আজকাল অনেকেই পাকিস্তানকে ফাকিস্তান বললে ব্যাথা পান, কষ্ট পান। যুক্তি দেন, ইন্ডিয়াকে যদি রেন্ডিয়া বলা কটূক্তি হয়, তাহলে পাকিস্তানকে ফাকিস্তান বলা কেন কটূক্তি হবে না। এই যুক্তি দেওয়ার দলে যেমন যুক্তিতর্কের ভালো মানুষ আছে, ঠিক তেমনি হঠাৎ হঠাৎ ল্যাঞ্জা উঁকি দেওয়া নধর ছাগ কিংবা শুষিল ছাগও আছেন। যুক্তিতর্ক দেখতে দেখতে মনে হলো কিছু বলা উচিৎ!
উর্দুতে বাংলার মত ‘প’ অক্ষরের উচ্চারণে কোন শব্দ নাই। তাই আমরা যেটাকে প উচ্চারণ করি, সেটাকে পাকিস্তানীরা ফ উচ্চারণ করে। সুতরাং পাকিস্তানীরা যদি উর্দু ব্যাকরণ মেনে তাদের দেশের নাম উচ্চারণ করে, তাহলে তাদের উচ্চারণ করতে হবে ‘ফাকিস্তান।‘ প্রথম এভাবে ব্যাকরণসম্মত উচ্চারণ করেছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, তবে তার এই শব্দটা উচ্চারণের প্রেক্ষাপট ছিল আলাদা। কাজী নজরুল ছিল ভারতবর্ষের কবি, তার সৃষ্টিকর্মের সময়ে আলাদা আলাদা কোন রাষ্ট্রের বাঁধাধরা সীমাবদ্ধতা ছিল না। কিন্তু চল্লিশের দশকের ওই সময়টায় পাকিস্তানের জিগির শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর সারাজীবন মানুষের কথা বলে যাওয়া মানবতার কবি নজরুল সহজেই বুঝে গিয়েছিলেন, ভারতবর্ষ ভেঙ্গে স্রেফ ধর্মের ভিত্তিতে মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই জিগির তুলে জোড়াতালি দিয়ে পাকিস্তান নামের যে কারাগারটা তৈরি হচ্ছে, তা ডেকে আনবে লক্ষ লক্ষ মানুষের অপরিসীম দুর্দশা আর মৃত্যু!
অতএব সমর্থন দূরের কথা, তিনি সরাসরি বিরোধিতা করেছিলেন পাকিস্তানের। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ পাকিস্তানবাদকে আক্রমণ করে তৎকালীন ‘নবযুগ’ পত্রিকায় তীব্র ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় তিনি প্রথমবারের মত উচ্চারণ করেছিলেন ‘ফাকিস্তান’ শব্দটা।তাই শুরুতেই বলে নেই আপনারা যারা পাকিস্তানকে ফাকিস্তান উচ্চারণ করতে দেখলে ছুরি-চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসেন, তারা অনুগ্রহ করে জেনে রাখুন, কেউ যদি ব্যাকরণের যুক্তিতে ফাকিস্তান উচ্চারণ করে, তাহলে সে কোনভাবেই কটূক্তি করেনি। কেউ যদি পাকিস্তানবাদ নামের এই নির্লজ্জ জঘন্য নোংরা মতাদর্শের বিরুদ্ধে কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসামান্য প্রতিবাদের স্মৃতি স্মরণ করে ফাকিস্তান উচ্চারণ করে, তাহলে সে কোনভাবেই ভুল কিংবা কটূক্তি করেনি। বরং সেই-ই সবচেয়ে শুদ্ধ এবং ব্যাকরণসম্মত সঠিক উচ্চারণ করেছেন।
