারায় নজর বুলালে এটা ধ্রুব সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়ে উঠে। আল্লাহর প্রিয় হাবীব ও উভয় জগতের বাদশা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর জীবনাচরণ ও জীবনধারা ছিল অতি সাধারণ। সর্বশ্রেষ্ঠ এ নবীর (স) সাহচর্যে এসে ইসলাম কবুল করার পরে সাহাবীগণ ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের অনেক মহান ব্যাক্তি মহানুভতার ভুরি ভুরি উদাহারন রেখে গেছেন মানবজাতির জন্যে।

আমরা জানি রাজা-বাদশাদের কোন অভাব থাকে না। অভাব অনটন তো তাদের ছুঁতেই পারে না। সিন্ধুকে থাকে কাড়ি কাড়ি টাকা। দামি আলমিরায় থরে থরে সাজানো থাকে হাজার রকম পোশাক। আর সুস্বাদু খাবার-দাবারে তো ঘর বোঝাই থাকে। দুনিয়ার রাজা-বাদশাদের ধারাই এমন। এর উল্টো হতে কখনো দেখিনি। কিন্তু আল্লাহর রাসূলের সাহাবিগণ সবকিছুই উল্টে-পাল্টে দিয়েছেন। তাদের দু’চোখের সামনে ছিল আখেরাত। তারা সংযম আর দারিদ্রের মধ্যেই নিজেদেরকে অভ্যস্থ করে তুলেছিলেন।এখানে ইসলামের স্বর্ণযুগের খলীফাদের অনন্যসাধারণ ১০টি অসাধারণ কাহিনী তুলে ধরার চেস্টা করব। ভুল হলে ক্ষমা মার্জনীয়। এটি ইসলামী ইতিহাসের সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্রে আলোচিত।

১।

ইসলামের প্রথম খলিফা সাহাবি আবু বকর (রা.)-এর পত্নীর একবার ইচ্ছে হলো কিছু মিষ্টি জাতীয় খাবর রান্না করে পরিবারের সবাইকে খাওয়াবেন। স্বীয় স্বামী খলিফাতুল মুসলিমীনের নিকট এ ইচ্ছা তিনি ব্যক্ত করলেন। খলিফা সাফ জবাব দিলেন, মিষ্টির জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা আমার কাছে নেই। তিনি খলিফার সাথে কথা আর না বাড়িয়ে সংসারের দৈনন্দিন খরচ থেকে অল্প অল্প করে রেখে মিষ্টি কেনার মতো পয়সা জমালেন। একদিন খলিফাকে তিনি আনন্দের সাথে সংবাদটি দিলেন। কিন্তু এবার খলিফা গম্ভীর হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাইতুল মালে খবর পাঠালেন। বাইতুল মালের লোক খলিফার বাড়িতে এসে হাজির হল। খলিফা পত্নী দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলেন, খলিফা তার সঞ্চিত অর্থ বায়তুল মালের লোকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। স্ত্রীর সঞ্চিত অর্থ বাইতুল মালে জমা দিয়ে খলিফা আবু বকর সিদ্দিক রা. বললেন, এই সঞ্চয়ের ঘটনায় প্রমাণ হলো যে, এ পরিমাণ অর্থ বায়তুল মাল থেকে না তুললেও আমার সংসারের খরচ চলে যাবে। অতিরিক্ত সম্পদ আমি কিছুতেই বাইতূল মাল থেকে গ্রহণ করতে পারি না।

কৃচ্ছ্রতা সাধন ও সাদাসিধে জীবনের এর চেয়ে বড় নজির আর কি হতে পারে?

