সরাইলের গ্রে-হাউন্ড কুকুর স্থানীয়ভাবে ‘সরাইলের কুকুর’ নামে সুপরিচিত। এই কুকুর চেহারা-আকৃতি-আচার আচরণে সব দিক দিয়েই অন্যান্য কুকুরের চেয়ে একবারেই আলাদা। এইসব কুকুরের মুখটা লম্বাটে ধরনের হয়, অনেকটাই শেয়ালের মত। এদের পায়ের থাবাগুলো বাঘের মত হয়। এদের গায়ে বাঘের মত ডোরাকাটা দাগ আছে। এদের কান ও লেজ লম্বা। আর এইসব কুকুরের লেজ থাকে নীচের দিকে। এইসব কুকুর চিকন ও লম্বাটে হয়। এরা খুব হিংস্র ও নজর তীক্ষ। এরা খুব শিকারী জাতের। শিকার এদের রক্ত মিশে আছে।
সরাইলের কুকুরের মূল ক্ষমতা কিন্তু তার ঘ্রাণশক্তিতে নয় বরং তার দৃষ্টিশক্তিতে। এরা খুব বেশী দৌঁড়াতে পারে। প্রতি ঘন্টায় একটি কুকুর ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌঁড়াতে পারে। ইউরোপের কিছু দেশে গ্রে হাউন্ড কুকুর দিয়ে রেইস খেলা হয়ে থাকে। এই জাতের পুরুষ কুকুরের উচ্চতা হয় ২৫-২৮ ইঞ্চি এবং ওজন ২৩-৩৩ কেজি আর নারী কুকুরের উচ্চতা হয় ২৩-২৬ ইঞ্চি এবং ওজন ১৮-২৮ কেজি। এই কুকুরের রং দুই ধর কারণের হয় বাদামী-সাদা ও সাদা-কালো। এই কুকুর সাধারণ কুকুর থেকে বেশী দীর্ঘায়ু হয়ে থাকে। এই কুকুর গড়ে ৮-১৪ বছর বাঁচে।
সরাইলের কুকুরের বিশেষত্ব হল, এরা সাধারণ কুকুরের চেয় অধিক ক্ষিপ্র, কষ্ট সহিঞ্চু, শারিরীক গঠন একটু হালকা-পাতলা। ক্ষিপ্রতার কারণে খরগোশ, শিয়াল, বনবিড়াল,বাঘডাস শিকারে এরা বেজায় পারদর্শী। তাছাড়া, সাধারণ মানুষ, চোর কিংবা ডাকাতরা একটু বেশিই ভয় পায় এই কুকুরকে। এইসব কুকুরের আদিবাসী ইউরোপ। প্রায় দুই’শ বছর আগে তদানীন্তর সরাইল পরগনার জমিদার দেওয়ান মজতুবা আলী একজন ইংরেজ সাহেবের নিকট থেকে হাতির বিনিময়ে এই বিশেষ জাতের কুকুর সংগ্রহ করেন। দেওয়ানরা এইসব কুকুর গুলো লালন-পালন করত। তখন এইগুলো ছিল দেওয়ান বাড়ীর শোভা। কুকুরগুলো দেওয়ান বাড়িতে অনেকটাই প্রহরীর মতই কাজ করত। জনশ্রুতিতে আছে, কুকুরের সাথে শেয়ালের সংমিশ্রনে যে প্রজাতি তৈরী হয় তাই সরাইলের কুকুর। এজন্য কুকুরের মুখায়ব শেয়ালের মত।
বলা হয়, জমিদার দেওয়ানের এই কুকুর একসময় হারিয়ে যায় বনে। বেশ কিছু দিন পরে কুকুরটি ফিরে আসে গর্ভবতী হয়ে। বাচ্চা প্রসব করার পরে দেখা গেল এর সাথে বাঘের বেশ মিল। ধারণা করা হয়, বাঘের সাথে মিলনে এই প্রজাতির উৎপন্ন। সরাইলের প্রতিটি বাড়িতে ছিল এই কুকুরর আনাগোনা। নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই লোকজন এগুলো পুষতেন। আর যেই বাড়িতে এইসব কুকুর থাকতো, ঐ বাড়িতে রাতে তো বটেই, দিনের বেলায়ও অপরিচিত লোক প্রবেশ করতে পারতো না। প্রতিটি কুকুর বিশ্বস্ততার সাথে মালিকের বাড়ি পাহারা দিত। আশির দশক পর্যন্ত সরাইল সমৃদ্ধ ছিল এই গ্রে-হাউন্ড কুকুরে। বিখ্যাত এই কুকুর পরিণত হয়েছিল এলাকার ঐতিহ্য।
সরাইলে নিয়মিত এইসব গ্রে-হাউন্ড কুকুরের প্রদর্শনী হতো। প্রদর্শনীর বিচারকের দৃষ্টিতে যার কুকুর সবদিক দিয়ে ভাল লাগত, তাকে দেওয়া হত সেরা পুরস্কার। তখন ছিল কুকুর সংরক্ষণাগার কেন্দ্র। ১৯৮৩ সাল সরকারীভাবে হাউন্ড কুকুর রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখনই ৩২ হাজার টাকা ব্যয় করে সরাইল ৪ কক্ষ বিশিষ্ট কুকুর সংরক্ষণাগার কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দু’তিন বছরের মধ্যেই এটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এই কুকুর পালন করেন বিত্তশালীরা। প্রতিদিন দুই-আড়াই কেজি খাদ্য দিতে হয় একটি পুর্ণবয়স্ক কুকুরকে। ড. শাহজাহান ঠাকুর নামে একজন গবেষক তাঁর গবেষণায় প্রমাণ করেছেন গ্রে-হাউন্ড কুকুর সরাইলের ঐতিহ্যের গুরুত্বপুর্ণ অংশ। সরাইলের কুকুর বর্তমান অস্তিত্বের হুমকিতে আছে।
এলাকার কয়েকটি বাড়িতে দেখা মেলে এইসব কুকুরের। সারা দেশে খাঁটি সরাইলের কুকুর প্রায় হাতেগোনা। এক সময় সরাইলের কুকুর পালন করত স্থানীয় বেশ কিছু পরিবার। কিন্তু পারিবারিক এই ব্যবসা থেকে সরে এসেছেন অনেকেই। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে উপমহাদেশখ্যাত সরাইলের এই বিরল প্রজাতির কুকুরের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব। বর্তমানে ৩ থেকে ৫ মাসের একটি বাচ্চা কুকুর ২০-২৫ হাজার টাকা আর বড় কুকুরের দাম ৬০-৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয় বলে জানা যায়।
সরাইলের ইতিহাস-ঐতিহের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিরল প্রজাতির গ্রে-হাউন্ড কুকুরের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এমনটাই আশা করছেন সরাইলের সাধারণ মানুষ। সরাইলের এই ঐতিহ্য রক্ষা করতে সরকারী ভাবে একটি প্রজনন কেন্দ্র করার জোর দাবী এলাকাবাসীর।
শেখ মোঃ ইব্রাহীম : সহসম্পাদক, দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: খবর, নাগরিক সাংবাদিকতা
[sharethis-inline-buttons]