ব্যাপক খাদ্য ঘাটতিকে দুর্ভিক্ষ বলা হয়। ফসলহানি, যুদ্ধ, সরকারের নীতিগত ব্যর্থতা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়; কিছুদিন পর তা কেটেও যায়। কিন্তু চিন্তার দুর্ভিক্ষ শত বছরেও কাটে না। চিন্তার দুর্ভিক্ষ হলো চিন্তার ব্যাপক খাদ্যাভাব। ধর্ম ও রাজনীতি চিন্তার খোপ তৈরি করে। এ খোপে একবার প্রবিষ্ট হয়ে গেলে সারাজীবনেও মুক্তি নেই। পদ-পদবি, বিত্ত, সফলতা-ক্ষমতার লোভ তৈরি করে আরেকটি খোপ। উন্মাদের মতো এসবের পেছনে ছুটতে থাকে কেউ কেউ। সব পেয়ে গেলেও চিন্তার দুর্ভিক্ষ যেখানে ছিল সেখানেই থাকে। বেশিরভাগ মানুষ সারাজীবন খোপের মধ্যেই থাকে। মাঝে-মধ্যে ভাবে বেড়িয়ে যাবে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। ‘করা না করা’র দ্বৈরথে কেটে যায় জীবন। কিছু কিছু চিন্তার প্রতি মানুষ নেশাগ্রস্ত থাকে। সে জানে এসব চিন্তা কাজের না, কিন্তু থামাতে পারে না। কিছু কিছু চিন্তা এত শক্তিশালী হয়ে যায় যে আমরা ছেড়ে দিলেও, আমাদের ছাড়ে না। গরু জীবনের প্রয়োজনে খাদ্য জাবর কাটে, কিন্তু মানুষ অপ্রয়োজনে চিন্তার জাবর কাটে। একই চিন্তার পুনরাবৃত্তি থেকে উৎপন্ন হয় চিন্তার দুর্ভিক্ষ। যা শেষ পর্যন্ত মানুষকে নিঃশেষ করে দেয়।
মানবদেহ একটা রথের মতো, রথের ঘোড়া ইন্দ্রিয়গুলো আর সারথি হচ্ছে চিন্তা। সারথি যে পথে চালায় রথ সে পথে চলে। তাই চিন্তার দুর্ভিক্ষ দূর না হলে কর্ম শুদ্ধ হয় না। চিন্তাই মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু, আবার চিন্তাই চরম শত্রু। চিন্তাই সকল বন্ধনের কারণ, আবার চিন্তাই মুক্তির কারণ। জন্মের পর মানব শিশুর মস্তিষ্ক থাকে ফাঁকা-‘টাবুলা রাসা’। অনেকটা কম্পিউটারের মতো। কম্পিউটারে যেসব সফটওয়্যার ইনস্টল করা হয়, সেসব কাজই কম্পিউটার করে। মানুষও যেসব তথ্য ধারণ করে, তাই নির্ধারণ করে তার ভবিষ্যৎ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মনস্তাত্বিক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মগজটি খুলে ‘ঐ বইটি’ ঢুকিয়ে দেয়। এরপর যা হবার তাই হয়। কুকুর হাড় কামড়াতে থাকে, মাড়ি থেকে রক্ত ঝরে; কিন্তু কুকুরটি ভাবতে থাকে রক্ত ঝরছে হাড় থেকে। এমনই এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে আটকে যায় চিন্তার সমগ্র কাঠামো। আর, এটাই মানবজাতির ভয়াবহ দুর্দশা।
আমাদের দেশে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটছে, কিন্তু আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে উচ্চশিক্ষিত ব্যাঙের সংখ্যা। বাড়ছে চিন্তার দুর্ভিক্ষ, কমছে সৃজনশীলতা। রেডিও, টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকার ধর্মানুষ্ঠান আরো প্রকট করছে চিন্তার বন্ধ্যাত্ব। তাদের কাছে ‘চিন্তার দুর্ভিক্ষ’ ছাপার যোগ্য নয়- হাজার বছর ধরে কোটিবার মুদ্রিত গলিত বিকৃত মিথ্যাচারগুলো খুব ছাপার যোগ্য। ধিক্ তাদের কূপমূণ্ডকতায়।
আমরা কী দেখছি, কী শুনছি, কী তথ্য ধাারণ করছি তাই চিন্তার মুল খাদ্য। মানব মস্তিষ্ক হলো একটি তথ্য প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্র। এ যন্ত্রটি যে তথ্য গ্রহণ করে, সে অনুযায়ীই কাজ করে। ক্যাসেটে যে গান রেকর্ড করা আছে, সে গানই বাজে। প্রত্যেক মানুষের সামর্থ্য রয়েছে রেকর্ড না বাজিয়ে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে নতুন তথ্য পরিবেশন করার। ব্যাপারটি দুরূহ ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই মানুষ দুর্ভিক্ষ মেনে নেয়। এরিস্টটল বলেছিলেন, পুরুষ থেকে নারীর ৪টি দাঁত কম। দেড় হাজার বছর কেউ এর সত্যতা যাচাই করেনি। মেনে নিয়েছে। একেই বলে চিন্তার দুর্ভিক্ষ। চিন্তার দুর্ভিক্ষ দেখা দিলেই মানুষ প্রথা পূজারী, ধর্মান্ধ, মতান্ধ হয়। ইদানিং কিছু ডারউইন পূজারীরও প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। একই কথা বারবার বলা, তা আইনস্টাইনের কথা হলেও দুর্ভিক্ষের লক্ষণ।
