বর্তমানে আমাদের দেশে শিশু-কিশোর ও যুবাদের মধ্যে ইন্টারনেটের ব্যাবহার ব্যাপক হারে ভেরে গেছে।সেই সাথে পাল্লা দিয়ে ভেরে গেছে বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল অপরাধ।আর এ সব অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে বাংলদেশ সরকারের তথ্য, আইন ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০০৬ সালে সর্ব প্রথম প্রনিত হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুতক্তি আইন।পরে২০১৩ সালে ৫৪ ,৫৫, ৫৬, ৫৭ ,ও ৬৬ ধারা সংযোজন করে শাস্তি বাড়িয়ে
আইনটিকে আরও কঠোর করা হয়। এই আইনের ৫৭ ধারয় বহু গণমাধ্যমকর্মী, পরীক্ষার্থী, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীও নিরহী মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছেন।তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগের শিকার হয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরা।এর পরও বিরোধীমত, দল ও গণমাধ্যমকর্মীদেরকে আরো কঠোরে ভাবে নিয়ন্ত্ররে উদ্দ্যেশে তারাহুরো করে গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিরোধী রাজনৈতিকদল,সাংবাদিক ও প্রান্তিক জনতার হাজারো আপত্তি ও মতামতকে উপেক্ষা করে জাতীয় সংসদে সরকারী দলের সদস্যদের কন্ঠ ভোটে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ পাস করা হয়েছে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর আইনটি বাস্তব রূপ লাভ করেছে।বর্তমান বিশ্বে একমাত্র বাংলাদেশেই এ আইন প্রণীত হলো। তথ্য প্রযুক্তির এ আইনে মৌলিক কোনো পরিবতর্ন আসেনি।পূর্বে ৫৭ ধারায় আপরাধের ধরন গুলো ছিলো একসঙ্গে, নতুন আইনে সেগুলো ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০,৩১,৩২, ৩৩, ৩৪ বিভিন্ন ধারায় ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। নতুন আইনে শাস্তির মেয়াদ কিছুটা কমালেও উল্লেখি ১৪টি ধারা স্মবলিত ৩২ ধারা জামিন অযোগ্য হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে বির্তকিত ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা সস্পর্কে আপামর জনগনের সুস্পষ্ট ধারনা থাকা একান্ত দরকার।এখানে অতি সংক্ষিত আকারে তা আলোচনা করা হল।
১৷ ৫৭ ধারা যখন সামনে এলো, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো ‘অপব্যবহার’ হবে না৷ গণমাধ্যম নেতৃবৃন্দের অনেকে সরকারের কথায় আশ্বস্ত হলেন৷ তারপর ৫৭ ধারায় গণমাধ্যম কর্মীদের নামে মামলা হতে থাকল৷ গণমাধ্যম নেতৃবৃন্দসহ অনেকে বলতে শুরু করলেন, আইনের ‘অপব্যবহার’ করা হচ্ছে৷ এ কথার অর্থ দাঁড়ায় ‘আইনটি ভালো, কিন্তু অপব্যবহার হচ্ছে’৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রেও বলা হচ্ছে ‘অপব্যবহার’ হবে না৷ যখন এই আইন প্রয়োগ শুরু হবে, তখন বলা হবে ‘অপব্যবহার’ হচ্ছে৷ পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা স্বাধীনতা বিরোধী মতাদর্শের লোক৷ তিনি বা তারা আইনের ‘অপব্যবহার’ করে সংবাদকর্মীদের নাজেহাল -হয়রানি করছেন৷ গণমাধ্যম নেতৃবৃন্দসহ আরও অনেকের থেকে এমন আলোচনা শোনাটা সময়ের অপেক্ষা মাত্র৷
২৷ আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিয়ে সরকার একটি খসড়া আইন তৈরী করে৷ পর্যায়ক্রমে তা মন্ত্রিসভায় পাস হয়৷ জাতীয় সংসদে আলোচনা করে বা না করে পাস হলেও, সেটি আইনে পরিণত হয়৷ পাস হওয়ার আগে কোনো কোনো ক্ষেত্রে খসড়া আইনটি সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিতে যায়৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু আলোচনা, সংশোধন হয়, কখনো হয় না৷ সংসদে পাস হওয়ার পর আইনটি বাস্তবায়নের প্রথমিক দায়িত্ব পায় সরকারের পুলিশ বাহিনী।বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই ৫৭ ধারা আইনে পরিণত হয়েছিল৷ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জাতীয় সংসধে পাস হয়েছে৷ রাষ্টপতি সই করেছেন। তারপরও বলা হচ্ছে, এটা ‘খসড়া’-র চেয়ে বেশি কিছু৷ এখনও মন্ত্রীসভায় আলোচনা সাপেক্ষে তা পরিবতর্ন করা যাবে। প্রধানমন্ত্রীসহ সকল মন্ত্রী এই আইনটি বাস্তবায়নহোক, তা চাইছেন৷ প্রধানমন্ত্রী চাওয়ার পরে, মন্ত্রীসভায় বড় কোনো সংশোধনী বা পরিবর্তন আনবেন, এ ধরনের বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই৷ তারপরও দেখছি, অনেকে বিশেষ করে গণমাধ্যম নেতৃবৃন্দ তা বিশ্বাস করতে চাইছেন৷ এরাই পরবর্তী কালে আইনটি প্রয়োগ হওয়ার পর বলবেন ‘অপব্যবহার’ করা হচ্ছে৷