২।

বর্ণিত আছে, প্রতিদিন ফজরের আগে খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা)মদীনার বাইরে একটি তাবুতে যেতেন। তিনি তাবুতে প্রবেশ করে সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটাতেন। আবু বকর (রা) যখন মারা যান তখন সাইয়্যিদিনা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন যে ঐ তাবুতে কে থাকে। তিনি সেখানে গিয়ে এক বৃদ্ধ মহিলাকে দেখতে পেলেন, যে বয়সের কারণে প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছে। উমর (রা) বৃদ্ধার কাছে তার সম্পর্কে জানতে চান। বৃদ্ধা উত্তর দেয়, ‘আমি এক বৃদ্ধা ,যার এই দুনিয়াতে কেউ নেই এবং আমি আমার ভেড়াসহ একা এই তাবুতে থাকি। প্রতিদিন মদীনা থেকে একটা লোক এখানে এসে আমার তাবু ঝাড়ু দিয়ে দেয়, খারার রান্না করে দেয়, ভেড়া থেকে দুধ দোহন করে দেয় এবং সেগুলোর যত্ন নেয়। তারপর চলে যায়। তার পরিচর্যা ছাড়া আমার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না।’ উমর (রা) প্রশ্ন করলেন,‘আপনি কী জানেন ঐ ব্যক্তি কে?’ ; সে বলল যে, ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। তিনি কখনোই বৃদ্ধার কাছে নিজের ব্যাপারে কিছু বলেননি। উমর (রা) তাকে বললেন, ‘তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ ( সা) এর খলিফা, আবু বকর সিদ্দিক (রা)।’

৩।

ইসলামী শাসনকালের লৌহমানব হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর খিলাফতকাল। তখন ইরানের একটি প্রদেশের শাসক ছিলেন হরমুজান। হরমুজান একদিকে যেমন অত্যাচারী অপরদিকে ঘোর ইসলাম বিরোধী। মুসলমানদের সাথে তার লড়াই হতো প্রায়ই। লড়াইয়ে পরাজিত হলেই তিনি বিভিন্ন শর্তে সন্ধী করতেন এবং নিজের রাজ্যে ফিরে যেতেন। কিন্তু এরপর আবার যখনই সুযোগ পেতেন মুসলমানদের ক্ষতি সাধন করেতেন।

শেষে খলীফা হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু আদেশ দিলেন, হরমুজানকে জীবন্ত ধরে এনে তাঁর মজলিসে হাজির করতে। ইতিমধ্যে এক যুদ্ধে হরমুজান মুসলমানদের হাতে বন্দী হলেন। খলীফার হুকুম মোতাবেক তাকে বেঁধে খলীফার দরবারে হাজির করা হলো।

খলীফা হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে লক্ষ্য করে বললেন,

“আপনি আমাদের সাথে বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, আর আপনার বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই আমাদের বারবার যুদ্ধ বিগ্রহে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। ফলে অসংখ্য মুসলিম সৈন্যকে অযথা প্রাণ দিতে হচ্ছে। তাদের অর্থ সম্পদ নষ্ট হয়েছে। অনেকে ঘরবাড়ি আপনি ধ্বংস করেছেন। নিরীহ অনেক লোকের উপর আপনি অন্যায়ভাবে অত্যাচার চালিয়েছেন। আপনাকে আর সুযোগ দেয়া যায় না। আপনার একমাত্র শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পূর্বে আপনার কোন কথা থাকলে বলতে পারেন।”

হরমুজান ছিলেন খুব সূক্ষবুদ্ধির লোক। সুযোগ পেয়ে তিনি একটি ফন্দী আঁটলেন। তিনি বললেন,

“মহানুভব খলীফাতুল মুসলিমিন, আমার বড়ই পিপাসা পেয়েছে, দয়া করে আমাকে একটু পানি পান করতে দিন।”

খলীফার নির্দেশে তাকে একটি পাত্রে পানি পান করতে দেয়া হল। সুচতুর হরমুজান পানির পাত্র হাতে নিয়ে তা পান না করে ভীতু ভীতু ভাব দেখাতে লাগলেন এবং ডানে বামে তাকাতে লাগলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, “কি হলো, আপনি পানি পান করছেন না কেন?” তিনি জবাব দিলেন,” আমিরুল মুমিনিন, আমার ভয় হচ্ছে যে, পানিটুকু পান করার আগেই আমাকে হত্যা করে ফেলা হয় কিনা?”