এখন আসি আমাদের সীমাবদ্ধতা ও চিন্তার সংকীর্ণতার ব্যাপারে। আমাদের প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে আমরা পাকিস্তান নামের পৃথিবীর বৃহত্তম শিটহোলটা থেকে আলাদা হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে পঁচাত্তরের পর থেকে মাঝখানে কয়েকটা বছর বাদে গত ৪৩ বছর ধরে অবাধ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উগ্র ধর্মান্ধতা আর ধর্মীয় মৌলবাদের চাষ হওয়ায় আমাদের দেশে পালে পালে বেড়ে উঠেছে ভয়ংকর হিন্দুবিদ্বেষ লালনকারী উগ্র মৌলবাদী ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠী। এখানে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের কথা না এনে মোটা দাগে হিন্দুবিদ্বেষের কথাটা আনলাম এই কারণে যে, আমাদের দেশে বাচ্চাদের ব্রেনওয়াশের শুরুটা হয়ই কালো পিপড়া মুসলমান আর লাল পিপড়া হিন্দু-এইভাবে! একদম ছোট থেকেই আমাদের বাচ্চাগুলোকে শেখানো হয় লাল পিপড়া হিন্দু বলে কামড়ায়, তাই ব্যাথা লাগে, কালো পিপড়া মুসলিম বলে কামড়ায় না, তাই ভালো। সুতরাং যুগের পর যুগ ধরে এই দেশে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দুর্ভাগা জনগোষ্ঠী এইভাবে ছোট থেকেই ভারতকে বিশেষ করে হিন্দুদের ঘৃণা করার শিক্ষা পায়, মালাউন বলে গালি দেওয়ার শিক্ষা পায়। উল্টোটাও যে হয় না, তা না। কিন্তু মূল দাগে এটাই প্রথম এবং সবচেয়ে ভয়ংকর ব্রেনওয়াশিং।
তারপর বড় হয়ে এরা এই ঘৃণা আরো বড় স্কেলে চাষাবাদ করার সুযোগ পায়, নিজের ধর্মবিশ্বাসের বাইরে পৃথিবীর বাকি সকল বিশ্বাসকে পায়ে দলে গালি দিয়ে নিজের ধর্মবিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা দেয়, বাকি ধর্মবিশ্বাসী এবং ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষকে কুপিয়ে জবাই করে বেহেশতে যেতে চায় ( অথচ পৃথিবীর প্রত্যেক ধর্মগ্রন্থেই এটা মহাপাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে), সংকীর্ণ, খুবই নিম্নস্তরের দৃষ্টিভঙ্গি ছোটবেলা থেকে লালনের শিক্ষা পাওয়ায় নিজেদের জ্ঞানের বাইরে, চেনাজানা দুনিয়ার বাইরে সবকিছুকেই ঘৃণার পাত্র বানিয়ে ফেলে খুব সহজে, নিজের অজান্তেই।
এই ধর্মান্ধ মৌলবাদী ফ্রাংকেস্টাইনরা সাকিবের পেইজে গিয়ে শিশিরকে বোরকা পড়ার, পর্দা করার তালিম দেয়, আলাইনাকে নিয়ে নোংরা মন্তব্য করে, তামিমের স্ত্রীকে রাতের বেলা ফোন দিয়ে নোংরা করা বলে, নাসিরের বোনের সাথে ছবির নীচে জঘন্য মন্তব্য করে, তাহসানের ডিভোর্সের সব দোষ মিথিলার উপর চাপিয়ে তাকে গালাগালি করে, জাফর ইকবাল স্যার কিভাবে বেঁচে গেলেন এটা নিয়ে আফসোস করে, তাকে কুপিয়ে বেহেশতে যেতে চায়, স্টিফেন হকিংকে এইবার সব হিসাব সুদে আসলে দিতে হবে বলে টিটকারী করে, মরার পর নরকে যাবে বলে ৩০০ টাকার ষ্ট্যাম্পে সাইন দিয়ে দেয়, বিমান কেন নারী চালাবে বলে প্রতিবাদ জানায়, মৃত্যুর আগ মুহুর্তেও ১০ জন যাত্রীর জীবন বাঁচানো সদ্য প্রয়াত নারী পাইলট পৃথুলা রশিদ আসলে যৌনকর্ম করছিল বলেই বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ মতামত দেয়। নানা চেহারা নানা বেশে থাকলেও এরাই ঘুরেফিরে এই ভয়ংকর ঘৃণার চাষাবাদের ডামাডোলের নেতৃত্ব দেয়, এরাই বর্তমানে আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষের প্রতিনিধি।