৫৭ ধারায় ছিল, আছে ডিজিটাল আইনের ৩২ ধারাতেও৷ স্পষ্টভাবে বলা আছে ‘পুলিশ যদি বিশ্বাস করে যে অপরাধ হয়েছে’ তাহলে মামলা নিতে পারবে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অর্থাৎ গ্রেফতার করবে৷ এই ক্ষমতা বা অধিকার, জিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশকে দেয়া হয়েছে৷ সেই ক্ষমতা এবং অধিকার অনুযায়ী, পুলিশ যদি বিশ্বাস করে যে, এটা অপরাধ এবং যদি ব্যবস্থা নেয়, মানে একজন সাংবাদিক বা সম্পাদককে গ্রেফতার করে; তখন স্বাভাবিক ভাবে বলা হবে, এটা তো আইনের ‘অপব্যবহার’ নয়৷ এটা তো স্বাভাবিক ‘ব্যবহার’৷
সরকার আইন করে পুলিশকে দিয়ে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার উদ্যোগ নিয়েছে৷ এই সহজ কথাটা বুঝতে না পারলে, বুঝেও আনুগত্য বজায় রেখে তোষামোদ করলে, ‘অপব্যবহার’-এর অজুহাত দেখালে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকবে না৷আইনটি মন্ত্রীসভায় পাস হওয়ার পূর্বেই বলা দরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারাগুলো বিশেষ করে ৩২ ধারা, ৫৭ ধারার চেয়েও ভয়ংকর।
৩৷ ৩২-এর ১ ধারায় ‘কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ ও দণ্ড’ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘‘যদি কোনো ব্যক্তি বে-আইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি,স্বায়ত্বশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার কোনো ধরনের অতি গোপণীয় বা গোপণীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে অপরাধী হইবে। এই অপরাধের শাস্তি ১৪ বছরের জেল, ২৫ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে৷
প্রথমে ধারণা করা হচ্ছিল ‘বে-আইনি প্রবেশ’ বলতে আইনে উল্লেখিত অফিসগুলোতে অনুমতি ছাড়া প্রবেশকে বোঝানো হয়েছে৷ পুরো আইনটি পড়ে জানা গেল, ‘অনুমতি ছাড়া অফিসে প্রবেশ নয় আইনি প্রবেশ বলতে ‘কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে বা উক্তরূপ অনুমতির শর্ত লঙ্ঘনক্রমে কোনো কম্পিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইস বা ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা ডিজিটাল তথ্য ব্যবস্থায় প্রবেশ’ বোঝানো হয়েছে৷
৪. আইনমন্ত্রীসহ অনান্য মন্ত্রীদের ‘মনে হয়’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না৷ ৫৭ ধারা বিষয়ে এখন আইনমন্ত্রীসহ অনন্য মন্ত্রীদের উপলব্ধি হয়েছে ‘বাকস্বাধীনতা হরণের’ অনেক কিছু তার মধ্যে ছিল৷ আগে তেমন কিছু ‘মনে হয়নি’৷ এখন যেভাবে মনে হচ্ছে না, ৩২ ধারার ক্ষেত্রে৷ ৫৭ ধারার চেয়ে ৩২ ধারা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর এবং নিপীড়নমূলক৷ সাংবাদিকের একটি তথ্য সংগ্রহকে গুপ্তচরবৃত্তির মতো রাষ্ট্রবিরোধী কাজ হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নামক ‘কালো’ আইনটিতে৷
৫. গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের সমালোচনার প্রেক্ষিতে আইনমন্ত্রী বলছেন,এই আইনের দ্বারা গণমাধ্যম বা সাংবাদিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না – প্রয়োজনে এমন উপধারা সংযোজন করা যেতে পারে৷ জানি না সাংবাদিকরা আইনমন্ত্রীর প্রস্তাব সমর্থন করার মতো ভুল করে বসবেন কিনা৷ কারণ এই আইনটি শুধু গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের জন্যেই ক্ষতিকর নয়৷ দেশের সব অঙ্গণের, বিশেষ করে সৃজনশীল কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার জন্যে ক্ষতিকর৷ প্রতিবাদ করার সুযোগ আছে বলে সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের বিষয়টি বেশি করে সামনে এসেছে৷ যাদের কথা বলার সুযোগ নেই বা সুযোগ কম, তাদের পক্ষে কথা বলা গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের দায়িত্ব- কর্তব্য৷জাতীয় সংসদে বিলটি পাস হওয়ার পরও আইন, তথ্য এবং তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রীগন সমভাবে বলছেন্, এ আইনে মত প্রকাশে প্রতিবদ্ধকতা তৈরি করে এমন কেনো উপাদান নেই৷ তারা আরো বলেন, ৫৭ ধারা ‘অপব্যবহার’ হয়েছে কিন্তু ৩২ ধারা ‘অপব্যবহার’ হবে না৷ মন্ত্রীগনের উক্ত কথাটা উদ্ভট এবং অসত্য৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা বাংলাদেশ তথ্য অধিকার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এবং বাংলাদেশ সংবিধানে প্রনীত ব্যক্তির বাক স্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যমের পরিপন্থি। এর দ্বারা গণতান্ত্রিক পরিবেশ কলুষিত হবে, গণতান্ত্রিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তখন গণমাধ্যকর্মীদের মধ্যে দ্রুত আতংক ও উদ্বেগ বাড়বে।সুতরাং সুস্থ গণতান্ত্রিক বিকাশের স্বার্থে, স্বাধীন ভাবে গণমাধ্যমকর্মীদের কাজ করার সুবিধার্থে এবং পুলিশের যথেচ্ছাচার ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরার স্বার্থে সরকার বাহাদুরের উচিৎ দ্রুত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা সংশোধন করা।
Some text
ক্যাটাগরি: মতামত
[sharethis-inline-buttons]