খলীফা হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “আপনি নির্ভয়ে পান করুন। হাতের পানি পান করার পূর্বে আপনাকে হত্যা করা হবে না। এ ব্যাপারে আপনাকে নিশ্চয়তা দিলাম।”

হরমুজান আমীরুল মুমিনিনের এ কথা শেষ হবার সাথে সাথেই হাতের পানির পাত্রটি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, আর বললেন,

“মহামান্য খলীফা, আপনি নিজেই বলেছেন, হাতের পানিটুকু পান করার আগে আমাকে হত্যা করবেন না। আমি পানি ফেলে দিয়েছি, সে পানি আর পান করবো না। ওয়াদা অনুযায়ী আপনিও আমাকে আর হত্যা করতে পারবেন না।”

হরমুজানের এ চাতুরীপূর্ণ কথা শুনে মুসলিম সৈনিকেরা খুব রেগে গিয়ে বললেন, ” আমীরুল মুমিনিন, আপনি অনুমতি দিন আমরা এখনই তার চাতুরীর সাধ মিটিয়ে দেই।তাকে এখনই হত্যা করে ফেলবো।”

কিন্তু খলীফা হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সকলকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “না তা হতে পারে না। মুসলমানের কথার মূল্য অনেক। সুতরাং যে কথা আমি বলে ফেলেছি, যেকোন মূল্যে আমি তা রক্ষা করবই ইনশা’আল্লাহ। যেহেতু আমি তাকে বলেছি, তার হাতের পানিটুকু পান করার পূর্বে তাকে আমি হত্যা করব না, আর সে যখন পানি পান করেনি সুতরাং, বন্দী হরমুজানকে হত্যা করা চলবে না।”হরমুজানকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, “যান। আপনি মুক্ত। আমার কথার খেলাফ আমি করবো না।”

কথার কি অদ্ভুত দাম ! ওয়াদা পালনের কি অপূর্ব নযীর। হরমুজান কল্পনাও করতে পারেননি যে, তিনি এত সহজে মুক্তি লাভ করতে পারবেন। খলীফা হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মহানুভবতা দেখে তিনি দারুণভাবে প্রভাবিত হলেন। তিনি ভাবলেন, এই যদি হয় ইসলামের আদর্শ তবে এর থেকে দূরে থাকা হবে আমার জন্যে চরম দুর্ভাগ্যজনক। ইসলামের অতুলনীয় আদর্শে মুগ্ধ হয়ে তিনি সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করে নিলেন।

এমনিভাবেই যুগে যুগে ইসলামের অতুলনীয় আদর্শে মুগ্ধ হয়ে অসংখ্য মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।

৪।

মোমের আলোয় কাজ করছিলেন খলিফা উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু । এমন সময় সেখানে আসলেন তার দুই আত্মীয় । খলিফা তাড়াতাড়ি ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলেন । অন্য আরেকটি মোমবাতি ধরিয়ে অতিথিদের বসতে দিয়ে তাদের খোজখবর নিলেন ।

কৌতুহল চাপতে না পেরে একজন জানতে চাইলেন , আমাদের দেখে কেন আপনি আগের মোমবাতি নেভালেন আর নতুন একটি জ্বালালেন ? খলিফা জবাব দিলেন : আগের মোমবাতি ছিল রাষ্ট্রের সম্পত্তি থেকে কেনা । তোমরা যেহেতু আমার আত্মীয় , তাই তোমাদের সাথে আমার ব্যক্তিগত অনেক আলাপ হবে । আমার নিজের কাজে জনগণের আমানত থেকে আমি কিছু খরচ করতে পারি না । তাহলে আল্লাহর দরবারে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে । তাই নিজের টাকায় কেনা মোমবাতিটি তোমাদের দেখে জ্বালালাম ।

এই জবাবে আত্মীয়রা হতভম্ব হলেন । তারা এসেছিলেন আত্মীয়তার খাতিরে বিশেষ কোন সুবিধা পাওয়া যায় কি না , সেই অনুরোধ করতে । কিন্ত্ত সামান্য মোমবাতি নিয়ে খলিফার এত বিবেচনা ও সতর্কতা দেখে নিজেদের প্রস্তাব জানাতে তারা আর সাহসই করলেন না ।