এতো এতো অসাধারণ কাজের সাথে এরা আরো একটা কাজ করে। সেটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক নানা পেইজে, পোষ্টে গিয়ে গণহারে বিদেশী দল, ক্রিকেটারদের গালাগালি করা। তারই একটা অংশ হচ্ছে নাম বিকৃত করা। বেশিরভাগ ধর্মান্ধ মানুষগুলোর ছোটবেলা থেকে ব্রেনওয়াশে প্রবল হিন্দুবিদ্বেষ ঢুকিয়ে দেওয়ায় এই মানুষগুলো ভারতকে রেন্ডিয়া এবং ভারতীয়দের মালাউন ডাকাটা মোটামুটি নিজেদের জন্মগত অধিকার হিসেবে ধরে নিয়েছে। এমনকি এই কয়েক দিন আগ পর্যন্ত ভারতকে রেন্ডিয়া আর হিন্দুদের মালাউন ডাকাটা আর দশটা বাংলা শব্দের মত স্বাভাবিক ছিল।
সমস্যাটা শুরু হয়েছে মূলত ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ক্রিকেটে ভালো খেলতে শুরু করার পর। ফাকিস্তানী শব্দটা ব্যবহার ব্লগস্ফিয়ারে আগে থেকেই ছিল, কিন্তু ২০১৩ সালে রাজাকারের ফাঁসীর দাবীতে গণজাগরণের পর যখন থেকে একাত্তরের পাকিস্তানের নির্লজ্জতম পৈশাচিক ভূমিকার কথা যখন তরুণদের মাঝে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, ফাকিস্তান শব্দের ব্যবহারটা ব্লগস্ফিয়ারে আগে থেকেই ছিল, কিন্তু ২০১৩ সালে রাজাকারের ফাঁসীর দাবীতে গণজাগরণের পর যখন থেকে একাত্তরের পাকিস্তানের নির্লজ্জতম পৈশাচিক ভূমিকার কথা যখন তরুণদের মাঝে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, ফাকিস্তান শব্দের ব্যবহারটা অনেক বেশি বেড়ে যায়। কারণটাও খুবই স্বাভাবিক, পাকিস্তানীদের বীভৎসতা আর নির্মমতার ইতিহাস জানার পর কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে রাগ সংবরণ প্রচন্ড কঠিন, আর যেখানে পাকিস্তান নামের ভেতরেই মিডল ফিঙ্গার দেখানোর এতো চমৎকার একটা সুযোগ আছে, সেখানে কেন ছেলেমেয়েরা সেটা মিস করবে?
ব্যস, এতোদিন পর বাংলার আপামর ছাগুকুল একটা সহায় পায়। নধর ছাগপাল যুক্তি দিতে শুরু করে, “এই যে দেখো তোমরা একটা মুসলিম দেশের নাম বিকৃত করছো, তাহলে আমরা ভারতকে রেন্ডিয়া ডাকলে দোষ কোথায়?” শুষিল ছাগপাল একটু কৌশলে খেলে, “দেখুন, আমরা যদি রেন্ডিয়া গালির ব্যবহার থামাতে চাই, সবার আগে আমাদের ফাকিস্তানকে পাকিস্তান উচ্চারণ করতে হবে। সবার জন্য সমান নীতি।“ ওদিকে শান্তিকামী গান্ধীবাদী ছাগপালের হিসেবটা আবার আলাদা, “নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে কেন কোন দেশের নাম বিকৃত করতেই হবে আমাদের? আমরা কি পারি না এই ঘৃণার চাষাবাদ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখে দেশের সবাই মিলে(ছাগপালসহ) ভালো থাকতে?”
