সম্প্রতি ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তানের ১১তম সাধারন নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনে ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরান খানের দল পিটিআই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আরও কিছু দলের সহযোগিতায় কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেছে এবং স্বয়ং ইমরান খান নিয়াজী ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট পাস্তিানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ইমরান খান জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম রেডিও-টেলিভিশন ভাষণে সুইডিশ মডেল অনুসরন করে পাকিস্তানকে একটা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। এটা অবশ্যই স্বীকৃত সত্য সুইডেন পৃথিবীর একটি অন্যতম উন্নত ও কল্যানমুখী রাষ্ট্র। প্রত্যেক দেশের প্রধানমন্ত্রীই স্বপ্ন দেখেন তার দেশ ও জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যওয়ার। ইমরান খানও এর ব্যতিক্রম নন।
পাকিস্তানের রজনীতিতে ভুট্টো ও শরিফ পরিবারের প্রভাব অনেক আগে থেকেই। সামরিক শাসক বাদ দিলে এই দু’টি পরিবরের সদস্যদের হাতেই মূলত পাকিস্তানের ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। তবে এবারের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ইমরান খানের দল পিটিআই এর জয় দেশটির রাজনীতিতে সেই পরিবারতন্ত্র প্রথা ভেঙ্গে দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে এক যুগান্তকারী ইতিহসের সূচনা করেছে।
এদিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী আর্ন্তজাতিক সংস্থাগুলো বলেছে, ভোটকেন্দ্রে মোতায়েন করা সেনা সদস্যরা ভোটে কোনো হস্তক্ষেপ করেন নি;নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর ভাবে হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা ইমরান খানকে অভিন্দন জানিয়েছে।
ইমরান খানের বয়স এখন ৬৫ বছর। পাকিস্তানের লাহোরে জন্ম নেওয়া ইমরান খানের পুরো নাম ইমরান আহমেদ খান নিয়াজি। তবে ক্রিকেট বিশ্বে ইমরান খান নামেই খ্যাতি কুড়ান তিনি। ১৯৭১ সালে আন্তরর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়। ১৯৯২ সালে একক নৈপূন্যে বিশ্বকাপ জয় করেন। অলরাউন্ডার নৈর্পূন্যে তার সময়ের সেরাদের কাতারেই ছিলেন। টেষ্টে ৩০০ উইকেট ও ৩০০০ রান নিয়ে তিনি রেকর্ড বুকে নাম লেখান। সেই শৈশব কাল থেকে ইমরান খান আমার প্রিয় খেলোয়ার। তার ব্যাটিং ও বোলিং স্টাইল দু’টোই আমাকে মুগ্ধ করে। ইমরান খানের প্রতিটি খেলা আমি টেলিভিশনে দেখেছি। আর বাংলাদেশে যত বারই খেলতে এসেছে তত বারই ষ্টেডিয়ামে গিয়ে সরাসরি তার খেলা উপভোগ করেছি ও খেলা শেষে গ্রিনরুম অথবা হোটেল লাউঞ্জে গিয়ে তার অটোগ্রাফ নিয়েছি। অনেক সময় সুযোগ পেলে ছবিও তুলেছি। আমি যত বারই ইমরান খানকে সরাসরি অতি কাছ থেকে দেখেছি ততবারই তার বাচন ভঙ্গি, ভদ্রতা ও মুখচ্ছবি আমাকে বিমুগদ্ধ করেছে।
ইমরান খানের ২১ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ার ছিল নানা অজর্নের। “পাকিস্তানের ক্রিকেট জাদুকর”, পাকিস্তানের ক্যাপ্টেন” ও “পাকিস্তানের প্রতিভা” এমন বিশেষণ তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আশির দশকের শুরুতে ইমরান খানকে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার মানা হতো। অন্তত পাঁচ বছর ক্রিকেট বিশ্বে রাজত্ব করেছেন তিনি। ৩৯ বছর বয়সে শেষ উইকেট শিকার করে ক্রিকেটকে বিদায় জানান।১৯৯৬ সালে “তেহরিক-ই-ইনসাফ” রাজনৈতিক দল গঠন করে সবাইকে চমকে দেন তিনি।
ইমরান খান ধার্মীক ও র্দুনীতিমুক্ত সাধারন মানুষ। কিন্তু পর পর তিনটি বিয়ে করার জন্য নিন্দুকেরা তার তীব্র সমালোচনা করে থাকেন। তবে এর জবাবে ইমরান খান বলেন,“আমি ধর্মীয় ও সামাজিক বিধান মেনেই বিবাহবিচ্ছেদের পর তিনটি বিয়ে করেছি, কোনো অন্যায় কাজ করিনি। কখনো কোনো র্দুনীতি করিনি, বিদেশে টাকা পাচার করিনি, কোনো কর ফাঁকি দেইনি এবং রাষ্ট্রদ্রোহ মুলক কোনো কাজে কখনো জড়িত হইনি। তবে এ কথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, যুবক বয়সে ইমরান খান একজন রমনীমোহন প্লেবয় হিসেবে,-যিনি ক্রিকেট খেলার অন্ধিসন্ধি যেমন জানতেন, তেমনি চিনতেন লন্ডনের নাইট ক্লাব গুলো।