আরেকবার খলিফার কাছে এক লোক অবৈধ সুবিধা চায় । খলিফার সামনে রাখা কিছু কাঠে তখন আগুন জ্বলছিল। খলিফা বললেন , ঠিক আছে । তুমি এই আগুনের ভিতর তোমার হাত কিছু সময়ের জন্য রাখো ; তারপর তোমার অনুরোধ আমি বিবেচনা করবো । লোকটি ভয় পেয়ে বললো , হে খলিফা ; এই আগুনে হাত ঢুকালে আমার হাত তো জ্বলে যাবে । খলিফা বললেন , তুমি দুনিয়ার এই সামান্য আগুনকে ভয় পাচ্ছ অথচ আমাকে তুমি দোযখের অনন্ত আগুনের ভিতরে নিয়ে যেতে চাও ? তদবিরকারী নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে যায়।

৫।

খলিফা উমর (রা.) এর শাসনামলে মুসলিমরা যখন একটার পর

একটা রাজ্য জয় করে যাচ্ছিল, তখন একসময়

তারা জেরুজালেমে পৌঁছে। জেরুজালেম অবরোধ করে রাখে।

এই পরিস্থিতিতে জেরুজালেম বাসী বুঝতে পারছিল

না যে তারা কী করবে—যুদ্ধ নাকি আত্মসমর্পণ? তখন

তারা তাদের ধর্ম যাজকের কাছে যায়। ধর্মযাজক তাওরাত

ঘেঁটে বলে যে, ‘কেবল একজন ব্যক্তিই তোমাদের শহরকে জয়

করবে। তিনি হবেন শেষ নবীর সহচর। যদি সৈন্য বাহিনী সেই

ব্যক্তিরই পাঠানো হয়ে থাকে, তবে তোমাদের যুদ্ধ

করা বৃথা,কারণ তোমাদের পরাজয় সুনিশ্চিত।’ তখন

তারা যাজককে প্রশ্ন করল, কীভাবে বুঝব যে ইনিই সেই

ব্যক্তি কিনা। যাজক বলল, ‘তার পোশাকে ১৭

টা তালি থাকবে। যদি থাকে তাহলেই বুঝবে তিনি সেই

ব্যক্তি।’

এর সূত্র ধরেই জেরুজালেম বাসী শর্ত দেয় যে তারা কেবল

স্বয়ং খলিফা এলেই চুক্তি সাক্ষর করবে। সুদূর

মদীনা থেকে ১টি মাত্র গোলাম এবং একটি উট নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন মুসলিম জাহানের খলিফা উমর ফারুক (রা.);।উটটি আবার এত দুর্বল ছিল যে,একসাথে ২জন ব্যাক্তিকে বহন করতে পারত না।উমর (রা) তার দাসের

সাথে চুক্তি করেছিলেন যে,কিছুদূর তিনি উটে চরে যাবেন আর

দাস উটের রশি টানবে; আবার কিছু দূর দাস

উটে চরে যাবে আর খলিফা উমর (রা.) উটের রশি টানবেন!

যখন তিনি শহরে প্রবেশ করলেন

তিনি উটের রশি ধরে টানছিলেন আর দাস ছিল উটে চড়া!

তারপর আবার তার পোশাকটি ছিল তালিতে ভরা।

তাকে দেখে মুসলিম সেনারা লজ্জিত হলো। আমাদের খলিফা!

যাকে সবাই এত ভয় করে সে এই বেশে শহরে ঢুকলে মুসলিমদের

মান-সম্মান থাকে কই!

কিন্তু উনি আর কেউ নয়। স্বয়ং উমর ফারুক

যাকে দেখলে শয়তানও উলটা পথে হাঁটা ধরে। তিনি সৈন্যদের

তিরস্কার করে জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। বললেন:

‘আমরা এমন জাতি যাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না,

সম্মান ছিল না। আল্লাহ আমাদের ইসলামের

মাধ্যমে সম্মান দিয়েছেন। আমরা যদি ইসলামকে ছেড়ে অন্য

কোনো কিছুর মাধ্যমে সম্মান পেতে চাই তাহলে আল্লাহ

আমাদের আবার লাঞ্ছিত করবেন।’

তারপর তিনি যখন জেরুসালেমে প্রবেশ করলেন, তখন তো প্রথমে উটের পিঠে বসা দাসকেই খলিফা ভাবছিল সবাই।যখন উনাকে দেখিয়ে দেয়া হল,তখন তারা খলিফার শতছিন্ন কাপড় আর দাসের সাথে রাখা চুক্তির মূল্যায়ন দেখে বুঝে নিল, ইনিই সেই ব্যাক্তি। তারা চুক্তি সাক্ষর করল।