মাঝখানে আরেক প্রজাতির ছাগলের উদ্ভব হয়েছিল যারা ভারতে অনেক রেপ হয় বোঝাতে রেপ+ইন্ডিয়া= রেপিন্ডীয়া>রেন্ডীয়া এই সমীকরণ বের করেছিল। তারপর যখন আমাদের দেশে একটার পর একটা বাসে ধর্ষণ, কয়েক মাস বয়সী থেকে দুই, তিন, চার, পাঁচ বছর বয়সী শিশু ধর্ষণ, ৬০ বছরের বৃদ্ধা ধর্ষণের মত অগুনতি ধর্ষণের ঘটনা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লো, তখন হঠাৎ করেই এই প্রজাতি ছাগুরা কিভাবে যেন কোন গর্তে লুকিয়ে গেল। এদের মিস করি অনেক, খুবই রেয়ার চিড়িয়া ছিল এরা।
মজার ব্যাপারটা হচ্ছে এই যুগান্তকারী সব যুক্তি কিন্তু আসতে শুরু করলো রাজাকারের ফাঁসীর দাবীতে গণজাগরণের পর, এদেশের তরুণ-তরুণীরা যখন আরো আগ্রহ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানছে, যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে চলা মিথ্যাচার ও প্রোপ্যাগান্ডার জবাব দিচ্ছে, জীবনে প্রথমবারের মত নিজের রক্তাক্ত জন্মভূমির ইতিহাস জেনে পাকিস্তান নামক জন্মশত্রুর মুখের উপর থুথু ফেলে ঘৃণা করার মত জন্মগত দায়িত্ব পালন করছে, ঠিক তখন এই বাহারী যুক্তির পসরা সাজিয়ে বসলো এদেশীয় পাকিপ্রেমীরা। অথচ ১৯৭৫ সালের পর থেকে যে রাষ্ট্রীয় মদদে এই দেশে ধর্মান্ধতার চাষ হয়েছে, প্রবল হিন্দু বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, ইন্ডিয়াকে রেন্ডিয়া আর ভারতীয়-হিন্দু-এমনকি এদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল মানুষকে মালাউন ডাকা হয়েছে, সেসব নিয়ে এই চিন্তাশীল ছাগপাল কখনো কোন কথা বলে নাই। অথচ আজকে পাকিস্তানকে ঘৃণা করার কথা আসলেই তারা এর মধ্যে ঘৃণার চাষাবাদ খুঁজে পায়, রেন্ডিয়ার পক্ষে যুক্তি দিতে ফাকিস্তান টেনে আনে। কারণটা স্রেফ একটাইঃ প্রজন্মের পর প্রজন্ম এরা পাকিস্তানকে মুসলিম ভাই হিসেবে জেনে আসছে, তাদের সত্যিকারের জন্মভূমি জেনে আসছে, তাদের কাছে স্বাধীনতা দিবস ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ না, ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট।
আপনাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা ছাগপালের একজন না হয়েও বিশ্বাস করেন, আমাদের সমানভাবে বিচার করা উচিৎ সবকিছু, কোন দেশের নামই বিকৃত করা উচিৎ না এবং এই “কোন দেশের” তালিকায় পাকিস্তানকেও রাখা উচিৎ। কারণ আমরা যদি নাম বিকৃত করি ওদের, তাহলে ওরাও আমাদের দেশের নাম কাংলাদেশ বা আরো বাজে কোন বিকৃত করে ডাকবে। আপনাদের এই চিন্তাভাবনায় ৯৯ ভাগই সঠিক, এর সাথে আমি একমত। আসলেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের নাম খারাপ হচ্ছে এই উগ্র ফ্যানাটিকদের বাড়াবাড়ির কারণে এবং ভিনদেশের উগ্র ফ্যানাটিকেরা আমাদের দেশের নাম বিকৃত করার সুযোগ পায় যখন তারা আমাদের কাউকে তাদের দেশের নাম বিকৃত করতে দেখে। অস্বীকার করা কোন উপায় বা যুক্তি নাই।
