যত বলি না কেন, আমি ছোটবেলা এমন ছিলাম তেমন ছিলাম! তা বিশ্বাস করা কষ্টকর। কারণ বর্তমানের আমি আর অতীতের আমি এক নই। তখন ছিলাম চঞ্চল ও অবুঝ। এখন অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও বুঝি, কোনটা নিজের জন্য ও মানুষের জন্য ভাল। তখন শুধু নিজের খেয়াল-খুশি এবং আত্মতৃপ্তির জন্য সবকিছু করতাম। ঘর থেকে বের হওয়া আমার জন্য নিষিদ্ধ ছিল ঠিকই। তবু কী আর আমার মতো সাত-আট বছরের ছেলেকে ঘরে আটকে রাখা যায়?
জীবনের দীর্ঘ ছয়টা বছর কেটেছে গ্রামের পরিবেশে। বদ্ধ জীবন তো সহজে মেনে নেয়া যায় না। যতই নিষেধ থাকুক, তাতে কী? আমাকে আমার কাজ করতে হবে। বস্তিতে আড়াই বছর থাকাকালীন রীমা আন্টির কড়া নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আমি প্রায়ই বাসা থেকে লুকিয়ে বের হয়ে সেখানকার ছেলেদের সঙ্গে বস্তির ভেতরেই এক কোণায় খালি একটা জায়গায় ছিল, সেখানে বরই বিচি দিয়ে মার্বেল খেলতাম। সে সময় কখনো কোনো ঝগড়া-বিবাদ হলে সেখানেই তা মিমাংসা করে ফেলতে হতো। কারণ ঘরে আসলে বিপদ। শুধু বিপদ নয়, ঘর থেকে বের পর্যন্ত করে দিতে পারে।
আম্মা-নানীর কথা অমান্য করলে আন্টি কড়া পানিশমেন্ট দিতেন। তবে এখনো মনে আছে, আন্টি একদিন একটা ক্রিকেট ব্যাট এনে আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, তিনি আমাকে ক্রিকেটার বানাবেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তার কথায় অটুট থাকেননি। বড় হতে থাকলে তিনি আমার মেধা ভালো দেখে পড়ালেখার প্রতি গুরুত্ব দেন বেশি। পড়াশুনা আর স্কুল, প্রাসঙ্গিক কিছু কাজ- যা না করলেই নয়- তা ব্যতীত আমি আমার জীবনে কিছুই ভাবতে পারতাম না তখন। আন্টির ইংরেজির প্রতি একটা দুর্বলতা আছে। তাই বরাবরই তিনি আমার ইংরেজি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতেন বেশি। আসলে সেদিনের আমাকে আন্টি যদি এভাবে ধরে না রাখতেন, তবে আমি কী আজ এভাবে এত কিছু ভাবতে পারতাম? হয়তো পারতাম, আবার নাও পারতাম।
যা হোক, যা হবার তাতো হয়েই গিয়েছে। সুতরাং তা নিয়ে আর না ভাবাটাই ভালো। সবাই ঘরে আমাকে খুব আদর করত। আবার শাসন করার বেলায় কেউ ছাড় দিত না। মনে মনে সে কারণে সবসময় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকতাম। কোনো উল্টাপাল্টা কাজ করার আগেই মনে মনে ভাবতাম, এই বুঝি মাইর পড়ল। যার প্রভাব আজো মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে কাজ করে।