৬।

খলীফা হযরত উমর (রাঃ) তাঁর অধীনস্থ লোকদের মঙ্গলচিন্তায় এতটা উদ্বিগ্ন থাকতেন যে, তিনি রাতে ছদ্মবেশে মদীনা শহরে বেরিয়ে পড়তেন, নিজ চোখে এটা দেখার জন্য যে কার কোন সাহায্যের প্রয়োজন কিনা। একদা, রাতে প্রদক্ষিণের সময়, তিনি লক্ষ্য করলেন এক মহিলা একটি পাত্রে কিছু পাকাচ্ছিলেন যখন তার বাচ্চারা তার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদ ছিল। তিনি মহিলা থেকে জানতে পারলেন যে, বাচ্চারা দু’দিন যাবত ক্ষুধার্ত র‌য়েছে এবং পাত্র আগুনের উপড় রাখা হয়েছে কেবল তাদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। তিনি তৎক্ষণাৎ রাষ্ট্রীয় খাঞ্চাজিখানা/ ধনাগারে চলে যান এবং নিজে স্বয়ং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য বহন করে নিয়ে আসেন। পথিমধ্যে, তাঁর একজন ভৃত্য তাঁর নিকট থেকে সেই বোঝা নিতে চাইলে তিনি তাকে বাধা দিয়ে বলেনঃ “বিচারের দিনে তো তুমি আমার বোঝা বহন করতে পারবে না।”

মহিলাটি, যে পূর্বে হযরত উমর (রাঃ) কে দেখেনি, এতই সন্তুষ্ট হলেন যে, তিনি উচ্চস্বরে এই বলে তাঁর জন্য দোয়া করেন, “আল্লাহতা’লা উমরের পরিবর্তে আপনাকে খলিফা বানান”। এই কথা শুনে হযরত উমর (রাঃ) কাদঁতে শুরু করেন এবং কিছু না বলে সে স্থান ত্যাগ করেন।

৭।

আমীরুল মুমিনীন উমার রা. সাহাবী আমের বিন সায়ীদ রা. কে হিমসের (বর্তমানে সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত) শাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। সায়ীদ বিন আমের রা. ছিলেন অত্যন্ত আল্লাহভীরু, ইবাদতগুজার ও সৎ ব্যক্তি। শাসক হওয়ার পরও তিনি গরীবের জীবন যাপন করতেন।

কয়েক বছর পর। উমার রা. তাঁর খেলাফতের বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন সময় গিয়ে সাধারণ জনগণের খোঁজ-খবর নিতেন। এবং জনগণকে শাসক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন, শাসকের সামনেই। প্রয়োজনে সেখানেই সবার সামনে বিচার করতেন।

তো, উমার রা. হিমসে গেলেন। জনগণকে সায়ীদ বিন আমের রা. সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বলল, সবই ঠিক আছে, তিনি অত্যন্ত সৎ মানুষ, ভালো মানুষ, আল্লাহভীরু মানুষ। তবে চারটি অভ্যাস আছে তাঁর।

উমার রা. জানতে চাইলে, কী সেগুলো?

তারা জবাব দিল, প্রথমত, তিনি সকালে একটু দেরী করে (বাসা থেকে) বের হন।

উমার রা. বললেন, একটা হলো, দ্বিতীয়টা কী? উল্লেখ্য, উমার রা. এঁর কাছে দোররা থাকত, যা দিয়ে প্রয়োজনে তিনি শাসককে শাসাতেন।

বলা হলো, সপ্তাহে একদিন তিনি আমাদের সময় দেন না। (বাসায় থাকেন)

উমার রা.: তৃতীয়টা?

বলা হলো, রাতে তিনি দরজা খুলেন না, যতই আমরা দরজা নক করি না কেন।

উমার রা.: চতুর্থটা?