কিন্তু আমার আপত্তি স্রেফ এক পার্সেন্টে! সেটা হচ্ছে পাকিস্তান। আজও, ৪৭ বছর পরেও, পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে-চায়ের আড্ডায়-সেলুনে-কসাইয়ের দোকানে-টেলিভিশন চ্যানেলে- বন্ধুদের আড্ডায়-পারিবারিক বৈঠকে-রাষ্ট্রীয় সভাতে, পাকিস্তানের প্রত্যেক কোণায় এবং প্রত্যেকটা স্থানে বাংলাদেশ নামের এই দেশটার পরিচয় একাত্তরে ভারতের সাথে হাত মিলিয়ে গাদ্দারী করে পাকিস্তান ভাঙা বেইমান হিসেবে। হ্যাঁ, ঠিক এই জায়গাটাতে এসে আপনারা যারা গুটিকয়েক পাকিস্তানীর একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে কথা বলা এবং পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ বলে বিশেষজ্ঞ মতামতকে সামনে এনে ”দেখেন ভাই পাকিস্তানীরা কত ভালু, তারা তাদের দোষ স্বীকার করে আবার মিলে যেতে চায়” টাইপের বয়ান দেবেন বলে ঠিক করেছেন, তারা অনুগ্রহ করে হামিদ মীরের ইতিহাসটা জেনে আসুন। ইনাকে প্রথম আলো ভালো পাকিস্তানী হিসেবে পরিচয় করানোর চেষ্টা করেছে গত এক যুগ ধরে, কিন্তু ইনি মুক্তিযুদ্ধকালে ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলায় তার বাবাকে দেওয়া পুরষ্কার গ্রহণ করেও আবার ফিরিয়ে দিয়ে প্রথম আলোসহ এই দেশের সকল পাকিপ্রেমীদের গালে বিরাশি শিক্কার চড় মেরে বুঝিয়ে দিয়েছেন ভালো পাকিস্তানী বলতে কিছু নাই। কেন উনি পুরষ্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন জানেন? কারণ তার মনে হয়েছে তার বাবা ভুল করেছিলেন, এই পুরষ্কার তার জাতির জন্য অপমানজনক!
জ্বি ভাই, তার জাতি মানে পাকিস্তান জাতির জন্য অপমানজনক। কেন অপমানজনক? আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে, পাকিস্তান একাত্তরে গণহত্যা চালিয়েছে, তাই এই সাবজেক্টটা তাদের জন্য অপমানজনক। হা হা হা, না ভাই, একাত্তরের এই গণহত্যা পাকিস্তানের জন্য অপমানজনক, কারণ পাকিস্তান আজও, এই ৪৭ বছর পরেও পৃথিবীর অন্যতম পৈশাচিক গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া তো দূরে থাক, একটা সেকেন্ডের জন্যও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করেনি যে তারা গণহত্যা চালিয়েছে, স্বীকার করেনি যে তারা ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছে, চার থেকে সাড়ে ছয় লাখ নিরীহ নিরপরাধ নারীকে ধর্ষণ-নির্যাতন ও তাদের অনেককে হত্যা করেছে, স্বীকার করে নাই যে তারা ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটারের একটা
