এখন রূপচর্চার হিরিক চলছে। সে পেঁপে খায় না, কিন্তু বেঁটে মুখে লাগায়; আশা- তামাটে গায়ের রঙ ফর্সা হবে। মসুর ডাল বাঁটা, ধনেপাতা বাঁটা, চন্দন, টকদই মুখে মেখে বসে থাকা- কে শেখাল এসব?
গোলাপ ফুলের একটি ব্যবহারই সে জানে- পাপড়ি ছিঁড়ে মুখে লাগানো। কাঁচা দুধে তুলা ভিজিয়ে ঠোঁটে ঘষা, রসুন, পিঁয়াজ, আমলকী আর নারকোল তেল মিশিয়ে চুল ধোয়া, ডিমের কুসুম, তরমুজের বীচি বাঁটা, টমেটো গাজরের রস, হরিদ্রা, মধু, লেবুর রস, কলা, শসা কোনোকিছুই মুখে মাখতে অরুচি নেই তার। চোখে শসার প্রলেপ, পেটে গরুর ভুরি; কি হলো তাতে?
দেখেশুনে সুন্দরী বউ বিয়ে করল অজয়, স্নান শেষে রূপ দেখে অজ্ঞান হয়! মানুষ জানেই না যে, যথার্থ রূপচর্চা হলো চিন্তার রূপচর্চা। চিন্তা যখন স্থির হয়, তখন মুখে ছড়িয়ে পড়ে জ্ঞানের প্রভা, এক রহস্যময় সৌন্দর্য ঘিরে রাখে তাকে। চিন্তার রূপ খুবই সূক্ষ্ম। অবাস্তব মনে হলেও এটি অতিবাস্তব। প্রত্যেকটি চিন্তারই বাস্তব মূল্য আছে। দেহের সৌন্দর্য, মনের সৌন্দর্য, জীবনের সৌন্দর্য নির্ভর করে চিন্তার প্রকৃতির উপর।
চিন্তার রূপচর্চা করতে হলে একে নিয়ন্ত্রণ করা চাই, চিন্তাকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে প্রেরণ করার শিল্পকলা আয়ত্ত করা চাই, এবং সম্যক চিন্তার স্পন্দন গ্রহণ করা চাই। মানুষের কাছে এমন চিন্তা প্রেরণ করা যায়, যা মানুষকে প্রেরণা দেয়, সুস্থ ও শুদ্ধ করে তুলে। জগৎ থেকেও এমন চিন্তা গ্রহণ করা যায়। যে ধরণের চিন্তা আমরা প্রেরণ করি, প্রাপকের মধ্যে সে ধরণের চিন্তার উদয় হয় এবং দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে আমাদের কাছে।
সুতরাং, যদি সুন্দর হতে চাই তবে অন্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করি। যদি শান্তিতে থাকতে চাই অন্যের প্রতি শান্তিময় চিন্তা প্রেরণ করি। সুন্দর চিন্তাই সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। অর্থবহ চিন্তা অর্থ উৎপন্ন করে। অর্থহীন চিন্তা অনর্থ উৎপন্ন করে।
যার জীবিকা দ্রোহমুক্ত, যে সত্য বলে, সত্য পথে চলে তার চিন্তায় থাকে পরম সৌন্দর্য ও অপরিমেয় শক্তি। ডিমের কুসুম, গাজরের রস, লেবুর রস দিয়ে দেহের রূপচর্চা হয়, আর অহিংসা, সততা, সত্যবাদিতা, অধ্যবসায়, আন্তরিকতা দ্বারা হয় চিন্তার রূপচর্চা। সৎ চিন্তার সঙ্গে সৎ কর্ম যুক্ত হলে বৃদ্ধি পায় চিন্তার মোহন রূপ।
প্রত্যেক ইন্দ্রিয়পরায়ণ চিন্তার প্রত্যাহার চিন্তাজগতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। প্রত্যেক প্রত্যাহত প্রলোভন চিন্তাজগতে শক্তির সঞ্চার করে। মুখ থেকে ফিরিয়ে দেওয়া প্রতিটি রূঢ় বাক্য চিন্তাজগতে রূপের আভা ছড়িয়ে দেয়। প্রতিটি সহযোগিতা, প্রতিটি প্রেরণা, প্রতিটি শুভ কামনা চিন্তাজগতে শক্তির যোগান দেয়।
প্রতিবার যখন আমরা অভ্যাস পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়ে সফল হই চিন্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। যতবার বলি ‘আমিও পারি’ ততবার চিন্তার শক্তি বৃদ্ধি পায়। যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করি, ন্যায়ের পক্ষে বলি, চিন্তার সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়। চিন্তার সম্যক প্রকাশ চিন্তাকে করে তীক্ষ্মতর।
দৈহিক রূপচর্চার গভীরতা চামড়া পর্যন্ত। কিছুদিনের মধ্যেই চামড়া বিবর্ণ হয়ে যায়, চুল পড়ে যায়, যৌবন হারিয়ে যায়; দেহের আকর্ষণ, বিকর্ষণে পরিণত হয়। বাস্তব সৌন্দর্য হলো চিন্তার সৌন্দর্য। চিন্তা সুন্দর তো জগৎ সুন্দর। বস্তু সুন্দর হয় না। সুন্দর হয় চিন্তা। প্রেমিক প্রেমাস্পদের মধ্যে চিন্তাসৃষ্ট সৌন্দর্য আরোপ করে এবং চিন্তাসৃষ্ট সৌন্দর্য উপভোগ করে। মানুষ তার চিন্তাসৃষ্ট সৌন্দর্যের সঙ্গেই প্রেম করে।
প্রেমিকের কাছে সমগ্র মহাবিশ্ব ঐশ্বর্যময় সৌন্দর্যে মহিমান্বিত। কঁচি পাতা সুন্দর, ঝরা পাতাও সুন্দর। সূর্যোদয় সুন্দর, সূর্যাস্তও সুন্দর। সুন্দর আবিষ্কার করে আমাদেরই চিন্তা। তাই চিন্তা সুন্দর না হলে সব উলট-পালট হয়ে যায়- অসুন্দরকে মনে হয় সুন্দর, সুন্দরকে মনে হয় অসুন্দর। সর্পকে রজ্জু মনে করা আর রজ্জুকে সর্প মনে করা, কতই না ভয়ঙ্কর!
“হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর/ এ জীবনে যা-কিছু সুন্দর/ সকলি আজ বেজে উঠুক সুরে/ প্রভু, তোমার গানে, তোমার গানে, তোমার গানে।”
Some text
[sharethis-inline-buttons]