বলা হলো, বিধানসভায় বসে মাঝে মধ্যেই তিনি বেহুঁশ হয়ে যান।

উমার রা. এঁর চোখ টলমল করছিল। তিনি দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! সায়ীদ বিন আমেরের ব্যাপারে আমার ধারণাকে হতাশায় পরিণত করবে না। বললেন, সায়ীদ, দাঁড়ান। আপনার স্বপক্ষে জবাব দিন। এটা নির্দেশ এবং এখানে ইনসাফের বিচার হবে। প্রজাদের সামনেই।

সায়ীদ রা. দাঁড়ালেন, বললেন, বিষয়গুলো আমি গোপন রাখতে চেয়েছিলাম। আজ যখন তারা এ ব্যাপারে কথা বললই, তাহলে… (আমার জবাব)

A. তারা যে বলেছে আমি সকালে একটু দেরী করে বের হই। ঘটনা হলো, আমার স্ত্রী অসুস্থ। তাই আমি পরিবারের জন্য নাস্তা প্রস্তুত করি, এরপর সালাতুদ দোহা (চাশতের নামায) আদায় করে বের হই।

B. তারা বলেছে আমি রাতে সময় দেই না। আমি তাদের জন্য রেখেছি দিনকে, আর রাতকে রেখেছি রাবের জন্য। ভোর পর্যন্ত সালাত আদায় করি আর দোয়া করি।

C. তারা বলেছে, সপ্তাহে একদিন আমি বের হই না। সেদিন আমি কাপড় ধুই। (এক সেট জামা, তা ধুয়ে শুকাতেন)

D. আমি মুশরিক অবস্থায় খুবাইব বিন আদী রা.কে শহীদ করতে দেখেছি, অথচ তিনি ছিলেন মুসলিম, আমি তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসি নি। সেদিনের কথা মনে করতেই আমি বেহুশ হয়ে যাই।

উমার রা. এঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আপনার ব্যাপারে আমাকে হতাশ করেন নি।

সায়ীদ রা. বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! এরপর আর আমি শাসকের পদে থাকতে পারছি না। অত:পর তিনি বের হতে লাগলেন।

কিন্তু উমার রা. তাঁকে হিসাবের আগে থামালেন। তাঁর ব্যাপারে সকল হিসাব, ব্যক্তিগত ও প্রশাসনিক, এবং তাঁর শাসনকার্যের নথিপত্র আনালেন। সবই পেশ করা হলো। দেখা গেল, তিনি একটি দিরহাম বা একটি দিনারও নেন নি। যেভাবে প্রশাসনে ঢুকেছিলেন, সেভাবেই বের হলেন। একটি পাত্র, একটি চাদর আর একটি লাঠি নিয়ে!

৮।

একদিন হযরত উসমান (রা) নিকট এক ভিক্ষুক এল, লোকটি আগে হুজুর (স) এর কাছে গিয়েছিল, তিঁনি তাকে হযরত উসমানের কাছে পাঠিয়ে দেন। সে এসে শুনতে পেল, বাতিতে মোটা সলতে ব্যবহারের ফলে তেলের অপচয় হচ্ছে তাই উসমান (রা) নিজ স্ত্রী কে শাসাচ্ছেন।ভিক্ষুক ভাবল, এ কোন কঞ্জুসের কাছে এলাম, ও আমাকে কিছুই দিবে না।কিন্তু পরক্ষনে আবার ভাবল, আল্লাহর নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন পাঠিয়েছেন, তখন একটা হাঁক দিয়েই দেখি না?

ভিক্ষুক হাক দিয়ে ভিক্ষা চাইল, জানাল তাকে আল্লাহর নবী পাঠিয়েছেন। হযরত উসমান (রা) দিরহাম ভর্তি একটি থলে এনে তার হাতে তুলে দিলেন, কত চাই, কি প্রয়োজন কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। থলেতে তিন হাজার দিরহাম ছিল। ভিক্ষুক বিস্মিত হয়ে বলল, একটা কথা জিগেস করি? উসমান (রা) বললেন, বলো। ভিক্ষুক বলল আপনি আমাকে এতো দিয়েছেন যে আমি সারা জীবন বসে বসে খেয়ে যেতে পারব, অথচ বাতিতে মোটা সলতে দেয়ার কারনে আপনি স্ত্রীকে শাসালেন, ব্যাপারটা কী? বুঝলাম না। হযরত উসমান রাঃ বললেন, ওই খরচটা ছিল নিজের জন্য যা পাই পাই হিসাব করে ব্যয় করতে হয়। আর এটা হলো আল্লাহর জন্য আর এটি যত বেশি দেওয়া যায় ততই মঙ্গল।