জ্বি ভাই, তার জাতি মানে পাকিস্তান জাতির জন্য অপমানজনক। কেন অপমানজনক? আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে, পাকিস্তান একাত্তরে গণহত্যা চালিয়েছে, তাই এই সাবজেক্টটা তাদের জন্য অপমানজনক। হা হা হা, না ভাই, একাত্তরের এই গণহত্যার সময় পাকিস্তান দেশ পুরোপুরি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে এবং আজ পর্যন্ত একটা টাকা ক্ষতিপুরণ দেয় নাই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যেক পাকিস্তানী এবং পাকিস্তান জাতির কাছে অপমানজনক, কারণ এই যুদ্ধে পরাজিত হয়েই পৃথিবীর একমাত্র পাবলিক সারেন্ডারে সই করতে বাধ্য হয়েছিল, সারা দুনিয়ার সামনে তারা যখন নাকে খত দিয়ে কানে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে রেসকর্স ময়দানে এসে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিল, তখন তাদের ঘাড়ের উপর পা দিয়ে একটা দেশ মাথা তুলে আত্মপ্রকাশ করেছিল এই পৃথিবীর মানচিত্রে! ঠিক এই কারণে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ প্রত্যেক পাকিস্তানীর কাছে পরম অপমানের আর ভয়ংকর লজ্জার। তারা চাইলেও জাপান-জার্মানী-তুরস্কের মত নিজেদের ভুল স্বীকার করে রাষ্ট্রীয় ও জাতিগতভাবে ক্ষমা চেয়ে নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মগুলোকে গণহত্যাকারীর অপবাদ থেকে মুক্ত করতে পারতো, কিন্তু সেটা করলে তারা আর পাকিস্তানী কেন?
তো এহেন পাকিস্তান এবং পাকিস্তানী জাতির সাথে যখন আপনি শুধু ভারত না, পৃথিবীর বাকি সকল দেশকে একই পাল্লায় তুলবেন, একইভাবে মাপবেন, একই আচরণ করতে বলবেন, তখন আমি প্রবল বিরক্ত ও ক্ষুব্দ হবো। আপনাকে বুঝতে হবে পাকিস্তানের সাথে ভারত কিংবা পৃথিবীর অন্য সকল রাষ্ট্রের বিশাল একটা পার্থক্য আছে। অনেক চওড়া বিস্তৃত একটা বর্ডার আছে পাকিস্তানের সাথে বাকি রাষ্ট্রগুলোর ভেতরে। সেই বর্ডারটা কিসের জানেন? ৩০ লাখ বাঙ্গালী, আমার বাবা-মা, ভাই-বোন,স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-আত্মীয় আপনজনের, ৩০ লাখ হতভাগ্য নিরীহ নিরপরাধ মানুষের লাশ একটার উপর একটা জমে এই বিশাল বর্ডারটা তৈরি হয়েছে। যেই মুহুর্তে আপনি এই বর্ডারের উপর দাঁড়িয়ে পাকিস্তানকে এই বর্ডারের ওপাশ থেকে তুলে এনে এই পাশে বাকি দেশগুলোর সাথে একসাথে মিলিয়ে কোন কিছু বিচার করতে যাবেন, একটাবার পায়ের নীচে ভালোভাবে তাকাবেন। দেখবেন ৩০ লাখ শহীদ আপনার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, হয়তো তাদের অশ্রুসিক্ত চোখের ভাষা বলছে, কিভাবে পারো তুমি? কিভাবে পাকিস্তানের সাথে পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনা করতে পারো? কিভাবে অন্যদেশের সাথেও তুলনায় পাকিস্তানকে টানতে পারো? কিভাবে?
