চিন্তা দেহ না, দেহ থেকে পৃথকও না। দেহ চিন্তারই প্রতিরূপ। চিন্তা অদৃশ্য, দেহ দৃশ্য। পেটের অসুখ হলে চিন্তার অসুখ হয় না বটে, কিন্তু চিন্তার কার্যক্রম ব্যাহত হয়; চিন্তা উপদ্রুত ও অস্থির হয়ে উঠে; হারিয়ে ফেলে তার স্বাভাবিক গতি। দেহের উত্তাপ বৃদ্ধি পেলে চিন্তার গতি হয়ে উঠে তীব্র- খুব দ্রুত অনেক চিন্তার আগমন-নির্গমন ঘটে। চিন্তা যদি পীড়িত হয়, তবে দেহও সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।
দেহ ও চিন্তার আন্তঃসম্পর্ক প্রাচীন ঋষিগণ জানতেন; তাই তাঁরা যে কোনো ব্যাধিকেই বলতেন ‘আধিব্যাধি’। যাহা দ্বারা চিন্তা আহিত হয়, তাকে বলে আধি। সংসদ বাঙ্গালা অভিধান বলছে- আধি হলো চিন্তা রোগ, ব্যাধি হলো দৈহিক রোগ। আধিব্যাধি হলো চিন্তাদৈহিক রোগ। রোগ মানেই আধিব্যাধি- মনোদৈহিক বা চিন্তাদৈহিক। এখন আধি থেকে ব্যাধি আলাদা হয়ে গেছে- চিকিৎসকরাও মানতে চান না যে, ব্যাধি মানেই আধিব্যাধি। তাই এখনকার চিকিৎসকরা রোগীর সমস্যা বুঝার চেষ্টা করে না- এন্টিবায়োটিক দিয়ে ব্যাধি সারায়, কিন্তু আধিব্যাধি তো এন্টিবায়োটিকে সারে না। এর চেয়ে বড় ফাঁকি, আর আছে কি?
কবিগুরু তাঁর `ফাঁকি’ কবিতায় লিখেছিলেন-
“বিনুর বয়স তেইশ তখন, রোগে ধরল তারে।
ওষুধে ডাক্তারে
ব্যাধির চেয়ে আধি হল বড়ো;
নানা ছাপের জমল শিশি, নানা মাপের কৌটো হল জড়ো।
বছর দেড়েক চিকিৎসাতে করলে যখন অস্থি জরজর
তখন বললে, ‘হাওয়া বদল করো’।”
‘ব্যাধির চেয়ে আধি বড়ো’ অর্থাৎ দেহের রোগ থেকে চিন্তার রোগ বড়। প্রতিটি চিন্তা থেকে, দেহের প্রতিটি কোষে স্পন্দন ছড়ায়। সুস্থ চিন্তা থেকে ছড়ায় সুস্থ স্পন্দন, অসুস্থ চিন্তা থেকে ছড়ায় অসুস্থ স্পন্দন। তাই দৈহিক স্বাস্থ্যের তুলনায় মানসিক স্বাস্থ্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চিন্তা নিয়ন্ত্রণের শিল্পকলা যার আয়ত্তে আছে সে সুস্থ চিন্তার মাধ্যমে দেহে ছড়িয়ে দিতে পারে সুস্থতা। অসুস্থ চিন্তা করে সুস্থ কেউ থাকতে পারে না। হিংসার চিন্তা করে প্রেম করা যায় না। বিরোধের চিন্তা করে সংযোগ করা যায় না। দেহের কার্য নিয়ন্ত্রিত হয় চিন্তা দ্বারা। চিন্তাজগতের তেজ দেহকে বলবান ও প্রাণশক্তিতে ভরে রাখে। দিব্য চিন্তার ধারণ ও লালনে দেহে বিরাজ করে সুস্থতা, ধীরতা ও পূর্ণতা।
চাপ, ঈর্ষা, লিপ্সা চিন্তাজগতে অস্থিরতা উৎপন্ন করে এবং চিন্তাজগৎ থেকে অস্থির স্পন্দন দেহে ছড়িয়ে পড়ার কারণে লিভার, প্লীহা, পাকস্থলী, কিডনি, হৃদপিণ্ড আক্রান্ত হয়। দেহের প্রত্যেকটি কোষ চিন্তার স্পন্দনে সাড়া দেয় এবং চিন্তার স্পন্দন অনুযায়ী সতেজ কিংবা নিস্তেজ হয়; কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধি করে কিংবা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। চিন্তা যদি সর্বদা কেন্দ্র ঘিরে বর্তিত হয়, তবে যথাযথ ও নির্দিষ্ট স্পন্দন প্রেরিত হয় এবং দেহ-মনে শান্তি বিরাজ করে।