৯।

৬৫৮ সাল। হযরত আলী (রা) খলীফার আসনে। তাঁর ঢাল চুরি গেল। চুরি করল একজন ইহুদী। খলীফা আলী কাযীর বিচার প্রার্থী হলেন। কাযী আহবান করলেন দু’পক্ষকেই। ইহুদি খলিফার অভিযোগ অস্বীকার করল। কাযী খলীফার কাছে সাক্ষী চাইলেন। খলিফা হাজির করলেন তাঁর এক ছেলেকে এবং চাকরকে। কিন্তু আইনের চোখে এ ধরণের সাক্ষী অচল। কাযী খলিফার অভিযোগ নাকচ করে দিলেন। মুসলিম জাহানের খলিফা হয়েও কোন বিশেষ বিবেচনা তিনি পেলেন না।ইসলামী আইনের চোখে শত্রু-মিত্র সব সমান। ইহুদি বিচার দেখে অবাক হল। অবাক বিস্ময়ে সে বলে উঠল, “অপূর্ব এই বিচার, ধন্য সেই বিধান যা খলীফাকে পর্যন্ত খাতির করে না,আর ধন্য সেই নবী যার প্ররণায় এরূপ মহৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবনের সৃষ্টি হতে পারে। হে খলিফাতুল মুসলিমিন, ঢালটি সত্যিই আপনার,আমিই তা চুরি করেছিলাম। এই নিন আপনার ঢাল। শুধু ঢাল নয়, তার সাথে আমার জান- মাল,আমার সবকিছু ইসলামের খেদমতে পেশ করলাম”। সত্য তার আপন মহিমায় এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে।

১০।

দানশীলতার ব্যাপারে রাসুলের অন্যতম সাহাবী ও ইসলামী রাষ্ট্রের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.) ছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের উদারহস্ত।

তিনি ছিলেন তদানীন্তন আরবের সর্বাধিক ধনাঢ্য ব্যক্তি। তার দান-খয়রাতের এক-একটি ঘটনাও ছিল রুপকথার মত।

একদা জনৈক অভাবগ্রস্থ ব্যক্তি সাহায্যের প্রত্যাশায় হযরত উসমান (রা.) এর শরনাপন্ন হল। লোকটি যখন হযরত উসমান (রা.)-এর বাড়ীর সন্নিকটে পৌছল সে দেখল তিনি নিবিষ্টচিত্তে মাটি হতে সরিষার দানা খুটিয়ে খুটিয়ে তুলছিলেন। এই দৃশ্য দেখে আগন্তুক লো্কটি ভীষণভাবে হতাশাগ্রস্ত হল। সে হযরত উসমান (রা.)-কে এক কৃপণ ব্যক্তি ভেবে ফিরে যেতে উদ্যত হল।

সহসা হযরত উসমান (রা.) আগন্তুক ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন। তিনি তাকে কাছে ডেকে এভাবে ফিরে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। লোকটি সবকথা আদ্যপান্ত খুলে বলল। হযরত উসমান (রা.) তার কথা শুনে একটু মুচকি হাসলেন।

ঘটনাক্রমে এই সময় পণ্য-সামগ্রী বোঝাই সাতটি উট এসে সেখানে থামল। হযরত উসমান (রা.) উটসহ সমগ্র পণ্য-সামগ্রীই আগন্তুককে দান করে দিলেন। এই ঘটনায় লোকটি একেবারে হতবাক হয়ে গেল এবং উসমান (রা.) সম্পর্কে তার বিরুপ ধারণার জন্য বারবার অনুশোচনা প্রকাশ করতে লাগল।
.
.
.
তথ্যসূত্র: (খেলাফতে রাশেদা-পৃষ্ঠা নং ১৪৫; টীকা নং -০১)

গোলাম কিবরিয়া অধ্যায়নরত অনার্স এবং লেখক ও প্রাবন্ধিক।

 

Some text

ক্যাটাগরি: বিবিধ

[sharethis-inline-buttons]

Leave a Reply

আমি প্রবাসী অ্যাপস দিয়ে ভ্যাকসিন…

লঞ্চে যৌন হয়রানি