একটা কথা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে, ভারত কিংবা অন্য কোন দেশ চাইলেও কখনো কোনদিন ৩৪ লাখ কারণ তৈরি করতে পারবে না তাদের ঘৃণা করবার জন্য। ভারতকে রেন্ডিয়া ডাকলে তাতে ভারতীয়রা ক্ষেপে গিয়ে আমাদের কাংলাদেশ ডাকবে, এই সমীকরণ পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কখনই প্রযোজ্য না। কারণ পাকিস্তানীদের কাছে ভারতীয়দের কোন অংশেই কোনদিক থেকেই তুলনা হয় না। পাকিস্তানীরা গত ৪৭ বছর ধরে স্রেফ কাংলাদেশ না, আরো অসংখ্য জঘন্য ভয়ংকর নোংরা সব ডাকে ডেকে এসেছে আমাদের, বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষকে ঘৃণা করার শিক্ষা তারা বুদ্ধি হবার পর থেকেই পরিবারের কাছ থেকে, ক্লাসে পাঠ্যপুস্তকে, শিক্ষকদের কাছ থেকে, বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন হিসেবে পেয়ে আসছে। সুতরাং এর সাথে যদি আপনি ভারতীয়দের কিংবা শ্রীলংকান কিংবা অস্ট্রেলীয় কিংবা ওয়েস্টইন্ডিয়ানদের মেলাতে যান, সেটা খুব বাজে একটা অপরাধ হবে। কারণ এইসব দেশের মানুষ কখনো জন্ম থেকে বাংলাদেশকে ঘৃণা করার শিক্ষা পেয়ে আসে নাই, বরং এদের সাথে আমাদের যা হচ্ছে, এটাই সত্যিকারের ঘৃণার চাষাবাদ, যার জন্য দায়ী যেমন আমরা, ঠিক তেমনি ওরা।
আগামীকাল যদি আমরা জাতিগতভাবে পাকিস্তানকে ক্ষমাও করে দেই, একাত্তরের গণহত্যার যন্ত্রণা ভুলেও যাই, পাকিস্তানীদের দিকে ফুলের মালা নিয়ে আগাই, তারপরেও তারা আমাদের গালি দেবে, প্রবলভাবে ঘৃণা করবে, আমাদের দেশটার ধ্বংস চাইবে মনের গহীনে। কারণ তাদের হাতে আমার স্বজাতির রক্ত লেগে আছে, কারণ প্রত্যেক পাকিস্তানী জন্মায় গণহত্যার দায় মাথায় নিয়ে, গণধর্ষণের দায় মাথায় নিয়ে, ৩০ লাখ মানুষের খুনী হিসেবে, চার থেকে সাড়ে ছয় লাখ নিরীহ মা-বোনের ধর্ষক হিসেবে। এবং বাকিটা জীবন তারা এরজন্য বিন্দুমাত্র দুঃখিত কিংবা অনুতপ্ত না হয়ে তাদের অপমানজনক পরাজয়ের জন্য আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ঘৃণা করে।
হ্যাঁ, পাকিস্তানীরা ঠিক এই লেভেলের পশু, বিবর্তনের ইতিহাসে নতুন ধারার নিকৃষ্ট এক পশু। এবং তাদের ঘৃণা করার আমাদের, নিজেকে বাঙ্গালী বাংলাদেশী পরিচয় দেওয়া নাগরিকদের ৩৪ থেকে সাড়ে ৩৬ লাখ কারণ আছে। ঠিক এই কারণগুলোর জন্য পাকিস্তানকে ঘৃণা করা, জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আদিম ঘৃণা করা এই জমিনে জন্মানো প্রত্যেক সন্তানের পরম কর্তব্য। ঠিক এই কারণগুলোর জন্যই আমরা প্রাণভরে ফাকিস্তান শব্দটা উচ্চারণ করতে পারি, তার জন্য ব্যাকরণগত শুদ্ধি কিংবা কবি নজরুলের মত পাকিস্তানবাদ নামের সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের বিরুদ্ধে ঘৃণা জানানোর কারণের দরকার হয় না। ঠিক এই কারণগুলোর জন্যই রেন্ডিয়া শব্দটা উগ্র ঘৃণার চাষাবাদ হলেও ফাকিস্তান শব্দটা তা