মূল চিন্তা রোগ হলো উদ্বেগ। এর উৎপত্তি নিয়ন্ত্রণহীন চিন্তা, ভয় ও বিপদের আশঙ্কা থেকে। মাত্রাতিরিক্ত উদ্বেগে মাথা ঘুরে, হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, অতিরিক্ত ঘাম ঝরে, বুকে চাপ বা ব্যথা অনুভূত হয়, দাঁড়ানোর শক্তি পাওয়া যায় না, ত্বক জ্বলতে থাকে, কাঁদতে ইচ্ছা করে; চিন্তা রোগ থেকে দেহে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য রোগ।
চিকিৎসকরা যদি চিন্তার সঙ্গে দেহের এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের রহস্য স্বীকার করত, তবে রোগীকে পরামর্শ দিয়ে আধিব্যাধির চিকিৎসা করতে পারত। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে উল্টো। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে প্রত্যেক রোগী হতাশ হয়, তারা রোগীর কথা শুনে না- বিশ্বাস করে প্যাথলজিতে। সামান্য একটু কাশি হলে যক্ষ্মার টেস্ট দেয়। খরচের বোঝা, চিকিৎসকের অবহেলা ও ভয়ে, রোগী আধমরা হয়ে যায়।
আয়ুর্বেদিক বৈদ্যদের শরণাপন্ন হলে তারা প্রত্যেককেই যৌনরোগী বানিয়ে দেয়। তারা চিন্তা বুঝে না, ব্যর্থতা, হতাশা, বিষণ্নতা বুঝে না। বৈদ্যদের কাছ থেকে রোগীরা নিয়ে আসে রোগের চিন্তাবীজ, কিছুকাল পর সে ঐ রোগেই আক্রান্ত হয়। অথচ সমস্যা জটিল হলেও চিকিৎসকের বলা উচিত ছিল, ‘এটি তেমন কিছু না, পথ্য সেবন করলে এবং কিছু বদঅভ্যাস ত্যাগ করলে আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন’।
আধিব্যাধি দূর করতে পারে সম্যক পরামর্শ। সম্যক পরামর্শ দানের জন্য প্রত্যেক চিকিৎসকের বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। চিন্তা রোগ মানেই হলো এখন এবং এখানে না থাকা। বর্তমানে কোনো চিন্তারোগ নেই। উদ্বেগ, অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা, সন্দেহ, ভয় সবকিছুরই বাস ভবিষ্যৎ কিংবা অতীতে।
বিপদ যদি প্রকৃতই উপস্থিত হয়, তবে উদ্বেগ কিংবা ভয় থাকে না- থাকে আত্মরক্ষার চিন্তা।
সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। গ্লাস ভেঙে গেলে, দুশ্চিন্তা করলেও তা আর জোড়া লাগে না। এ নিয়ে আফসোস করা চিন্তারোগের লক্ষণ। সম্পর্ক তো গ্লাসের মতোই। একটু অসাবধানে নাড়াচাড়া করতে গেলেই ভেঙে যায়। নতুন গ্লাস কিনতে পয়সা লাগে, কিন্তু নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পয়সা লাগে না- পৃথিবীতে ৭০০কোটি মানুষ! তবু ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের জন্য উদ্বেগের শেষ নেই। “চুন খেয়ে মুখ পুড়লে, দই দেখলেও ভয় লাগে।” ভয় হলো ভবিষ্যতের চিন্তা। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। কারণ, ভবিষ্যৎ কখনো আসে না জীবনে।
বেঁচে থাকি ফুলের মতো, পাখির মতো, ঝর্ণার মতো- ভয় ছাড়া, উদ্বেগ ছাড়া, চিন্তা রোগ ছাড়া। “তোমরা যখন শিখছো পড়া, মানুষ হওয়ার জন্য/আমি না হয় পাখিই হবো, পাখির মতো বন্য।”
Some text
ক্যাটাগরি: মতামত
[sharethis-inline-buttons]