ধর্ম, দর্শন, মতবাদ, দারিদ্র্য, স্বার্থ, লোভ-লালসা-কাম-ক্রোধ-মোহ ইত্যাদি বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে চিন্তার দুর্ভিক্ষ উৎপাদনে। তথাকথিত ধর্মগুরু, রাজনীতিক ও সমাজপতিদের প্রধান কাজই হলো- চিন্তা করার অক্ষমতা তৈরি করা, চিন্তার দুর্ভিক্ষ তৈরি করা। আড়তদাররা যেমন খাদ্য মজুত করে কৃত্রিম খাদ্যভাব তৈরি করে তেমনি শক্তিশালী বিত্তশালী স্বার্থান্বেষীরা চিন্তার কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করে। তাদের প্রভাব উপেক্ষা করে নতুন চিন্তা করার সাহস হারিয়ে ফেলে সাধারণ মানুষ। কদাচিৎ যদি কোথাও কেউ নতুন চিন্তা করে তাহলে সে পরিত্যক্ত হয়।
এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়, যারা নিজের সমস্যা সমাধানের চিন্তাও নিজে করে না। তার হয়ে চিন্তা করার ভার আরেকজনের ওপর অর্পন করে। ঐ নির্ভরশীল ব্যক্তি (নেতা, ধর্মগুরু) যা বলে, তা-ই বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়। যারা প্রশ্ন না করে, বিপরীত যুক্তি না দিয়ে, বিশ্লেষণ না করে, প্রস্তাবনাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে মেনে নেয়, চিন্তার দুর্ভিক্ষ তাদের মজ্জায় ঢুকে যায়।
ধর্মান্ধতা ও মতান্ধতা মানেই হলো চিন্তার দুর্ভিক্ষ। আত্ম-নিগ্রহ, জীবন থেকে সুস্থ স্বাভাবিক আনন্দের বিসর্জন, আদেশ-নিষেধ বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়া ইত্যাদি সব ধর্মেরই অলঙ্ঘনীয় বিষয়। এ রকম ধর্মচর্চার উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন নয়, চিন্তার দুর্ভিক্ষ উৎপন্ন করা। প্রাণহীন শুষ্ক ধর্মীয় আচার পালনে চিন্তার খাদ্য নেই। চিন্তার দুর্ভিক্ষ থেকেই ধর্মচর্চা এখন মূর্খতার পর্যায়ে অধঃপতিত হয়েছে। মধ্যযুগের তিমিরাচ্ছন্ন অধঃপতিত অবস্থার চেয়েওেএখন ভয়ঙ্কর দুরাবস্থায় পতিত হয়েছে মানবজাতি। উপাসনালয়গুলোর মার্বেল পাথরের চাপে থেঁতলে গেছে চিন্তা। ধর্ম নিয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার অধিকার হরণ করেছে ধর্মান্ধরা। ধর্ম নিয়ে ভাববেন কেবল ঠাকুর, মোল্লা, পুরোহিত, গুরুরা। বাকিরা কেবল যন্ত্রের মতো অনুষ্ঠান পালন করবে।
আমাদের দেশে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটছে, কিন্তু আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে উচ্চশিক্ষিত ব্যাঙের সংখ্যা। বাড়ছে চিন্তার দুর্ভিক্ষ, কমছে সৃজনশীলতা। রেডিও, টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকার ধর্মানুষ্ঠান আরো প্রকট করছে চিন্তার বন্ধ্যাত্ব। তাদের কাছে ‘চিন্তার দুর্ভিক্ষ’ ছাপার যোগ্য নয়- হাজার বছর ধরে কোটিবার মুদ্রিত গলিত বিকৃত মিথ্যাচারগুলো খুব ছাপার যোগ্য। ধিক্ তাদের কূপমূণ্ডকতায়।
মানুষ সৃষ্টিশীল হয় চিন্তার খাদ্য থেকে- জন্মগত বিশেষত্বের কারণে নয়। চিন্তাই তৈরি করে নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র। এজন্য অনবরত খাদ্যের যোগান দেয়া চাই, যাতে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে নতুন ধারণা গঠন করা যায়। মাথা নিংড়ালেই রস বের হয়। বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা করতে করতেই জ্ঞানের কাছাকাছি পৌঁছা যায়। চিন্তার কতগুলো পর্যায়ক্রমিক আবরণ রয়েছে। চিন্তার দুর্ভিক্ষ দূর করতে হলে ঐ আবরণগুলো ছিঁড়তে হবে। নিঃসন্দেহে এটি যন্ত্রণার, কিন্তু সহজ উপায় নেই। নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হলে পুরাতন, জীর্ণ, শীর্ণ চিন্তার প্রাচীর ভেঙে চিন্তার দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি চাই-ই চাই।
ড. এমদাদুল হক : লেখক, গবেষক
Some text
ক্যাটাগরি: মতামত
[sharethis-inline-buttons]