নয়, বরং পাকিস্তানকে ঘৃণা জানানোর জন্য ফাকিস্তান শব্দটা উচ্চারণ করা কোনভাবেই অপরাধ না। কেউ যদি স্রেফ শোঅফের জন্য কিংবা দুটো লাইক কামানোর জন্যও ফাকিস্তান শব্দটা উচ্চারণ করে, সেটাতেও তাকে দোষ দেওয়ার কোন উপায় নাই। কারণ পাকিস্তানকে ঘৃণা করে উচ্চারিত প্রত্যেকটা শব্দ আমাদের দায়িত্ব, আমাদের অধিকার! এর জবাবে পাকিস্তানীরা আমাদের কি বলবে, এটা খুবই হাস্যকর চিন্তাভাবনা। কারণ পাকিস্তানীরা আমাদের কি বলবে, সেটা গত ৪৭ বছর ধরেই আমরা দেখে আসছি, কেয়ামত পর্যন্ত এর চেয়ে আলাদা কিছু বলার কোন কারণ নাই, কোন সম্ভবনা নাই।
আর যারা ভাবছেন পাকিস্তানের সাথে আমাদের কূটনীতির সম্পর্ক আছে কেন, বিপিএলে কেন ওদের খেলতে দেয়া হয় এসব বলে পাকিস্তানকে ঘৃণার বিষয়টা হালকা করবেন, তাদের জন্য বলি- আমরা সরকার চালাই না, আমরা বিসিবিও চালাই না, বিপিএলে দলও পরিচালনা করি না, তাই সরকার কিংবা বিসিবির কিংবা বিপিএলের দলের নেওয়া সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাদের কোন দায় নাই। এত কিছুর পরেও ক্রিকেটাররা হয়তো চাইলে পিএসএল বর্জন করতে পারতেন, কিন্তু যেহেতু তারা সেখানে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, খেলছেন, সুতরাং তাদের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাদের কাছ থেকে এই ব্যাপারে কোন আশা করাই অনুচিত। তাই এক মাশরাফি ছাড়া বাকিদের কাছ থেকে এই ধরণের প্রত্যাশা না রাখাই বাঞ্ছনীয়।
এরপরেও যদি আপনি পাকিস্তানের সাথে তুলনায় অন্য দেশকে টানতে চান, কিচ্ছু বলার নাই। এরপরেও যদি আপনি ভারত আর পাকিস্তানকে ব্যালেন্স করে নিরপেক্ষ শুষিল সাজতে চান, কিছু বলার নাই। এরপরেও যদি আপনি ফাকিস্তান বললে সেটা পাকিস্তানীদের জন্য মানহানীকর ভেবে রেন্ডিয়া টেনে আনেন, তাহলে কিছু বলার নাই। স্রেফ জানবার ইচ্ছে হবে, পাকিস্তানকে ঘৃণা করা, প্রতি পদে পদে তাদের অপমান করা যেমন আমার জন্মগত অধিকার, ঠিক তেমনি আপনারও অধিকার। আমি আমার অধিকার পালন করছি মাত্র! আপনার সমস্যা হচ্ছে কোথায়?
Some text
ক্যাটাগরি: মতামত
[sharethis-inline-buttons]
আমাদের সাইটে ব্লগে সক্রিয় থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে কিছু বিষয় জানা দরকার। দেশ দর্শন সাইটটি অন্যান্য ব্লগ সাইট ও নিউজ পোর্টাল থেকে অনেকটাই ব্যতিক্রম। এখানে চিন্তাশীলতা, আন্তরিকতা, সম্পর্ক, সমন্বয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভদ্রতা প্রভৃতি বিষয়গুলো অপরিহার্য।
দেশ দর্শনে পারতপক্ষে আমরা ছদ্মনামের ব্লগ আইডি সমর্থন করি না। বিশেষ কোনো রাষ্ট্র অথবা শ্রেণি-গোষ্ঠীকে আক্রমণাত্মক ভাষায় লেখা সমর্থন করি না। যা অন্যান্য ব্লগ সাইট এ পর্যন্ত করে এসেছে। এসব পুরনো স্টাইল। আর লেখা আরো ছোট হলে ভালো, এটি অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। -সম্পাদক