বর্তমানে ষাটোর্ধ্ব ইমরান খান কোনো বালক, কিশোর বা যুবক নন, একজন পরিপূর্ণ বয়স্ক রাজনীতিবিদ,শিক্ষিত এবং সর্বক্ষেত্রে অভিজ্ঞ। নির্বাচনের পরেরদিন, প্রধামন্ত্রী হিসেবে তখনো শপথ নেওয়া হয়নি এক টিভি সাক্ষাৎকারে ইমরান খান যে দিকগুলোর দিকে ইঙ্গিত দিয়ে অথবা সমস্যা হিসেবে চিহিৃত করেছে তার প্রথমটাই হলো পাক-ভারত সমস্যা অর্থাৎ কাশ্মীর সমস্যা। দ্বিতীয়ত দরিদ্রতা, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; শুধু উপমহাদেশ নয়, বিশ্বশান্তির জন্যও। পাক-ভারত সমস্যার ব্যাপারে বলেছেন,ভারত এক কদম এলে পাকিস্তান দুই কদম এগিয়ে যাবে। অত্যন্ত সুন্দরভাবে উর্দুভাষী খান ইংরেজিতে যা বলেছেন তা শুধু সুমিষ্ট নয় বরং সৌন্দর্যমন্ডিত এবং গ্রহনযোগ্য।
নির্বাচণী প্রচারনার ইস্তেহারে তিনি কৌশলগত কারনে কাশ্মীর সম্যার ওপর তেমন জোর দেননি। তবে তিনি বিনা যুদ্ধে জাতিসংঘের দেওয়া সিদ্ধান্তের বা নির্দেশমতোই এটির স্থায়ী সমাধান চান।কিন্তু এ কথা সত্য যে,পাকিস্তানের মতো শক্তিধর সেনাবাহিনীর ওপর র্নিভর করেই ইমরান খানকে এ সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।যদিও তিনি কোনো টেষ্ট ক্রিকেটে ভারতের কাছে কখনো পরাজিত হননি।তবে কাশ্মীরের ক্ষেত্রে কোনো জয়-পরাজয় নয়, এখানে দরকার সৌহার্দ্যপূর্ণ স্থায়ী সমাধান।
প্রথম কাশ্মীর সমস্যা, দ্বিতীয় দারিদ্র্য দূরীকরন,তৃতীয় বাংলাদেশ,ভারত,সৌদি আরব,ইরান চীন ও আমেরিকাসহ সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক চান।চতুর্থটি হলো, দুর্নীতির সূত্র কোথায়,কেন দুর্নীতির প্রতি কিছু লোকের এত আগ্রহ এবং কীভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এর স্থায়ী সমাধানের পন্থা বের করা।এ ছাড়াও তালেবানদের সঙ্গে আলোচনা করে আফগান সমস্যা সমাধানেও তিনি প্রচন্ড আশাবাদী।
প্রাধানমন্ত্রী হিসেবে তার র্বতমান দায়িত্ব হলো দ্রুত নিজের ভাবমূর্তিকে বিরোধী রাজনীতিক থেকে সরকারপ্রধানের জায়গায় স্থানান্তর করা এবং ভোট জালিয়াতির অভিযোগ করা বিরোধী দলগুলোর ক্ষোভের আগুনে যত তারাতারি সম্ভব পানি ঢেলে দেওয়া।
পাকিস্তানের সুশীলসমাজের অনেকেই একাওরের ঘটনাবলির জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চওয়ার দাবি তুলেছেন। এসব গুণী ব্যক্তির মিছিলও হয়েছে ইসলামাবাদের সড়কে।কিন্তু ইমরান খানই সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি যিনি ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে তুলে ধরেন। কারণ তিনি মনে করেন,একাওরের ঘটনাবলির জন্য পাকিস্তানকে অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তবে তিনি উল্টোরথেও যাত্রা করেন একসময়। অন্যতম শীর্ষ যুদ্ধারাধী কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ডের পর তিনি সামালোচনায় মুখর হন। এরও ব্যাখ্যা দিয়েছেন পরে, বলেছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এবং আসল লোককে শাস্তি না দিয়ে নকল লোককে শাস্তি দেওয়া হয়েছে মনে করে এমনটা তিনি করেছেন।
ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বেশ কিছু প্রসংশনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে;যেমন, পাকিস্তান বিমানবন্দরে সরকারি শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রটোকল বাতিল,চলচ্চিত্রের নগ্ন পোষ্টার প্রদর্শন নিষিদ্ধ ঘোষনা করা, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাস ভবন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা ও বাংলাদেশ ও আগানিস্তান থেকে আসা শরনার্থীদের পাকিস্তানের নাগরিত্ব প্রদান।
পাকিসÍান এখন নতুনভাবে চলবে, নতুন নেতৃত্বে অগ্রসর হবে। ইমরান খান তার দেশবাসীকে ‘নতুন পাকিস্তান’ উপহার দেওয়ার কথা বলেছেন, একটি দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তনের কথা বলেছেন। আমরা তার সাফল্য কামনা করি । দেখা যাক , এই দীর্ঘ ইংনিসে তিনি কেমন খেলেন এবং পরিচালনা করেন। কেননা তিনি এখন আর ক্রিকেট দলের প্রধান নন বরং সরকার প্রধান।
খায়রুল আকরাম খান : ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন ডটকম
Some text
ক্যাটাগরি: মতামত, স্মৃতিচারণ
[sharethis-inline-buttons]