রফিক মাদ্রাজের বাড়িতে থাকাকালীন আব্বা এসে পড়ায় আমার উপর পরিবারের খবরদারি আরো বেড়ে যায়। কারণ আমার বাবা-মার একমাত্র সন্তান আমি। তাই তাদের সকল আশা-ভরসা-স্বপ্ন আমাকে ঘিরেই। তাই আমি যেন নষ্ট না হয়ে যায়, সেজন্য আমাকে বাহিরে কম বের হতে দেওয়া হতো। প্রয়োজন হলে আব্বা নিজে আমার সঙ্গে সময় কাটাতেন। বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন। নিজে যতটুকু জানতেন বুঝতেন, ততটুকুই আমার কাছে বর্ণনা করে বলতেন। কোনো নামিদামি জায়গা দিয়ে যাওয়ার সময় তা দেখিয়ে আমাকে রীতিমতো অপমানও করতেন, আবার তার গুণগানও গাইতেন। কারণ তিনি তখন আমার মধ্যে অমনোযোগী একটা স্বভাব বোধ হয় লক্ষ্য করেছিলেন। অথচ এ বয়সে ছেলেমেয়েরা এমনই হয়ে থাকে। তাদের নানা ছলে-বলে-কৌশলে অনেক কিছু করিয়ে নিতে হয় । তা না করে আমাকে সবসময় একটা চাপে রাখতেন।
তবে সবচেয়ে বেশি মজা লাগত ছুটির দিনে আমাকে ঘণ্টাখানেকের জন্য তারা একা ছেড়ে দিতেন। কি যে ভাল লাগতো! তা ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সে সুযোগে তখন থেকেই আমার মাঝে একটা বিরাট পরিবর্তন আসে। আমি তখনই আমার বয়সি ছেলেদের সাথে না মিশে মিশতাম আমার চেয়ে যারা বয়সে বড় তাদের সাথে। তখন আমার যুক্তি ছিল বললে ভুল হবে। মনে হতো ক্লাসে কিছু সহপাঠী তো রয়েছে, যারা আমার বয়সী, তাদের সাথে অনেকটা সময় পার করা যায়। কিন্তু বড়দের সাথে থাকলে বোধহয় অনেক কিছু শিখতে পারব। অন্ততপক্ষে নিজের সহাপাঠীদের কাছে বড় হতে পারব। এই ভেবে যে, আমি যা পারি তোরা তা পারস না। ঘণ্টাখানেকের সেই উপলব্ধিটা ভবিষ্যতে আমার জীবনে যে এতো কাজে লাগবে তা তখনো আমি ভাবতে পারিনি।
রফিক মাদ্রাজের বাড়িতে আম্মা-নানী যে পীর সাহেবের মুরিদ ছিলেন, তার রীতি অনুযায়ী একদিন জিকিরের ব্যবস্থা করেন। যা তিনি খুব সহজে মেনে নিতে পারেননি। তিনি আমাদের বাসা ছেড়ে দিতে বললে ছয় মাসের মুন্সিপাড়ার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। আম্মা তখন আমাকে বলতেন, তিনি নাকি ওহাবি ছিলেন। আসলে তারা আমাকে তখন যেভাবে বুঝাতেন আমি সেভাবেই বুঝতাম। এ বুঝ নিয়েই কথা বলতাম বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে। তবে না বুঝে কথা বলা দ্বারা আমার খুব বেশি একটা ক্ষতি হয়নি। বরং জীবনে অনেক অজানা বিষয় আমি জানতে পেরেছি।
আব্বা তখনো ছিলেন খেলার পুতুলের মতো। তাকে যেভাবে নাচানো হতো তিনি সেভাবে নাচতেন। বুঝতাম, তার এ ধরনের আচরণের কারণ কী? বড় হয়ে বুঝতে পারলাম, তিনি তখন আমাদের চাহিদা মেটানোর জন্য যা করা দরকার ছিল, তা করতে পারছিলেন না বলে চুপচাপ থাকতেন। অথবা তার যে প্রতিবন্ধকতা ছিল সেগুলো হয়তো তিনি দূর করতে পারেননি। তাই তিনি অনেক কিছু বলার থাকলেও বলতেন না। অন্য কোনো সমস্যা থাকলেও থাকতে পারে, যা আমি হয়তো এখনো বুঝতে পারছি না।
চলবে…
Some text
ক্যাটাগরি: আত্মজীবনী, স্মৃতিচারণ
[sharethis-inline-buttons]